TRANSLATE WITHIN 20 MINUTES
সকালটা বেশ সুন্দর। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। গাছগুলোর পাতা সব ধোওয়া, ঝকমকে সবুজ। আজও একটা ময়ূর এসে ডাকছে। পোষা হরিণগুলো ঘুরছে আপন মনে।
বারান্দায় বসেই চা খাওয়া হয়ে গেছে একটু আগে। এঁটো কাপ-ডিশগুলো পড়ে আছে টেবিলের ওপর। কাকাবাবু গেছেন বাথরুমে। ম্যানেজার নুরুলসাহেব গল্প করছেন সন্তুদের সঙ্গে।
নুরুলসাহেবের পাঁচ বছরের মেয়ে আমিনা খেলা করছে সামনে। সে ছুটে-ছুটে একটা প্রজাপতি ধরার চেষ্টা করছে। চার-পাঁচ রকমের রঙিন ফ্রক পরা মেয়েটি নিজেও যেন একটা প্রজাপতি।
একটা জিপগাড়ি এসে থামল বাগানের পাশে। তার থেকে নামল একটা গাঁট্টাগোট্টা লোক, এগিয়ে আসতে লাগল বাংলোর দিকে।
আমিনা প্রজাপতির দিকে চেয়ে-চেয়ে ছুটছে, অন্য কিছু দেখছে না, সেই লোকটার সঙ্গে তার ধাক্কা লেগে গেল বেশ জোরে।
এরকম ধাক্কা লাগলে যে-কোনও লোক ছোট মেয়েটিকে আদর করে কিংবা কোলে তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করে যে তার লেগেছে কি না। কিন্তু এই লোকটা বিরক্তভাবে আমিনাকে জোরে ঠেলে দিল, সে আছড়ে পড়ল মাটিতে। কেঁদে উঠল সঙ্গে-সঙ্গে।
নুরুলসাহেব মেয়েকে ধরতে গেলেন না, লোকটিকেও কিছু বললেন না।
প্রচণ্ড রাগে সন্তুর মুখ-চোখ লাল হয়ে গেল। লোকটা আর একটু কাছে আসতেই সন্তু অন্য কিছু আর চিন্তা না করে ছুটে গিয়ে লোকটির মুখে খুব জোরে একটা ঘুসি কষাল।
লোকটা ধড়াম করে পড়ে গেল চিত হয়ে। এক ঘুসিতেই প্রায় অজ্ঞান। ঘুসিটা লেগেছে ঠিক নাকের ডগায়। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে।
নুরুলসাহেব আঁতকে উঠে বললেন, এ কী করলে ভাই? সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। ওকে মারলে?
সন্তু হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, মারব না, নিশ্চয়ই মারব।
জোজো বলল, বেশ করেছে মেরেছে। ও না মারলে আমি নিজেই ওর মাথাটা একটা নারকোলের মতন ফাটিয়ে দিতাম।
জোজো ছুটে গিয়ে আমিনাকে মাটি থেকে তুলে নিল।
নুরুলসাহেব বললেন, ও লোকটা কতার সিং! তোমরা চেনো না। ঠাকুর সিংয়ের ডান হাত!
সন্তু বলল, ডান হাত, বাঁ হাত যাই-ই হোক, ওইটুকু একটা মেয়েকে মারলে শাস্তি দিতে হবে না?
