২ । গ্রন্থরচনা
চৈতন্যের রূপ গুণ সদা পড়ে মনে ।
পরাণ কাঁদায় দেহ ফাঁপায় সঘনে ॥১॥
কাঁদিতে কাঁদিতে মনে হইল উদয় ।
লেখনী ধরিয়া লিখি ছাড়ি’ লাজ ভয় ॥২॥
নামেতে ‘পণ্ডিত’ মাত্র, ঘটে কিছু নাই ।
চৈতন্যের লীলা তবু লিখিবারে চাই ॥৩॥
স্বরূপ গোসাঞি ও পণ্ডিত জগদানন্দ
গোসাঞি স্বরূপ বলে, “কি লিখ পণ্ডিত” ।
আমি বলি, “লিখি তাই যাহাতে পীরিত ॥৪॥
চৈতন্যের লীলাকথা যাহা পড়ে মনে ।
লিখিয়া রাখিব আমি অতি সঙ্গোপনে” ॥৫॥
স্বরূপ বলেন, “তবে লিখ প্রভুর চরিত ।
যাহা পড়ি’ জগতের হবে বড় হিত” ॥৬॥
আমি বলি, “জগতের হিত নাহি জানি ।
যাহা যাহা ভাল লাগে তাই লিখে আনি” ॥৭॥
স্বরূপ ছাড়িল মোরে বাতুল বলিয়া ।
একা বসি’ লিখি আমি প্রভু ধেয়াইয়া ॥৮॥
দেখিছি অনেক লীলা থাকি’ প্রভু-সঙ্গে ।
কিছু কিছু লিখি তাই নিজ মনোরঙ্গে ॥৯॥
মন কাঁদে, প্রাণ কাঁদে, কাঁদে দুটী আঁখি ।
যখন যাহা মনে পড়ে তখন তাহা লিখি ॥১০॥
শ্রীমহাপ্রভু ও গ্রন্থকার
প্রভু মোরে হাস্য করি’ কৈল এক দিন ।
“দ্বারকার পাটেশ্বরী তুমি ত’ প্রবীন ॥১১॥
আমি ত’ ভিখারী অতি, মোরে সেব কেন ।
কত শত সন্ন্যাসী পাইবে আমা হেন” ॥১২॥
মুঞি বলি, “রেখে দাও তোমার ছলনা ।
রাধাপদ-দাসী আমি, ও কথা বলো না ॥১৩॥
আমার রাধার বর্ণ করিয়াছ চুরি ।
ব্রজে লয়ে যাব আমি তোমায় চোর ধরি’ ॥১৪॥
আমি চাই রাধাপদ, তুমি ফেল ঠেলি’ ।
দ্বারকা পাঠাও মোরে, এই তোমার কেলি ॥১৫॥
তোমার সন্ন্যাসি-গিরি আমি ভাল জানি ।
মোদের বঞ্চিয়া রাধা সেবিবে আপনি” ॥১৬॥
বাল্য-ঘটনা-স্মরণে গ্রন্থকারের আক্ষেপোক্তি
আহা সে চৈতন্যপদ ভজনের সম্পদ
কোথা এবে গেল আমা ছাড়ি’ ।
আমাকে ফেলিয়া গেল মৃত্যু মোর না হৈল
শোকে আমি যাই গড়াগড়ি ॥১৭॥
একদিন শিশুকালে দুজনেতে পাঠশালে
কোন্দলে করিনু হাতাহাতি ।
মায়াপুরে গঙ্গাতীরে পড়িয়া দুঃখের ভারে
কাঁদিলাম এক দিন রাতি ॥১৮॥
সদয় হইয়া নাথ না হইতে পরভাত
গদাধরের সঙ্গেতে আসিয়া ।
ডাকেন, “জগদানন্দ ! অভিমান বড় মন্দ
কথা বলো বক্রতা ছাড়িয়া” ॥১৯॥
প্রভুর বদন হেরি’ অভিমান দূর করি’
জিজ্ঞাসিলাম, “এত রাত্রে কেন ।
নদীয়ার কড়া ভূমি চলি’ কষ্ট পাইলে তুমি
মো লাগি’ তোমার কষ্ট হেন” ॥২০॥
প্রভু বলে, “চল চল নিশি অবসান ভেল
গৃহে গিয়া করহ ভোজন ।
তব দুঃখ জানি’ মনে ছিলাম আমি অনশনে
শয্যা ছাড়ি’ ভূমিতে শয়ান ॥২১॥
হেনকালে গদাধর আইল আমার ঘর
দুঁহে আইনু তোমার তল্লাসে ।
ভাল হৈল মান গেল এবে নিজ গৃহে চল
কালি খেলা করিব উল্লাসে” ॥২২॥
গদাই-চরণ ধরি’ উঠিলাম ধীরি ধীরি
প্রভু-আজ্ঞা ঠেলিতে না পারি ।
প্রভুর গৃহেতে গিয়া কিছু খাই জল পিয়া
শুইলাম দণ্ড দুই চারি ॥২৩॥
প্রাতে শচী-জগন্নাথ মোরে দিলা দুধ-ভাত
প্রভু সঙ্গে পড়িতে পাঠায় ।
পড়িয়া শুনিয়া তবে আইলাম গৃহে যবে
প্রভু মোরে গৃহে আসি’ খায় ॥২৪॥
কোন্দলের পরে প্রেম হয় যেন শুদ্ধ হেম
কত সুখ মনেতে হইল ।
প্রভু বলে, “এই লাগি’ তুমি রাগো, আমি রাগি
