বেতালপঞ্চবিংশতি-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [1847 CE]
লল্লুলাল রচিত বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বনে
উপক্রমণিকা
উজ্জয়িনী নগরে গন্ধৰ্বসেন নামে রাজা ছিলেন। তাঁহার চারি মহিষী। তাঁহাদের গর্ভে রাজার ছয় পুত্র জন্মে। রাজকুমারেরা সকলেই সুপণ্ডিত ও সর্ব বিষয়ে বিচক্ষণ ছিলেন। কালক্রমে, নৃপতির লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সর্বজ্যেষ্ঠ পুত্র সিংহাসনে অধিরোহণ করিলেন। তৎকনিষ্ঠ বিক্রমাদিত্য বিদ্যানুরাগ, নীতিপরতা ও শাস্ত্রানুশীলন দ্বারা সবিশেষ বিখ্যাত ছিলেন; তথাপি, রাজ্যভোগের লোভসংবরণে অসমর্থ হইয়া, জ্যেষ্ঠের প্রাণসংহারপূর্বক, স্বয়ং রাজ্যেশ্বর হইলেন; এবং, ক্রমে ক্রমে, নিজ বাহুবলে, লক্ষযোজনাবিস্তীর্ণ জম্বুদ্বীপের অধীশ্বর হইয়া, আপন নামে অব্দ প্রচলিত করিলেন।
একদা, রাজা বিক্রমাদিত্য মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, জগদীশ্বর আমায়, নানা জনপদের অধীশ্বর করিয়া, অসংখ্য প্ৰজাগণের হিতাহিতচিন্তার ভার দিয়াছেন। আমি, আত্মসুখে নির্বৃত হইয়া, তাহাদের অবস্থার প্রতি ক্ষণমাত্রও দৃষ্টিপাত করি না; কেবল অধিকৃতবর্গের বিবেচনার উপর নির্ভর করিয়া, নিশ্চিন্ত রহিয়াছি। তাহারা প্ৰজাগণের সহিত কিরূপ ব্যবহার করিতেছে, অন্ততঃ একবারও পরীক্ষা করিয়া দেখা উচিত। অতএব আমি, প্রচ্ছন্ন বেশে পৰ্যটন করিয়া, প্ৰজাগণের অবস্থা প্রত্যক্ষ করিব। অনন্তর তিনি, নিজ অনুজ ভর্তৃহরির হস্তে সমস্ত সাম্রাজ্যের ভারার্পণ করিয়া, সন্ন্যাসীর বেশে, দেশে দেশে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।
উজ্জয়িনীবাসী এক দরিদ্র ব্ৰাহ্মণ, বহু কাল, অতি কঠোর তপস্যা করিতেছিলেন। তিনি, আপন উপাস্য দেবতার নিকট বরস্বরূপ এক অমরফল পাইয়া, আনন্দিত মনে গৃহে আসিয়া, স্বীয় ব্ৰাহ্মণীকে বলিলেন, দেখ, দেবতা, তপস্যায় তুষ্ট হইয়া, আজ আমায় এই ফল দিয়াছেন; বলিয়াছেন, ইহা ভক্ষণ করিলে, নর অমর হয়। ব্ৰাহ্মণী শুনিয়া, অতিশয় খেদ করিয়া, কহিলেন, হায়! অমর হইয়া, আর কতকাল যন্ত্রণাভোগ করিবে। তুমি, কি সুখে, অমর হইবার অভিলাষ কর, বুঝিতে পারিতেছি না। বরং, এই দণ্ডে মৃত্যু হইলে, সাংসারিক ক্লেশ হইতে পরিত্রাণ হয়।
গৃহিণীর এই আক্ষেপবাক্য শুনিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া, ব্ৰাহ্মণ কহিলেন, আমি তৎকালে, না বুঝিয়া, এই দেবদত্ত ফল লইয়াছিলাম; এক্ষণে, তোমার কথা শুনিয়া, আমার চৈতন্য হইল। এখন তুমি যেরূপ বলিবে, তাহাই করিব। ব্ৰাহ্মণী কহিলেন, এই ফল রাজা ভর্তৃহরিকে দিয়া, ইহার পরিবর্তে, পারিতোষিকস্বরূপ, কিঞ্চিৎ অর্থ লইয়া আইস; তাহা হইলে, অনায়াসে সংসারযাত্ৰা সম্পন্ন করিতে পরিবে।
ইহা শুনিয়া, ব্ৰাহ্মণ রাজার নিকটে উপস্থিত হইলেন এবং, যথাবিধি আশীৰ্বাদপ্রয়োগের পর, দেবদত্ত ফলের গুণব্যাখ্যা ও পূর্বাপর সমন্ত বৃত্তান্তের প্রকৃতরূপ বর্ণন করিয়া, বিনীত বচনে নিবেদন করিলেন, মহারাজ! আপনি, এই ফল লইয়া, আমায় কিছু অর্থ দেন। আপনি চিরজীবী হইলে, সমন্ত রাজ্যের মঙ্গল। রাজা, ফল গ্ৰহণ করিয়া, লক্ষমূদ্রাপ্ৰদানপূর্বক, ব্ৰাহ্মণকে বিদায় করিলেন এবং, নিতান্ত স্ত্ৰৈণতাবশতঃ, মনে মনে বিবেচনা করিলেন, যে ব্যক্তির চির জীবন ও স্থির যৌবন হইলে, আমি যাবজ্জীবন সুখী হইব, তাহাকেই এই ফল দেওয়া আবশ্যক। অনন্তর, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া, রাজা প্ৰাণাধিক মহিষীর হস্তে ফল প্ৰদান করিলেন এবং কহিলেন, প্রিয়ে! তুমি আমার জীবন-সর্বস্ব; এই ফল খাও, চিরজীবিনী ও স্থিরযৌবনা হইবে। রাজ্ঞী, নিরতিশয় আহ্নলাদপ্রদর্শনপূর্বক, ফলগ্রহণ করিলেন। রাজা প্ৰীত মনে, সভায় প্রত্যাগমন করিয়া, অমাত্যবর্গের সহিত রাজকাৰ্য পৰ্যালোচনা করিতে লাগিলেন।
উজ্জয়িনীর নগরপাল রাজমহিষীর সাতিশয় প্রিয় পাত্র ছিল; তিনি, ঐ ফলের গুণব্যাখ্যা করিয়া, তাহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। নগরপাল এক বারাঙ্গনাকে অত্যন্ত ভালবাসিত; সে, তাহার হস্তে প্ৰদানপূর্বক, ঐ ফলের সবিশেষ গুণবর্ণনা করিল। বারাঙ্গনা, ফল পাইয়া, মনে মনে বিবেচনা করিল, আমি অতি অধম জাতি, কুক্রিয়া দ্বারা উদরপূর্তি করি; আমার চিরজীবিনী হওয়া বিড়ম্বনা মাত্র। অতএব, এই ফল রাজাকে দেওয়া উচিত; রাজা চিরজীবী হইলে, অসংখ্য লোকের মঙ্গল হইবেক। অনন্তর, রাজার নিকটে গিয়া, বারবনিতা, বিনয়পূর্বক, নিবেদন করিল, মহারাজ! আমি এই এক অপূর্ব ফল পাইয়াছি; ইহা ভক্ষণ করিলে, নর অমর হয়; এই ফল আপনকার যোগ্য; আপনি গ্ৰহণ করুন।
রাজা, অমরফল বারাঙ্গনার হস্তগত দেখিয়া, বিস্ময়াপন্ন হইলেন; এবং, ফল লইয়া, পুরস্কারপ্রদানপূর্বক, তাহাকে বিদায় দিয়া, ভাবিতে লাগিলেন, এই ফল রাজ্ঞীকে দিয়াছি; ইহা কিরূপে বারাঙ্গনার হস্তগত হইল। পরে, সবিশেষ অনুসন্ধান দ্বারা, তিনি পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত অবগত হইলেন এবং, সাংসারিক বিষয়ে নিরতিশয় বীতরাগ হইয়া, বিবেচনা করিতে লাগিলেন, সংসার অতি অকিঞ্চিৎকর, ইহাতে সুখের লেশমাত্র নাই; অতএব, বৃথা মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, আর ইহাতে লিপ্ত থাকা, কোনও ক্রমে, শ্রেয়স্কর নহে। অতএব, সংসারযাত্রায় বিসর্জন দিয়া, অরণ্যে গিয়া, জগদীশ্বরের আরাধনায় প্রবৃত্ত হই; চরমে পরম পুরুষাৰ্থ মুক্তিপদার্থ প্রাপ্ত হইতে পারিব।
অন্তঃকরণে এইরূপ আলোচনা করিয়া, অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া, রাজা রাজ্ঞীকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি সে ফল কি করিয়াছ। তিনি কহিলেন, ভক্ষণ করিয়াছি। রাজা, সাতিশয় বিরাগপ্রদর্শনপূর্বক, রাণীকে সেই ফল দেখাইলেন। রাণী, এক কালে, হতবুদ্ধি ও অধোবদন হইয়া রহিলেন, বাক্য নিঃসরণ করিতে পারিলেন না। রাজা ভর্তৃহরি, অবিলম্বে অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া, প্রক্ষালনপূর্বক ফলভক্ষণ করিলেন। এবং, রাজ্যাধিকারে জলাঞ্জলি দিয়া, একাকী অরণ্যে গিয়া, যোগসাধনে প্ৰবৃত্ত হইলেন।
বিক্ৰমাদিত্যের সিংহাসন শূন্য রহিল। দেবরাজ, উজ্জয়িনীর অরাজকসংবাদ প্রাপ্ত হইবামাত্র, এক যক্ষকে রক্ষক নিযুক্ত করিয়া পাঠাইলেন। যক্ষ, সাতিশয় সতর্কতাপূর্বক, অহোরাত্ৰ, নগরীর রক্ষণাবেক্ষণ করিতে লাগিল। অল্পদিনের মধ্যেই, দেশে বিদেশে প্রচার হইল, রাজা ভর্তৃহরি, রাজত্বপরিত্যাগপূর্বক, বনপ্রস্থান করিয়াছেন। বিক্ৰমাদিত্য শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র ব্যগ্র হইয়া, স্বদেশে প্রত্যাগমন করিলেন। তিনি, অর্ধারাত্র সময়ে, নগরে প্রবেশ করিতেছেন; এমন সময়ে, নগররক্ষক যক্ষ আসিয়া নিষেধ করিয়া কহিল, তুই কে, কোথায় যাইতেছিস, দাঁড়া, তোর নাম কি বল। রাজা কহিলেন, আমি বিক্ৰমাদিত্য, আপন নগরে যাইতেছি; তুই কে, কি নিমিত্তে আমার গতিরোধ করিতেছিস, বল।
যক্ষ কহিল, দেবরাজ ইন্দ্ৰ আমায় এই নগরের রক্ষক নিযুক্ত করিয়াছেন। তাঁহার অনুমতি ব্যতিরেকে, আমি তোমায় অসময়ে নগরে প্রবেশ করিতে দিব না। অথবা, যদি তুমি যথার্থই রাজা বিক্ৰমাদিত্য হও, অগ্রে আমার সহিত যুদ্ধ কর, পরে নগরে যাইতে দিব। রাজা শ্রবণমাত্র, বদ্ধপরিকর হইয়া, যুদ্ধার্থে প্ৰস্তুত হইলেন। যক্ষও, তৎক্ষণাং প্রস্তুত হইয়া, তাঁহার সম্মুখীন হইল। ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল। পরিশেষে, রাজা, যক্ষকে ভূতলে ফেলিয়া, তাহার বক্ষঃস্থলে বসিলেন। তখন যক্ষ কহিল, মহারাজ! তুমি আমায় পরাভূত করিয়াছ। তোমার প্রভাব ও পরাক্রম দেখিয়া বুঝিতে পারিলাম, তুমি যথার্থই রাজা বিক্ৰমাদিত্য। এক্ষণে আমায় ছাড়িয়া দাও; আমি তোমায় প্ৰাণদান দিতেছি।