নুরুলসাহেব ভয়ে আমসির মতন মুখ করে বললেন, ওদের চটালে আমি যে এখানে চাকরিই করতে পারব না। ওরা যা ইচ্ছে তাই-ই করে। শিকার করা নিষেধ, তবু জঙ্গলে গিয়ে হরিণ মারে, খরগোশ মারে। আমার এখানে খাবার নিতে আসে মাঝে-মাঝে। যক্ষুনি যা চাইবে, দিতে হবে সঙ্গে-সঙ্গে।
কতার সিং উঠে বসল আস্তে-আস্তে। জ্বলন্ত চোখে তাকাল সন্তুর দিকে। দাঁত কিড়মিড় করে কী যেন একটা খারাপ গালাগালি দিল।
সন্তু যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই রইল, সরল না এক চুলও।
কর্তার সিং উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কুত্তার বাচ্চা, তোকে জানে মেরে দেব।
সন্তু দুটো হাত মুঠি করে বুক আড়াল রেখে বলল, আও না, আও! তোমাকে আরও শিক্ষা দেব আমি।
সন্তুর তুলনায় কতার সিংয়ের শরীর অন্তত আড়াইগুণ বড়। সন্তুকে দেখলে মনেই হয় না তার গায়ে খুব জোর আছে। সে মাল-টাল ফোলায় না। প্যান্ট আর শার্ট পরা সাধারণ চেহারা। কিন্তু বক্সিং সে ভাল জানে।
কতার সিং বক্সিংটক্সিংয়ের ধার ধারে না। একটা ঘুসি খেয়েই সে সন্তুর মুঠোর ওজন বুঝে গেছে। সে আর ও লাইনে গেল না।
বাঁ হাত দিয়ে সে মুখের রক্ত মুছল। ডান হাতে ঝাঁ করে একটা ছুরি বার করল।
সন্তু তবু পালাল না। তার সিংয়ের চোখে চোখ রেখে পিছিয়ে গেল খানিকটা।
এই সময় ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন কাকাবাবু। এরকম একটা আসন্ন লড়াইয়ের দৃশ্য দেখে হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, কী ব্যাপার, কী হয়েছে?
জোজো বলল, ওই লোকটা অমানুষ। বাচ্চা মেয়ে আমিনাকে ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছে। সন্তু রেগে গিয়ে ওর নাকে একটা ঘুসি মেরেছে বলে এখন ও ছুরি তুলেছে। কাওয়ার্ড কোথাকার! রোদ্দুরে কতার সিংয়ের স্থবির ফলাটা চকচক করে উঠল।
কাকাবাবু ইচ্ছে করলেই চট করে ঘর থেকে রিভলভারটা আনতে পারতেন। কিন্তু আনলেন না। নিজের একটা ক্রাচ সন্তুর দিকে ছুড়ে দিয়ে বললেন, এটা ধর, সন্তু। লোকটাকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দে।
সন্তু চট করে একটু ঘুরেই লুফে নিল ক্রাচটা। তারপর সেটা বনবন করে ঘোরাতে লাগল।
কতার সিং একটা ন ইঞ্চি ছুরি নিয়ে অত বড় ক্রাচের সঙ্গে কী করে লড়বে? সে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সন্তু দমাস দমাস করে মারতে লাগল তার পিঠে, বুকে।
আমিনা কান্না ভুলে গিয়ে খলখল করে হাসতে লাগল তা দেখে।
দুবার কতার সিং ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। তারপর উঠেই সে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করল। সন্তু তাড়া করে গেল তাকে।
কাকাবাবু চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, মার, আরও মার দে, সন্তু। ওর এত সাহস, সকালবেলাতেই ছুরি বার করে এত লোকের সামনে?
কতার সিং কোনওক্রমে উঠে পড়ল জিপগাড়িতে। দুর্বোধ ভাষায় কী যেন শাসাল মুখ বার করে। তারপর হুস করে বেরিয়ে গেল জিপটা।
সন্তু ফিরে আসতেই কাকাবাবু তার কাঁধ চাপড়ে বললেন, বাঃ, ভাল লড়েছিস, সন্তু। বেশ করেছিস ওকে মেরেছিস।
নুরুলসাহেবের দিকে ফিরে বললেন, আপনার ওইটুকু মেয়েকে মারল, আপনি নিজে কিছু বললেন না?
নুরুলসাহেব বললেন, আমাকে এখানে চাকরি করতে হয়। পুলিশ পর্যন্ত ওঁদের ভয় পায়। এই যে কাণ্ডটা ঘটল, এর পর কী হয় কে জানে!
