শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত Prema Vivarta of Jagadananda Pandit (INDEX PAGE)
৭। সকলের পক্ষে নাম
অসাধুসঙ্গে নাম হয় না
অসাধুসঙ্গে ভাই কৃষ্ণনাম নাহি হয় ।
নামাক্ষর বাহিরায় বটে তবু নাম কভু নয় ॥১॥
কভু নামাভাস হয়, সদা নাম-অপরাধ ।
এ সব জানিবে ভাই কৃষ্ণভক্তির বাধ ॥২॥
নামভজন-প্রণালী
যদি করিবে কৃষ্ণনাম সাধুসঙ্গ কর ।
ভুক্তি-মুক্তি-সিদ্ধি-বাঞ্ছা দূরে পরিহর ॥৩॥
“দশ-অপরাধ” ত্যজ মান অপমান ।
অনাসক্ত্যে বিষয় ভুঞ্জ আর লহ কৃষ্ণনাম ॥৪॥
কৃষ্ণভক্তির অনুকূল সব করহ স্বীকার ।
কৃষ্ণভক্তির প্রতিকূল সব কর পরিহার ॥৫॥
জ্ঞানযোগচেষ্টা ছাড় আর কর্ম্মসঙ্গ ।
মর্কটবৈরাগ্য ত্যজ যাতে দেহরঙ্গ ॥৬॥
কৃষ্ণ আমায় পালে রাখে জান সর্ব্বকাল ।
আত্মনিবেদনদৈন্যে ঘুচাও জঞ্জাল ॥৭॥
সাধু পাওয়া কষ্ট বড় জীবের জানিয়া ।
সাধুগুরুরূপে কৃষ্ণ আইল নদীয়া ॥৮॥
গোরাপদ আশ্রয় করহ বুদ্ধিমান্ ।
গোরা বৈ সাধু গুরু আছে কে বা আন ॥৯॥
বৈরাগীর কর্ত্তব্য
বৈরাগী ভাই গ্রাম্যকথা না শুনিবে কানে ।
গ্রাম্যবার্তা না কহিবে যবে মিলিবে আনে ॥১০॥
স্বপনেও না কর ভাই স্ত্রী-সম্ভাষণ ।
গৃহে স্ত্রী ছাড়িয়া ভাই আসিয়াছ বন ॥১১॥
যদি চাহ প্রণয় রাখিতে গৌরাঙ্গের সনে ।
ছোট হরিদাসের কথা থাকে যেন মনে ॥১২॥
ভাল না খাইবে আর ভাল না পরিবে ।
হৃদয়েতে রাধাকৃষ্ণ সর্ব্বদা সেবিবে ॥১৩॥
বড় হরিদাসের ন্যায় কৃষ্ণনাম বলিবে বদনে ।
অষ্টকাল রাধাকৃষ্ণ সেবিবে কুঞ্জবনে ॥১৪॥
গৃহস্থ ও বৈরাগীর প্রতি আদেশ
গৃহস্থ বৈরাগী দুঁহে বলে গোরারায় ।
“দেখ ভাই নাম বিনা যেন দিন নাহি যায়” ॥১৫॥
বহু-অঙ্গ সাধনে ভাই নাহি প্রয়োজন ।
কৃষ্ণনামাশ্রয়ে শুদ্ধ করহ জীবন ॥১৬॥
বদ্ধ জীবে কৃপা করি’ কৃষ্ণ হইল নাম ।
কলিজীবে দয়া করি’ কৃষ্ণ হইল গৌরধাম ॥১৭॥
একান্ত-সরল-ভাবে ভজ গৌরজন ।
তবে ত’ পাইবে ভাই শ্রীকৃষ্ণচরণ ॥১৮॥
গৌরজন সঙ্গ কর গৌরাঙ্গ বলিয়া ।
‘হরে কৃষ্ণ’ নাম বল নাচিয়া নাচিয়া ॥১৯॥
অচিরে পাইবে ভাই নামপ্রেমধন ।
যাহা বিলাইতে প্রভুর নদে এ আগমন ॥২০॥
প্রভুর কুন্দলে জগা কেঁদে কেঁদে বলে ।
নাম ভজ নাম গাও ভকত সকলে ॥২১॥
৮। কুটীনাটি ছাড়
সরল মনে গোরাভজন
গোরা ভজ, গোরা ভজ, গোরা ভজ ভাই ।
গোরা বিনা এ জগতে গুরু আর নাই ॥১॥
যদি ভজিবে গোরা সরল কর নিজ মন ।
কুটীনাটি ছাড়ি’ ভজ গোরার চরণ ॥২॥
