Advocatetanmoy Law Library

Legal Database and Encyclopedia

Home » Lectures » ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (1869)

ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (1869)

তিনি সর্ব্বব্যাপী—দেশেতে তাঁহার সীমা হয় না। তিনি কোন এক দেশে বসিয়া রাজত্ব করিতেছেন, এমত নহে। সমুদয় জগৎই তাঁহার আবাস স্থান, আমাদের আত্মাও তাঁহার আসন। তিনি অচিন্ত্য-দূরস্থিত নক্ষত্রেও আছেন, এবং সকল অপেক্ষা নিকটের বস্তু যে আমি, আমাতেও তিনি আছেন। তাঁহাকে পাইবার জন্য স্থান বিশেষ অন্বেষণ করিতে হয় না, এবং স্থান বিশেষ হইতে দূরে গেলেও তাঁহা হইতে দূরস্থ হওয়া যায় না।

ঈশ্বরকে একবার লাভ করিতে পারিলে তাঁহাকে রক্ষা করিবার আকিঞ্চন সর্ব্বদাই জাগ্রৎ থাকে। কিন্তু সেই অমূল্য ধন রক্ষা করিবার উপায় কি? মনকে সুস্থ এবং, আত্মাকে সুস্থ রাখাই তাহার উপায়।

Brahma Dharmer Mat O Biswas

ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস।

শ্রীযুক্ত প্রধান আচার্য্য মহাশয় কর্ত্তৃক ১৭৮১ । ৮২ শকে ব্রহ্মবিদ্যালয়ে প্রদত্ত দশ উপদেশ।

কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের যন্ত্রে মুদ্রিত।

তৃতীয় বার। ১৭৯১ শক।

উপক্রমণিকা।

পরমেশ্বর আমাদের জ্ঞানের সমুদায় কার্য্য কেবল আমারদের বুদ্ধির হস্তে সমর্পণ করিয়া রাখেন নাই। তিনি যদি আমারদিগকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা না দিতেন, আর আমারদের বুদ্ধি ও বিবেচনা করিয়া শরীর পোষণ করিতে হইত, তাহা হইলে আমারদের যেরূপ দুর্দশা হইত; সেই রূপ প্রত্যেক জ্ঞান-ক্রিয়া যদি কেবল আমারদের বুদ্ধির হস্তে থাকিত, তাহা হইলেও আমরা পদে পদে দুর্দ্দশা-গ্রস্ত হইতাম। যদি যুক্তি ও তর্ক এবং বুদ্ধি ও শাস্ত্রের সাহায্য ব্যতিরেকে ঈশ্বরকে জানা না যাইত—যদি সমুদায় দর্শন শাস্ত্র উদঘাটন করিয়া না দেখিলে আমাদের ধর্ম্মজ্ঞান জন্মিত; তবে পৃথিবীর অধিকাংশ লোকেই ধর্ম্ম ও ঈশ্বর হইতে বিচতি থাকিত। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে; আমারদের প্রত্যক্ষ জ্ঞান যে রূপ সহজে হয়, সেই প্রকার সহজ জ্ঞান অন্যান্য বিষয়েরও হইয়া থাকে। এই প্রকার সহজ জ্ঞান আমার ও তোমারও নহে, কিন্তু ইহা সকল মনুষ্যেরই সাধারণ সম্পত্তি।

আমরা দুই শ্রেণীর লোক সচরাচর দেখিতে পাই। কতকগুলি লোকের অতি তীক্ষ-বুদ্ধি; তাহারা তীক্ষতা সহকারে বস্তু-তত্ত্ব-সকল নির্ণয় করে, তাহারা এক বিষয়ের সকল দিক্ দেখিয়া বিচার করে, এবং অতি দুরূহ বিষয়-সকলও খণ্ড খণ্ড করিয়া স্পষ্টরূপে অবধারণ করে। অন্য কতকগুলি লোক ঠিক ইহার বিপরীত। তাহারা যদিও সুশিক্ষিত পণ্ডিতদিগের মত নিপুণ-রূপে বলিতে কহিতে পারে না, যদিও ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক বিচার করিতে পারে না; তথাপি তাহারদের স্বাভাবিক কেমন এক প্রকার ভাব যে তাহারদের মুখ হইতে সহজে যে সকল কথা বিনির্গত হয়, তাহা দেব-বাক্য তুল্য। যখন জন-সমাজের চতুর্দ্দিক অজ্ঞানান্ধকারে আবৃত থাকে, তখন সেই অন্ধকারের মধ্য হইতে যে এক এক প্রখর জ্যোতিষ্মান্ পুরুষ উথিত হয়েন; তাঁহাদের জ্ঞান উক্ত প্রকার সহজ জ্ঞান। তাঁহাদের অন্তর্দৃষ্টি অতি উজ্জ্বল। তাঁহারা অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া, কি বহুবিধ গ্রন্থ পাঠ করিয়া, কোন বিষয় শিক্ষা করেন না বটে; কিন্তু বহির্দৃষ্টিতে বাহিরের বিষয়-সকল যেমন সহজে উপলব্ধি হয়, তাঁহাদের অন্তর্দৃষ্টিতে সত্যের প্রতিভা তেমনি সহজে পড়ে। যে সকল সময়ে এই রূপ এক এক মহাত্মা উদিত হন, তখনকার জুন-সমাজের অবস্থা দেখিয়া আশ্চর্য্য হইতে হয়, যে এমন আন্ধকারের মধ্য হইতে এ প্রকার তেজীয়ান্ পুরুষ কোথা হইতে আইলেন। ঈসা, নানক, মহম্মদ; এই সকল লোকের এই প্রকার ভাব।

এই প্রকার অন্তর্দৃষ্টিতে আমরা যে সকল জ্ঞান উপলব্ধি করি তাহা সহজ, সাক্ষাৎ, স্বাভাবিক; তাহা স্বতঃসিদ্ধ; তাহা মনুষ্যের সাধারণ সম্পত্তি। বাহিরের বস্তু-সকল আমরা যেমন সাক্ষাৎ দেখি, অতীন্দ্রিয় উচ্চতর বিষয়েরও আমাদের সেই রূপ সাক্ষাৎ জ্ঞান লাভ হইতে পারে। বিষয়-জ্ঞান আমারদের দুই প্রকারে উপলব্ধি হইতে পারে। হয়, আমরা কোন বস্তু চক্ষে দেখি; নয়, তাহা কোন গ্রন্থ মধ্যে বা অন্যের নিকট হইতে শিক্ষা করি। আমি যদি স্বচক্ষে এই বৃক্ষের শোভা দেখিয়া আমোদিত হই, তবে এই স্থলে আমার প্রত্যক্ষ জ্ঞান হইল। কিন্তু আমি দেখি নাই, এমন এক বৃক্ষের বিষয় যদি কেহ আমার নিকটে বর্ণন করে; তবে এ স্থলে আমার জ্ঞান সাক্ষাৎ জ্ঞান নহে তাহা পরোক্ষ জ্ঞান। আমি তাহা জানিলাম বটে; কিন্তু সে জানা সাক্ষাৎ দেখার সঙ্গে এত প্রভেদ যে তাহাতে সংশয় জন্মিলে তাহা ভঞ্জন করিবার জন্য প্রত্যক্ষ জ্ঞান আবশ্যক।

আমরা জগতের প্রতি দৃষ্টি করিলে যে কেবল জড়ীয় গুণ সকল উপলব্ধি করি, তাহা নহে। শিশুর মন, যখন সে কথা কহিতেও শিক্ষা করে নাই, তখন তাহাকে নানা প্রকার ভাবে আকৃষ্ট হইতে দেখা যায়। প্রথমে সে যে কেবল আকৃতি, বিস্তৃতি, বর্ণ, এই সকল দেখিতে পায়, তাহা নহে; কিন্তু নূতন নূতন বস্তুর শোভা দেখিয়াও আশ্চর্য ও আমোদিত হইতে থাকে। বিশ্বরাজ্য, শ্রী ও সৌন্দর্য্যে এ প্রকার বিভূষিত যে তাহাতে আমারদের দৃষ্টি পড়িবামাত্র আমারদের মন সৌন্দর্য্য রসে আর্দ্র হয়। সুন্দর বস্তু দেখিবা মাত্র আমরা সহজ জ্ঞানে তাহার সৌন্দর্য্য গ্রহণ করি। আমরা যখনি কোন সুরম্য পুষ্প, বা স্পৃহণীয় চন্দ্রমা, বা তারকা-সঙ্ক‌ুল-গগনের প্রতি দৃষ্টি করি; তখন আমরা কি দেখি? তাহাদের আকৃতি বিস্তৃতি প্রভৃতি যে তাহাদের জড়ীয় গুণ, কেবল তাহা দেখি না; তাহা আপেক্ষাও অধিক দেখি। সেই সকল জড় পিণ্ডের মধ্যে আমরা শোভা দর্শন করি। এই শোভার জ্ঞান আমারদের পরোক্ষ জ্ঞান নহে, তাহা প্রত্যক্ষ জ্ঞান; কিন্তু যখনি আমি সেই শোভা অন্যের নিকটে ব্যক্ত করি, অথবা তাহা দেখিবার পরে পুনর্ব্বার তাহা ভাবিতে যাই। ভামনি বুদ্ধি আসিয়া তাহার উপরে কার্য্য করিতে থাকে। সঙ্গীতের বিষয়েও এই রূপ। প্রথমে আমরা সহজ-জ্ঞান দ্বারা সঙ্গীত-রস গ্রহণ করি, তাহা যদি না পারিতাম। তবে সঙ্গীতের ব্যাকরণ বুঝাইয়া, সমুদায় সঙ্গীত-সূত্র নির্ব্বাচন করিয়াও কেহ আমারদিগকে সঙ্গীতের ভাব বুঝাইয়া দিতে পারিত না। কিন্তু আমি সঙ্গীত রসজ্ঞ হইয়া যদি সঙ্গীতের এক ব্যাকরণ রচনা করি, তবে সে স্কুলে তাহা বুদ্ধির হস্ত দিয়া বাহির হইল। শোভার জ্ঞান সঙ্গীতের ভাব, আমরা এমন সহজে পাই, যে শোভা দেখা, সঙ্গীত রস পান করা, ভাষায় এই সকল বাক্যই প্রচলিত হইয়াছে।