রাজা শুনিয়া ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, তুই বাতুল, নতুবা এরূপ অসঙ্গত কথা বলিবি কেন। তুই আমায় প্রাণদান কি দিবি; আমি মনে করিলে, এখনই তোর প্ৰাণদণ্ড করিতে পারি। যক্ষ শুনিয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিল, মহারাজ! যাহা কহিতেছ, তাহা সম্পূর্ণ যথার্থ, কিন্তু, আমি তোমায় আসন্ন মৃত্যু হইতে বাঁচাইতেছি, এজন্য এরূপ বলিতেছি। যাহা কহি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। সবিশেষ সমস্ত অবগত হইয়া, তদনুযায়ী কাৰ্য করিলে, দীর্ঘজীবী হইবে, এবং নিরুদ্বেগে, অখণ্ড ভূমণ্ডলে, একাধিপত্য করিতে পরিবে। তখন ভূপতি, অতিশয় বিস্মিত ও উৎকণ্ঠিত হইয়া, যক্ষের বক্ষঃস্থল হইতে উত্থিত হইলেন। যক্ষও, ক্ষণ মধ্যে সমরশ্রান্তিপরিহারপূর্বক, বিক্ৰমাদিত্যকে সম্বোধিয়া, তদীয় জীবনসংক্রান্ত গৃঢ় বৃত্তান্ত তাঁহার গোচর করিতে আরম্ভ করিল।
মহারাজ! শ্রবণ কর,—
ভোগবতী নগরে, চন্দ্ৰভানু নামে অতি প্ৰতাপশালী নরপতি ছিলেন। তিনি, এক দিবস, মৃগয়ার অভিলাষে, কোনও অটবীতে প্ৰবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, এক তপস্বী, অধঃশিরাঃ ও বৃক্ষে লম্ববান হইয়া, ধূমপান করিতেছেন। অনেক অনুসন্ধানের পর, তত্ৰত্য লোকের মুখে অবগত হইলেন, তপস্বী কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না; বহুকাল অবধি, একাকী এইভাবে তপস্যা করিতেছেন। রাজা, সন্ন্যাসীর কঠোর ব্ৰত দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া, নগর প্রত্যাবর্তন করিলেন; এবং পর দিন, যথাকালে, রাজসভায় অধিষ্ঠান করিয়া কহিলেন, হে অমাত্যবর্গ! হে সভাসদগণ! আমি গতকল্য, মৃগয়ায় গিয়া, বিপিনমধ্যে এক অদ্ভূত তপস্বী দেখিয়াছি; যদি কেহ তাঁহারে রাজধানীতে আনিতে পারে, তাহাকে লক্ষ মুদ্রা পারিতোষিক দিব।
এই রাজবাক্য নগর মধ্যে প্রচারিত হইলে, এক প্রসিদ্ধ বারবনিতা, নৃপতিসমীপে আসিয়া, নিবেদন করিল, মহারাজ! আজ্ঞা পাইলে, আমি, ঐ তাপসীর ঔরসে পুত্র জন্মাইয়া, ঐ পুত্র তাহার স্কন্ধে দিয়া, আপনকার সভায় আনিতে পারি। রাজা শুনিয়া সাতিশয় চমৎকৃত হইলেন এবং পরম সমাদরপূর্বক, বারনারীর উপর তাপসের আনয়নের ভারার্পণ করিলেন। সে ভূপালের নিয়োগ অনুসারে, যোগীর আশ্রমে উপস্থিত হইয়া দেখিল, যোগী যথার্থই মুদ্রিতনয়ন, অধঃশিরাঃ ও বৃক্ষে লম্বমান হইয়া, ধূমপান করিতেছেন; নিরতিশয় শীর্ণদেহ, কেহ কোনও প্রশ্ন করিলে উত্তর দেন না। তদ্দর্শনে বারযোষিৎ, সহসা সন্ন্যাসীর সমাধিভঙ্গ করা অসাধ্য জানিয়া তদীয় আশ্রমের অনতিদূরে এক সুশোভন উপবন ও তন্মধ্যে পরম রমণীয় বাসভবন নির্মিত করাইল এবং নানা উপায় চিন্তিয়া, পরিশেষে, যুক্তিপূর্বক, মোহনভোগ প্রস্তুত করিয়া, ধূমপায়ী তপস্বীর আস্যে অৰ্পিত করিল। তপস্বী, রসনাসংযোগ দ্বারা মিষ্ট বোধ হওয়াতে, ক্ৰমে ক্ৰমে সমুদয় ভক্ষণ করিলেন। বারাঙ্গনা পুনরায় দিল; তিনিও পুনরায় ভক্ষণ করিলেন।
এইরূপে, ক্ৰমাগত কতিপয় দিবস, মোহনভোগ উপযোগ করিয়া, শরীরে কিঞ্চিৎ বলসঞ্চার হইলে, সন্ন্যাসী, নেত্ৰদ্ধয় উল্মীলিত করিয়া, তরু হইতে অবতীর্ণ হইলেন, এবং বারনারীকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি অভিপ্ৰায়ে, একাকিনী এই নির্জন বনস্থানে আগমন করিয়াছ। সে কহিল, আমি দেবকন্যা, দেবলোকে তপস্যা করি; সম্প্রতি, তীৰ্থপৰ্যটনপ্রসঙ্গে, পরম পবিত্র কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে আসিয়া, যোগাভ্যাসবাসনায়, অনতিদূরে আশ্রমনির্মাণ করিয়াছি; নিয়ত তথায় অবস্থিতি করি। অদ্য সৌভাগ্যক্ৰমে, এই আশ্রমে প্রবেশ করিয়া, আপনকার সন্দর্শন ও সম্ভাষণানুগ্রহ দ্বারা, চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলাম। তপস্বী কহিলেন, আমি, তোমার সৌজন্য ও সুশীলতা দর্শনে, পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তোমার মধুর মূর্তি সন্দর্শনে আত্মাকে চরিতার্থ বোধ করিতেছি; যেহেতু জন্মান্তরীণ পুণ্যসঞ্চয় ব্যতিরেকে, সাধুসমাগম লব্ধ হয় না। যাহা হউক, তোমার আশ্রম দেখিবার নিমিত্ত, আমার অতিশয় বাসনা হইতেছে। যদি প্রতিবন্ধক না থাকে, ও অধিক দূরবর্তী না হয়, আমায় তথায় লইয়া চল।
বারবিলাসিনী, তপস্বীর অভ্যর্থনা শ্রবণে কৃতাৰ্থম্মন্য ও অতিমাত্র ব্যগ্ৰ হইয়া, তাঁহাকে আপন আলয়ে লইয়া গেল, এবং, সাতিশয় যত্ন ও সবিশেষ সমাদর পুরঃসর, নানাবিধ সুম্বাদ মিষ্টান্ন ও সুরস পানীয় প্রদান করিল। তিনি, বারনারীর কপটজালে বন্ধ হইয়া, তাহার দত্ত সমস্ত বস্তু ভক্ষণ ও পান করিলেন। এইরূপে, তপস্বী, ধূমপান পরিত্যাগপূর্বক, যোগাভ্যাসে জলাঞ্জলি দিয়া, বারবনিতার সহিত বিষয়বাসনায় কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। বারাঙ্গনা গর্ভবতী ও যথাকালে পুত্রবতী হইল। কিছুদিন অতীত হইলে পর, সে সন্ন্যাসীর নিকট নিবেদন করিল, মহাশয়। বহু দিবস অতিক্রান্ত হইল, আমরা নিরন্তর কেবল বিষয়বাসনায় কালাহরণ করিলাম; এক্ষণে তীর্থযাত্রা দ্বারা দেহ পবিত্র করা উচিত।
বারবনিতা, এইরূপ প্রবঞ্চনা দ্বারা, তপস্বীকে সংজ্ঞাশূন্য করিয়া, তাঁহার স্কন্ধে পুত্রপ্রদানপূর্বক, চন্দ্ৰভানুর রাজধানীতে লইয়া চলিল। সে রাজসভার সমীপবৰ্তিনী হইলে, রাজা তাহাকে চিনিতে পারিয়া, এবং সন্ন্যাসীর স্কন্ধে পুত্ৰ দেখিয়া, সামাজিকদিগকে বলিলেন, দেখ দেখ, যে বারনারী যোগীর আনয়নবিষয়ে প্ৰতিজ্ঞা করিয়া গিয়াছিল, সে আপন প্রতিজ্ঞা পূৰ্ণ করিয়া আসিতেছে। আমি উহার অসম্ভব বুদ্ধিকৌশলে চমৎকৃত হইয়াছি। অধিক আর কি বলিব, এই বুদ্ধিমতী বারবনিতা চিরশুষ্ক নীরস তরুকে পল্লবিত এবং পুষ্পে ও ফলে সুশোভিত করিয়াছে। সামাজিকেরা কহিলেন, মহারাজ! যথার্থ আজ্ঞা করিতেছেন; এ সেই বারাঙ্গনাই বটে।
রাজা ও সভাসদগণের এইরূপ কথোপকথন শ্রবণে, সহসা বোধসুধাকরের উদয় হওয়াতে, সন্ন্যাসীর মোহান্ধকার অপসারিত হইল। তখন তিনি, পূর্বাপরপর্যালোচনা করিয়া, যৎপরোনাস্তি ক্ষোভ প্রাপ্ত হইলেন এবং আপনাকে বারংবার ধিক্কার দিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, দুরাত্মা চন্দ্ৰভানু, ঐশ্বৰ্যমদে মত্ত ও ধর্মাধৰ্মজ্ঞানশূন্য হইয়া আমার তপস্যাভ্রংশের নিমিত্ত এই দুর্বিগাহ মায়াজাল বিস্তারিত করিয়াছিল। আমিও অতি অধম ও অবশেন্দ্ৰিয়; অনায়াসে স্বৈরিণীর মায়ায় মুগ্ধ হইয়া, চিরসঞ্চিত কর্মফলে বঞ্চিত হইলাম। অনন্তর, ক্ৰোধে কম্পান্বিতকলেবর হইয়া স্কন্ধস্থিত পুত্রকে ভূতলে নিক্ষিপ্ত করিয়া, তিনি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে প্ৰস্থান করিলেন; অন্য এক অরণ্যে প্রবেশপূর্বক, পূর্ব অপেক্ষায় অধিকতর মনোযোগ ও অধ্যবসায় সহকারে, যোগসাধন করিতে লাগিলেন, এবং, কিয়াৎ কাল পরে, ঐ নরেশ্বরের মৃত্যুসাধন করিয়া, কৃতকাৰ্য হইলেন।
এইরূপে, আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, যক্ষ কহিল, মহারাজ! তুমি, ও রাজা চন্দ্ৰভানু, আর ঐ যোগী, এই তিন জন এক নগরে, এক নক্ষত্রে, এক লগ্নে, জন্মিয়াছিলো। তুমি, রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়া পৃথিবীর রাজত্ব করিতেছ। চন্দ্ৰভানু, তৈলিকাগৃহে জন্মিয়া ভাগ্যক্রমে ভোগবতী নগরীর অধিপতি হইয়াছিল। আর, যোগী, কুম্ভকারকুলে উৎপন্ন হইয়া যত্নপূর্বক যোগসাধন করিয়া চন্দ্ৰভানুর প্রাণবধ করিয়াছে, এবং তাঁহাকে বেতাল করিয়া শ্মশানবর্তী শিরীষবৃক্ষে লন্বিত করিয়া রাখিয়াছে; এক্ষণে, অনন্যকর্মা হইয়া, তোমার প্রাণসংহার করিবার চেষ্টায় আছে; ইহাতে কৃতকাৰ্য হইলেই, উহার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। যদি তুমি তাহার হস্ত হইতে নিস্তার পাও, বহুকাল অকণ্টকে রাজ্যভোগ করিতে পরিবে। আমি, সবিশেষ সমস্ত কহিয়া, তোমায় সতর্ক করিয়া দিলাম; তুমি এ বিষয়ে ক্ষণমাত্রও অনবহিত থাকিবে না।
এইরূপ উপদেশ দিয়া, যক্ষ স্বস্থানে প্ৰস্থান করিল। রাজাও শুনিয়া, ত্ৰস্ত ও বিস্ময়গ্ৰস্ত হইয়া, নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে, রাজবাটীতে প্রবিষ্ট হইলেন। পর দিন প্রভাতে, তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট হইলে, ভৃত্যগণ ও প্ৰজাবৰ্গ, বহুদিনের পর, রাজসন্দর্শন প্ৰাপ্ত হইয়া, আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইল। রাজা বিক্ৰমাদিত্য, রাজনীতির অনুবর্তী হইয়া, রাজ্যশাসন ও প্ৰজাপালন করিতে লাগিলেন।