পরস্পর প্রেম বৃদ্ধি ভেল” ॥২৫॥
গ্রন্থকারের শ্রীচৈতন্য প্রীতি
এ হেন গৌরাঙ্গচাঁদ না ভজিলে পরমাদ
ভজিলে পরম সুখ হয় ।
দয়ার ঠাকুর তেঁহ তাঁকে কি ভুলিবে কেহ
এত দয়া দাসে বিতরয় ॥২৬॥
চৈতন্য আমার প্রভু চৈতন্যে না ছাড়ি কভু
সেই মোর প্রাণের ঈশ্বর ।
যে “চৈতন্য” বলি’ ডাকে উঠে কোল দিই তাকে
সেই মোর প্রাণের সোদর ॥২৭॥
“হা চৈতন্য প্রাণধন” না বলিল যেই জন
মুখ তার না দেখি নয়নে ।
চৈতন্যে ভুলিল যেবা যদিও সে দেবী দেবা
কুপ্রভাত তার দরশনে ॥২৮॥
চৈতন্যে ছাড়িয়া অন্য সন্ন্যাসীরে করে মান্য
তারে যষ্টি করিব প্রহার ।
ছাড়িয়া চৈতন্যকথা অন্য ইতিহাস বৃথা
বলে যেই মুখে আগুন তার ॥২৯॥
চৈতন্যের যাহে সুখ তাহে যদি ঘটে দুঃখ
চির দুঃখ ভোগ হউ মোর ।
সে যদি স্বসুখ ত্যজে যতি-ধর্ম্ম কভু ভজে
আমি তাহে দুঃখেতে বিভোর ॥৩০॥
শ্রীগৌর-গদাধর তত্ত্ব
একদিন প্রভু মোর খেলিতে খেলিতে ।
চলিল অলকাতীরে নিবিড় বনেতে ॥৩১॥
আমি আর গদাধর আছিলাম সঙ্গে ।
বকুলের গাছে শুক পক্ষী ধরে রঙ্গে ॥৩২॥
শুকে ধরি’ বলে, “তুই ব্যাসের নন্দন ।
রাধাকৃষ্ণ বলি’ কর আনন্দ বর্ধন” ॥৩৩॥
শুক তাহা নাহি বলে, বলে, “গৌরহরি” ।
প্রভু তারে দূরে ফেলে কোপ ছল করি’ ॥৩৪॥
তবু শুক “গৌর গৌর” বলিয়া নাচয় ।
শুকের কীর্ত্তনে হয় প্রেমের উদয় ॥৩৫॥
প্রভু বলে, “ওরে শুক এ যে বৃন্দাবন ।
রাধাকৃষ্ণ বল হেথা শুনুক সর্ব্বজন” ॥৩৬॥
শুক বলে, “বৃন্দাবন নবদ্বীপ হইল ।
রাধাকৃষ্ণ গৌরহরি-রূপে দেখা দিল ॥৩৭॥
আমি শুক এই বনে গৌর-নাম গাই ।
তুমি মোর কৃষ্ণ, রাধা এই যে গদাই ॥৩৮॥
গদাই-গৌরাঙ্গ মোর প্রাণের ঈশ্বর ।
আন কিছু মুখে না আইসে অতঃপর” ॥৩৯॥
প্রভু বলে, “আমি রাধাকৃষ্ণ-উপাসক ।
অন্য নাম শুনিলে আমার হয় শোক” ॥৪০॥
এত বলি’ গদাইয়ের হাতটী ধরিয়া ।
মায়াপুরে ফিরে আইল শুকেরে ছাড়িয়া ॥৪১॥
শুকে বলে, “গাও তুমি যাহা লাগে ভাল ।
আমার ভজন আমি করি চিরকাল” ॥৪২॥
মধুর চৈতন্যলীলা জাগে যার মনে ।
মোর দণ্ডবৎ ভাই তাঁহার চরণে ॥৪৩॥
শ্রীনবদ্বীপ ও বৃন্দাবন
গদাই গৌরাঙ্গে মুঞি “রাধাশ্যাম” জানি ।
ষোলক্রোশ “নবদ্বীপে” “বৃন্দাবন” মানি ॥৪৪॥
যশোদানন্দনে আর শচীর নন্দনে ।
যে জন পৃথক্ দেখে সে না মরে কেনে ॥৪৫॥
নবদ্বীপে না পাইল যেই বৃন্দাবন ।
বৃথা সে তার্কিক কেন ধরয় জীবন ॥৪৬॥
গৌর-ভজন বিনা ‘রাধাকৃষ্ণ’-ভজন বৃথা
গৌর-নাম গৌর-ধাম গৌরাঙ্গ-চরিত ।
যে ভজে তাহাতে মোর অকৈতব প্রীত ॥৪৭॥
গৌর-রূপ গৌর-নাম গৌর-লীলা গৌর-ধাম
যে না ভজে গৌড়েতে জন্মিয়া ।
রাধাকৃষ্ণ-নাম-রূপ- ধাম-লীলা অপরূপ
কভু নাহি স্পর্শে তার হিয়া ॥৪৮॥
More Stories
দাম্পত্য দণ্ডবিধির আইন (Dampatya Dandabidhir Aain): Bamkim Chandra
Sudden Rise and Quick Fall of Brahma Dharma: Ramesh Chandra (1967)
Brahma Sangit of Vijaykrishna (বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী: ব্রাহ্ম সঙ্গীত-1905)