ধর্ম্ম এবং ঈশ্বরের বিষয়েও এই রূপ। আমাদের স্বাভবিক ধর্ম্ম-জ্ঞান প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ন্যায় অতি সহজ। আমরা স্বাভাবিক ধর্ম্ম-বুদ্ধি হইতে যে সকল বিষয় দেখিতে পাই, তাহা আর ছায়ার ন্যায় দেখি না, কিন্তু প্রত্যক্ষবৎ দেখি—কর্ত্তব্য, ন্যায়, সত্য, এ সকল কল্পনা মাত্র বোধ হয় না, কিন্তু এ সকলকে সার বোধ হয়—ঈশ্বর, পরকাল, এ সক।লের প্রতি বাহ্য বস্তুর ন্যায় আর কোন সংশয় থাকে না। কিন্তু আমি যদি কেবল ধর্ম্ম-শাস্ত্র হইতে ধর্ম্ম শিক্ষা করি— যদিও ঈশ্বর, পরকাল; পাপ পুণ্য; উপকার, অনিট; এই সকল শব্দ আমার মুখগ্রে থাকে; তথাপি হয় তো সে শিক্ষা কেবল মুখেই থাকে—সে ধর্ম্ম-জ্ঞান জীব-শূন্য নিষ্ফল হইয়া থাকে। যে পর্য্যন্ত না সেই শিক্ষিত বিষয়-সকল আমার জ্ঞাননেত্রের সন্মুখে আইসে—যে পর্য্যন্ত না আমি স্বয়ং পরীক্ষা করিয়া সেই সকল বিষয় দেখিতে পাই, সে পর্য্যন্ত সে শিক্ষা কোন কার্য্যেরই নহে। এই হেতু এক সামান্য কৃষকের মুখ হইতে যে সকল ধর্ম্ম-নীতি বহির্গত হয়, তাহাতে এক মহা অধ্যাপকেরও প্রকৃষ্ট রূপে শিক্ষা হইতে পারে। এ স্থলে পণ্ডিত আর মুখ উভয়েরই সমান অধিকার। ঈশ্বরকেও আমরা জ্ঞান-নেত্রে প্রত্যক্ষ, উপলব্ধি করি। আমরা যদি কেরল যুক্তির সোপান দিয়া ঈশ্বরে যাই, তবে আমরা শূন্য ঈশ্বর মাত্র পাই। কেবল বুদ্ধির অলোক এ স্থলে অন্ধকার তুল্য। ঈশ্বরের অস্তিত্ব যতক্ষণ না আমরা তর্ক দ্বারা সিদ্ধান্ত করিতে পারি, ততক্ষণ যে আমরা ঈশ্বরকে জানিতে পারি না; এ কোন কায্যেরই কথা নহে। জগৎ, আমি, ঈশ্বর, এ তিনেরই সত্তা আমাদের আত্ম-প্রত্যয়-সিদ্ধ; তাহা সিদ্ধান্ত সাপেক্ষ নহে, এবং সে সকলকে যুক্তি দ্বারা সংস্থাপন করিতেও পারা ঘায় না। আমরা কি জগতের অস্তিত্ব তর্ক দ্বারা সিদ্ধান্ত করিয়া পরে তাহা প্রত্যয় করি? যদিও সহস্র সহস্র প্রখর বুদ্ধি একত্র হইয়া বহুতর যুক্তি প্রদর্শন পূর্ব্বক জগতের অস্তিত্ব খণ্ডন করিয়াছে; তথাপি কোন্ উন্মাদ এমন আছে, যে বাহ্য বস্তুর অস্তিত্বের প্রতি সংশয় করে। বিপক্ষের শত সহস্র যুক্তি ও তর্ক এ স্থলে পরাভব পায়। ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণও সেই রূপ তর্ক তরঙ্গের উপর নির্ভর করে না। আমি যখন তাঁহাকে জ্ঞান-নেত্রে প্রত্যক্ষ প্রতীতি করি; তখন আর আমি ছায়া দেখি না, তখন করতল-ন্যস্ত আমলকের ন্যায় তাঁহার সত্তা স্পষ্ট রূপে উপলব্ধি করি—তখন “ভিদ্যতে হৃদয় গ্রন্থি শ্চিদ্যন্তে সর্ব্বসংশয়ঃ” হৃদয়ের গ্রন্থি ভিদ্যমান হয়, সকল সংশয় নিরাকৃত হয়। এই স্বাভাবিক সহজ-জ্ঞান ব্যতীত কোন সত্যই আমাদের প্রত্যক্ষ গোচর হয় না। কোন প্রকার ব্যাখ্যাতে কেহ জন্মান্ধকে বর্ণ বুঝাইয়া দিতে পারে না— কোন বর্ণনাতেই আমরা মিষ্ট, কি কটু, কি কোন প্রকার আস্বাদন উপলব্ধি করিতে পারি না। মহত্তর উচ্চতর আধ্যাত্মিক বিষয়-সকলও আমাদের পক্ষে এই রূপ।

এই সহজ-জ্ঞান আর বুদ্ধি, এ দুয়ের স্বরূপ বিস্তর ভিন্ন। সহজ-জ্ঞানে আমরা বিষয় পাই, বুদ্ধি সেই সকল বিষয়, লইয়া নির্ম্মাণ করে। বিস্তৃতি আর সংখ্যার জ্ঞান আমরা সহজে উপলব্ধি করি, বুদ্ধি তাহা লইয়া গণিত শাস্ত্র নির্ম্মাণ করে; কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য জ্ঞান সহজে লাভ করি, বুদ্ধি তাহার উপরে নীতি-শাস্ত্র নির্ম্মণ করে। ঈশ্বর, পরকাল, সহজ-জ্ঞানে গ্রহণ করি, বুদ্ধি তাহাতে ধর্ম্ম-শাস্ত্র রচনা করে। এই সকল বিষয় না পাইলে বুদ্ধি কিসের উপর নির্মাণ করিবে। শুদ্ধ উপকরণ থাকিলেও একটী গৃহ নির্ম্মাণ হয় না; উপকরণ না থাকিলে কেবল নির্ম্মাতার বুদ্ধিতেও গৃহ নির্মাণ হইতে পারে না। জ্ঞান-নেত্রে আমরা শোভা দেখিতে পাই; বুদ্ধিতে শোভার প্রকার ও স্বরূপ ও তাহার তারতম্য এই সকল বিষয় বিবেচনা করি। ধর্ম্মের নিয়ম ও ব্যবস্থা—তাহার অনুষ্ঠানের ফল, এই সকল বিষয় লইয়া বুদ্ধি আলোচনা করে; কিন্তু ন্যায়, মঙ্গল, সত্য, এ সকলের আভা প্রথমে আমারদের অন্তদৃর্ষ্টিতেই পতিত হয়। ঈশ্বরের মহান্ ওরমণীয় ভাব-সকল প্রথমে আমরা সহজে উপলব্ধি করি, পরে তাহা বুদ্ধি দ্বারা বিশেষ করিয়া ব্যাখ্যা করি। এই দুই প্রকার করিয়া আমরা সকল জ্ঞান উপলব্ধি করিতেছি—সকল তত্ত্ব উদ্ঘট করিতেছি। প্রথমেই আমরা অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা সত্যকে দেখিতে পাই—পরে সেই সকল সত্যকে বিভাগ করা, শ্রেণীবদ্ধ করা তাহারদের মধ্যে প্রভেদ নির্দ্দেশ করা, এ সকল আমারদের বুদ্ধির কার্য্য।