কিছুদিন পরে, শান্তশীল নামে এক সন্ন্যাসী, শ্ৰীফল হস্তে রাজসভায় উপস্থিত হইলেন এবং শ্ৰীফলপ্ৰদানপূর্বক রাজাকে আশীৰ্বাদ করিয়া, কক্ষস্থিত আসন পাতিয়া, তদুপরি উপবেশন করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ কথোপকথন করিয়া, রাজার নিকট বিদায় লইয়া, সন্ন্যাসী সভা হইতে প্ৰস্থান করিলে পর, তিনি অন্তঃকরণে এই বিতর্ক করিতে লাগিলেন, যক্ষ যে সন্ন্যাসীর কথা কহিয়াছিল, এ সেই ব্যক্তি কিনা। যাহা হউক, সহসা শ্ৰীফলভক্ষণ করা উচিত নহে। রাজা, মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, কোষাধ্যক্ষের হন্তে সমর্পণপূর্বক কহিলেন, তুমি এই শ্ৰীফল সাবধানে রাখিবে। সন্ন্যাসী প্ৰত্যহ রাজদর্শন ও শ্ৰীফলপ্ৰদান করিতে লাগিলেন।
এক দিবস রাজা, বয়স্যবর্গ সমভিব্যাহারে, মন্দুরাসিন্দর্শনার্থ গমন করিয়াছেন, এমন সময়ে সন্ন্যাসী তথায় উপস্থিত হইয়া, পূর্ববং শ্ৰীফলপ্রদানপূর্বক, আশীৰ্বাদ করিলেন। দৈবযোগে, শ্ৰীফল ভূপতির করতল হইতে ভূতলে পতিত ও ভগ্ন হওয়াতে, তন্মধ্য হইতে এক অপূর্ব রত্ন নিৰ্গত হইল। রাজা ও রাজবয়স্যগণ তদীয় প্ৰভা দর্শনে চমৎকৃত হইলেন। রাজা যোগীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়। আপনি কি জন্যে আমায় এই রত্নগর্ভ শ্ৰীফল দিলেন।
যোগী কহিলেন, মহারাজ! শাস্ত্রে রাজা, গুরু, জ্যোতির্বিদ, ও চিকিৎসকের নিকট রিক্ত হস্তে যাইতে নিষেধ আছে; এইজন্যে, আমি এই রত্নগৰ্ভ শ্ৰীফল লইয়া আসিয়াছিলাম। আর, এক রত্নগৰ্ভ শ্ৰীফলের কথা কি কহিতেছেন, প্রতিদিন আপনাকে যে শ্ৰীফল দিয়াছি, সকলের মধ্যেই এতাদৃশ এক এক রত্ন আছে। তখন রাজা কোষাধ্যক্ষকে ডাকাইয়া কহিলেন, তোমাকে যত শ্ৰীফল রাখিতে দিয়াছি, সমুদয় এই স্থানে আন। কোষাধ্যক্ষ, রাজকীয় আদেশ অনুসারে, সমস্ত শ্ৰীফল তথায় উপস্থিত করিলে, রাজা প্রত্যেক শ্রীফল ভাঙ্গিয়া, সকলের মধ্যেই এক এক রত্ন দেখিয়া যৎপরোনাস্তি আহ্লাদিত ও চমৎকৃত হইলেন এবং, তৎক্ষণাৎ রাজসভায় গমনপূর্বক, এক মণিকারকে ডাকাইয়া, ঐ সমস্ত রত্বের পরীক্ষা করিতে আজ্ঞা দিয়া কহিলেন, এই অসার সংসারে ধর্মই সার পদার্থ; অতএব, তুমি ধর্মপ্রমাণ প্রত্যেক রত্বের মূল্য নির্ধারিত করিয়া দাও।
এইরূপ রাজবাক্য শ্রবণগোচর করিয়া, মণিকার কহিল, মহারাজ! আপনি যথার্থ আজ্ঞা করিয়াছেন। ধর্মরক্ষা করিলে, সকল বিষয়ের রক্ষা হয়; ধর্মলোপ করিলে সকল বিষয়ের লোপ হয়। অতএব, আমি ধৰ্মীসাক্ষী করিয়া প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, আপন জ্ঞান অনুসারে, যথার্থ মূল্য নির্ধারিত করিয়া দিব। ইহা কহিয়া, সে প্রত্যেক রত্নের লক্ষণপরীক্ষা করিয়া কহিল, মহারাজ! বিলক্ষণ বিবেচনা করিয়া দেখিলাম, সকল রত্নই সর্বাঙ্গসুন্দর; কোটি মুদ্রাও একৈকের প্রকৃত মূল্য নহে। এ সকল অমূল্য রত্ন।
রাজা শুনিয়া, সাতিশয় হৃষ্ট হইয়া, সমুচিত পারিতোষিক প্রদানপূর্বক, মণিকারকে বিদায় করিলেন এবং, হস্তদ্বারা সন্ন্যাসীর হস্তগ্রহণ করিয়া, সিংহাসনার্থে উপবেশন করাইয়া কহিলেন, মহাশয়! আমার, সমস্ত সাম্রাজ্যও আপনকার প্রদত্ত রত্নসমূহের তুল্যমূল্য হইবেক না। আপনি, সন্ন্যাসী হইয়া এ সকল অমূল্য রত্ন কোথায় পাইলেন, এবং কি অভিপ্ৰায়েই বা আমায় দিলেন, জানিতে ইচ্ছা করি। যোগী কহিলেন, মহারাজ! ঔষধ, মন্ত্রণা, গৃহচ্ছিদ্র, এসকল সর্বসমক্ষে ব্যক্ত করা বিধেয় নহে; যদি অনুমতি হয়, নির্জনে গিয়া নিবেদন করি। মহারাজ! নীতিজ্ঞেরা বলেন, মন্ত্রণা, ষট্ কৰ্ণে প্রবিষ্ট হইলে, অপ্রকাশিত থাকে না, তাহাতে কাৰ্যহানির সম্পূর্ণ সম্ভাবনা; চারিকর্ণে হইলে, প্রকাশিত হয় না, অথচ কাৰ্যসিদ্ধি করে; আর, দুই কর্ণের মন্ত্রণা, মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, ব্ৰহ্মাও জানিতে পারেন না।
ইহা শুনিয়া, রাজা সন্ন্যাসীকে নির্জনে লইয়া কহিতে লাগিলেন, যোগীশ্বর। আপনি আমায় এত রত্ন দিলেন, কিন্তু একদিনও আমার আলয়ে ভোজন বা জলগ্রহণ করিলেন না; এজন্য, আমি আপনকার নিকট অতিশয় লজ্জিত হইতেছি। আপনকার কোনও অভিপ্রায় থাকে, ব্যক্ত করুন: আমি প্রাণান্তেও তৎসম্পাদনে পরাঙ্মুখ হইব না। সন্ন্যাসী কহিলেন, মহারাজ! গোদাবরীতীরবর্তী শ্মশানে মন্ত্র সিদ্ধ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছি; তাহাতে অষ্টসিদ্ধি লাভ হইবেক। অতএব, তোমার নিকট আমার প্রার্থনা এই, তুমি একদিন, সন্ধ্যা অবধি প্রভাত পর্যন্ত, আমার সন্নিহিত থাকিবে। তুমি সন্নিহিত থাকিলেই, আমার মন্ত্র সিদ্ধ হইবেক। রাজা কহিলেন, অবধারিত যাইব; আপনি দিন নির্ধারিত করিয়া বলুন। সন্ন্যাসী কহিলেন, তুমি, আগামী ভাদ্রীকৃষ্ণচতুর্দশীতে, সন্ধ্যাকালে, একাকী আমার নিকটে যাইবে। রাজা কহিলেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকিবেন; আমি, নিঃসন্দেহ, যথাসময়ে, আপনকার আশ্রমে উপস্থিত হইব। এইরূপে রাজাকে বচনবদ্ধ করিয়া, বিদায় লইয়া, সন্ন্যাসী স্বীয় আশ্রমে প্ৰতিগমন করিলেন।
কৃষ্ণচতুর্দশী উপস্থিত হইল। সন্ন্যাসী, সায়ং সময়ে, আবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীর সংগ্ৰহপূর্বক, শ্মশানে যোগাসনে বসিলেন। রাজা বিক্ৰমাদিত্যও, প্রতিশ্রুত সময় সমুপস্থিত দেখিয়া, সাহসে নির্ভর করিয়া, করে তরবারি ধারণপূর্বক, একাকী সন্ন্যাসীর আশ্রমে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, বহুসংখ্যক বিকটাকৃতি ভূত, প্ৰেত, পিশাচ, শঙ্খিনী, ডাকিনী প্রভৃতি আনন্দে উন্মত্তপ্রায় হইয়া, সন্ন্যাসীর চতুর্দ্দিকে নৃত্য করিতেছে; সন্ন্যাসী, যোগাসনে আসীন হইয়া, দুই হস্তে দুই নরকপাল লইয়া, বাদ্য করিতেছেন। রাজা, এতাদৃশ্য ভয়াবহ ব্যাপার দর্শনে, কিঞ্চিম্মাত্র ভীত হইলেন না; যথোপযুক্ত ভক্তিযোগ সহকারে প্রণাম করিয়া, কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্য উপস্থিত; আদেশ দ্বারা চরিতার্থ করিতে আজ্ঞা হয়। যোগী, আশীৰ্বাদপ্রয়োগপূর্বক, সমীপপাতিত আসনের দিকে অঙ্গুলি প্রয়োগ করিয়া কহিলেন, এই আসনে উপবেশন কর।
রাজা, তদীয় আদেশ অনুসারে, আসন পরিগ্রহ করিয়া, কিয়ৎক্ষণ পরে, পুনরায় নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্যের প্রতি কি আজ্ঞা হয়। যোগী কহিলেন, মহারাজ! তোমার বাক্যনিষ্ঠায় নিরতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। বুঝিলাম, সৎপুরুষেরা, প্ৰাণান্তেও, প্ৰতিজ্ঞাপ্রতিপালনে পরাঙ্মুখ হয়েন না। যাহা হউক, যদি অনুগ্ৰহ করিয়া আসিয়াছ, এক বিষয়ে আমার সাহায্য কর। দুই ক্রোশ দক্ষিণে এক শ্মশান আছে; তথায় দেখিতে পাইবে, এক শিরীষবৃক্ষে শব ঝুলিতেছে; ঐ শব আমার নিকটে লাইয়া আইস। রাজা, যে আজ্ঞা বলিয়া, তৎক্ষণাৎ প্ৰস্থান করিলেন। এইরূপে, রাজাকে শবানয়নে প্রেরণপূর্বক, যথাবিধি বিবিধ আয়োজন করিয়া, সন্ন্যাসী পূজায় বসিলেন।
একে কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত্ৰি সহজেই ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত; তাহাতে আবার, ঘনঘটা দ্বারা গগনমণ্ডল আচ্ছন্ন হইয়া মুষলধারায় বৃষ্টি হইতেছিল; আর, ভূতপ্ৰেতগণ চতুর্দ্দিকে ভয়ানক কোলাহল করিতেছিল। এইরূপ সঙ্কটে কাহার হৃদয়ে না ভয়সঞ্চার হয়। কিন্তু রাজার তাহাতে ভয় বা ব্যাকুলতার লেশমাত্ৰ উপস্থিত হইল না। পরিশেষে, নানা সঙ্কট হইতে উত্তীর্ণ হইয়া, রাজা নির্দ্দিষ্ট প্ৰেতভূমিতে উপনীত হইলেন; দেখিলেন, কোনও স্থলে অতি বিকটমূর্তি ভূতপ্ৰেতগণ, জীবিত মনুষ্য ধরিয়া, তাহাদের মাংস ভক্ষণ করিতেছে; কোনও স্থলে ডাকিনীগণ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালক ধরিয়া, তদীয় অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গ চর্বণ করিতেছে। রাজা, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে শিরীষবৃক্ষের নিকটে গিয়া দেখিলেন, উহার মূল অবধি অগ্রভাগ পর্যন্ত, প্ৰত্যেক বিটপ ও পল্লব ধক্ ধক্ করিয়া জ্বলিতেছে; আর, চারিদিকে অনবরত কেবল মার্ মার্, কাট্ কাট্ ইত্যাদি ভয়ানক শব্দ হইতেছে।
এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়াও রাজা ভয় পাইলেন না; কিন্তু মনে মনে বিবেচনা করিয়া স্থির করিলেন, যক্ষ যে যোগীর কথা কহিয়াছিল, এ সেই ব্যক্তি, তাহার সন্দেহ নাই। অনন্তর, তিনি সেই বৃক্ষের সন্নিহিত হইয়া দেখিলেন, শব রজ্জুবদ্ধ, অধঃশিরাঃ, লম্বমান রহিয়াছে। শবদর্শনে শ্রম সফল বোধ করিয়া, রাজা সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। এবং, নিৰ্ভয়ে বৃক্ষে আরোহণপূর্বক, খড়গাঘাত দ্বারা, শবের বন্ধনরজ্জ্ব ছিন্ন করিলেন। শব, ভূতলে পতিত হইবামাত্ৰ, উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিল। রাজা, তদীয় কণ্ঠরব শ্ৰবণে, সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন, এবং ত্বরায় তরু হইতে অবতীর্ণ হইয়া, নিকটে গিয়া জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কে, কি নিমিত্তে তোমার এরূপ দুরবস্থা ঘাঁটিয়াছে, বল। শব খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। রাজা, দেখিয়া শুনিয়া, সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন ও চিন্তান্বিত হইলেন, এবং এই অদ্ভুত ব্যাপারের মর্মাববোধে অসমৰ্থ হইয়া, অন্তঃকরণে অশেষপ্রকার কল্পনা করিতে লাগিলেন।
এই অবকাশে শব, বৃক্ষে উঠিয়া পূর্ববৎ রজ্জুবদ্ধ ও লম্বমান হইয়া রহিল। রাজাও তৎক্ষণাৎ বৃক্ষে আরোহণ ও রজ্জুচ্ছেদন পুরঃসর, শবকে কক্ষে নিক্ষিপ্ত করিয়া অবতীর্ণ হইলেন, এবং নিরতিশয় নির্বন্ধ সহকারে, তাহার এরূপ বিপৎপ্রাপ্তির কারণ জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। সে কিছুই উত্তর দিল না। রাজা, ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, যক্ষের নিকট যে তৈলিকের উপাখ্যান শুনিয়াছিলাম, এ সেই ব্যক্তি; আর, যোগীও সেই কুম্ভকার, আপনি যোগসিদ্ধির উদ্দেশে, ইহার প্রাণসংহার করিয়া, শ্মশানে রাখিয়াছে। অনন্তর তিনি, শবকে উত্তরীয়বস্ত্ৰে বদ্ধ করিয়া, যোগীর নিকটে লইয়া চলিলেন।
অর্ধপথে উপস্থিত হইলে, শবাবিষ্ট বেতাল বিক্ৰমাদিত্যকে জিজ্ঞাসিল, অহে বীর পুরুষ! তুমি কে, আমায়, কি নিমিত্তে, কোথায়, লইয়া যাইতেছ, বল। ভূপতি কহিলেন, আমি রাজা বিক্ৰমাদিত্য; শান্তশীল নামক যোগীর আদেশ অনুসারে, তোমায় তাঁহার আশ্রমে লইয়া যাইতেছি। বেতাল কহিল, মহারাজ! মূঢ়, নিৰ্বোধ, ও অলসেরা কেবল নিদ্রায়, আলস্যে ও কলহে কালাহরণ করে; কিন্তু বুদ্ধিমান, চতুর, পণ্ডিত ব্যক্তিরা, সদা সদালাপ, শাস্ত্রচিন্তা, ও সৎকর্মের অনুষ্ঠান দ্বারা, আনন্দে কালযাপন করিয়া থাকেন। অতএব, সমস্ত পথ মৌনভাবে গমন করা অপেক্ষা, সৎকথার আলোচনা শ্ৰেয়সী বোধ করিয়া, এক এক প্রসঙ্গ করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রত্যেক প্রসঙ্গের পরিশেষে প্রশ্ন করিব; যদি তুমি তত্তৎ প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর দাও, তৎক্ষণাৎ ফিরিয়া যাইব; আর, যদি জানিয়াও যথার্থ উত্তর না দাও, অবিলম্বে তোমার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হইবেক। রাজা, অগত্যা তদীয় প্রস্তাবে সন্মত হইয়া, তাহাকে সন্ন্যাসীর আশ্রমে লইয়া চলিলেন এবং বেতালও উপাখ্যানের আরম্ভ করিল।
বেতালপঞ্চবিংশতি-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [1847 CE]
প্রথম উপাখ্যান
বেতাল কহিল, মহারাজ! শ্রবণ কর,
বারাণসী নগরীতে, প্রতাপমুকুট নামে, এক প্রবলপ্ৰতাপ নরপতি ছিলেন। তাঁহার মহাদেবী নামে প্ৰেয়সী মহিষী ও বজ্রমুকুট নামে হৃদয়নন্দন নন্দন ছিল। একদিন রাজকুমার, একমাত্র অমাত্যপুত্রকে সমভিব্যাহারে লইয়া, মৃগয়ায় গমন করিলেন। তিনি নানা বনে ভ্রমণ করিয়া, পরিশেষে এক নিবিড় অরণ্যে প্রবেশপূর্বক, ঐ অরণ্যের মধ্যবর্তী অতি মনোহর সরোবর সন্নিধানে উপস্থিত হইলেন; দেখিলেন, ঐ সরোবরের নির্মল সলিলে হংস, বক, চক্ৰবাক প্রভৃতি নানাবিধ জলচর বিহঙ্গমগণ কেলি করিতেছে; প্রফুল্ল কমলসমূহের সৌরভে চারিদিক আমোদিত হইয়া আছে; মধুকরেরা, মধুগন্ধে অন্ধ হইয়া গুন গুন ধ্বনি করত, ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতেছে; তীরস্থিত তরুগণ অতিনব পল্লব, ফল, কুসুম সমূহে সুশোভিত রহিয়াছে; উহাদের ছায়া অতি স্নিগ্ধ; বিশেষতঃ, শীতল সুগন্ধ গন্ধবহের মন্দ মন্দ সঞ্চার দ্বারা, পরম রমনীয় হইয়া আছে; তথায় উপস্থিতি মাত্র, শ্রান্ত ও আতপক্লান্ত ব্যক্তির শ্রান্তি ও ক্লান্তি দূর হয়।
এই পরম রমণীয় স্থানে, কিয়ৎক্ষণ সঞ্চরণ করিয়া, রাজকুমার অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন, এবং সমীপবর্তী বকুলবৃক্ষের স্কন্ধে অশ্ববন্ধন ও সরোবরে অবগাহনপূর্বক, স্নান করিলেন; অনন্তর, অনতিদূরবর্তী দেবাদিদেব মহাদেবের মন্দিরে প্রবেশপূর্বক, দর্শন, পূজা, ও প্ৰণাম করিয়া কিয়ৎ ক্ষণ পরে বহির্গত হইলেন। ঐ সময়মধ্যে এক রাজকন্যাও, স্বীয় সহচরী বর্গের সহিত, সরোবরের অপর পারে উপস্থিত হইয়া স্নান ও পূজা সমাপনপূর্বক, বৃক্ষের ছায়ায় ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। দৈবযোগে, তাঁহার ও বজ্রমুকুটের চারি চক্ষুঃ একত্র হইল। তদীয় নিরুপম সৌন্দর্য সন্দর্শনে, নৃপনন্দন মোহিত হইলেন। রাজকুমারীও, বজ্রমুকুটকে নয়নগোচর করিয়া, কৃতাৰ্থন্মন্য হইয়া, শিরঃস্থিত পদ্ম হন্তে লইলেন; অনন্তর, কর্ণসংযুক্ত করিয়া, দন্ত দ্বারা ছেদনপূর্বক, পদতলে নিক্ষিপ্ত করিলেন; পুনর্বার গ্রহণ ও হৃদয়ে স্থাপন করিয়া, বারংবার রাজতনয়ের দিকে সতৃষ্ণ দৃষ্টিপাত করিতে করিতে, স্বীয় প্ৰিয়বয়স্যাগণের সহিত স্বস্থানে প্ৰস্থান করিলেন।
কুমারী ক্ৰমে ক্ৰমে দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইলে, রাজকুমার বিরহবেদনায় অতিশয় অস্থির হইলেন, এবং সর্বাধিকারিকুমারের নিকটে গিয়া, লজ্জানম্র মুখে কহিতে লাগিলেন, বয়স্য! আজি আমি এক পরম সুন্দরী রমণী নিরীক্ষণ করিয়াছি; তাহার নাম ধাম কিছুই জানিতে পারি নাই; কিন্তু প্ৰতিজ্ঞা করিয়াছি, তাহাকে না পাইলে, প্ৰাণত্যাগ করিব। সর্বাধিকারিতনয়, সমস্ত শ্ৰবণগোচর করিয়া, তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে গৃহে প্রত্যানীত করিলেন। রাজকুমার, দুঃসহ বিরহবেদনায় নিতান্ত অধীর হইয়া, শাস্ত্রচিন্তা, সদালাপ, রাজকাৰ্যপর্যালোচনা, ও স্নান ভোজন প্ৰভৃতি আবশ্যক ক্রিয়া পর্যন্ত পরিত্যাগপূর্বক, একাকী নির্জনে বিষন্ন মনে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন; পরিশেষে চিত্তবিনোদনের কোনও উপায় না দেখিয়া স্বহস্তে সেই কামিনীর প্রতিমূর্তি চিত্ৰিত করিলেন। দিন যামিনী, কেবল সেই প্ৰতিমূর্তির সন্দর্শন করেন; কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন না; কেহ কিছু জিজ্ঞাসা করিলে, উত্তর দেন না। সৰ্বাধিকারিপুত্র, নৃপনন্দনের এতাদৃশী দশা নিরীক্ষণ করিয়া, উপদেশচ্ছলে অশেষপ্রকার ভর্ৎসনা করিলেন।
প্রিয় বয়স্যের উপদেশবাক্য শ্ৰবণগোচর করিয়া, রাজকুমার কহিলেন, সখে! আমি যখন এ পদবীতে পদার্পণ করিয়াছি, তখন আমার হিতাহিতচিন্তা ও সুখদুঃখবিবেচনা নাই। প্রতিজ্ঞা করিয়াছি, মনোরথ সম্পন্ন না হইলে, জীবনবিসর্জন করিব। রাজকুমারের ঈদৃশ আক্ষেপবাক্য কর্ণগোচর করিয়া, সৰ্বাধিকারিকুমার মনে মনে বিবেচনা করিতে লাগিলেন, আর এখন উপদেশ দ্বারা ধৈৰ্যসম্পাদনের সময় নাই; ইনি নিতান্ত অধীর হইয়াছেন; অতঃপর কোনও উপায় স্থির করা আবশ্যক। অনন্তর, তিনি রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য! প্ৰস্থানকালে, সেই সীমন্তিনী তোমাকে কিছু বলিয়াছিল, কিংবা তুমি তাহাকে কিছু বলিয়াছিলে। রাজপুত্র কহিলেন, না বয়স্য! আমি তাহাকে কিছু বলি নাই; এবং সেই সৰ্বাঙ্গসুন্দরীও আমায় কোনও কথা বলে নাই। তখন সৰ্বাধিকারিপুত্ৰ কহিলেন, তবে তাহার সমাগম দুর্ঘট বোধ হইতেছে। রাজপুত্ৰ কহিলেন, যদি সেই সুলোচনা লোচনানন্দদায়িনী না হয়, আমি প্ৰাণত্যাগ করিব। তখন তিনি, অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, পুনরায় কহিলেন, ভাল বয়স্য! জিজ্ঞাসা করি, প্ৰস্থানসময়ে, সে কোনও সঙ্কেত করিয়াছিল কি না।
