Advocatetanmoy Law Library

Legal Database and Encyclopedia

আফগানিস্থান ভ্রমণ – রামনাথ বিশ্বাস 1942

আফগানিস্থান ভ্রমণ করার সময় যাহা দেখেছি এবং শুনেছি তাই লিখেছি। ১৯১৯ সালের মে মাসে আফগানিস্থান স্বাধীন হয় এবং ইহা একটি বাফার স্টেটে পরিণত হয়। যদিও আফগানিস্থান স্বাধীনতালাভ করেছিল কিন্তু নানা কারণে সাধারণ লােকের কোন উন্নতি হয় নি। রক্ষণশীলতা ও সনাতন আচার-পদ্ধতির বেড়াজাল ছাড়িয়ে যেতে যে পরিমাণ শিক্ষা এবং আন্দোলনের আবশ্যক, আফগানিস্থানে তার অভাব দেখেছি। রাজা আমানউল্লা নূতন জগতের নূতন ধারায় দেশটাকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কিন্তু সে অবসর তিনি পান নি। যে পরিবর্তন ও উন্নতি আফগানিস্থানে এখনও আসে নি এক দিন সেই পরিবর্তন নিশ্চয় আসবে, আফগানিস্থানের জনগণ চারিদিকের দৃষ্টান্ত দেখে উদ্বুদ্ধ হবে।

লক্ষ্মীর কথা

 পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ইচ্ছা হল একবার স্থানীয় সব্জি মণ্ডি দেখে আসি। উদ্দেশ্য সেখানে মাছ কি দরে বিক্রি হয় তা দেখব। যদি মাছ কিনতে পাই তবে কোন পাঠানের দোকানে নিয়ে তা’ ভেজে দিতে বলব এবং আরাম করে খাব। মাছ ভাজা খাবার প্রবল ইচ্ছাই আমাকে সব্জি মণ্ডির দিকে টেনে নিয়ে গেল।

 সব্জি মণ্ডির বাইরে একস্থানে জন কতক লোক কতকগুলি মাছ বিক্রি করছিল। মাছগুলি দেখতে বড়ই কুৎসিত। তখন সমাজতত্বের কথা ভাবছি। কিন্তু তা সত্বেও কি কারণে বলতে পারি না। আপনা হতেই মুখ দিয়ে গুণ গুণ স্বরে একটি গানের কলি বের হয়ে এল। সেটি হল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ হঠাৎ নজরে পড়ল, অদুরে বোরখা পরিহিত একজন নারী চলতে চলতে থমকে দাঁড়ালেন। সেখান হতে তিনি ইসারায় আমাকে ডাকলেন। আমি নিকটে গেলে বোরাখার ভেতর হতেই তিনি পরিষ্কার বাংলা ভাষায় আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। আফগানিস্থানে কাবুল শহরের বুকে পরিষ্কার বাঙলাভাষায় একটি নারীকে কথা বলতে দেখে আশ্চর্যান্বিত হলাম। তাঁর কথা শুনে তাঁকে বাঙালী ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হল। তিনি আমাকে যতগুলি কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন তার সকল কথারই উত্তর দিলাম। আমার কথা শুনে তিনি ক্ষণকাল চুপ করে রইলেন, তারপর বলেলন তিনিও বাঙালী। কাবুলের মত স্থানে একজন বাঙালীর সংগে সাক্ষাৎ হওয়ায় সুখী হয়েছেন। ঘটনাচক্রে কাবুলেই তিনি বাস করেন। বাড়িতে তাঁর স্বামী এবং ছেলেমেয়ে রয়েছেন। আমাকে তিনি তাঁরই সংগে তাঁর বাড়ীতে যেতে বললেন। আফগানিস্থানে অনাত্মীয় স্ত্রীলোকের পেছনে চলা বড়ই অন্যায় কাজ। আমার মনে কোন অসদভিপ্রায় ছিলনা। কাবুলের মত স্থানে একটি বাঙালী নারীর দর্শন পেয়ে তার সম্বন্ধে জানবার কৌতুহল হয়েছিল। কোনরূপ চিন্তা না করেই তাঁর কথায় সম্মত হলাম। তিমি আগে চললেন, আমি তাঁর অনুসরণ করলাম। তিনটি সরু গলি ঘুরে আমরা একটি বাড়ীর সামনে এলাম। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। একটি বার তের বৎসরের মেয়ে ও একটি আট বৎসরের ছেলে বের হয়ে এল। তাদের মায়ের সংগে একজন অপরিচিত লোককে দেখে তারা বিস্মিত হল। তাদের মা তাদের ডেকে কি যেন বল্লেন। তখন তারা একটু ভয়ে ভয়ে সংগে চলল।