অমারদের জ্ঞানের ভাব এই প্রকার করিয়া দিয়া ঈশ্বর কি উদার করুণা ও নিপুণ কৌশল প্রকাশ করিয়াছেন। যদি বুদ্ধির বিকাশ না হইলে আমারদের নিকটে প্রাণ হইতেও প্রয়োজনীয় সত্যসকল অপ্রকাশিত থাকিত; তবে যাহারা আপনাদের বুদ্ধি মার্জিত করিবার অবকাশই পায় না, তাহারদের কি দুর্দ্দশা হুইত। কিন্তু বস্তুতঃ হা নহে। জগদীশ্বর কতগুলি লোককে বাছিয়া কেবল তাহারদের উপরেই সকল করুণা বর্ষণ করেন নাই, কিন্তু তাঁহার অজস্র দান সকল পুত্রেরই জন্য। মূর্খ ও পণ্ডিত কৃষক ও শিল্পী, সকলেরই নিকটে আপনাকে প্রকাশ করিতেছেন। কুটীর-বাসী দীন ব্যক্তি তাহার পরিবারের মধ্যে থাকিয়া যেমন সুনির্ম্মল ধর্ম ও অকপট সত্যকে আশ্রয় করিতে পারে, জ্ঞানী ব্যক্তিও সেই প্রকার। এক সামান্য ব্যক্তি ঈশ্বরের মঙ্গল-স্বরূপে অটল নিষ্ঠা রাখিয়া রাশি রাশি বিপদের মধ্যে যেমন অনায়াসে চলিয়া যাইতে পারে, একজন বিদ্বান্ ধার্ম্মিকও সেই প্রকার। সকল মনুষ্যই এক পিতার পুত্র—মানব জাতিই এক শরীর। সকলের উপরে সকলের নির্ভর করিতেছে। এক ব্যক্তি, এক পরিবার, এক জাতি-ইহার কিছুই সমগ্র নহে। কিন্তু সকল মনুষ্যই এক জাতি—এক পরিবার। জ্ঞানের উন্নতি, মনের প্রাশস্ত্য, ধর্ম্মের বিস্তৃতি, এ সকল এক জন কি এক জাতির উপরে নির্ভর করিতেছে, এমত নহে; কিন্তু সকল মনুষ্য মিলিত হইয়া ঈশ্বরের এই সকল মহান্ উদ্দেশ্য সিদ্ধা করিতেছে।

এই স্বাভাবিক সাধারণ সহজ-জ্ঞানের উপরেই ব্রাহ্ম ধর্ম্ম স্থাপিত হইয়াছে, বালু-রাশির উপরে ইহার পত্তন হয় নাই। ব্রাহ্মধর্ম্মের সত্য-সকল আত্মপ্রত্যয়-সিদ্ধ; সেই সকল সত্যের আলোক মনুষ্যের অন্তর্দৃষ্টিতেই পতিত হয়। শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, তন্ত্র উৎপত্তির পূর্ব্বে ও ব্রাহ্মধর্ম্ম ছিল; এবং এ সকল যদি একেবারে ধ্বংস হয়, তথাপি তাহা থাকিবে। বেদ, কোরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ বিশেষে বা ঈসা মুসা প্রভৃতি ব্যক্তি বিশেষে ব্রাহ্মধর্ম্ম আবদ্ধ নহে। যে সকল সত্য বুদ্ধির হস্তে পতিত হইয়া বিকৃত হয় নাই, যে সকল সত্য গ্রন্থ মধ্যে নিহিত হইয়া বিবর্ণ হয় নাই, যে সকল সত্য এক মত কি এক সম্প্রদায় কি এক জাতির মধ্যে বদ্ধ নহে; তাহাই ব্রাহ্মধর্মের অন্তর্গত। সকল ধর্মের মধ্য হইতেই ব্রাহ্মধর্মের নৈসর্গিক সৌন্দর্য প্রকাশ পাইতেছে। যে ধর্ম্ম অস্থায়ী, সঙ্কীর্ণ, পরিবর্তসহ, তাহা ব্রাহ্মধর্ম্ম নহে; আর যাহা স্থায়ী, সাধারণ, অপরিবর্তনীয়, দেশ কালে অপরিচ্ছিন্ন; তাহাই ব্রাহ্মধর্ম। ব্রাহ্ম ধর্ম ইউরোপ কি ভারতবর্য কি বঙ্গ দেশের ধর্ম নহে, কিন্তু সকল দেশের উপরেই তাহার সমান অধিকার। ব্রাহ্মধর্ম অবস্থারও দাস নহে, ঘটনারও অধীন নহে; কিন্তু সকল কালেই তাহার সমান আধিপত্য।

এই বিশুদ্ধ ব্রাহ্মধর্ম্মের সহজ ভাব-সকল বুদ্ধির দ্বারা আলোচনা করিয়া কলিকাত ব্রহ্ম-বিদ্যালয়ে আমার পরম পূজনীয় পিতা মহাশয় যে সকল উপদেশ প্রদান করিয়া। ছেন, তাহা সাধারণের উপকারের জন্য গ্রন্থ-বদ্ধ করিয়া আমি প্রকাশ করিতেছি; ইহাতে যদি একটী আত্মাও ধর্মের সহায়ে উন্নতি লাভ করে এবং ঈশ্বর-ভাবে পূর্ণ হয়, তবে আমি কৃতার্থ হইব।

শ্রীসত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কলিকাতা। 
৭ চৈত্র
১৭৮৩ শক।


[nextpage title=”প্রথম উপদেশ– ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং লক্ষণ
“]

ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে বাক্য ব্যয়ের কিছু মাত্র আবশ্যক করে না। বোধ-বিশিষ্ট ব্যক্তি মাত্রেই তাহা অঙ্গীকার করিয়া থাকেন। জগতের অস্তিত্বই তাঁহার অস্তিত্বের দেদীপ্যমান প্রমাণ। জগতে সকলই সুশৃঙ্খল সকলই কৌশলময়। ইহাতে কিছুই অসম্বদ্ধ বিশৃঙ্খল নহে। অনিচ্ছোৎপন্ন আকস্মিক ব্যাপার একটিও নাই। কোন পদার্থ— কোন নিয়মই নিরর্থক হয় নাই। এক সত্যকাম মঙ্গল সঙ্কল্প মহান্ পুরুষের ইচ্ছা এই বিশ্ব সংসারে দেদীপ্যমান: প্রকাশ পাইতেছে। ঈশ্বরের জনস্বরূপ ও মঙ্গল-ভাব। মনোমধ্যে ধারণ না করিয়া তাঁহার অস্তিত্ব মাত্র স্বীকার করলে কেবল শূন্য ঈশ্বর, এই মাত্র মুখে বলা হয়। তাঁহার অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার জ্ঞান এবং মঙ্গল-ভাবও এই জগতে সুব্যক্ত হইতেছে। সকল কৌশলে তাঁহার জ্ঞান জাজ্বল্যমান রহিয়াছে। সমস্ত ঘটনাতেই তাহার মঙ্গলভাব মুদ্রিত রহিয়াছে। মনুষ্য, পশু, পক্ষী, কীট, পতঙ্গ সকলে মিলিয়া তাঁহার জ্ঞান ও মঙ্গলাভিপ্রায়ের পরিচয় দিতেছে। তিনি আছেন, এই মাত্র বলিলে তাঁহার কিছুই বলা হয় না। তিনি আছেন, এবং তিনি জ্ঞান-স্বরূপ ও মঙ্গল-স্বরূপ। তাঁহার জ্ঞান ও মঙ্গল-ভাবের কি সীমা হয়? না, তিনি অনন্ত জ্ঞান—তিনি পূর্ণ মঙ্গল। জগতের কারণ ঈশ্বর আছেন, কিন্তু তাঁহার জ্ঞান নাই, এমন কথনই হয় না। জগতের কারণ জ্ঞানবান্ পুরুষ আছেন, কিন্তু তাঁহার মঙ্গল-ভাব নাই, ইহাও বলা যায় না। তিনি যে এই জগৎ সৃজন করিয়াছেন, তাহা অমঙ্গলের জন্য—তবে তিনি ঈশ্বর নহেন; কোন ভীষণ দৈত্য কিম্বা অসুর এই বিশ্বের রচয়িতা। ঈশ্বর আছেন তাহার সঙ্গে সঙ্গে এই দুইটা লক্ষণ স্পষ্ট রহিয়াছে যে তিনি জ্ঞান-স্বরূপ এবং মঙ্গলস্বরূপ। আমরা মনুষ্যের আকৃতি ও তাহার জ্ঞান ধর্ম্ম মনে না করিয়া মনুষ্যকে ভাবিলে, যেমন মনুষ্যের ভাব আমারদের মনে আইসে না, সেই রূপ ঈশ্বরের জ্ঞান এবং তাঁহার মঙ্গল-ভাব অবগত না হইলে ঈশ্বর শব্দের অর্থই বোধগম্য হয় না। তাঁহার জ্ঞান নাই, তবে তিনি জড়; তাঁহার মঙ্গল ভাব নাই, তবে তিনি নিষ্ঠ‌ুর অসুর বা নির্দয় দৈত্য। সমুদায় সৃষ্টি প্রক্রিয়াই তাঁহার জ্ঞান ও মঙ্গল সঙ্কল্প প্রচার করিতেছে। এমন নিয়ম নাই, যাহাতে তাঁহার দুর্ব্বিগাহ মঙ্গল অভিপ্রায় প্রকাশিত না রহিয়াছে। এমন কার্য্য নাই, যাহাতে তাঁহার অসীম জ্ঞান প্রকাশ না পাইতেছে। এই দুই লক্ষণ তাঁহার স্বরূপের প্রধান লক্ষণ। ঈশ্বরের স্বরূপ হইতে এই দুই লক্ষণ প্রত্যাহার করিয়া লইলে, তাঁহাতে ঈশ্বরের ভাব কিছুই থাকে না। তাঁহার অস্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার স্বরূপ লক্ষণ সর্ব্বত্রই সুব্যক্ত হইতেছে। সমুদয় জগৎ সংসারই কার্য্য, তাহার তিনি মূল কারণ। সমুদয় জগৎ শৃঙ্খলাই কৌশলময় এবং তিনিই সেই কৌশলের কারণ জ্ঞান-স্বরূপ পরব্রহ্ম। জগতের সমুদয় নিয়মই মঙ্গলাবহ এবং ইহার নিয়ন্তা মঙ্গল সঙ্কল্প।

