Advocatetanmoy Law Library

Legal Database and Encyclopedia

Home » Bengali Documents » দিল্লী চলো-সুভাষচন্দ্র বসু – Dilli Cholo by Subhas Chandra Bose

দিল্লী চলো-সুভাষচন্দ্র বসু – Dilli Cholo by Subhas Chandra Bose

আমি তোমাদের কর্ত্তব্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি,—সে কর্ত্তব্য দ্বিবিধ। অস্ত্রবলের দ্বারা এবং নিজেদের শোণিতোৎসর্গ করে ভারতের স্বাধীনতা অর্জ্জন করতে হবে। তারপর ভারত যখন স্বাধীন হবে, তখন স্বাধীন ভারতের জন্যে স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে তোমরাই। তখন কর্ত্তব্য হবে ভারতের স্বাধীনতা রক্ষা করা। তোমরা আমাদের দেশরক্ষার শক্তি এমন অটল ভিত্তির উপর স্থাপন করবে যেন আর কোনদিন, আমরা স্বাধীনতা না হারাই। সৈনিক হিসাবে তোমাদের তিনটি আদর্শ হৃদয়ে পোষণ করতে হবে এবং তদনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালিত করতে হবে।

দিল্লী চলো

১৯৪৫

আজাদ-হিন্দ গবর্নমেণ্ট, আজাদ-হিন্দ ফৌজ ও নেতাজীর অলৌকিক কর্মকাহিনী আজ ইতিহাসের বস্তু। দুর্বার সংগঠনশক্তি, নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়, সাম্প্রদায়িকতা এবং প্রাদেশিকতার কৃত্রিম বিভেদ অবলীলাক্রমে বিলুপ্ত করে লক্ষ লক্ষ ভারতবাসীকে সর্বস্বত্যাগে অনুপ্রাণিত করেছিল,—তার সকল সংবাদ-লাভের জন্য মুক্তিকামী দেশবাসী উদগ্রীব হয়ে আছেন।

 আজাদ-হিন্দ সংঘ (ইণ্ডিয়ান ইণ্ডিপেণ্ডেন্স লীগ) হেড কোয়ার্টার্স থেকে Blood-bath (রক্ত স্নান) নামে নেতাজির কতকগুলি রচনা ও বক্তৃতা প্রকাশিত হয়। সেই বইটির সমগ্র এবং আরও চারটি বক্তৃতার প্রাঞ্জল অনুবাদ সুষ্ঠু মূদ্রণে পরম শ্রদ্ধায় গ্রন্থাকারে উপস্থাপিত হয়েছে। আজাদ-হিন্দ গবর্নমেণ্টের উদ্দেশ্য, ইউরোপ, পূর্ব্ব-এশিয়া ও ভারতবর্ষের সমসাময়িক ঘটনাবলীর সুনিপুণ বিশ্লেষণ এবং নেতাজির অনন্য দেশপ্রেমের পরিচয় রচনাগুলির ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে।

 প্রকাশকেরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই বইয়ের অর্ধেক লভ্য আজাদ-হিন্দ ফৌজ সাহায্য-ভাণ্ডারে দিতে প্রতিশ্রুত হয়েছেন। এর জন্য তাদের অভিনন্দন জানাই।