 উপরে উঠে গিয়ে দেখলাম, একজন পাঠান বসে আছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি সুখী হয়েছেন বলে মনে হল না। যা’ হোক তিনি ভদ্রতা প্রকাশ করতে কসুর করেন নি। “স্তাৱেমাসে” বলে সম্ভাষণ করলেন। উত্তরে আমি নমস্কার বলাতে তিনি কিছু বিস্মিত হলেন। তারপর তিনি হিন্দুস্থানীতে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। আমি ও হিন্দুস্থানীতে তাঁর কথার জবাব দিলাম। আমার পরিচয় পেয়ে এবং আমি যে একজন “সাইয়া দুনিয়া” শুনে তাঁর মুখের ভাব বদলে গেল। তিনি তাড়াতাড়ি আমাকে একটি নতুন টি-পট, এক ঘটি গরম জল এবং কতকগুলি চায়ের পাতা সামনে এনে দিয়ে চা বানিয়ে খেতে বললেন। হেসে বললাল “নতুন টি পটের কোন দরকার ছিল না। আমি হিন্দুকুলে জন্মেছি বটে, তা বলে হিন্দুদের সনাতন আচার বিচার মানতে কোন মতেই রাজি নই। ছুতমার্গ আমার ত্রিসীমানায় নেই।” আমার কথা শুনে সরলচিত্ত পাঠান অত্যন্ত খুশী হলেন এবং তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে আমার করমর্দন করলেন। বাঙালীরা দুধ ছাড়া চা খায় না, সে জন্য তিনি তাঁর স্ত্রীকে দুধ আনতে পাঠিয়ে ছিলেন। কথায় কথায় বললেন, মেওয়া বিক্রি করবার জন্যে বহুকাল যাবৎ প্রত্যেক বৎসরই বাঙলাদেশে যাওয়া তাঁর অভ্যাস। আঠার বৎসর পূর্বে তিনি লক্ষ্মীকে কলকাতায় বিয়ে করেছিলেন। লক্ষ্মী বাঙালীর মেয়ে, তিনি লক্ষ্মীকে চুরি করে আনেন নি। হিন্দুমতে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। এ দুটিই তাদের ছেলে মেয়ে। তাঁর স্ত্রী বাঙালী, বলে তিনি বাঙালীকে ভালবাসেন। সুজলা সুফল বাঙলা দেশের একটি কোমল বধু শুষ্ক কর্কশ পাঠানকে স্বামীত্বে বরণ করে তাঁর গৃহকে আপন করে নিয়েছে কথাটা ভাবতেও মনে বিস্ময় লাগছিল।

 এটা হবার কথাই। ছোটবেলা থেকে আমরা মুসলিম বিদ্বেষী। হঠাৎ, মুসলিম প্রেম জেগে উঠবে কোথা হতে এটাই বোধহয় পাঠান মহাশয়ের মনে ছিল কিন্তু আমি যে পৃথিবীকে আমার করে নিয়েছিলাম তা কারো মনে জাগতে পারে না, কারণ এখনও পৃথিবীর নরনারী নিজের ইচ্ছা মত কিছুই করতেও পারে না।

 ছেলেমেয়েদের কাছে ডেকে নিয়ে এলাম। এবার তাদের একটু সাহস হয়েছে। তারা ভয় না করে আমার কাছে এল। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের সংগে আমি কথা বলতে পারি নি। তারা জানত শুধু পোস্ত ভাষা। এ সময়ে লক্ষ্মী ঘরে এসে উপস্থিত হলেন। এবার তাঁর পরনে খাঁটি বাঙালী মেয়ের পোষাক। তার শাড়ি পরা দেখে আমার বেশ ভাল লাগল। দেখলাম পাঠানের চোখেমুখেও হাসি ফুটে উঠেছে।