কিন্তু ঈশ্বরের জ্ঞান ও মঙ্গল-ভাব পরিমিত কি অপরিমিত; তিনি কি কতক জানেন, কতক জানেন না—কতক দেশ দেখেন, কতক দেখেন না—তিনি বাহিরে আছেন, অন্তরে নাই; তাঁহার কতক সাধুভাব এবং কতক অসাধু ভাব? তিনি কি এই প্রকার অপূর্ণ? কখনই না। যে কিছু পরিমিত বস্তু, তাহাই সৃষ্ট বস্তু। যিনি জগদীশ্বর, তিনি অপরিমেয়— তিনি পরিপূর্ণ। এই সত্যটি সকলেরই বুদ্ধি ভূমিতে নিহিত আছে। ঈশ্বরকে অনন্ত অসীম অপরিমেয় না বলিলে তাঁহার কোন স্বরূপই বলা হয় না। ঈশ্বরের কোন বিষয়ের সীমা আছে—পরিমাণ আছে—তাঁহার কিছুরই খর্ব্বতা আছে, ইহা বলিলে তাঁহাকে ঈশ্বর বলা হয় না; অন্য কোন পরিমিত সৃষ্ট বস্তু বলিয়া নির্দ্দেশ করা হয়। ঈশ্বর যিনি, তিনি পূর্ণ। পূর্ণ যে কি তাহা সেই পূর্ণ-স্বরূপই জানেন; আমরা অপূর্ণ জীব হইয়া তাঁহার পূর্ণ ভাব মনে ধারণ করিতে পারি না। তবে তাঁহাকে অনন্ত অসীম অপরিমেয় বলাই আমারদের সাধ্য। তাঁহার যে কোন বিষয় মনে করি, সকলই অনন্ত। তিনি জ্ঞানেতে অনন্ত—তিনি শক্তিতে অনন্ত—তিনি মঙ্গলভাবে অনন্ত—তিনি দেশেতে অনন্ত— তিনি কালেতে অনন্ত।

যখন তাঁহার জ্ঞানের সহিত অনন্ত ভাবকে মিলিত করি, তখন তাঁহাকে সর্ব্বজ্ঞ বলি। তিনি ভূত ভবিষৎ বর্তমান সকল কালের সকল ব্যাপার বিশেষ রূপে অবগত হইতেছেন। তিনি যেমন বাহিরের সমস্ত বিষয় জানিতেছেন, সেই প্রকার আমাদের অন্তরের প্রত্যেক কামনা ও প্রত্যেক ভাব সম্যক অবধারণ করিতেছেন। অন্ধকার তাঁহার নিকটে কোন কুকর্ম্মকে গোপন রাখিতে পারে না এবং কপটতাও তাঁহার জ্ঞান হইতে সত্যকে আচ্ছন্ন করিতে পারে না। তাঁহার অনন্ত জ্ঞানের গুরুভার পরিমাণ করিয়া শেষ করা যায়।

যখন তাঁহার মঙ্গলস্বরূপ এবং অনন্ত ভাব একত্র করি, তখন তাঁহাকে পূর্ণ-মঙ্গল বলি। মন্দের সঙ্গে তাঁহার লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। কোন দোষ বা গ্লানি বা কলঙ্ক তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারে না। আলোকের সীমা কি? না, অন্ধকার। জ্ঞানের সীমা কি? না, অজ্ঞান। সদ্ভাবের সীমা কি?, অসদ্ভাব। মঙ্গলের সীমা কি? না, অমঙ্গল ঈশ্বর কোন সীমা বিশিষ্ট পদার্থ নহে। মনুষ্যের বিষয়ে যখন আমরা এই প্রকার বলি যে এ ব্যক্তির এত গুলি গুণ আছে, তখনই ইহাও বলা হইল, যে তাহার এতটকু দোষও আছে। কিন্তু ঈশ্বরের মঙ্গল ভাবের সীমা করা যায় না। তাঁহার জ্ঞানের সীমা নাই বলিয়া তিনি সর্বজ্ঞ; তাঁহার মঙ্গলভাবের সীমা নাই বলিয়া তিনি পূর্ণ মঙ্গল।

যখন তাঁহার শক্তির বিষয় বিবেচনা করি, তখন তাঁহাকে অয়ন্ত শক্তি ও সর্ব্বশক্তিমান্ বলিয়া প্রত্যয় যাই। আমাদের অভিপ্রায়ও যদি মঙ্গল হয়, তবে শক্তির অভাবে হয় তো তাহা সম্পন্ন হয় না। কিন্তু তাঁহার সে প্রকার নয়। তাঁহার ইচ্ছা মঙ্গলময়ী এবং তাঁহার যাহা ইচ্ছ তাহাই হইতেছে এবং পরেও তাহাই হইবে। তাঁহার অপরিসীম শক্তির প্রভাবে সমুদয় পদার্থ নিজ নিজ শক্তি ধারণ করিয়াছে। এখানে যত জড় রাশি, যত প্রাণি জঙ্গম, উপরে যত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড লোক মণ্ডল, যত লোক-নিবাসী জীবপুঞ্জ, যত প্রকার সূক্ষ্মাণুসূক্ষ্ম কৌশল সমূহ, তাহাতেই যে তাঁহার শক্তির পরিসমাপ্তি হইয়াছে, এমত নহে। তাঁহার শক্তির ক্রটি নাই। তিনি বিচিত্র শক্তি এবং তিনি সর্ব্বশক্তিমান্। তিনি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের এক মাত্র কারণ। তিনি যাহা ইচ্ছা করেন, তাহাই করিতে পারেন।

আবার যখন তাঁহার অনন্ত ভাব কালের সঙ্গে সংযোগ করি, তখন তাঁহাকে নিত্য শব্দে ব্যক্ত করি। তিনি পূর্ব্বেও ছিলেন, অদ্যও আছেন, তিনি পরেও থাকিবেন। যখন কিছুই সৃষ্টি হয় নাই, তখনও তিনি ছিলেন এবং যদি সমুদয়ই বিনাশ পায়, তথাপি তিনি থাকিবেন। কাল সহকাৱে তাঁহার স্বরূপের পরিবর্ত্তন নাই। তিনি ধ্রুব—তিনি অপরিবর্ত্তনীয়। তিনি সর্ব্বকালে সমভাবে স্থিতি করিতেছেন।

তিনি সর্ব্বব্যাপী—দেশেতে তাঁহার সীমা হয় না। তিনি কোন এক দেশে বসিয়া রাজত্ব করিতেছেন, এমত নহে। সমুদয় জগৎই তাঁহার আবাস স্থান, আমাদের আত্মাও তাঁহার আসন। তিনি অচিন্ত্য-দূরস্থিত নক্ষত্রেও আছেন, এবং সকল অপেক্ষা নিকটের বস্তু যে আমি, আমাতেও তিনি আছেন। তাঁহাকে পাইবার জন্য স্থান বিশেষ অন্বেষণ করিতে হয় না, এবং স্থান বিশেষ হইতে দূরে গেলেও তাঁহা হইতে দূরস্থ হওয়া যায় না।

তিনি নিয়ন্তা, নিয়ন্তা ব্যতীত নিয়ম হয় না, নিয়ম কথন কোন কার্য্যের স্বয়ং কর্ত্তা হইতে পারে না। নিয়ম বলিলেই তাহার সঙ্গে সঙ্গে তাহার নিয়ন্তাকেও বলা হয়। ঈশ্বর এখানে কেবল উদাসীনের ন্যায় রহিয়াছেন, এমত নহে; তিনি সকলের নিয়ন্তা রূপে, সকলের যন্ত্রী রূপে বিদ্যমান আছেন। তাঁহার নিয়মের অধীনে থাকিয়া সকলেই তাঁহার আজ্ঞা পালন করিতেছে।

তিনি সর্ব্বাশ্রয়, তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া সকলে স্ব স্ব কার্য্যে নিযুক্ত রহিয়াছে। তিনি একাকী সকলেরই আধারভূত—আর সকলই তাঁহার আশ্রিত। পূর্ব্বে যখন ইহার কিছুই সৃষ্টি হয় নাই, তখনও তাহার সৃজন-শক্তি তাহাতেই অব্যক্ত রূপে নিহিত ছিল। এক্ষণে সেই শক্তি কার্য্যেতে পরিষ্ফ‌ুট হইয়া যাহা কিছু উৎপন্ন হইয়াছে, সে সকলই সেই শক্তিকে অবলম্বন করিয়া নিয়তই চলিতেছে। বৃক্ষ কখন মূল হইতে পৃথক্ থাকিতে পারে না। মা, জগৎ সংসারেও কখন জগৎ কর্ত্তা হইতে নিচ্ছিন্ন থাকিতে পারে না। তিনি লোক ভঙ্গ নিবারণের সেতু স্বরূপ হইয়াছেন। তাঁহার ইচ্ছার অসদ্ভাবে সমুদায়ই ধ্বংস হয়। তিনিই সমস্ত আধারের মূলাধার—তিনিই সকল শক্তির মূল শক্তি।