রাজকুমার কমলবৃত্তান্ত বর্ণনা করিলেন। তখন সৰ্বাধিকারিপুত্ৰ কহিলেন, সখে! আর চিন্তা নাই; আমি তৎকৃত সঙ্কেতের তাৎপর্যগ্ৰহ করিয়াছি, এবং তাহার নাম ধাম জানিতে পারিয়াছি। এখন প্ৰতিজ্ঞা করিতেছি, অল্প দিনের মধ্যেই, তাহার সহিত তোমার সমাগম সম্পন্ন করিয়া দিব। অধিক ব্যাকুল হইলেই, অভীষ্টসিদ্ধি হয় না; ধৈৰ্য অবলম্বন কর। তখন রাজপুত্ৰ কহিলেন, যদি বুঝিয়া থাক, সমুদয় বিশেষ করিয়া বল; শুনিলেও, আপাততঃ স্থির হইতে পারি। তিনি কহিলেন, বয়স্য! শ্ৰবণ কর, পদ্মপুষ্প, মস্তক হইতে নামাইয়া, কৰ্ণে সংলগ্ন করিয়াছিল; তদ্বারা তোমাকে ইহা জানাইয়াছে, আমি কর্ণাটনগরীনিবাসিনী; দন্ত দ্বারা খণ্ডিত করিয়া, ইহা ব্যক্ত করিয়াছে, আমি দন্তবাট রাজার কন্যা; তৎপরে, পদতলে নিক্ষিপ্ত করিয়া, এই সঙ্কেত করিয়াছে, আমার নাম পদ্মাবতী; আর, হৃদয়ে স্থাপন করিয়া, এই অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিয়াছে, তুমি আমার হৃদয়বল্লভ।
বয়স্যের এই বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া রাজকুমার অপার আনন্দসাগরে মগ্ন হইলেন; এবং ব্যগ্র হইয়া বারংবার কহিতে লাগিলেন, বয়স্য! ত্বরায় আমায় কর্ণাটনগরে লইয়া চল। অনন্তর, উভয়ে সমুচিত পরিচ্ছদধারণ ও অস্ত্ৰবন্ধনপূর্বক অশ্বে আরোহণ করিলেন। কতিপয় দিবসের পরে, কর্ণাটনগরে উপস্থিত হইয়া, তাঁহারা রাজবাটীর নিকটে গিয়া দেখিলেন, এক বৃদ্ধ আপন ভবনদ্বারে উপবিষ্টা আছে। উভয়ে, অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইয়া, তাহার নিকটে গিয়া কহিলেন, মা! আমরা বাণিজ্যব্যবসায়ী বিদেশীয় লোক; দ্রব্যসামগ্ৰী সমগ্র পশ্চাৎ আসিতেছে; বাসার অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত, আমরা অগ্রসর হইয়াছি; যদি কৃপা করিয়া স্থান দাও, তবে থাকিতে পাই। বৃদ্ধা, তাঁহাদের মনোহর রূপ দর্শনে ও মধুর আলাপ শ্রবণে প্ৰীত হইয়া, প্ৰসন্ন মনে কহিল, এ তোমাদের গৃহ, যতদিন ইচ্ছা, সচ্ছন্দে অবস্থিতি কর।
এইরূপে, উভয়ে সেই বর্ষীয়সীর সদনে আবাসগ্রহণ করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে বৃদ্ধা, তাঁহাদের সন্নিধানে আগমন করিয়া, কথোপকথন আরম্ভ করিলে, সৰ্বাধিকারিপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, মা! কয়জন তোমার পরিবার, আর কি প্রকারে বা সংসারযাত্ৰানিৰ্বাহ হয়। বৃদ্ধা কহিল, আমার পুত্র রাজসংসারে কর্ম করে, রাজার অতি প্ৰিয় পাত্র। আর, পদ্মাবতী নামে রাজার এক কন্যা আছেন, আমি তাঁহার ধাত্রী ছিলাম। এক্ষণে বৃদ্ধ হইয়াছি, গৃহে থাকি; রাজা অনুগ্ৰহ করিয়া অন্ন বস্ত্ৰ দেন। আর, রাজকন্যা আমায় ভালবাসেন; এজন্য, প্রতিদিন, এক একবার, তাঁহাকে দেখিতে যাই। এই কথা শুনিয়া, রাজপুত্ৰ কহিলেন, কল্য যখন রাজবাটীতে যাইবে, আমায় বলিবে; আমি তোমা দ্বারা রাজকন্যার নিকট কোনও সংবাদ পাঠাইব। বৃদ্ধা কহিল, যদি প্রয়োজন থাকে, বল, আজই আমি রাজকন্যাকে জানাইয়া আসি। রাজকুমার, এই কথা শুনিবা মাত্র, অতিমাত্র হৃষ্ট হইয়া কহিলেন, তুমি রাজকন্যাকে বলিবে, শুক্লপঞ্চমীতে, সরোবরতীরে, যে রাজকুমারকে দেখিয়াছিলে, সে, তোমার সঙ্কেত অনুসারে, উপস্থিত হইয়াছে।
এই বাক্য কর্ণগোচর হইবামাত্র, বৃদ্ধা যষ্টিগ্রহণপূর্বক রাজভবনে গমন করিল। সে কন্যান্তঃপুরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, রাজকন্যা একাকিনী নির্জনে উপবিষ্টা আছেন। বৃদ্ধা সম্মুখবর্তিনী হইবামাত্র, রাজকন্যা সমাদরপূর্বক বসিতে আসন দিলেন। সে উপবিষ্ট হইয়া কহিল, বৎসে। বাল্যকালে, অনেক যত্নে, তোমায় মানুষ করিয়াছি। এক্ষণে, ভগবানের অনুগ্ৰহে, তুমি তরুণাবস্থা প্রাপ্ত হইয়াছ। আমার অন্তঃকরণের একান্ত অভিলাষ এই, অবিলম্বে উপযুক্ত পাত্রের হস্তগতা হও। এইরূপ আড়ম্বরপূর্বক ভূমিকা করিয়া, বৃদ্ধা কহিতে লাগিল, শুক্লপঞ্চমীতে, বাপীতটে, যে রাজকুমারের মন হরণ করিয়া আনিয়াছিলে, তিনি আমার গৃহে উপস্থিত হইয়াছেন, এবং আমা দ্বারা এই সংবাদ পঠাইয়াছেন, কমলসঙ্কেত দ্বারা যে অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করিয়াছিলে, তাহা সম্পন্ন কর; আমি উপস্থিত হইয়াছি। আর, আমিও কহিতেছি, এই রাজকুমার সর্বাংশে তোমার যোগ্য পাত্র; তুমি যেরূপ রূপবতী ও গুণবতী, তিনিও সর্বাংশে তদনুরূপ।
রাজকন্যা শ্রবণমাত্র, কোপ প্রকাশ করিয়া, হস্তে চন্দন লেপনপূর্বক, বৃদ্ধর উভয় গণ্ডে চপেটাঘাত করিলেন, এবং কহিলেন, তুমি এই মূহুর্তে আমার অন্তঃপুর হইতে দূর হও। বৃদ্ধা, এইপ্ৰকার তিরস্কার লাভ করিয়া, বিরক্ত হইয়া, বিষন্ন বদনে সদনে প্রত্যাগমনপূর্বক, পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত রাজকুমারের কর্ণগোচর করিল। তিনি শ্রবণমাত্র, অতিমাত্র ব্যাকুল ও হতাশ্বাস হইয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, পার্শ্ববর্তী প্রিয় বয়স্যের দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া কহিতে লাগিলেন, সখে। এখন কি উপায় করি; নিতান্ত বুঝিলাম, বিধি বাম হইয়াছেন; মনস্কামসিদ্ধির কোনও সম্ভাবনা আছে, এরূপ বোধ হইতেছে না; নতুবা, সেই বামলোচনা, কি নিমিত্ত, তিরস্কার করিয়া, বৃদ্ধাকে বিদায় করিল। অন্তঃকরণে অনুরাগ সঞ্চার হইলে, দূতীর প্রতি এত অনাদর হয় না। তখন তিনি কহিলেন, বয়স্য! মৰ্মগ্রহ না করিয়া, অকারণে এত ব্যাকুল হও কেন। শ্ৰীখণ্ডরসে অভিষিক্ত দশ করশাখা দ্বারা প্ৰহারের তাৎপৰ্য এই যে, শুক্ল পক্ষের দশ দিবস অবশিষ্ট আছে; তদবসানে, অর্থাৎ কৃষ্ণ পক্ষে তোমার সহিত সমাগম হইবেক।
শুক্ল পক্ষ অতিক্রান্ত হইল। বৃদ্ধা, পুনরায় রাজকুমারীর নিকটে গিয়া, রাজকুমারের প্রার্থনা জানাইল। তিনি শুনিয়া সাতিশয় কোপপ্ৰকাশ করিলেন; এবং, গলহস্তপ্রদানপূর্বক, বৃদ্ধাকে, অন্তঃপুরের খড়কী দিয়া, বিদায় করিয়া দিলেন। সে, তৎক্ষণাৎ রাজকুমারের নিকটে গিয়া, এই বৃত্তান্ত জানাইল। তিনি শুনিয়া, নিতান্ত হতাশ্বাস হইয়া, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্বক, অধোমুখে চিন্তা করিতে লাগিলেন। তখন সৰ্বাধিকারীর পুত্ৰ কহিলেন, বয়স্য! কেন উৎকণ্ঠিত হইতেছে, আর ভাবনা নাই; এ অনুকুল গলহস্ত, অপ্ৰশস্ত নহে; তুমি পূর্ণমনোরথ হইয়াছ। অন্য রজনীযোগে, তোমায়, সেই খড়কী দিয়া, তাহার অন্তঃপুরে যাইতে সঙ্কেত করিয়াছে। রাজপুত্র, আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া, নিতান্ত উৎসুক চিত্তে, সূৰ্যদেবের অস্তগমনপ্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।
রজনী উপস্থিত হইল। রাজকুমার, বিহারযোগ্য বেশভূষার সমাধান করিয়া, প্রিয় বয়স্যের সহিত, অন্তঃপুরের খড়কীতে উপস্থিত হইলেন। সর্বাধিকারীর পুত্র বহির্ভাগে দণ্ডায়মান রহিলেন; তিনি, তন্মধ্যে দিয়া, অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন; দেখিলেন, রাজকুমারী তাঁহার প্রতীক্ষা করিতেছেন। নয়নে নয়নে আলিঙ্গন হওয়াতে, উভয়ে চরিতার্থতা প্রাপ্ত হইলেন। রাজকুমারী, পার্শ্ববর্তিনী বয়স্যার প্রতি, দ্বার বদ্ধ করিবার আদেশ দিয়া, রাজকুমারের করগ্রহণপূর্বক, বিলাসভবনে প্রবেশ করিলেন, এবং সুশোভিত স্বর্ণময় পল্যঙ্কে উপবেশনানন্তর, বল্লভের কণ্ঠদেশে স্বহস্তসঙ্কলিত ললিত মালতীমালা সমৰ্পণ করিয়া, স্বয়ং তালবৃন্তসঞ্চালন করিতে লাগিলেন। তখন রাজকুমার কহিলেন, প্রিয়ে! তোমার বদনসুধাকরসন্দর্শনেই, আমার চিত্তচকোর চরিতার্থ হইয়াছে, আর এরূপ ক্লেশস্বীকারের প্রয়োজন নাই; বিশেষতঃ, তোমার কোমল করপল্লব শিরীষ কুসুম অপেক্ষাও সুকুমার, কোনও ক্রমে তালবৃন্তধারণের যোগ্য নহে; আমার হস্তে দাও; আমি তোমার সেবা দ্বারা আত্মাকে চরিতার্থ করি। পদ্মাবতী কহিলেন, নাথ! আমার জন্য, তোমায় অনেক ক্লেশভোগ করিতে হইয়াছে; অতএব, তোমার সেবা করাই আমার উচিত হয়।