 এবার পাঠান-স্বামী লক্ষ্মীর সংগে আমার পরিচয় করে দিলেন। তিনি ভাঙা ভাঙা বাঙলাতে স্ত্রীকে বললেন, ইনি তোমার দাদা, একে অভিবাদন কর। সত্যই লক্ষ্মী যখন বাঙালী মেয়ের মত আমার পায়ের কাছে প্রণাম করলেন তখন নিমিষে আমার মনে বাঙলা দেশের কল্যাণমণ্ডিত গৃহচ্ছবি ভেসে উঠল। লক্ষ্মীর মধ্যে যেন সমস্ত বাঙলাদেশ মূর্ত হয়ে উঠল। লক্ষ্মী আমার জন্য চা প্রস্তুত করবেন কি না ইতস্তত করছেন দেখে তাঁর পাঠান স্বামী হেসে উঠলেন। তিনি তাকে আশ্বাস দিয়ে চা বানাতে বললেন। লক্ষ্মী যত্ন সহকারে চা বানিয়ে রুটির সংগে চা দিলেন। তারপর তাঁর নিজের কথা বলতে লাগলেন।

 লক্ষ্মীর সংগে বাংলাতেই কথা বলছিলাম। পাঠানকে বললাম, “ভাই বাঙালী বোনের সংগে আমি নিজের ভাষায়ই কথা বলব। এতে তুমি নিশ্চয়ই দুঃখিত হবে না।” পাঠান বললেন “তুমি বাঙলাতে কথা বল এতে আমার আপত্তি নেই। আমি বাঙলা একটু আধটু বলতে পারি। কিন্তু তোমার বোন আমাকে ভাল করে বাঙলা শেখায় নি সেজন্য আমি দুঃখিত। যখনই আমি কলকাতা যাই তখনই অনেক চেষ্ট্রা করে তোমার বোনের জন্য বাঙলা কেতাব কিনে আনি। তুমি ইচ্ছা করলে এসব কেতাব দেখতে পার।”

 কথা বলতে বলতে লক্ষ্মী তাঁর পুস্তকের ভাণ্ডার আমার সামনে ধরলেন। দেখলাম কাশীদাসের মহাভারত, টেকচাঁদের গ্রন্থাবলী, সুরথ-উদ্ধার গীতাভিনয়, বংকিমচন্দ্রের চন্দ্রশেখর, যুগলাঙ্গুরীয়, আনন্দমঠ, বিষবৃক্ষ, লোকরহস্য, পুরাতন কএকখানা প্রবাসী এবং নব্য ভারত রয়েছে। বইগুলি দেখে মনে বেশ আনন্দ হল। বুঝতে পারলাম যদিও পাঠানের বহিঃবয়ব কর্কশ তবু অন্তর কোমল। লক্ষীকে তিনি প্রকৃতপক্ষেই অন্তরের সহিত ভালবাসেন। লক্ষ্মীকে সুখী রাখবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে থাকেন।

 লক্ষ্য করলাম, লক্ষ্মীর মনে প্রথমেই ছুৎমার্গের ভাব এসেছিল। তিনি যদিও পাঠানকে বিয়ে করেছেন তবুও তিনি মনে প্রাণে হিন্দুই আছেন। আজও তিনি অখাদ্য কিছুই খান নি। নিজেই পাঁঠা অথবা দুম্বার মাংস কিনে আনেন। মাছ যা পাওয়া যায় তার দাম বেশ সস্তা।

 মাছের কথা শুনতেই আপনা থেকেই মুখে জল এল। লক্ষ্মী বললেন এক দিন মাছ রেঁধে আমাকে খাওয়াবেন। কিন্তু তত সময় অপেক্ষা করা আমার সহ্য হল না। বললাম, পরের কথা পরে হবে, এখন ঘরে যা আছে তা দিলেই খুশী হব।

 আমার কথা শুনে লক্ষ্মী হেসে ফেললেন এবং পাঠানকে কি বলে বাইরে চলে গেলেন। লক্ষ্মী বাইরে চলে গেলে পাঠান বললেন স্থানীয় ইলেকট্রিক কোম্পানীতে একজন বাঙালী সাহেব কাজ করেন, তাকে অনেক দিন নিমন্ত্রণ করা হয়েছে, কিন্তু তিনি কখনও নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন নি। লক্ষ্মী বাঙালীর সংগ পছন্দ করে, আমিও বাঙালীর সংগে মেলামেশা করতে চাই, কারণ এতে আমার ইজ্জত বাড়ে। কিন্তু ঐ ছোটলোক একদিনও আমার বাড়ী আসে নি। তুমি এসেছ, বড়ই সুখী হয়েছি। ‘পাঠানকে জানিয়ে দিলাম, যে কোন দিন আমাকে খেতে ডাকবেন সেদিনই আমি আসব।