তিনি নিরবয়ব। তিনি জ্ঞান-স্বরূপ, সুতরাং তাঁহার কোন অবয়ব নাই। জড় বস্তুরই অবয়ব আছে। যাহা খণ্ড খশু করা যায়—যাহার আকৃতি আছে—বিস্তৃতি আছে, তাহারই অবয়ব থাকা সম্ভব। সূর্য-কিরণে উদ্দীপ্ত অতি সূক্ষ্ম বালুকা রেণুও অবয়ব বিশিষ্ট। কিন্তু জ্ঞান পদার্থ নিরবয়ব। জড় বস্তু আকাশ অবলম্বন করিয়া আছে, কিন্তু জ্ঞান বস্তু সে রূপে নাই। আমাদের আত্মাও নিরবয়ব এবং পরমাত্মাও নিরবয়ব।

তিনি নির্ব্বিকার। তিনি পূর্ণ-মঙ্গল স্বরূপ ইহা বলতেই, তিনি নির্ব্বিকার ইহা বলা হইয়াছে। মনুষ্যের শরীরের বিকার যে রোগ, তাহাও তাঁহাতে নাই, মনুষ্যের মনের বিকার যে পাপ, তাহাও তাঁহাতে নাই। পাপই অমঙ্গল; অত এব মঙ্গল স্বরূপেতে পাপ স্পর্শ করিতে পারে না। তিনি অকায় অব্রণ; তিনি পরিশুদ্ধ অপপ-বিদ্ধ।

তিনি একমাত্র অদ্বিতীয়। সমুদায় বিশ্বব্যাপার এক প্রকাণ্ড কৌশল যন্ত্রের অন্তর্গত। ব্রহ্মাণ্ডান্তর্গত সমুদায় পদার্থের মধ্যে এক অভেদ্য সম্বন্ধ নিবদ্ধ রহিয়াছে। যিনি জ্যোতির সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনিই নেত্রের সৃষ্টি করিয়াছেন। যিনি ক্ষুধা তৃষ্ণা দিয়াছেন, তিনিই অন্নপান পরিবেশন করিতেছেন। সমুদায় সৃষ্টিই একটী কৌশল যন্ত্র এবং তিনি মাত্র তাহার একই যন্ত্রী—অপর কাহারও হস্ত তাহাতে নাই।

তিনি স্বতন্ত্র। তাঁহার কেহ নিয়ন্তা নাই, তিনি কাহরও অধীন নহেন। তিনি কাহারও সহায়তা গ্রহণ করিয়া সৃষ্টি করেন নাই; আমাদের সকলই তাঁহার সহায়তার অধীন। তিনি কাহারও মন্ত্রণা লইয়া জগৎ কার্য্য চালনা করিতেছেন, এমনও নহে। তিনি একাকী—তাঁহার যাহা ইচ্ছা হয়, তাহাই সম্পন্ন হয়। আমরা সকলে তাঁহার অধীনে থাকিয়া তাঁহারই অভিপ্রায় সম্পন্ন করিতেছি, কিন্তু তিনি একমাত্র স্বতন্ত্র।

তিনি পরিপূর্ণ। তাঁহার কিছুই খর্ব্বতা নাই। তাঁহার কোন তত্ত্বের অন্ত হয় না—সীমা হয় না—পরিমাণ হয় না। তিনি অনন্ত, অপরিসীম, অপরিমেয় পূর্ণ পদার্থ। কাহারও সহিত তাঁহার উপমা হয় না।

এই অনন্ত-জ্ঞান পূর্ণ মঙ্গল পুরুষের প্রতি স্থিরদৃষ্টি রাখিয়া আমরা যেন জীবন-যাত্রা নির্ব্বাহ করি। যিনি সর্বজ্ঞ, তিনি আমারদের অন্তর্যামী। তাঁহার নিকটে অন্ধকার ও আলোক উভয়ই তুল্য। নির্জনে পাপাচরণ করিলে, তাঁহার নিকট অপ্রকাশ থাকে না। আমরা তাঁহাকে অন্তস্থায়ী সর্ব্বসাক্ষী জ্ঞান করিয়া যেন তাঁহার প্রিয় কার্য্যসাধনে তৎপর থাকি। তিনি মঙ্গল স্বরূপ। তাঁহার শুভ অভিপ্রায় যাহাতে সম্পন্ন হয়, তাহার জন্য আমারদের প্রাণপণে যত্নবান থাকা উচিত। আমাদের ইচ্ছা যেন। তাঁহার মঙ্গলময়ী ইচ্ছার বিরোধিনী না হয়। তিনি আমাদিগকে এই শুভ উদ্দেশে এখানে প্রেরণ করিয়াছেন যে আমরা জ্ঞান ধর্ম্ম লাভ করিয়া তাঁহার সহবাসের উপযুক্ত হই। আমাদের ইচ্ছা ও চেষ্টা যদি সেই মহান উদ্দে- শের উপযােগিনী হয়, তবেই আমাদের মঙ্গল। তামরা ঈশ্বরের আদেশ পালন করিলে এবং তাহার প্রতি প্রেম ও অনুরাগ বদ্ধ করিলে, দুই মহংকার্য এক কালে সুসিদ্ধ হয়—তাহাতে ঈশ্বরের মঙ্গল অভিপ্রায় সম্পন্ন করা হয় এবং আমাদের আপনাদেরও অশেষ কল্যাণ সংসাধন করা হয়।

সত্যং শিবং সুন্দর ।

অনন্ত, পরিপূর্ণ, অদ্বিতীয়, কাহারও সহিত
তঁহার উপমা হয় না।
অনন্ত জ্ঞান—অপরিমিত জ্ঞান, পূর্ণ-জ্ঞান, সর্ব্বজ্ঞ,
নিরবয়ব, একমাত্র ।
অনন্ত মঙ্গল—অপরিমিত মঙ্গল-ভাব, পূর্ণ-মঙ্গল, নিষ্পাপ,
নির্বিকার, পবিত্র-স্বরূপ, নির্দোষ, সুন্দর,
আনন্দ-রূপ, প্রেম-স্বরূপ ।
অনন্ত সক্তি—সর্বশক্তিমান, অপরিমিত শক্তি, সৃষ্টিস্থিতি
প্রলয়কর্ত্তা, স্বতন্ত্র, সাশ্রয়, সৰ্বনিয়ন্তা।
অনন্ত কালে—নিত্য, অনাদনন্ত, ধ্রুব, অপরিবর্তনীয়-
সবভাব।
অনন্তু দেশে—সর্ব্বব্যাপী, অপরিসীম।


[nextpage title=”দ্বিতীয় উপদেশ-ঈশ্বর সৃষ্টিস্থিতি প্রলয়কর্ত্তা”]

ঈশ্বর সৃষ্টিস্থিতি প্রলয়কর্ত্তা।

পরমেশ্বরই সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের একমাত্র কারণ। সেই পূর্ণ পুরুষের ইচ্ছামাত্র সমুদায় জগৎ অসদবস্থা হইতে উদ্ভাবিত হইয়া সৎভাব প্রাপ্ত হইয়াছে, তাঁহার মহতী ইচ্ছার অধীনে ইহাৱা অদ্যাপি স্থিতি করিতেছে এবং সেই ইচ্ছার বিরাম হইলে সমুদায় পদার্থ স্বীয় স্বীয় শক্তির সহিত তাঁহার শক্তিতে লয় প্রাপ্ত হইয়া অন্তে তাঁহাতেই বিশ্রাম করিবে। পরমেশ্বর সর্বশক্তিমান্ এবং যিনি সর্ব্বশক্তিমান্, তিনিই সৃষ্টিস্থিতি প্রলয় কর্ত্তা। সৃজন শক্তি, পালন শক্তি এবং সংহার শক্তি, এই তিন অলৌকিক শক্তি কেবল তাঁহারই। যিনি সৃষ্টি করিতে পারেন; তিনিই সংহার করিতে পারেন, যে নির্ম্মাণ করিতে পারে, সে ভঙ্গ করিতেও পারে। এক রেণু বালুকা আমরা সৃষ্টি করিতে পারি না, এক রেণু বালুকা ধ্বংস করিতেও পারি না। আমরা যেমন কতকগুলি উপকরণ একত্র করিয়া এবং সেই সকলকে উপযুক্ত মত সংযোগ করিয়া কোন যন্ত্র নির্ম্মাণ করি, জগদীশ্বর সে রূপে বিশ্ব নির্ম্মাণ করেন নাই। তাঁহার ইচ্ছাতেই এই সমুদয় উৎপন্ন হইয়াছে। তিনি স্বীয় মহীয়সী শক্তির প্রভাবে এই বিশ্বকে অসৎ অবস্থা হইতে সদ্ভাবে আনিয়াছেন। তাঁহার শক্তির কোন সহকারী কারণ নাই।