মনের কথা গোরা জানে ফাঁকি কেমনে দিবে ।
সরল হলে গোরার শিক্ষা বুঝিয়া লইবে ॥৩॥
আনের মন রাখিতে গিয়া আপনাকে দিবে ফাঁকি ।
মনের কথা জানে গোরা কেমনে হৃদয় ঢাকি ॥৪॥
গোরা বলে, “আমার মত করহ চরিত ।
আমার আজ্ঞা পালন কর চাহ যদি হিত” ॥৫॥
কপট ভজন
“গোরার আমি, গোরার আমি” মুখে বলিলে নাহি চলে ।
গোরার আচার, গোরার বিচার লইলে ফল ফলে ॥৬॥
লোক দেখান গোরা ভজা তিলক মাত্র ধরি’ ।
গোপনেতে অত্যাচার গোরা ধরে চুরি ॥৭॥
অধঃপতন হবে ভাই কৈলে কুটীনাটি ।
নাম-অপরাধে তোমার ভজন হবে মাটি ॥৮॥
নাম লঞা যে করে পাপ হয় অপরাধ ।
এর মত ভক্তি আর আছে কিবা বাধ ? ॥৯॥
নাম করিতে কষ্ট নাই নাম সহজ ধন ।
ওষ্ঠ-স্পন্দ-মাত্রে হয় নামের কীর্ত্তন ।
তাহাও না হয় যদি হয় নামের স্মরণ ॥১০॥
তুণ্ডবন্ধে চিত্তভ্রংশে শ্রবণ তবু হয় ।
সর্ব্বপাপ ক্ষয়ে জীবের মুখ্য ফলোদয় ॥১১॥
বহুজন্ম অর্চ্চনেতে এই ফল ধরে ।
কৃষ্ণনাম নিরন্তর তুণ্ডে নৃত্য করে ॥১২॥
কর্ম্মজ্ঞানযোগাদির সেই শক্তি নহে ।
বিধিভঙ্গদোষে ফলহীন শাস্ত্রে কহে ॥১৩॥
সে সব ছাড় ভাই নাম কর সার ।
অতি অল্পদিনে তবে জিনিবে সংসার ॥১৪॥
কবি কর্ণপূর
ধন্য কবি কর্ণপূর স্বগ্রামনিবাসী ।
নামের মহিমা কিছু রাখিল প্রকাশি’ ॥১৫॥
গৌর যারে কৃপা করে, বিশ্বে সেই ধন্য ।
সপ্তবর্ষ বয়সে হৈল মহাকবি মান্য ॥১৬॥
ধন্য শিবানন্দ কবি-কর্ণপূর-পিতা ।
মোরে বাল্যে শিখাইল ভাগবত-গীতা ॥১৭॥
নদীয়া লইয়া মোরে রাখে প্রভুপদে ।
শিবানন্দ ত্রাতা মোর সম্পদে বিপদে ॥১৮॥
তার ঘরে ভোগ রান্ধি’ পাক-শিক্ষা হইল ।
ভাল পাক করি’ শ্রীগৌরাঙ্গ-সেবা কৈল ॥১৯॥
জগাই বলে, “সাধুসঙ্গে দিন যায় যার ।
সেই মাত্র নামাশ্রয় করে নিরন্তর” ॥২০॥
৯। যুক্তবৈরাগ্য
বৈরাগ্য দুই প্রকার—ফল্গু ও যুক্ত
একদিন জিজ্ঞাসিলেন গোসাঞি সনাতন ।
“‘যুক্ত বৈরাগ্য’ কারে বলে প্রভু করুন বর্ণন ॥১॥
মায়াবাদী বলে, ‘সব কাকবিষ্ঠাসম ।
বিষয় জানিলে ন্যাসী হয় সর্ব্বোত্তম’ ॥২॥
বৈষ্ণবের কি কর্ত্তব্য জানিতে ইচ্ছা করি ।
কৃপা করি’ আজ্ঞা কর আজ্ঞা শিরে ধরি” ॥৩॥
প্রভু বলে, “বৈরাগ্য হয় দুই ত প্রকার ।
‘ফল্গু’-‘যুক্ত’ ভেদে আমি শিখাইনু বার বার ॥৪॥
ফল্গুবৈরাগ্য
কর্ম্মী জ্ঞানী যবে করে নির্ব্বেদ আশ্রয় ।
তার চিত্তে ফল্গুবৈরাগ্য পায় দুষ্টাশয় ॥৫॥
সংসারেতে তুচ্ছবুদ্ধি আসিয়া তখন ।