উভয়ের এইরূপ বচনবৈদগ্ধী শ্ৰবণগোচর করিয়া, পার্শ্ববর্তিনী সহচরী, পদ্মাবতীর হস্ত হইতে তালবৃন্ত গ্রহণপূর্বক, বায়ুসঞ্চারণ করিতে লাগিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, রাজকুমার ও রাজকুমারী সহচরীদিগকে সাক্ষী করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে, দাম্পত্যবন্ধনে আবদ্ধ হইলেন। অনন্তর, উভয়ের সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাব দেখিয়া, সহচরীগণ, কার্যান্তরব্যপদেশে, বিলাসভবন হইতে বহির্গত হইলে, কান্ত ও কামিনী কৌতুকে যামিনী যাপন করিলেন।
রজনী অবসন্না হইল। রাজকুমার অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইবার অভিপ্ৰায় প্রকাশ করিলেন। তখন রাজকুমারী কহিলেন, নাথ! আমার এ অন্তঃপুরে, সখীগণ ব্যতিরেকে, অন্যের প্রবেশ করিবার অধিকার নাই; তুমি নিৰ্ভয়ে অবস্থিতি কর। আমি, তোমায় বিদায় দিয়া, ক্ষণমাত্রও প্রাণধারণ করিতে পারিব না। রাজকুমার, প্রিয়তমার ঈদৃশ প্রণয়রসাভিষিক্ত মৃদু মধুর বচন পরম্পরা শ্রবণে শ্রবণেন্দ্রিয়ের চরিতার্থতা লাভ করিয়া, তদীয় প্ৰস্তাবে সম্মত হইলেন, এবং তাঁহার সহচর হইয়া, পরম সুখে, কালব্যাপন করিতে লাগিলেন।
এইরূপে কতিপয় দিবস অতিবাহিত হইলে, রাজকুমার রাজধানীপ্ৰতিগমনের অভিপ্রায়প্ৰকাশ করিলেন। রাজকন্যা, কোনও মতে, সম্মত হইলেন না। ক্রমে ক্রমে, প্রায় মাস অতীত হইয়া গেল; রাজকুমার তথাপি প্ৰস্থানের অনুমতিলাভ করিতে পারিলেন না। এইরূপে, স্বদেশপ্ৰতিগমনবিষয়ে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া, তিনি একদিন, নির্জনে বসিয়া মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, আমি নিতান্ত নরাধম; অকিঞ্চিৎকর ইন্দ্ৰিয়সুখের পরতন্ত্র হইয়া, পিতা মাতা জন্মভূমি প্রভৃতি সকল পরিত্যাগ করিলাম; আর, যে জীবিতাধিক বান্ধবের বুদ্ধিকৌশলে ও উপদেশবলে, ঈদৃশ অসুলভ সুখসম্ভোগে কালাহরণ করিতেছি, মাসাবধি তাহারও কোনও সংবাদ লইলাম না; বোধ করি, বন্ধু আমায় নিতান্ত স্বার্থপর ও যার পর নাই অকৃতজ্ঞ ভাবিতেছেন।
রাজকুমার একাকী এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, এমন সময়ে রাজকন্যা তথায় উপস্থিত হইয়া, তাঁহাকে সাতিশয় বিষন্ন দেখিয়া জিজ্ঞাসিলেন, নাথ! আজি কি জন্যে তুমি এমন উন্মনা হইয়াছ। তোমার চন্দ্ৰবদন বিষন্ন দেখিলে, আমি দশ দিক শূন্য দেখি। অসুখের কারণ কি, বল; ত্বরায় তাহার প্রতিবিধান করিতেছি। বজ্রমুকুট কহিলেন, পিতার সর্বাধিকারীর পুত্র আমার সমভিব্যাহারে আসিয়াছেন। তিনি আমার পরম সুহৃৎ; মাসাবধি তাঁহার কোনও সংবাদ পাই নাই; জানি না, তিনি কেমন আছেন। তিনি অতি চতুর, সর্বশাস্ত্ৰে পণ্ডিত, ও নানা গুণরত্নে মণ্ডিত। তাঁহারই বুদ্ধিকৌশলে ও মন্ত্রণাবলে, তোমার সমাগম লাভ করিয়াছি। তিনিই তোমার সমস্ত সঙ্কেতের মর্মোদ্ভেদ করিয়াছিলেন।
পদ্মাবতী কহিলেন, অয়ি নাথ! ঈদৃশ বন্ধুর অদর্শনে, চিত্ত অবশ্যই উৎকণ্ঠিত হইতে পারে। এত দিন তাহার কোনও সংবাদ না লওয়ায়, যৎপরোনাস্তি অভদ্রতা প্ৰকাশ হইয়াছে। রহস্যবিদ বন্ধু প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তর। বিবেচনা করিয়া দেখিলে, তুমি তাঁহার নিকট সম্পূর্ণ অপরাধী হইয়াছ, এবং, যার পর নাই, অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করিয়াছ। এক্ষণকার কর্তব্য এই, তাহার পরিতোষার্থে, আমি স্বহস্তে নানাবিধ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিয়া পাঠাই; এবং তুমিও, একবার, কিয়ৎ ক্ষণের নিমিত্ত, তথায় গিয়া, সমুচিত সদ্ভাবপ্রদর্শন করিয়া আইস। রাজপুত্র, তৎক্ষণাৎ, সেই খড়কী দিয়া, অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইয়া, বৃদ্ধার ভবনে উপস্থিত হইলেন, এবং, বহু দিবসের পর, অকপটপ্রণয় পবিত্র মিত্র সহ সাক্ষাৎকারলাভে অশ্রুপূর্ণলোচনা হইয়া, তাঁহার নিকট পূর্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন।
রাজপুত্রকে বন্ধুদর্শনে প্রেরণ করিয়া, রাজকন্যা মনে মনে এই আলোচনা করিতে লাগিলেন, এ কেবল বন্ধুর বুদ্ধিকৌশলেই কৃতকাৰ্য হইয়াছে; অতএব অবশ্যই সকল কথা তাঁহার নিকট ব্যক্ত করিবেক; আর, সে ব্যক্তিও আপনি বান্ধবগণের নিকট, সমস্ত প্ৰকাশ করিবেক, সন্দেহ নাই। এইরূপে আমার কলঙ্কঘোষণা, ক্রমে ক্রমে, জগদ্ব্যাপিনী হইবার সম্ভাবনা। অতএব, এতাদৃশ ব্যক্তিকে জীবিত রাখা, কোনও ক্ৰমে, শ্রেয়স্কর নহে। এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া, পদ্মাবতী, অবিলম্বে নানাবিধ বিষমিশ্ৰিত মিষ্টান্ন প্ৰস্তুত করিয়া সখী দ্বারা রাজকুমারের নিকট পাঠাইয়া দিলেন।
মিষ্টান্ন উপনীত হইলে, সর্বাধিকারিপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, বয়স্য। এ সকল কি। রাজপুত্ৰ কহিলেন, মিত্র। আজ আমি তোমার জন্য অতিশয় উৎকণ্ঠিত হইয়াছিলাম। রাজকন্যা, আমার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, কারণজিজ্ঞাসু হইলে, আমি তোমার সবিশেষ পরিচয় দিয়া ও অশেষবিধ প্ৰশংসা করিয়া বলিলাম, প্রিয়ে! আমি এই বন্ধুর অদর্শনে বিষন্ন হইতেছি। রাজকন্যা, তোমার সবিশেষ পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় সন্তষ্ট হইয়াছেন, এবং আমায় অগ্ৰে পাঠাইয়া দিয়া, স্বহস্তে এই সমস্ত প্ৰস্তুত করিয়া, তোমার জন্য প্রেরণ করিয়াছেন। আমায় বলিয়া দিয়াছেন, তুমি আপন সমক্ষে তাঁহাকে মিষ্টান্ন ভোজন করাইয়া আসিবে। অতএব বয়স্য! কিছু ভক্ষণ কর, তাহা হইলে পরম পরিতোষ পাই, এবং যাইয়া তাঁহার নিকটে বলিতে চাই, আমার বন্ধু, মিষ্টান্ন আহার করিয়া, তোমার শিল্পনৈপুণ্যের অশেষপ্রকার প্রশংসা করিয়াছেন।
এই সকল কথা শুনিয়া, সর্বাধিকারিপুত্র, কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর রাজপুত্রের মুখে পুনর্বার মনোযোগপূর্বক পূর্বাপর সমস্ত শ্ৰবণ করিয়া কহিলেন, বয়স্য! তুমি আমার জন্যে কালকূট আনিয়াছ; এ মিষ্টান্ন নহে, সাক্ষাৎ কৃতান্ত, জিহ্বাস্পৰ্শমাত্রই প্ৰাণসংহার করিবেক। আমার পরম সৌভাগ্য এই, তুমি খাও নাই। তুমি নিতান্ত ঋজুস্বভাব, কাহার কি ভাব, কিছুই বুঝিতে চেষ্টা কর না। তোমায় এক সার কথা বলি, স্বৈরিণীরা, স্বভাবতঃ, আপনি প্ৰিয়ের প্ৰিয় পাত্রের উপর অতিশয় বিষদৃষ্টি হয়। অতএব, তুমি, তাহার নিকট আমার পরিচয় দিয়া, বুদ্ধির কার্য কর নাই।
রাজকুমার কহিলেন, বয়স্য। আমি তোমার এ কথায় বিশ্বাস করিতে পারি না। তুমি তাঁহার স্বভাব জান না, এজন্য এরূপ কহিতেছ। এমন সদাশয় স্ত্রীলোক তুমি কখনও দেখ নাই। তাঁহার নাম করিলে, আমার রোমাঞ্চ হয়। আর, আমি, সমবেত সখীগণ সমক্ষে, ধর্ম সাক্ষী করিয়া, গান্ধৰ্ব বিধানে, তাঁহার পাণিগ্রহণ করিয়াছি; এমন স্থলে, স্বৈরিণীশব্দে তাঁহার নির্দেশ করা, কোনও মতে, ন্যায়ানুগত হইতেছে না। সে যাহা হউক, তিনি যেমন চারুশীলা, তেমনই উদারশীলা, তিনি তোমার প্রাণসংহারের নিমিত্ত, মিষ্টান্নাচ্ছলে কালকূট পাঠাইয়াছেন, তুমি কেমন করিয়া এমন কথা মুখে আনিলে, বুঝিতে পারিতেছি না। বলিতে কি, তুমি আর বার এ প্রকার কহিলে, আমি তোমার উপর যার পর নাই, বিরক্ত হইব। ভাল, কথায় প্রয়োজন নাই, আমি তোমার সন্দেহ দূর করিতেছি। এই বলিয়া, এক লাড়ু লইয়া, রাজকুমার বিড়ালকে ভক্ষণ করাইলেন। বিড়াল তৎক্ষণাৎ পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। তখন রাজপুত্ৰ চকিত হইয়া কহিতে লাগিলেন, এরূপ দুর্বৃত্তার সহিত পরিচয় রাখা কদাচি উচিত নহে। আর আমি, জন্মাবচ্ছেদে, সে পাপীয়সীর মুখাবলোকন করিব না। মন্ত্ৰিপুত্র কহিলেন, না বয়স্য। তাহারে একবারে পরিত্যাগ করা হইবেক না; কৌশল করিয়া, রাজধানীতে লইয়া যাইতে হইবেক। রাজপুত্ৰ কহিলেন, তাহাও তোমার বুদ্ধিসাধ্য।