অসৎ হইতে সৎ, আপনাপনিই জন্মিতে পারে না। “কথমসতঃ সজ্জায়েত।” অনন্ত-শক্তিসম্পন্ন অনাদি পুরুষের ইচ্ছাই এই জগতের অস্তিত্বের মূলীভূত কারণ। আবার যাঁহার ইচ্ছাতে সৃষ্টি হইয়াছে, তাঁহার সেই ইচ্ছার বিরাম ব্যতীত সৃষ্টির কণামাত্রও ধ্বংস হইতে পারে না। ঈশ্বরের শক্তি ব্যক্ত হওয়ার নাম সৃষ্টি—ঈশ্বরের শক্তি ঈশ্বরেতেই প্রত্যাবৃত্ত হওয়ার নাম প্রলয়। যে অনাদি পুরুষের শক্তি হইতে এই সকল বস্তু উৎপন্ন হইয়া স্বীয় স্বীয় শক্তি লাভ করিয়াছে, তিনি যদি সেই মহীয়সী শক্তি অপনয়ন করিবার ইচ্ছা করেন, তবে স্বীয় স্বীয় শক্তির সহিত সমুদয় সৃষ্ট বস্তু তাঁহার শক্তিতে লয় পাইয়া পুনর্ব্বার তাঁহাতেই গমন করিবে। সৃষ্টি হইবার পরে ঈশ্বরের যে শক্তি যাবতীয় সৃষ্টি প্রক্রিয়াতে আবির্ভূত হইয়াছে, সৃষ্টির পূর্ব্বে বস্তুতও সেই শক্তি ঈশ্বরেতে অব্যক্ত রূপে অবস্থিত ছিল এবং তিনি যদি ইচ্ছা করেন, তবে সেই শক্তির আবির্ভাব নিবৃত্তি প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার শক্তি তাঁহাতেই পূর্ব্বের মত অব্যক্ত রূপে স্থিতি করিবে।

স্থিতি কালে সমুদায় লোক তাঁহারই মহতী ইচ্ছার অধীনে স্থিতি করিতেছে। চেতনাচেতন সমুদয় পদার্থই তাঁহার নিয়ম অবলম্বন করিয়া আছে, কেহই তাঁহার নিয়ম অতিক্রম করিতে পারে না। পরমেশ্বর জ্ঞানেতে অভ্রান্ত— তিনি শক্তিতে অনন্ত। তিনি প্রথমে যে সকল ভৌতিক শারীরিক ও মানসিক নিয়ম সংস্থাপন করিয়াছেন, তাহা অখণ্ডনীয়, তাহা অপরিবর্ত্তনীয়। জীব মাত্রেই তাঁহার মঙ্গলময় নিয়মের অধীন—মনুষ্যও তাঁহার আশ্রয়ে থাকিয়া জীবন যাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছে। তিনি অচেতন জড় পদার্থকে যে প্রকার নিয়মে নিয়মিত করিয়াছেন, প্রাণ বিশিষ্ট উদ্ভিদ্ বর্গকে তদ্ভিন্ন আর তার নিয়মে বদ্ধ করিয়াছেন। তিনি প্রাণ বিশিষ্ট বৃক্ষ বল্লবাদির মধ্যে যে সকল নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন, সচেতন জীব জন্তুদিগকে তদতিরিক্ত আরো অনেক প্রকার নিয়মের অধীন করিয়াছেন। আবার তিনি পশু পক্ষী কীট পতঙ্গের মধ্যে যে সমুদয় নিয়ম ব্যবস্থিত করিয়াছেন, মনুষ্যের জন্য শুদ্ধ সে রূপ করিয়া ক্ষান্ত হন নাই। জগদীশ্বর মনুষ্যকে স্বীয় প্রবৃত্তির উপর কর্ত্ত‌ৃত্ব, দিয়াছেন, তাহার একান্ত অধীন করিয়া দেন। নাই। এই প্রকার আধিপত্য ও কর্ত্তৃত্ব ভার পাইয়াছে বলিয়াই মনুষ্য নামের এত গৌরব হইয়াছে। চন্দ্র সূর্য্য মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করিয়া এক পদও প্রসারণ করিতে পারে না; পশু পক্ষী স্ব স্ব প্রবৃত্তির প্রতিকূলে আপন ইচ্ছাতে চলিতে পারে না; কিন্তু মনুষ্য আপনার প্রকৃতির উপরে কর্ত্তৃত্ব করিতে পারে। আপনার উৎকর্ষ এবং অপকর্ষ সাধন মনুষ্যের যত্নাধীন। মনুষ্য আপনার শুভাশুভ বিষয়ে আপনিই দায়ী। মনুষ্যই ধর্ম্ম রূপ মন্ত্রী পাইয়াছেন। তিনি ন্যায় অন্যায়, কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য বিবেচনা ফরিয়া কার্য্য করিতে পারেন। মনুষ্যেরই এমত শক্তি আছে, যে তিনি স্বীয় প্রবৃত্তির কুটিল অভিসন্ধি সুদূর পরাহত করিতে পারেন। তিনি সহস্র প্রকার বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া ঈশ্বরের পথে পদ প্রসারণ করিতে পারেন। মানুষ্যের এই প্রকার কর্ত্ত‌ৃত্ব ভার রহিয়াছে বলিয়াই তিনি পাপের দগু ভোগ করিতেছেন এবং পুণ্যের পুরস্কার লাভ করিতেছেন; কখন বা আত্ম-প্রসাদ লাভ করিয়া স্ফুর্ত্তি ও প্রভাযুক্ত হইতেছেন এবং কখনও বা আত্ম-গ্লানিতে বিষগ্ন ও বিশীর্ণ হইতেছেন। ঈশ্বরের কি আশ্চর্য্য মহিমা! কি অদ্ভুত শক্তি! পূর্ব্বে কিছুই ছিল না, আর তিনি আপন ইচ্ছাতেই আশা ভরশা বুদ্ধি জ্ঞান ধর্ম্ম প্রভৃতি আশ্চর্য্য শক্তি সম্পন্ন মনুষ্যের সৃজন করিলেন। মনুষ্য অসদ্ভাব হইতে তাঁহার ইচ্ছায় উদ্ভাবিত হইয়া সেই অনাদ্যনন্ত সৎস্বরূপকে পাইবার অধিকারী হইয়াছে। মনুষ্য পশুদিগের ন্যায় অশনায়া পিপাসা স্নেহ শোক বিশিষ্ট হইয়াও এক ধর্ম্মের প্রসাদে এমত মহত্ত্ব প্রাপ্ত হইয়াছে। যাঁহার আশ্রয়ে সমস্ত লোক এবং সমুদয় জীব স্থিতি করিতেছে, তাঁহারই আশ্রয়ে থাকিয়া মনুষ্যও জ্ঞান ধর্ম্ম উপার্জন করিতেছে এবং ধর্ম্মের শেষ পুরস্কারস্বরূপ যে তিনি, তাঁহাকে লাভ করিয়া কৃতার্থ হইতেছে।

জগদীশ্বরের ইচ্ছাতে যেমন এই সমুদয় জগৎ স্থিতি করিতেছে; সেই রূপ তাঁহার যদি ইচ্ছা হয়, তবে তাহাদের কণামাত্রও থাকিতে পারে না। কিন্তু এই বলিয়া যে তিনি এই সুকৌশল-সম্পন্ন পরমাশ্চর্য্য বিশ্বষন্ত্র পুনর্ব্বার বিনষ্ট করিবেন, এমন সম্ভব হয় না। এই জগৎ সংসারের সমুদয় ব্যাপারই উন্নতির ব্যাপার। পৃথিবী প্রথমে ষেরূপ তেজস্বিনী ছিল, এখন আরও সতেজ হইয়াছে। পৃথিবীর মুখশ্রী দিন দিন আরও প্রফুল্ল হইতেছে। ভূতত্ত্ববেত্তারা পৃথিবীর আদিম অবস্থা যে প্রকার নিরূপণ করিয়াছেন, তাহা হইতে পৃথিবী এক্ষণে কত উন্নতাবস্থায় উপনীত হইয়াছে। আবার যদি কেবল এক মনুষ্য জাতির অবস্থা পর্য্যালোচনা করা যায়, তাহা হইলেও ঈশ্বরের মঙ্গল অভিপ্রায় স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। মনুষ্য-জাতির অবস্থা সবিশেষ উন্নতিশীল। তাহাদের মধ্যে জ্ঞানের উন্নতি হইতেছে, ধর্ম্মের উন্নতি হইতেছে এবং সামাজিক অবস্থারও উত্তরোত্তর উন্নতি হইয়া আসিতেছে। মনুষ্য জাতির মধ্যে যেমন পৃথিবীতে উন্নতির আলোক প্রকাশ পাইতেছে; সেই প্রকার প্রতি মনুষ্য অনন্ত কালের মধ্যে যে কত উন্নত হইবে, তাহা কে বলিতে পারে? ঈশ্বর আমাদিগকে তাঁহাকে পাইবার এবং অনন্ত অখণ্ড নির্মলানন্দ লাভ করিবার প্রখর আশা দিয়াছেন; সেই সত্য পুরুষ আমারদিগকে এই প্রত্যাশা দিয়া কথন তাহা হইতে নিরাশ করিবেন না। যিনি একটি ক্ষুদ্র তৃণও নিরর্থক করেন নাই, যিনি ক্ষুধা দিয়া অন্নের সৃষ্টি করিয়াছেন এবং পিপাসা দিয়া জল পরিবেশন করিতেছেন, তিনি এমন মহতী আশা কখনও নিরর্থক দেন নাই। তিনি এই স্পৃহাকে এখনই তৃপ্ত করিতেছেন এবং অনন্তকাল পর্যন্তও তৃপ্ত করিতে থাকিবেন। তিনি মঙ্গল সঙ্কল্প এবং তাঁহার বিশ্বরাজ্য কেবলই উন্নতির ব্যাপার। কিন্তু তিনি যদি এই বিশ্বসংসারকে সংহার করিতে ইচ্ছা করেন, তবে তাঁহার সেই ইচ্ছাকে কে খণ্ডন করিতে পারে? তিনি সেতু-স্বরূপ হইয়া এই লোক সকলকে ধারণ না করিলে, তাহাদিগকে আর কে রক্ষা করিতে পারে? “স সেতুর্ব্বিধৃতিরেষাং লোকানাম্ অসম্ভেদায়।”