 আমার কথা শুনে পাঠান বড়ই সুখী হলেন এবং পরের দিন তাঁর বাড়িতে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। ইতিমধ্যে লক্ষ্মী থালায় ভাত এবং বাটিতে তরকারী সাজিয়ে নিয়ে এলেন। ছোলার ডাল, পাঁঠার মাংসের ঝোল এবং প্রচুর আচার ছিল। বহুদিন পরে বাঙালী বোনের দেওয়া ডাল-ভাত খেয়ে তৃপ্ত হলাম।

 পরদিন ঘুম থেকে উঠেই ভগ্নীপতির মুখদর্শন হল। মুখ হাত ধুয়েই তাঁর সংগে চললাম। পথে চলতে চলতে কলকাতার সম্বন্ধে অনেক বিষয়ের কথা বলে আমার মনে কলকাতার একটি চিত্র এঁকে তুলে ধরলেন। বাড়ীতে উপস্থিত হয়ে দেখি লক্ষ্মী এবং ছেলেমেয়ে দুটি বাজারে যাবার জন্য কাপড় পরে প্রস্তুত হয়েছে। আমাকে চা রুটি দিয়েই তারা বাজারে যাবে ঠিক করেছিল। আমি কিন্তু তাতে রাজী হলাম না। ওদের সংগে বাজারে যেতে আমারও ইচ্ছা হল। পাঠানদের নিয়ম কিন্তু অন্য রকমের। অতিথিকে বাজারে গিয়ে কিছু কিনে আনতে নেই। আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা। বললাম, আমিও বাজারে যাব এবং আমার যা ভাল লাগে তা কিনতে বলব। তিনি হেসে সন্মতি দিয়ে বললেন, ভাই বোন এক সংগে বাজারে যাবে তাতে আপত্তি কি?

 লক্ষ্মীর ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাজারে গেলাম। পথে লক্ষ্মীকে বললাম, বাজারে গিয়ে আমার এক পয়সাও খরচ করা পাঠানদের মতে মহাপাপ। কিন্তু বোনকে যদি আমি আমার ইচ্ছামত কিছু কিনে দিই, তাতে কার কি আপত্তি থাকতে পারে? আমার দুটি বোন ছিল তাঁরা মারা গেছেন। আজ থেকে তুমিই আমার বোন। তোমাকে এবং তোমার ছেলেমেয়েকে কিছু কিনে দিলে শান্তি পাব। লক্ষ্মী তাতে কোন আপত্তি করলেন না। প্রথমত আমি ছেলেমেয়ে দুটিকে কিছু খেলনা কিনে উপহার দিলাম। মামার নিকট হতে উপহার পেয়ে তাদের বেশ আনন্দ হল। জংলী হাঁস এবং অন্যান্য কিছু আহার্য কিনে আনলাম।

 লক্ষ্মীর সংগে আমাকে বাজারে দেখে অনেকেই কৌতুহলপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল। লক্ষ্মী তা বুঝতে পেরে ছেলে-মেয়ের কানে কি বলে দিলেন। লক্ষ্মীর ছেলে-মেয়ে মার কথা শুনে আমাকে পোস্ত ভাষায় মামা বলে ডাকছিল। পথের লোক অনেকেই আমার কথা ছেলেমেয়ে দুটিকে জিজ্ঞাসা করেছিল। ছেলেমেয়েরা বলেছিল “ইনি কলকাতার মামা।” এদের হাবভাব দেখে মনে হল, কলকাতার লোককে মামা বলে ডাকা অগৌরবের নয়।

 বাড়ী ফিরে লক্ষ্মী রান্নার বন্দোবস্ত করলেন। রান্না করার ফাঁকে ফাঁকে তাঁর কুমারী, জীবনের কথা তিনি আমার কাছে বলে যাচ্ছিলেন। লক্ষ্মী নিজের কাহিনী যা বলেছিলেন তা এখানে বলছি। এই কাহিনীর পাত্রপাত্রীদের আসল নাম গোপন রেখে কাল্পনিক নামই ব্যবহার করব।