অমাত্যপুত্ৰ কহিলেন, বয়স্য! এক পরামর্শ বলি, শুন। আজ তুমি, পদ্মাবতীর নিকটে গিয়া, পূর্ব অপেক্ষা অধিকতর প্রণয়প্রদর্শন করিবে, এবং বলিবে, বন্ধু, মিষ্টান্ন ভক্ষণের অব্যবহিত পরক্ষণেই, অচেতন্যপ্ৰায় হইয়া, নিদ্রাগত হইয়াছেন। আমি, তোমায় দেখিবার নিমিত্ত নিতান্ত উৎসুক হইয়া, তাঁহার নিদ্ৰাভঙ্গ পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে না পারিয়া, চলিয়া আসিয়াছি। আমি এখন, তোমায় এক ক্ষণ নিরীক্ষণ না করিলে, দশ দিক শূন্য দেখি। ফলতঃ, আর আমি, বন্ধুর অনুরোধে এক মুহুর্তের নিমিত্তেও, তোমায় পরিত্যাগ করিয়া যাইতে পারিব না। এবম্প্রকার মনোহরবাক্যপ্রয়োগ দ্বারা, তাহারে মোহিত করিয়া, দিবাযাপন করিবে; অনন্তর, রাত্রিতে সে নিদ্রাগিতা হইলে, তদীয় সমস্ত আভরণ হরণপূর্বক, তাহার বাম জঙ্ঘাতে ত্ৰিশূলের চিহ্ন দিয়া, চলিয়া আসিবে। রাজপুত্র সম্মত হইলেন, এবং পদ্মাবতীর নিকটে গিয়া বিলক্ষণ প্রীতিপ্ৰদৰ্শন করিলেন। পরে, রজনীযোগে, উভয়ে শয়ন করিলে, রাজকন্যা ত্বরায় নিদ্রাভিভূত হইলেন। তখন রাজকুমার, মন্ত্রিপুত্রের উপদেশানুরূপ সমস্ত ব্যাপার সম্পন্ন করিয়া, বৃদ্ধার আবাসে উপস্থিত হইলেন।
পর দিন, প্রভাতে, মন্ত্রিপুত্র, সন্ন্যাসীর বেশধারণপূর্বক, এক শ্মশানে উপস্থিত হইলেন, এবং স্বয়ং গুরু হইয়া রাজপুত্রকে শিষ্য করিয়া কহিলেন, তুমি নগরে গিয়া এই অলঙ্কার বিক্রয় কর। যদি কেহ তোমায় চোর বলিয়া ধরে, তাহারে আমার নিকটে লইয়া আসিবে। রাজপুত্র, তদীয় উপদেশ অনুসারে, নগরে প্রবেশ করিয়া রাজসদনের সমীপবাসী স্বর্ণকারের নিকট, রাজকন্যার অলঙ্কারবিক্রয়ার্থে উপস্থিত হইলেন। সে, দর্শনমাত্র, বিস্ময়াপন্ন হইয়া, মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিল, কিছুদিন হইল, আমি রাজকন্যার নিমিত্ত এই সকল অলঙ্কার গড়িয়া দিয়াছি; ইহার হন্তে কি প্রকারে আইল। এ ব্যক্তিকে বৈদেশিক দেখিতেছি। অনন্তর, সাতিশয় সন্দিহান হইয়া, স্বর্ণকার কারিকরদিগকে জিজ্ঞাসা করাতে, তাহারা কহিল, হ্যাঁ, এ সমস্ত রাজকন্যার অলঙ্কার বটে। তখন সে, রাজকুমারকে চোর স্থির করিয়া, কহিল, এ রাজকন্যার অলঙ্কার দেখিতেছি, তুমি কোথায় পাইলে, যথাৰ্থ বল।
স্বর্ণকার, ভয়প্রদর্শনপূর্বক, বার বার এইপ্ৰকার জিজ্ঞাসা করাতে, রাজপথাবাহী বহুসংখ্যক লোক, কৌতুহলাক্রান্ত হইয়া, তথায় সমবেত হইল। ফলতঃ, অল্পকালমধ্যেই ঐ অলঙ্কার লইয়া, বিলক্ষণ আন্দোলন হইতে লাগিল। পরিশেষে, নগরপাল, এই সংবাদ পাইয়া, রাজকুমার ও স্বর্ণকার, উভয়কে রুদ্ধ করিল। পরে, সে অলঙ্কারের প্রাপ্তিবৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিলে, রাজকুমার কহিলেন, শ্মশানবাসী গুরুদেব আমায় এই অলঙ্কার বিক্রয় করিতে পাঠাইয়াছেন; তিনি কোথায় পাইয়াছেন, আমি তাহার কিছুই জানি না। যদি তোমাদের আবশ্যক বোধ হয়, শ্মশানে গিয়া, তাঁহাকে জিজ্ঞাসা কর। পরিশেষে, নগরপাল, গুরু শিষ্য উভয়কে, অলঙ্কার সমেত রাজসমক্ষে লইয়া গিয়া, পূর্বাপর সমস্ত বিজ্ঞাপন করিল।
রাজা, অলঙ্কার দর্শনে, নানাপ্রকারে সন্দিহান হইয়া, যোগীকে, নির্জনে লইয়া গিয়া বিনয়বাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়! আপনি এই সমস্ত অলঙ্কার কোথায় পাইলেন। যোগী কহিলেন, মহারাজ! কৃষ্ণচতুর্দশী রজনীতে, আমি নগরপ্রান্তবর্তী শ্মশানে ডাকিনীমন্ত্র সিদ্ধ করিয়াছিলাম। মন্ত্রপ্রভাবে ডাকিনী, স্বয়ং উপস্থিত হইয়া, প্ৰসাদস্বরূপ স্বীয় অলঙ্কার সকল উন্মোচিত করিয়া দিয়াছেন; এবং আমিও তাঁহার বাম জঙ্ঘাতে, যোগসিদ্ধির প্রমাণস্বরূপ ত্ৰিশূলের চিহ্ন করিয়া দিয়াছি। এ সমস্ত সেই অলঙ্কার। রাজা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়া, অবিলম্বে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন, এবং রাজমহিষীকে বলিলেন, দেখ দেখি, পদ্মাবতীর বাম জঙ্ঘাতে কোনও চিহ্ন আছে, কি না। রাজ্ঞী সবিশেষ অবগত হইয়া, রাজার নিকটে আসিয়া কহিলেন, এক ত্ৰিশূলের চিহ্ন আছে।
রাজা, এবম্প্রকার অঘটনঘটনা দর্শনে, হতবুদ্ধি ও লজ্জায় অধোবদন হইয়া, ভাবিতে লাগিলেন, এতাদৃশী দুশ্চারিণীকে গৃহে রাখা কদাচি উচিত নহে; ইহাতে অধৰ্ম আছে। অতএব, এখন কি কর্তব্য। অথবা, পণ্ডিতমণ্ডলী সমবেত করিয়া, সবিশেষ কহিয়া জিজ্ঞাসা করি; তাঁহারা, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে, যেরূপ ব্যবস্থা দিবেন, তদনুরূপ কাৰ্য করিব। কিন্তু, শাস্ত্ৰে গৃহচ্ছিদ্র প্রকাশ করিতে নিষেধ আছে। পণ্ডিতমণ্ডলী সমবেত করিয়া ব্যবস্থা জিজ্ঞাসিলে, আমার এই কলঙ্ক, ক্রমে ক্ৰমে দেশে বিদেশে প্রচারিত হইবেক। তদপেক্ষা উত্তম কল্প এই, সেই সন্ন্যাসীকেই ইহার পরামর্শ জিজ্ঞাসা করি। সন্ন্যাসী সবিশেষ সমস্ত অবগত আছেন; ধর্মতঃ প্রশ্ন করিলে, অবশ্যই যথাশাস্ত্র ব্যবস্থা দিবেন। অনন্তর, রাজা সন্ন্যাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহাশয়! ধর্মশাস্ত্ৰে দুশ্চরিত্রা স্ত্রীর বিষয়ে কিরূপ দণ্ড নিরূপিত আছে। সন্ন্যাসী কহিলেন, মহারাজ! ধৰ্মশাস্ত্ৰে লিখিত আছে স্ত্রীলোক, বালক, ব্ৰাহ্মণ ইহারা অত্যন্ত অপরাধী হইলেও, বিধার্হ নহে; রাজা ইহাদের নির্বাসনারূপ দণ্ডবিধান করিবেন।
রাজা, এই সমস্ত শ্রবণ করিয়া, অন্তঃপুরে গিয়া, রাজ্ঞীকে কহিলেন, পদ্মাবতী অতি দুশ্চরিত্রা; এজন্য শাস্ত্রের বিধান অনুসারে, আমি উহারে দেশবহিস্কৃতা করিব। রাজ্ঞী কন্যার প্রতি নিরতিশয় স্নেহবতী ছিলেন; কিন্তু, পতিব্ৰতাত্বগুণের আতিশয্যবশতঃ রাজার মতেই সন্মতিপ্ৰদৰ্শন করিলেন। অনন্তর নরপতি, কন্যাকে শিবিকারোহণের আদেশ দিয়া, তাহার অগোচরে, বাহকদিগকে আজ্ঞা দিলেন, তোমরা, পদ্মাবর্তীকে কোনও অরণ্যানীতে পরিত্যাগ করিয়া, ত্বরায় আমায় সংবাদ দিবে। বাহকেরা রাজাজ্ঞাসম্পাদন করিল। অমাত্যপুত্রও, তৎক্ষণাৎ, রাজকুমারকে সঙ্গে লইয়া, রাজকুমারীর উদ্দেশে চলিলেন; এবং, ইতস্ততঃ অনেক অন্বেষণ করিয়া, পরিশেষে সেই অরণ্যানীতে প্রবেশিয়া দেখিলেন, পদ্মাবতী, একাকিনী বৃক্ষমূলে বসিয়া, যূথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায়, বিষন্নবদনে রোদন করিতেছেন। অশেষবিধ আশ্বাসপ্রদান দ্বারা তাঁহার শোকাবেগনিবারণ করিয়া, সঙ্গে লইয়া, উভয়ে স্বদেশ অভিমুখে প্ৰস্থান করিলেন। তাঁহার রাজধানীতে উপস্থিত হইলে, প্ৰজাগণ অতিশয় আনন্দিত হইল। রাজা প্রতাপমুকুট, বধূ সহিত পুত্ৰ পাইয়া, আনন্দপ্রবাহে মগ্ন হইয়া, নগরে মহোৎসবের আদেশ করিলেন।
এইরূপে আখ্যায়িকার সমাপন করিয়া, বেতাল জিজ্ঞাসা করিল, মহারাজ। রাজা ও মন্ত্রিপুত্র, এ উভয়ের মধ্যে কোন ব্যক্তি, নিরপরাধে রাজনন্দিনীর নির্বাসনজন্য দুরদৃষ্টভাগী হইবেন। বিক্ৰমাদিত্য কহিলেন, আমার মতে, রাজা। বেতাল কহিল, কি নিমিত্তে। রাজা কহিলেন, শাস্ত্রকারেরা আততায়ীর বধে ও বিদ্রোহাচরণে দোষাভাব লিখিয়াছেন। অতএব, বিষপ্রদায়িনী রাজতনয়ার প্রতি এরূপ প্রতিকূল আচরণের নিমিত্ত, মন্ত্রিপুত্রকে দোষী বলিতে পারা যায় না। কিন্তু, রাজা যে, অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির বাক্যে বিশ্বাস করিয়া, প্রমাণান্তরনিরপেক্ষ ও বিচারবহির্মুখ হইয়া, অপত্যস্নেহবিস্মরণপূর্বক, অকৃত অপরাধে, কন্যাকে নির্বাসিত করিলেন, ইহাতে তাঁহার, রাজধর্মের বিরুদ্ধ কর্মের অনুষ্ঠানজন্য, পাপম্পৰ্শ হইতে পারে।
ইহা শুনিয়া, বেতাল পূর্বকৃত প্রতিজ্ঞা অনুসারে, শ্মশানে গিয়া, পূর্ববৎ বৃক্ষে লম্বমান হইল; রাজাও, তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইয়া, তাহাকে, বৃক্ষ হইতে অবতারণপূর্বক, স্কন্ধে করিয়া, সন্ন্যাসীর আশ্রম অভিমুখে চলিলেন।
বেতালপঞ্চবিংশতি-ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর [1847 CE]
দ্বিতীয় সংস্করণের বিজ্ঞাপন
কালেজ অব্ ফোর্ট উইলিয়ম নামক বিদ্যালয়ে, তত্ৰত্য ছাত্ৰগণের পাঠার্থে, বাঙ্গালা ভাষায় হিতোপদেশ নামে যে পুস্তক নির্দ্দিষ্ট ছিল, তাহার রচনা অতি কদৰ্য্য। বিশেষতঃ, কোনও কোনও অংশ এরূপ দুরূহ ও অসংলগ্ন যে কোনও ক্রমে অর্থবোধ ও তাৎপর্য্যগ্ৰহ হইয়া উঠে না। তৎপরিবর্ত্তে পুস্তকান্তর প্রচলিত করা উচিত ও আবশ্যক বিবেচনা করিয়া, উক্ত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মহামতি শ্ৰীযুত মেজর জি. টি. মার্শল মহোদয় কোনও নূতন পুস্তক প্রস্তুত করিতে আদেশ দেন। তদনুসারে আমি, বৈতালপচীসীনামক প্রসিদ্ধ হিন্দী পুস্তক অবলম্বন করিয়া, এই গ্রন্থ লিখিয়াছিলাম।