[nextpage title=”তৃতীয় উপদেশপরমেশ্বর আনন্দস্বরূপ“]

পরমেশ্বর আনন্দ স্বরূপ। যে সকল পবিত্র-চিত্ত মহাত্মার পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইয়া সুমহান্ আনন্দ লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা তাঁহাকে আনন্দ-স্বরূপ বলিয়া ব্যক্ত করিয়াছেন। পরমেশ্বর নির্ব্বিশেষ; তাঁহার কোন বিশেষ নাম নাই। সেই বিশ্বব্যাপী পরমাত্মাকে না চক্ষু দ্বারা দর্শন করা যায়; না হস্ত দ্বারা গ্রহণ করা যাইতে পারে। যখন তাঁহার নিষ্কলঙ্ক পবিত্র স্বরূপ—যখন তাঁহার সুমধুর মঙ্গল ভাব আমাদের বিশুদ্ধ বুদ্ধিতে প্রতিভাত হয়; যখন তাঁহার সন্নিকর্ষ আত্মার নিকটে উজ্জ্বল রূপে প্রকাশ পায়; তখন যে এক অনুপম স্বর্গীয় আনন্দ উপস্থিত হয়, তাহাতেই তাঁহার নিগূঢ় সত্তা উপলব্ধি হয়। মনের সঙ্গে বিষয়ের যেমন এক প্রকার সম্বন্ধ—পরমাত্মার সহিত আত্মারও সেই রূপ অতি নৈকট্য সম্বন্ধ রহিয়াছে। প্রিয় রস আস্বাদনে বা প্রিয় স্বর শ্রবণে মনেতে যেমন এক প্রকার সুখের সঞ্চার হয়; সেই রূপ ঈশ্বরের বিশুদ্ধ ভাব অনুভূত হইলে, আত্মাতে এক পবিত্র আনন্দরসের সঞ্চার হইয়া থাকে। বিষয়ের সংস্পর্শে মনেরই সুখ লাভ হয়, তাহাতে আত্মার পরিতোষ হয় না। আত্মার যে আনন্দ, সেই মঙ্গলস্বরূপের আবির্ভাবই তাহার কারণ। সেই আনন্দ-স্বরূপের প্রসন্ন মূর্ত্তিই সে আনন্দের জননী। এই ভূমানন্দের সঙ্গে সঙ্গে সেই মহান্ পুরুষের নিকট সম্বন্ধ অনুভূত হয় এবং তাঁহাকে প্রত্যক্ষবৎ প্রতীতি করা হয়। কিন্তু এই উজ্জ্বল পবিত্র ব্রহ্মানন্দ যে কি আনন্দ তাহা প্রতি জনের পরীক্ষার কথা; স্বীয় স্বীয় আত্মাতে ইহার পরীক্ষা ব্যতীত কাহারও বোধগম্য হইবার সম্ভাবনা নাই। ব্রহ্মানন্দ যে কি মহান্ আনন্দ, তাহা বাক্যেতেও ব্যক্ত হয় না এবং উপদেশ দ্বারাও বুঝান যায় না। কিন্তু ইহা নিশ্চয় যে যাহারা মনুষ্য জন্ম ধারণ করিয়াছে, তাহারা সকলেই সমান রূপে সেই আনন্দ-রস পানে অধিকারী। ঈশ্বর সকলেরই সাধারণ সমৃদ্ধি এবং তিনি প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধন। সকল অবস্থার লোকেই জগৎ-পিতার নিকট গমন করিতে পারে এবং সকল অবস্থার লোকেই তাঁহার পবিত্র সহবাস লাভে অধিকারী। আত্মম্পৃহারূপ স্বর্গীয় অগ্নি প্রচ্ছন্ন ভাবে বা প্রজ্জ্বলিত রূপে সকলেতেই আছে। কিন্তু এমন আশ্চর্য্য অগ্নির উদ্দীপন হয় না বলিয়া এক্ষণে উহা নির্ব্বাণপ্রায় হইয়া যাইতেছে। ঈশ্বরের এক অমূল্য অতুল্য দান আমরা তুচ্ছ করিতেছি। উর্দ্ধ্ববাহুর হস্তের ন্যায় আমাদের আত্মাও অসাড় হইয়া যাইতেছে। এ দেশের এহ্মণে যে প্রকার অবস্থা হইয়াছে, তাহাতে যে ঈশ্বরের ভাব কিছুমাত্র পরিস্ফুট হয়, ইহাই আশ্চর্য্য। বাল্যকালে কেবল অপরা বিদ্যার শিক্ষাতেই মন এমনি অহরহঃ নিমগ্ন থাকে, যৌবন কালে বিষয় চেষ্টাতেই এমনি বিব্রত থাকিতে হয়, বৃদ্ধ বয়সে অনর্থ চিন্তাতেই কাল এমনি গত হয়, যে ঈশ্বরতত্ত্ব সমালোচনা করিবার অবকাশও থাকে না—স্পৃহাও হয় না। ইহাতেও যে তিনি কখন কখন আমাদের আত্মাতে তাঁহার মহান্ ভাবের উদ্দীপন করেন, ইহা কেবুল তাঁহারই অসামান্য করুণার নিদর্শন। যদিও আমরা বিষয় চিন্তা হইতে নিশ্চিন্ত হইয়া ঈশ্বরে চিত্তার্পণ করিবার সময় পাই না, যদিও আমরা বিক্ষিপ্তচিত্ত হইয়া ঈশ্বর হইতে সততই দূরে ভ্রমণ করি, তথাপি যে তিনি এক এক বার আমাদের নিকটে আপনাকে প্রকাশ করিয়া বিমলানন্দ বিধান করেন, ইহাতে কেবল তাঁহার স্নেহ-দৃষ্টি ও প্রীতি দৃষ্টি প্রকাশ পাইতে থাকে। যদিও সেই পবিত্র আনন্দ তড়িতের ন্যায় চঞ্চল হয়—যদিও তাহা নিমেষের সমান তিরোহিত হয়, কিন্তু তাহাতেই বা কি? সেই যে চকিতের ন্যায় আনন্দ তাহার সহিত কোন প্রকার বিষয়ানন্দই সমযোগ্য হয় না।

এই ব্রহ্মানন্দ উপভোগ করিবার যাঁহাদিগের অভিলাষ হয়, তাঁহাদের কি রূপ আচরণ করা আবশ্যক? আপনাকে পবিত্র করা পবিত্রস্বরূপের সহবাস জনিত আনন্দ লাভ। করিবার প্রথম পথ। পাপ হইতে বিরত থাকা অপাপবিদ্ধ পরম পুরুষের প্রসন্নতা লাভের একমাত্র উপায়। যেমন শরীরের বিকার রোগ, সেই রূপ মনের বিকার পাপ। আত্ম-প্রসাদই মনের সুস্থতা, আত্ম-গ্লানিই মনের বিকৃতাবস্থা। শরীর সুস্থ না থাকিলে যেমন মন সুস্থ থাকে না, সেই রূপ মন প্রকৃতিস্থ না থাকিলে আত্মাও সুস্থতা লাভ করিতে পারে না। আমাদের আত্মা যদি অসুস্থ ও মলিন রহিল, তবে যিনি আমাদের আশার শেষ স্থল, প্রীতির পরমাস্পদ, তৃপ্তির একই তুমি, তাঁহাকে লাভ করিয়া আমরা সেই পরিশুদ্ধ আনন্দের আস্বাদ কি প্রকারে পাইতে পারি? তাহাতে সে আনন্দ উপভোগের প্রার্থনাও জন্মে না। পাপী ও পুণ্যাত্মা পরম্পর এত ভিন্ন, যেমন রোগী ও সুস্থ পুরুষ। বিকারী রোগী যেমন ক্রমিক জল পান করিয়াও পরিতোষ পায় না, সেই রূপ পাপী ব্যক্তি সম্ভোগসলিলে অনবরত বিলাস করিয়াও পরিতৃপ্ত হয় না। পাপেতে যতই লিপ্ত থাকা যায়, পাপ আপন অনুচরকে ততই আকর্যণ করিতে থাকে। পাপের সহিত বিশেষ রূপে প্রণয় বন্ধন হইলে, আর তাহার মলিনত্ব দেখা যায় না। পাপপঙ্কে নিমগ্ন থাকাই এখানকার নরক ভোগ। পাপীদিগের নিকটে ঈশ্বর উগ্র মূর্ত্তি ধারণ করেন—পাপীর পক্ষে তিনি মহদ্ভয়ং বজমুদ্যতং— ঈশ্বরের অপরাধী অসৎ সন্তান তাঁহার প্রেরিত দণ্ড ভোগ করিয়া তাঁহার পিতৃস্নেহ উপলব্ধি করিতে পারে না। কিন্তু তাঁহার দণ্ড স্নেহ সমন্বিত। তিনি আমাদিগকে আপন ক্রোড়ে আকর্ষণ করিবার জন্যই দণ্ড বিধান করেন। পাপের উপযুক্ত দণ্ড পাইয়া আমরা পাপ হইতে বিরত থাকি—ক্ষীণপাপ হইয়া তাঁহার পবিত্র সহবাসের প্রার্থনা করি এবং তাঁহাকে লাভ করিয়া নির্ম্মলানন্দ উপভোগ করি, ইহাই তাঁহার অভিপ্রায়।