জড়-বিপরীত ধর্ম্মে করে প্রবর্ত্তন ॥৬॥
কৃষ্ণসেবা সাধুসেবা আত্মরসাস্বাদ ।
জড়-বিপরীত ধর্ম্মে পায় নিতান্ত অবসাদ ॥৭॥
ফল্গুবৈরাগীর মন সদা শুষ্ক রসহীন ।
নামরূপগুণলীলা না হয় সমীচীন ॥৮॥
যুক্তবৈরাগ্য
যুক্তবৈরাগীর ভক্তি হয় ত’ সুলভ ।
কৃষ্ণভক্তি-পূত বিষয় তার ঘটে সব ॥৯॥
প্রকৃতির জড়ধর্ম্ম তার চিত্ত ছাড়ে অনায়াসে ।
চিৎ-আশ্রয়ে মজে শীঘ্র অপ্রাকৃত ভক্তিরসে ॥১০॥
ভক্তিযোগে শ্রীকৃষ্ণের প্রসন্নতা পায় ।
‘ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি’, প্রতিজ্ঞা জানায় ॥১১॥
প্রসন্ন হইয়া কৃষ্ণ যারে কৃপা করে ।
সেই জন ধন্য এই সংসার-ভিতরে ॥১২॥
গোলোকের পরম ভাব তার চিত্তে স্ফুরে ।
গোকুলে গোলোক পায় মায়া পড়ে দূরে ॥১৩॥
শুষ্কবৈরাগ্য অসম্ভব
ওরে ভাই শুষ্কবৈরাগ্য এবে দূর কর ।
যুক্তবৈরাগ্য আনি’ সদা হৃদয়েতে ধর ॥১৪॥
বিষয় ছাড়িয়া ভাই কোথা যাবে বল ।
বনে যাবে, সেখানে বিষয়-জঞ্জাল ॥১৫॥
পেট তোমার সঙ্গে যাবে, দেহের রক্ষণে ।
কত লেঠা হবে তাহা ভেবে দেখ মনে ॥১৬॥
অকারণে জীবনের শীঘ্র হবে ক্ষয় ।
মরিলে কেমনে আর মায়া করবে জয় ॥১৭॥
যদিও না মর তবু হইবে দুর্ব্বল ।
জ্ঞাননাশ হৈলে কোথা জ্ঞানের সম্বল ॥১৮॥
সুতরাং যুক্তবৈরাগ্য কর্ত্তব্য
ঘরে বসি’ সদা কাল কৃষ্ণনাম লঞা ।
যথাযোগ্য-বিষয় ভুঞ্জ, অনাসক্ত হঞা ॥১৯॥
‘যথাযোগ্য’ এই শব্দ দুটীর মর্ম্মার্থ বুঝে লহ ।
কপটার্থ লঞা যেন দেহারামী না হ ॥২০॥
শুদ্ধভক্তির অনুকূল কর অঙ্গীকার ।
শুদ্ধভক্তির প্রতিকূল কর অস্বীকার ॥২১॥
মর্ম্মার্থ ছাড়িয়া যেবা শব্দ অর্থ করে ।
রসের বশে দেহারামী কপট মার্গ ধরে ॥২২॥
ভাল খায়, ভাল পরে, করে বহু ধনার্জ্জন ।
যোষিৎসঙ্গে রত হঞা ফিরে রাত্রদিন ।
ভাল শয্যা অট্টালিকা খোঁজে অর্ব্বাচীন ॥২৩॥
দেহযাত্রার উপযোগী নিতান্ত প্রয়োজন ।
বিষয় স্বীকার করি’ কর দেহের রক্ষণ ॥২৪॥
সাত্ত্বিক সেবন কর আসব বর্জ্জন ।
সর্ব্বভূতে দয়া করি’ কর উচ্চ সঙ্কীর্ত্তন ॥২৫॥
দেবসেবা ছল করি’ বিষয় নাহি কর ।
বিষয়েতে রাগ-দ্বেষ সদা পরিহর ॥২৬॥
পরহিংসা কপটতা অন্য সনে বৈর ।
কভু নাহি কর ভাই যদি মোর বাক্য ধর ॥২৭॥
নির্জ্জন সুদৃঢ় ভক্তি কর আলোচন ।
কৃষ্ণসেবার সম্বন্ধে দিন করহ যাপন ॥২৮॥
মঠ মন্দির দালান বাড়ীর না কর প্রয়াস ।
অর্থ থাকে কর ভাই যেমন অভিলাষ ॥২৯॥