কাকাবাবু বললেন, এত ভয়ে-ভয়ে চাকরি করতে হবে? এর চেয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে না খেয়ে থাকাও ভাল। মানুষের আত্মসম্মান না থাকলে আর কী। রইল?
জোজো বলল, ওই লোকটা নিশ্চয়ই দলবল নিয়ে ফিরে আসবে।
কাকাবাবু বললেন, আসুক। দেখি ওদের মুরোদ। ঠাকুর সিং টের পেয়ে গেছে, আমি কে! তোরা এক কাজ কর তো জোজো। তুই আর সন্তু ওই যে চেকপোেস্টটা আছে, তার কাছে চলে যা। ওখান দিয়ে অনেক গাড়ি যায়। ঠা র সিং-এর গাড়ি কিংবা লোকজনেরাও যাবে নিশ্চয়ই। তোরা ওখানে অন্য লোকজনদের শুনিয়ে-শুনিয়ে গল্প কর যে কতার সিংকে কেমন মেরেছিস! সবাইকে বুঝিয়ে দে যে আমরা ভয় পাই না।
সন্তু আর জোজো মজা পেয়ে গেল। মহিমও যোগ দিল তাদের সঙ্গে। ওরা তিনজনে সেই চেকপোস্টের কাছে একটা কালভার্টে গিয়ে বসল।
একটা গাড়ি থামতেই জোজো হাসতে হাসতে বলল, ওই যে কর্তার সিং না কে একটা লোক এসেছিল, ঠাকুরুসিং-এর বাঁ হাত…
মহিম বলল, বাঁ হাত না, ডান হাত!
জোজো বলল, ডান হাত না ডান পা কে জানে! দেখতেই তাগড়া চেহারা, আসলে একটা ভা! একখানা ঘুসিতে কুপোকাত!
মহিম বলল, মটিতে পড়ে গিয়েই চ্যাঁচাতে লাগল, ঠাকুর সিং, বাঁচাও, বাঁচাও! কোথায় ঠাকুর সিং! সেও তো একটা মহাভিতু!
জোজো বলল, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি নামে সিনেমাটায় একটা গান ছিল জানিস!
তারপর সে গেয়ে উঠল, ভজন পূজন জানি না, মা, জেতেতে ফিরিঙ্গি…
থেমে গিয়ে বলল, এ গানটা না, আর-একটা গান আছে ঠাকুর সিং সম্পর্কে :
হয়ে ঠাকুর সিংয়ের বাপের জামাই
কোর্তা-টুপি ছেড়েছি।
মহিম হাসতেহাসতে বলল, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এই ঠাকুর সিংয়ের কথা কী করে জানল?
জোজো বলল, ঠাকুর সিং নাকি খুব বীরপুরুষ। তলোয়ার হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক যাত্রাদলের সেনাপতির মতন। কাকাবাবু মাত্র পাঁচ মিনিট লড়ে ওর হাত থেকে তলোয়ারটা উড়িয়ে দিলেন। তারপর থেকে আর ঠাকুর সিং কাকাবাবুর চোখের দিকে তাকাতেই সাহস পায়নি, লক্ষ করেছিলি?
সন্তু বলল, ঠাকুর সিংয়ের তো প্রাণ বেঁচে গেল কাকাবাবুর দয়ায়।
জোজো বলল, ভারী তো বীর! বনগাঁয়ে শিয়াল রাজা!
তিনজনে হোহো করে হেসে উঠল একসঙ্গে।
একটা গাড়ি থেমে চেকপোস্টে নম্বর লেখাচ্ছিল। দুজন লোক ওদের কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এল। একজন হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল, আপনারা কার কথা বলছেন? কোন ঠাকুর সিং?
জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, এই তো এখানকার ঠাকুর সিং। যার বাড়ির নাম রূপ মঞ্জিল। আমাদের কাকাবাবুর সঙ্গে লড়তে এসেছিল, হেরে ভূত হয়ে গেছে। [WORDS:-1044]