 পূর্ববংগের কোন এক জেলায় লক্ষ্মীর পিত্রালয় ছিল। পিতা হরিশংকর রায় সদরে চাক‍্‌রি করতেন। হরিশংকরের মাইনে সামান্যই ছিল। সেজন্যই বোধ হয় স্ত্রীকে চাক‍্‌রি-স্থানে রাখতে সক্ষম হতেন না। স্ত্রী একা বাড়ীতই থাকতেন। যখনই হরিশংকর সুযোগ পেতেন তখনই বাড়ী এসে সংসার দেখাশুনা করতেন, তারপর আবার চলে যেতেন। তঁদের গ্রামের ব্রাহ্মণকুলোস্তব কালু পণ্ডিত লোক ভাল ছিলেন না। তিনি দরিদ্র হরিশংকরের স্ত্রীর নামে নানা কুৎসা প্রচার করছিলেন। কিছুদিন পর হরিশংকরের স্ত্রী গর্ভবতী হলেন। যথাসময়ে লক্ষ্মীর জন্ম হল। তখন কালু পণ্ডিত গ্রামে হৈ চৈ শুরু করলেন। দরিদ্র হরিশংকর ধনী ব্রাহ্মণ কালু পণ্ডিতের চক্রান্তে একঘরে হলেন। কালু পণ্ডিতের কাছে অনেকেই টাকা ধায় করত। সেজন্য ঋণগ্রস্তু গ্রামবাসী হরিশংকর প্রকৃতই দোষী কি না তার বিচার না করেই হরিশংকরকে সমাজচ্যুত করল।  দরিদ্র হরিশংকরের পক্ষে এটা বরদাস্ত করা সম্ভব হল না। তিনি বিচলিত হয়ে পড়লেন এবং স্ত্রী ও কন্যার দায়িত্ব এড়াতে চেষ্টা করলেন। লক্ষ্মীর মা ছিলেন বুদ্ধিমতী। তিনি বুঝতে পারলেন প্রবল শত্র‍‌ুর সংগে বিবাদ করে গ্রামে বাস করা অসম্ভব। তাই তিনি তার এক দূরসম্পর্কিত ভগ্নীর কাছে কলিকাতায় চলে এলেন।

 লক্ষ্মীর মা কলিকাতায় এলেন। কালু পণ্ডিত কিন্তু তার সংগ ছাড়ল না। সে নানা চেষ্টা করে লক্ষ্মীর মার ঠিকানা বের করল এবং কলকাতায় চলে এল। যখনই সে সুযোগ পেত তখনই লক্ষ্মীর মার নিকট উপস্থিত হত এবং তাঁর কাছে কুপ্রস্তাব করত। একদিন লক্ষ্মীর মার অসহ্য বোধ হওয়ায় তিনি যাঁতি দিয়ে তাকে আঘাত করেন। ক্ষমতা মদে মত্ত কালু পণ্ডিত চলে গেলে কিন্তু তার মনে জেগে রইল প্রতিশোধ কামনা।

 একদিন লক্ষ্মীর মা লক্ষ্মীকে মুদির দোকানে ঘি কিনতে পাঠিয়েছিলেন। লক্ষ্মী আর ফিরে আসে নি। লক্ষ্মীর মা তার সাধ্যমত খোঁজাখুঁজি করলেন কিন্তু তার সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। কিছুদিন পর তিনি সংবাদ পেলেন কালু পণ্ডিত লক্ষ্মীকে চুরি করে ঢাকাতে নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে। লক্ষ্মীর মা অতি কষ্টে ঢাকা গেলেন। সেখানে কালু পণ্ডিত এক মুসলমান ভদ্রলোকের বাড়ীতে ছিল। ঘটনাচক্রে এক সহৃদয় মুসলমান ভদ্রলোকের সংগে লক্ষ্মীর মার পরিচয় হয়। তাঁর সাহায্যেই তিনি কালু পণ্ডিতের কবল থেকে লক্ষ্মীকে উদ্ধার করেন। বহুদিন পর লক্ষ্মীর মা মেয়েকে ফিরে পেয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন। এর কয়েক মাস পর কালু পণ্ডিত ইহধাম পরিত্যাগ করেন। গ্রামের লোক তার পরলোকগমনে সুখী হল বটে কিন্তু পর বৎসর কালু পণ্ডিতের দুর্দান্ত পুত্র অমলকৃষ্ণ গদিতে বসে অধিকতর প্রতাপে গ্রামের উপর আধিপত্য করতে লাগল।