যৎকালে প্ৰথম প্রচারিত হয়, আমার এমন আশা ছিল না, বেতালপঞ্চবিংশতি সৰ্ব্বত্র পরিগৃহীত হইবেক। কিন্তু, সৌভাগ্যক্রমে, বাঙ্গালা ভাষার অনুশীলনকারী ব্যক্তিমাত্রেই আদরপূর্বক গ্ৰহণ করিয়াছেন, এবং এতদ্দেশীয় প্রায় সমুদায় বিদ্যালয়েই প্রচলিত হইয়াছে। ফলতঃ, দুই বৎসরের অনধিক কাল মধ্যেই প্রথম মুদ্রিত সমস্ত পুস্তক নিঃশেষ রূপে পৰ্য্যবসিত হয়।
প্রায় সংবৎসর অতিক্রান্ত হইল, পুস্তকের অসদ্ভাব হইয়াছে। কিন্তু, কোনও কোনও কারণবশতঃ, আমি পুনর্ম্মুদ্রাকরণে এ পর্য্যন্ত পরাঙ্মুখ ছিলাম। পরিশেষে, গ্রাহকমণ্ডলীর আগ্রহাতিশয় দর্শনে, দ্বিতীয় বার মুদ্রিত ও প্রচারিত করিলাম। যে যে স্থান কোনও অংশে অপরিশুদ্ধ ছিল, পরিশোধিত হইয়াছে, এবং অশ্লীল পদ, বাক্য, ও উপাখ্যানভাগ পরিত্যক্ত হইয়াছে। এক্ষণে বেতালপঞ্চবিংশতি পূর্ববৎ সর্বত্র পরিগৃহীত হইলে শ্রম সফল বোধ করিব।
শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শর্ম্মা
কলিকাতা।
১০ই ফাল্গুন। সংবৎ ১৯০৬।
বেতালপঞ্চবিংশতি -Ishwar Chandra Vidyasagar [26 September 1820 – 29 July 1891]
Bengali Prose Before 1900 CE
Letter of Vidyasagar mentioning his work 1877 EC
সোদারাভিমানিনঃ
শ্রীগিরিশচন্দ্রশর্ম্মণঃ
কলিকাতা।
যোগেন্দ্র বাবু স্বীয় শ্বশুরের জীবনচরিত পুস্তকে, আমার সংক্রান্ত যে সকল কথা লিখিয়াছেন, তাহার অধিকাংশই এইরূপ অমূলক। দৃষ্টান্তস্বরূপ আর একটি স্থল প্রদর্শিত হইতেছে। তিনি ১৮ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন—
সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদ শূন্য হইল। এরূপ শুনিতে পাই, বেথুন তর্কালঙ্কারকে এই পদ গ্রহণে অনুরোধ করেন। তিনি বিদ্যাসাগরকে ঐ পদের যোগ্য বলিয়া বেথুনের নিকট আবেদন করায়, বেথুন সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়কেই ঐ পদে নিযুক্ত করিতে বাধ্য হইলেন। এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়, তাহা হইলে ইহা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে তর্কালঙ্কারের ন্যায় সদাশয়, উদারচরিত ও বন্ধুহিতৈষী ব্যক্তি অতি কম ছিলেন। হৃদয়ের বন্ধুকে আপনি অপেক্ষা উচ্চতর পদে অভিষিক্ত করিয়া তর্কালঙ্কার বন্ধুত্বের ও ঔদার্য্যের পরা কাষ্ঠা দেখাইয়া গিয়াছেন।
গ্রন্থকৰ্ত্তার কল্পনাশক্তি ব্যতীত এ গল্পটির কিছুমাত্র মূল নাই। মদনমোহন তর্কালঙ্কার, ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকপদে নিযুক্ত হয়েন; ইঙ্গরেজী ১৮৫০ সালের নবেম্বর মাসে, মুরশিদাবাদের জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, সংস্কৃত কালেজ হইতে প্ৰস্থান করেন। তর্কালঙ্কারের নিয়োগসময়েও, যিনি ( বাবু রসময় দত্ত ) সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন, তর্কালঙ্কারের প্রস্থানসময়েও, তিনিই ( বাবু রসময় দত্ত) সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ফলতঃ, তর্কালঙ্কার যত দিন সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত ছিলেন, সেই সময় মধ্যে, এক দিনের জন্যেও, ঐ বিদ্যালয়ে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হয় নাই। সুতরাং, সংস্কৃত কালেজে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হওয়াতে, বেথুন সাহেব মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে ঐ পদে নিযুক্ত করিতে উদ্যত হইলে, তর্কালঙ্কার, ঔদাৰ্য্যগুণের আতিশয্যাবশতঃ, আমাকে ঐ পদের যোগ্য বিবেচনা করিয়া, ও বন্ধুস্নেহের বশীভুত হইয়া, বেথুন সাহেবকে আমার জন্য অনুরোধ করাতে, আমি ঐ পদে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, ইহা কি রূপে সম্ভাবিতে পারে, তাহা যোগেন্দ্ৰ বাবুই বলিতে পারেন।
আমি যে সূত্রে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষতাপদে নিযুক্ত হই, তাহার প্রকৃত বৃত্তাত্ত এই—মদনমোহন তর্কালঙ্কার, জজপণ্ডিত নিযুক্ত হইয়া, মুরশিদাবাদ প্ৰস্থান করিলে, সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। শিক্ষাসমাজের তৎকালীন সেক্রেটারি, শ্ৰীযুক্ত ডাক্তর মোয়েট সাহেব, আমায় ঐ পদে নিযুক্ত করিবার অভিপ্ৰায় প্ৰকাশ করেন। আমি, নানা কারণ দর্শাইয়া, প্রথমতঃ অস্বীকার করি। পরে, তিনি সবিশেষ যত্ন ও আগ্ৰহ প্ৰকাশ করাতে, আমি কহিয়াছিলাম, যদি শিক্ষাসমাজ আমাকে প্রিন্সিপালের ক্ষমতা দেন, তাহা হইলে আমি এই পদ স্বীকার করিতে পারি। তিনি আমার নিকট হইতে ঐ মর্মে একখানি পত্র লেখাইয়া লয়েন। তৎপরে ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে, আমি সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশ্যাস্ত্রের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হই। আমার এই নিয়োগের কিছু দিন পরে, বাবু রসময় দত্ত মহাশয় সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাপদ পরিত্যাগ করেন। সংস্কৃত কালেজের বর্ত্তমান অবস্থা, ও উত্তরকালে কিরূপ ব্যবস্থা করিলে, সংস্কৃত কালেজের উন্নতি হইতে পারে, এই দুই বিষয়ে রিপোর্ট করিবার নিমিত্ত, আমার প্রতি আদেশ প্রদত্ত হয়। তদনুসারে আমি রিপোর্ট সমৰ্পণ করিলে, ঐ রিপোর্ট দৃষ্টে সন্তুষ্ট হইয়া, শিক্ষাসমাজ আমাকে সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করেন। সংস্কৃত কালেজের অধ্যক্ষতাকাৰ্য্য, সেক্রেটারি ও আসিষ্টাণ্ট সেক্রেটারি, এই দুই ব্যক্তি দ্বারা নির্ব্বাহিত হইয়া আসিতেছিল; এই দুই পদ রহিত হইয়া, প্রিন্সিপালের পদ নূতন সৃষ্ট হইল। ১৮৫১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষে, আমি সংস্কৃত কালেজের প্রিন্সিপাল অর্থাৎ অধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হইলাম।
যোগেন্দ্র বাবুর গল্পটির মধ্যে, “এই জনশ্রুতি যদি সত্য হয়,” এই কথাটি লিখিত আছে। যাঁহারা, বহুকাল অবধি, সংস্কৃত কালেজে নিযুক্ত আছেন, অথবা যাঁহারা কোনও রূপে সংস্কৃত কালেজের সহিত কোনও সংস্রব রাখেন, তাঁহাদের মধ্যে কেহ কখনও এরূপ জনশ্রুতি কৰ্ণগোচর করিয়াছেন, এরূপ বোধ হয় না। যাহা হউক, যদিই দৈবাৎ ঐ রূপ অসম্ভব জনশ্রুতি কোনও সূত্রে যোগেন্দ্র বাবুর কর্ণগোচর হইয়াছিল, ঐ জনশ্রুতি অমূলক অথবা সমূলক, ইহার পরীক্ষা করা তাঁহার আবশ্যক বোধ হয় নাই। আবশ্যক বোধ হইলে, অনায়াসে তাঁহার সংশয়চ্ছেদন হইতে পারিত। কারণ, আমার নিয়োগবৃত্তান্ত সংস্কৃত কালেজ সংক্রান্ত তৎকালীন ব্যক্তিমাত্রেই বিলক্ষণ অবগত আছেন। যোগেন্দ্ৰ বাবু সংস্কৃত কালেজের ছাত্র; যে সময়ে তিনি আমার নিয়োগের উপাখ্যান রচনা করিয়াছেন, বোধ হয়, তখনও তিনি সংস্কৃত কালেজে অধ্যয়ন করিতেন। যদি সবিশেষ জানিয়া যথার্থ ঘটনার নির্দ্দেশ করা তাঁহার অভিপ্রেত হইত, তাহা হইলে, আমার নিয়োগ সংক্রান্ত প্রকৃত বৃত্তান্ত তাঁহার অপরিজ্ঞাত থাকিত না।
ইঙ্গরেজী ১৮৪৬ সালে, পূজ্যপাদ জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মহাশয়ের লোকান্তরপ্রাপ্তি হইলে, সংস্কৃত কালেজে সাহিত্যশাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ শূন্য হয়। সংস্কৃত কালেজের সেক্রেটারি বাবু রসময় দত্ত মহাশয় আমায় ঐ পদে নিযুক্ত করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন। আমি, বিশিষ্ট হেতুবশতঃ, অধ্যাপকের পদগ্রহণে অসম্মত হইয়া, মদনমোহন তর্কালঙ্কারকে নিযুক্ত করিবার নিমিত্ত, সবিশেষ অনুরোধ করি। তদনুসারে, মদনমোহন তর্কালঙ্কার ঐ পদে নিযুক্ত হয়েন। এই প্রকৃত বৃত্তান্তটির সহিত, যোগেন্দ্র বাবুর কল্পিত গল্পটির, বিলক্ষণ সৌসাদৃশ্য দৃশ্যমান হইতেছে।
শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শর্ম্মা
কলিকাতা।
১লা পৌষ, সংবৎ ১৯৩৩