১নং উডবার্ণ পার্ক
২০শে ফাল্গুন, ১৩৫২
অমিয়নাথ বসু

 Text

ভারতের স্বাধীনতার সেনাদল, আজ আমার জীবনের সবচেয়ে গর্ব্বের দিন। আজ ঈশ্বর আমাকে এই কথা ঘোষণা করার অপূর্ব্ব সুযোগ এবং সম্মান দিয়েছেন যে, ভারতকে স্বাধীন করার জন্য সেনাদল গঠিত হয়েছে। সিঙ্গাপুর একদিন বৃটিশ-সাম্রাজ্যের প্রাকারস্বরূপ ছিল; সেই সিঙ্গাপুরেই আমাদের বাহিনী এখন ব্যূহবদ্ধ অবস্থায় আছে। এই বাহিনী শুধু যে ভারতবর্ষকে বৃটিশের অধীনতা পাশ থেকে মুক্ত করবে তাই নয়, এর পর এই সেনাদলকেই ভিত্তি করে স্বাধীন ভারতের ভবিষ্যৎ জাতীয় বাহিনী গড়ে উঠবে। প্রত্যেক ভারতবাসী এই বাহিনীর জন্যে গর্ব্ববোধ করবে। এই বাহিনী তাদেরই নিজ বাহিনী, সম্পূর্ণ ভাবে ভারতবাসীদের নেতৃত্বে এ বাহিনী গঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক মূহূর্ত্ত এলে ভারতীয় নেতৃত্বেই এ বাহিনী রণক্ষেত্রে এগিয়ে যাবে।

 বৃটিশ-সাম্রাজ্যে সূর্য্যাস্ত হয় না, বৃটিশ সাম্রাজ্য চিরস্থায়ী—একদিন লোকের মনে এই বিশ্বাস ছিল। আমি কোনদিনই এ ধরণের চিন্তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। ইতিহাস থেকে আমি এ শিক্ষা পেয়েছি, প্রত্যেক জাতিরই কোন না কোন সময়ে অধোগতি এবং পতন অনিবার্য্য। তাছাড়া, একদিন যেসব নগর ও দুর্গ সুরক্ষিত ছিল সেগুলো কি ভাবে সাম্রাজ্যের সমাধিভূমিতে পরিণত হয়েছে তাও আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আজ বৃটিশ-সাম্রাজ্যের সমাধির উপর দাঁড়িয়ে যে কোন শিশুও এই সত্য বুঝতে পারবে যে প্রবল পরাক্রান্ত ব্রিটিশ-সাম্রাজ্য অতীতের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ১৯৩৯ অব্দে ফ্রান্স যখন জার্ম্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ঘোষণা করে, তখন জার্ম্মান সেনাদের কণ্ঠে শুধু এই একটা ধ্বনি ছিল—প্যারিস চলো, প্যারিস চলো! ১৯৪১-এ অভিযান আরম্ভ করার সময় জাপানি সেনাদের মুখেও ছিল একই কথা—সিঙ্গাপুর চলো, সিঙ্গাপুর চলো!

 হে আমার সতীর্থগণ, সেনাদল, তোমাদেরও রণধ্বনি হোক—দিল্লী চলো, দিল্লী চলো! স্বাধীনতা-সংগ্রামের মধ্যে আমরা কে কতদিন বেঁচে থাকব জানি না; তবে একথা আমি নিশ্চয় জানি, চরম জয়লাভ আমরা করবই, এবং প্রাচীন দিল্লীর লাল-কেল্লায় বিজয়োৎসব সম্পন্ন না করা পর্য্যন্ত আমাদের কর্ত্তব্য শেষ হবে না।

 দেশসেবার সাধনায় আত্মনিয়োগ করার পর সব সময় আমার মনে হয়েছে, অন্য সব বিষয়েই ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভের উপযুক্ত হলেও একটি বিষয়ে তার অভাব আছে—তার স্বাধীনতা-প্রয়াসী সেনাদল নেই। সেনাদল ছিল বলেই আমেরিকার জর্জ্জ ওয়াশিংটন সংগ্রামের দ্বারা স্বাধীনতা অর্জ্জন করতে পেরেছিলেন। গ্যারিবল্ডীর পিছনেও সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনী ছিল বলে তিনি ইটালীকে স্বাধীন করতে পেরেছিলেন। তোমাদের সৌভাগ্য এই, তোমরা ভারতীয় জাতীয় বাহিনী গঠনের অগ্রণী হবার সুযোগ এবং সম্মান পেয়েছ। এই ভাবে তোমরা আমাদের স্বাধীনতা-লাভের পথে শেষ বাধাকে অপসারিত করেছ। এমন মহৎ ব্রতের পুরোভাগে তোমরা, অগ্রদূত তোমরা—এ জন্যে সুখী হও, গর্ব্ববোধ কর।