 দেখতে দেখতে বৎসরের পর বৎসর কেটে যাচ্ছিল। লক্ষ্মীয় বিয়ের বয়স হল। লক্ষ্মীর মা বারংবার পত্রযোগে স্বামীকে খবর দিলেন কিন্তু কোন ফল হল না। ঢাকার সেই মুসলমান ভদ্রলোককে লক্ষ্মীর মা দাদা বলে ডেকেছিলেন। এই পাতানো দাদাকে তিনি লক্ষ্মীর বিয়ের জন্য অনুরোধ করলেন। দাদা জানালেন তাঁর হাতে কলকাতায় একটি উপযুক্ত পাত্র আছে তাকে তিনি সংগে করে নিয়ে আসবেন। যথা সময়ে পাত্রকে সংগে করে মুসলমান ভদ্রলোকটি কলকাতায় উপস্থিত হলেন। পাত্রের চেহারা দেখে এবং ভাংগা কথা শুনে লক্ষ্মীর মায়ের সন্দেহ হল ভবিষ্যৎ জামাতা বাবাজী বাংগালী হিন্দু নয়। তাঁকে বলা হল যে পাত্র ছোট-বেলায় পেশোয়ারে ছিল। দুঃখিনীর মেয়ের বিয়ে, বেশি ভাবনা করার সময় ছিল না। হিন্দুমতে লক্ষ্মীর বিয়ে হয়ে গেল। পাত্র বললেন লক্ষ্মীকে নিয়ে তিনি ঢাকা যাচ্ছেন। কিন্তু ঢাকার পথ আর শেষ হয় না। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অবশেষে পাঠানমুল্লুক কাবুলে এসে লক্ষ্মী প্রকৃত অবস্থা উপলব্ধি করলেন।

 এই পর্যন্ত বলেই লক্ষ্মী স্বামীকে উদ্দেশ করে বললেন, লোকটি কিন্তু খারাপ নয়। আমাকে বিশেষ জ্বালাযন্ত্রণা দেয় নি। তবে প্রথম কিছুদিন অনভ্যস্ত জীবন-যাত্রার সংগে আপোষ করতে বেগ পেতে হয়েছিল। কি যে নিদারুণ কষ্টে আমায় দিন গিয়েছে। তারপর যতই দিন যাচ্ছিল ততই অদৃষ্টকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছিলাম। এ দুটি ছেলেমেয়ে জন্মেছে এখন আমার বিশেষ কিছু কষ্ট নেই। কিন্তু এ দেশে থাকতে মোটেই আমার ইচ্ছা হয় না। আমরা কি দেশে গিয়ে হিন্দুসমাজে মেলামেশা করবার সুযোগ পাব?

 লক্ষ্মীর কথা শুনে স্থান কাল পাত্র ভুলে একেবারে তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। তাঁর প্রশ্নে চমক ভাঙল।

 অত্যন্ত যত্ন সহকারে ভিন্ন ভিন্ন তরকারি রান্না করে লক্ষ্মী আমাকে খেতে দিলেন কিন্তু আমার ক্ষুধা তৃষ্ণা সবই দূর হয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্মীর করুণ কাহিনী থেকে থেকে অন্তরে আঘাত করছিল। কোন রকমে খাওয়া শেষ করে সেদিনের মত বিদায় নিয়েছিলাম। তারপর যে কয়েকদিন কাবুলে ছিলাম দুঃখিনী ভগ্নীকে ভুলি নি। কাবুল হতে বিদায় নেবার সময় লক্ষ্মীর পাঠান-স্বামী পথে খাবার জন্য অনেক রকম ফল দিয়ে গিয়েছিলেন।

 সমাজের পাপে, সমাজপতিদের জঘন্য মনোবৃত্তির দরুণ বাংলার কত লক্ষ্মী যে এরূপভাবে দিন কাটাচ্ছেন—কে তার সংখ্যা গণনা করবে? কে তার জন্য দায়ী?