অর্থ নাই তবে মাত্র সাত্ত্বিক সেবা কর ।
জল-তুলসী দিয়া গিরিধারীকে বক্ষে ধর ॥৩০॥
ভাবেতে কাঁদিয়া বল, ‘আমি ত’ তোমার ।
তব পাদপদ্ম চিত্তে রহুক আমার’ ॥৩১॥
বৈষ্ণবে আদর কর প্রসাদাদি দিয়া ।
অর্থ নাই দৈন্যবাক্যে তোষ মিনতি করিয়া ॥৩২॥
পরিজন পরিকর কৃষ্ণদাস-দাসী ।
আত্মসম পালনে হইবে মিষ্টভাষী ॥৩৩॥
স্মরণ-কীর্ত্তন-সেবা সর্ব্বভূতে দয়া ।
এই ত’ করিবে যুক্ত বৈরাগী হইয়া ॥৩৪॥
কৃষ্ণ যদি নাহি দেয় পরিজন-পরিকর ।
অথবা দিয়া ত লয় সর্ব্ব সুখের আকর ॥৩৫॥
শোক-মোহ ছাড় ভাই নাম কর নিরন্তর” ।
জগাই বলে, “এভাব গৌরের সনে মোর কোঁদল বিস্তর” ॥৩৬॥
১০। জাতিকুল
কুল ও ভজন যোগ্যতা
শ্রদ্ধা হইলে নরমাত্র নামের অধিকারী ।
জাতিকুলের তর্ক তর্কীর না চলে ভারিভুরি ॥১॥
ব্রাহ্মণের সৎকুল না হয় ভজনের যোগ্য ।
শ্রদ্ধাবান্ নীচজাতি নহে ভজনে অযোগ্য ॥২॥
কুলাভিমানী অভক্ত
সংসারের দশকর্ম্মে জাতিকুলের আধিপত্য ।
কৃষ্ণজনে জাতিকুলের না আছে মাহাত্ম্য ॥৩॥
জাতিকুলের অভিমানে অহঙ্কারী জন ।
ভক্তিকে বিদ্বেষ করি’ যায় নরক-ভবন ॥৪॥
না মানে বৈষ্ণবভক্ত, না মানে ধর্ম্মাধর্ম্ম ।
অহঙ্কারে করে সদা অকর্ম্ম-বিকর্ম্ম ॥৫॥
অভক্ত বিপ্র হইতে ভক্তি মুচি শ্রেষ্ঠ
মুচি হঞা কৃষ্ণ ভজে কৃষ্ণকৃপা পায় ।
শুচি হঞা ভক্তিহীন কৃষ্ণকৃপা নাহি তায় ॥৬॥
দ্বাদশ গুণেতে বিপ্র অলঙ্কৃত হঞা ।
কৃষ্ণভক্তি বিনা যায় নরকে চলিয়া ॥৭॥
কৃষ্ণভক্তি যথা, তথা সর্ব্বগুণগণ ।
আপন ইচ্ছায় দেহে বৈসে অনুক্ষণ ॥৮॥
মৃতদেহে অলঙ্কার হয় ঘৃণাস্পদ ।
অভক্তের জপ-তপ বাহ্য সে সম্পদ ॥৯॥
বিষয়ে রাগদ্বেষ বর্জ্জনীয়
ভজ ভাই একমনে শচীর নন্দন ।
জাতিকুলের অভিমান হবে বিসর্জ্জন ॥১০॥
অভিমান ছাড়িলে ভাই ছাড়িবে বিষয় ।
বিষয় ছাড়িলে শুদ্ধ হবে তোমার আশয় ॥১১॥
বিষয় হইতে অনুরাগ লও উঠাইয়া ।
কৃষ্ণপদাম্বুজে রাগে দেহ লাগাইয়া ॥১২॥
হও তুমি সৎকুলীন তাহে কিবা ক্ষতি ।
কুলের অভিমান ছাড়ি’ হও দীনমতি ॥১৩॥
অভিমানহীন দীনের প্রতি ভগবানের দয়া
দীনেরে অধিক দয়া করে ভগবানে ।
অভিমান দৈন্য নাহি রহে একস্থানে ॥১৪॥
অভিমান নরকের পথ, তাহা যত্নে ত্যজ ।
দৈন্যে রাধাগোবিন্দের পাদপদ্মে মজ ॥১৫॥
অভিমান-ত্যাগ নিত্যানন্দের দয়া সাপেক্ষ
আহা ! প্রভু নিত্যানন্দ কবে করিবে দয়া ।
অভিমান ছাড়াঞা মোরে দিবে পদ-ছায়া ॥১৬॥
Categories: CIVIL