 আমি তোমাদের কর্ত্তব্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি,—সে কর্ত্তব্য দ্বিবিধ। অস্ত্রবলের দ্বারা এবং নিজেদের শোণিতোৎসর্গ করে ভারতের স্বাধীনতা অর্জ্জন করতে হবে। তারপর ভারত যখন স্বাধীন হবে, তখন স্বাধীন ভারতের জন্যে স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে তোমরাই। তখন কর্ত্তব্য হবে ভারতের স্বাধীনতা রক্ষা করা। তোমরা আমাদের দেশরক্ষার শক্তি এমন অটল ভিত্তির উপর স্থাপন করবে যেন আর কোনদিন, আমরা স্বাধীনতা না হারাই। সৈনিক হিসাবে তোমাদের তিনটি আদর্শ হৃদয়ে পোষণ করতে হবে এবং তদনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালিত করতে হবে। বিশ্বস্ততা, কর্ত্তব্যপালন এবং আত্মত্যাগ— এই তিনটি হবে তোমাদের আদর্শ। যে সব সৈনিক জাতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, যারা কোন অবস্থাতেই কর্ত্তব্য-পালনে বিমুখ হয় না; যারা আত্মত্যাগের জন্যে সর্ব্বদা প্রস্তুত, তারা হয় অজেয়। তোমরাও যদি অজেয় হতে চাও, তবে অন্তরের অন্তস্থলে এই আদর্শ তিনটি গভীর ভাবে এঁকে রাখ। যে প্রকৃত যোদ্ধা, তার সামরিক ও আধ্যাত্মিক—উভয় প্রকার শিক্ষাই প্রয়োজন। তোমরা প্রত্যেকে নিজেদের এবং সতীর্থদের এমন ভাবে শিক্ষিত করে তোল যে প্রত্যেক সৈনিকের মনে যেন অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস থাকে। বিরুদ্ধপক্ষের চেয়ে তারা অনেক শক্তিশালী, এ বিশ্বাস যেন নিজেদের মনে মনে থাকে। মৃত্যু সম্বন্ধে মনে যেন ভয় না থাকে এবং সঙ্কটকালে প্রয়োজনমতো নিজের উদ্দেশ্য-সিদ্ধি করার মতো কর্ম্মক্ষমতা যেন থাকে। আধুনিক যুদ্ধে সাহস, নির্ভীকতা এবং উদ্যমের সঙ্গে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পরিচালিত সেনাদল কি অঘটন ঘটাতে পারে—তোমরা তা স্বচক্ষে দেখেছ। এসব দৃষ্টান্ত থেকে যা শিখতে পার শিখে নেবে এবং আমাদের মাতৃভূমির জন্যে সম্পূর্ণরূপে প্রথম শ্রেণীর সেনাবাহিনী গড়ে তুলবে। যারা সেনানী, তাদের আমি বলব, তাদের কর্ত্তব্য অতি গুরুতর।

জগতের সর্ব্বত্র প্রত্যেকটি বাহিনীর সেনানীদের দায়িত্বই গুরুতর; আর এদের বেলা সে দায়িত্ব আরও বেশী। রাজনৈতিক দিক দিয়ে আমরা পরাধীন; তাই অনুপ্রেরণা পাবার মতো আমাদের ইতিহাসে সুকদেন, পোট আর্থার অথবা সিভানের মতো কিছু নেই। বৃটিশ আমাদের যা শিক্ষা দিয়েছে, তার অনেক কিছুই আমাদের ভুলে যেতে হবে এবং যে শিক্ষা দেয় নি, এমন অনেক কিছু নতুন করে শিখতে হবে। যাই হোক, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে তোমরা চলতে পারবে এবং দেশবাসী তোমাদের সুদৃঢ় স্কন্ধে যে দায়িত্ব অর্পণ করেছে তোমরা তার মর্য্যাদা রাখবে। সেনাদলকে গড়ে তোল। একথাও মনে রেখ, বৃটিশরা যে এত জায়গায় পরাজিত হয়েছে, তার কারণ তাদের সেনানীদের অযোগ্যতা। মনে রেখ যে, তোমাদের মধ্য থেকেই স্বাধীন-ভারতের ভাবী সেনানায়কদল গড়ে উঠবে। তোমাদের সকলকে আমি এই কথাই বলতে চাই, এই যুদ্ধকালে তোমরা যে অভিজ্ঞতা লাভ করবে, তা আমাদের ভবিষ্যৎ সেনাদলকে অনুপ্রাণিত করবে। যে সেনাদলের পক্ষে বীরত্ব নির্ভীকতা অপরাজেয়তা সম্বন্ধে নিজেদের গর্ব করার মত অতীত স্মৃতি নেই, তারা কোন পরাক্রান্ত শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে টিকতে পারে না।

 সতীর্থগণ, তোমরা স্বেচ্ছায় এ ব্রত নিয়েছ। মানব-জীবনে এ ব্রত মহত্তম। এ ব্রত উদ্‌যাপনের জন্যে কোন ত্যাগ-স্বীকারই খুব বেশী নয়; নিজের জীবন পর্য্যন্ত তুচ্ছ। তোমরাই আজ ভারতের জাতীয় মর্য্যাদার রক্ষক এবং ভারতের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত্ত প্রতীক। এমন ভাবে চলবে যেন দেশবাসী সর্ব্বান্তঃকরণে তোমাদের আশীর্ব্বাদ করতে পারে এবং জাতির ভবিষ্যৎ বংশধররা তোমাদের জন্যে গর্ব্ববোধ করে।

 আজ আমার জীবনে সব চেয়ে বেশী গর্ব্বের দিন—একথা আমি বলেছি। পরাধীন জাতির পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সৈনিক হওয়ার চেয়ে বড় সম্মান এবং গৌরবের বিষয় অন্য কিছুই নাই। কিন্তু এই সম্মানের সঙ্গে সমপরিমাণ দায়িত্বও রয়েছে এবং সে দায়িত্ব সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। আমি দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করছি—আলোকে এবং অন্ধকারে, দুঃখে এবং সুখে, পরাজয়ে এবং বিজয়ে আমি সর্ব্বদা তোমাদের পাশে পাশে থাকব। বর্ত্তমানে তোমাদের আমি ক্ষুধা-তৃষ্ণা, দুঃখ-কষ্ট, দুর্গম অভিযান এবং মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু দিতে অসমর্থ। কিন্তু তোমরা যদি জীবনে ও মৃত্যুতে আমার অনুসরণ কর—আমি জানি তোমরা তা করবেই—তবে আমি তোমাদের বিজয় এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে নিয়ে যাব। আমাদের মধ্যে কে বেঁচে থেকে ভারতকে স্বাধীন দেখতে পারবে—সে কথা বিবেচ্য নয়। ভারত স্বাধীন হবে আমাদের পক্ষে সেই যথেষ্ট এবং ভারতের সেই স্বাধীনতার জন্যে আমরা সর্ব্বস্ব উৎসর্গ করব। ঈশ্বর আমাদের সেনাদলকে আশীর্ব্বাদ করুন এবং আসন্ন সংগ্রামে আমাদের জয়যুক্ত করুন। ইন‍্ক্লাব জিন্দাবাদ, আজাদ-হিন্দ জিন্দাবাদ!

 ১৯৪৩-এর ৫ই জুলাই আজাদ-হিন্দ ফৌজের কুচকাওয়াজ উপলক্ষে –

SOURCE: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু -দিল্লী চলো- বেঙ্গল পাবলিশার্স-

১৪, বঙ্কিম চাটুজ্জে ষ্ট্রীট, কলিকাতা

ফাল্গুন, ১৩৫২