ঈশ্বরকে একবার লাভ করিতে পারিলে তাঁহাকে রক্ষা করিবার আকিঞ্চন সর্ব্বদাই জাগ্রৎ থাকে। কিন্তু সেই অমূল্য ধন রক্ষা করিবার উপায় কি? মনকে সুস্থ এবং, আত্মাকে সুস্থ রাখাই তাহার উপায়। সুনিশ্চল ধর্ম্মানুষ্ঠানে আপনাকে পবিত্র রাখাই তাহার উপায়। মধুস্বরূপ ধর্ম্ম যে কেবল পৃথিবীতে কল্যাণ উৎপাদন করেন, এমত নহে; ঈশ্বরের সন্নিধান প্রাপ্ত হইবার জন্যও ধর্ম্ম আমাদের সহায়। ধর্ম্মই ব্রহ্মধামের সোপানস্বরূপ। ধর্ম্মকে রক্ষা করিলে ধর্ম্ম আমাদিগকে ইহকালে রক্ষা করেন এবং আমাদের যথার্থ ধামে লইয়া যান। আমরা পাপ হইতে যত দূরে থাকি, পুণ্যের যত অনুষ্ঠান করি, ঈশ্বরস্পহার ততই উদ্দীপন হয়। ঈশ্বর যখন সেই মহতী স্পৃহাকে তৃপ্ত করেন, যখন তিনি তাঁহার সন্তাপ-হারিণী মূর্ত্তি প্রকাশ করেন, তখনই আমরা ভূমানন্দ লাভ করিয়া কৃতার্থ হই; তখনই আমরা জীবনের পূর্ণ সুখ ভোগ করি। সেই আনন্দ যে কেবল মুহ‍ুর্ত্ত কালের নিমিত্ত, তাহা নহে—সে আনন্দের যে একই প্রকার ভাব, তাহাও নহে। সেই আনন্দের ক্রমিকই উৎকর্ষ সাধন হইতে থাকে। স্বর্গ হইতে স্বর্গ লাভ; সুখ হইতে কল্যাণকর সুখের আস্বাদ গ্রহণ হইতে থাকে। মনুষ্যের সকল বিষয়েই হয় উন্নতি, নয় দুর্গতি। মনুষ্যের জ্ঞান ক্রমিক উন্নত হয়,—মনুষ্যের ধর্ম্ম ক্রমশঃ সবল হয়—মনুষ্যের মঙ্গল ভাব ক্রমে প্রশস্ত হইতে থাকে। আত্মারও উন্নতি হইতেছে। ঈশ্বরের সহিত আত্মার ক্রমিক নিকট সম্বন্ধ হইতে থাকে। ঈশ্বরের নিকটবর্ত্তী হওয়াই আত্মার প্রখর আশা। সেই সত্য পুরুষ এই মহতী আশাকে এখানেই পূর্ণ করিতেছেন। আত্মার সুস্থাবস্থাতে তাহার স্ফ‌ুর্ত্তি ও প্রভা দিন দিন বিবৃদ্ধ হয়। প্রতি সূর্য্যের উদয়ান্তের সঙ্গে সঙ্গে মেদিনীও যেমন নূতন নূতন বেশ ধারণ করে, আত্মাও সেই রূপ নূতন নূতন ভাবে বিরাজ করিতে থাকে। মন ও আত্মা যতই পবিত্র হয় ব্রহ্মানন্দ ততই দীপ্তি পায়। এখানে থাকিয়া ঈশ্বরের সঙ্গে যে সম্বন্ধ নিবদ্ধ করা হয়, অনন্ত কালেও তাহা ক্রটিত হইবার নহে যিনি এক বার আপনাকে উজ্জ্বল রূপে প্রকাশ করিয়াছেন, তিনি আমাদের জ্ঞাননেত্র হইতে আর কখনই অন্তরিত হইবেন না। এই আমাদের স্পৃহা এই আমাদের আশা। চন্দ্র যদিও মলিন হয়—সূর্য্য যদিও নিস্তেজ হয়—নক্ষত্রসকল যদিও নির্ব্বাণ হয়, তথাপি আমাদের আত্মার কখন বিনাশ হইবে না। ঈশ্বর আমাদিগকে তাঁহাকে পাইবার প্রখর আশা দিয়া কদাপি নিরাশ করিবেন না।

পাপের সহিত লিপ্ত থাকিলে একে এখানে যন্ত্রণা, তাহাতে আবার ঈশ্বর হইতে বিচ্যুতি। আমরা যেন পাপ হইতে সর্ব্বদাই নিবৃত্ত থাকি; পাপকে বিষবৎ পরিত্যাগ করি; পাপচিন্তা, পাপালপ, পাপানুষ্ঠান, এই তিন প্রকার পাপ হইতে যেন প্রাণপণে দূরে থাকি। যদিও কখন পাপ-প্রলোভনে আকৃষ্ট অথবা মুগ্ধ হই, তবে ঈশ্বরের নিকটে অকৃত্রিম অনুশোচনা করিয়া যেন তাহা হইতে বিরত হই। অনুতাপ—অকৃত্রিম অনুতাপই পাপের প্রায়শ্চিত্ত।

ঈশ্বর কেবল ন্যায়বান্ রাজা নছেন, তিনি আমাদের করুণময় পিতা, আমাদের মঙ্গল সাধনই তাঁহার উদ্দেশ্য। আমরা অতি ক্ষীণস্বভাব; আমাদের এক বারও ধর্মপথ হইতে পদ স্থলিত হইবে না, এমন কথনই সম্ভব হয় না। আমরা যদি এক বার পতিত হইয়া সেই পতিত-পাবনের প্রসাদ হইতে এক কালে বঞ্চিত হই, তবে আমাদের উপায় কি—তবে আমাদের নিস্তার কোথায়! যখন পিতার নিকটে ক্রন্দন করিলে তিনি প্রসন্ন হইয়া আমাদের অপরাধ মার্জ্জনা করেন, যখন সাধু ব্যক্তির নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করিলে তিনি প্রশস্ত চিত্তে ক্ষমা বিতরণ করেন; তখন যিনি আমাদের পরম পিতা—যিনি পূর্ণ-মঙ্গল ও করুণাময় পাতা, তিনি কি অনুতাপিত হৃদয়কে কখনই শীতল করিবেন না। তিনি কি তাহার পতিত সন্তানের অকৃত্রিম ভাব দেখিলে ক্ষমা বিতরণে বিরত হইবেন? কখনই না। পরমেশ্বর যেমন রোগ শান্তির জন্য ঔষধের সৃজন করিয়াছেন, সেই প্রকার পাপের প্রতীকারের জন্য বিবিধ উপায় করিয়া দিয়াছেন। রোগী ব্যক্তি রোগ হইতে মুক্ত হইলেই যেমন আপনা আপনি জানিতে পারে, পাপীর ভাবও সেই প্রকার। যখন মন পাপেতে আসক্ত ও পতিত হয়, তখন তাহা আপনিই বুঝা যায় এবং যখন সে সেই পাপ হইতে পরিত্রাণ পায়, তখনও সহজে বুঝা যায় এবং তাহা বুঝিবার জন্য অন্যের সহিত মন্ত্রণা আবশ্যক হয় না। আত্ম-গ্লানি মনের রোগের লক্ষণ—আত্ম—প্রসাদই তাহার সুস্থতার লক্ষণ।

মনুষ্য অপূর্ণ বস্তু —অতি ক্ষুদ্র জীব। মনুষ্য এক বারেই নিষ্পাপ হইবে, এমন কখনই সম্ভব হয় না। ঈশ্বরই এক মাত্র শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ। কিন্তু ঈশ্বর মনুষ্যকে যে প্রকার বল দিয়াছেন, যে প্রকার কর্ত্তৃত্ব ভার দিয়াছেন, তাহাতে তাহার কিছুরই অনির্ব্বৃতি নাই। যাহাতে ধর্ম্মের পথে মনুষ্য উন্নতমস্তক থাকিতে পারে, তিনি তাহাকে এমত অতুল শক্তি দিয়াছেন। যাহাতে সে আপন প্রবৃত্তি ও অবস্থার সহিত সংগ্রাম করিয়া পুণ্যপদবীতে আরোহণ করিতে পারে, তিনি তাহাকে এমত অতুল শক্তি প্রদান করিয়াছেন। যাহাতে পশুভাব মনুষ্যের উপরে প্রভুত্ব না পায়—যাহাতে তাহার মহদ্ভাব সকল উন্নত ও স্ফূর্ত্তি যুক্ত হয়, তিনি এ প্রকার নানা উপায় বিধান করিয়াছেন। আবার তিনি মধুস্বরূপ ধর্ম্ম দিয়াই ক্ষান্ত হন নাই, তিনি আপনাকে আমাদের নিকটে প্রকাশ রাখিয়া আমাদের আত্মাকে সহস্রগুণ বলে সবল করিয়াছেন। পাপ হইতে মুক্ত হইলে ঈশ্বরের পবিত্র সহবাস উপার্জন করা যায়, আবার ঈশ্বরের সহবাস লাভ করিলে আত্মা পবিত্র হয় এবং পাপের আসক্তিও তেমনি ক্ষীণ হইতে থাকে। পাপ। হইতে মুক্ত হওয়া প্রথমে আমাদের যত্নাধীন, পরে আমরা ঈশ্বরের প্রসাদ ও আশ্রয় পাইলে পাপ আরো দূরে পলায়ন করে। কিন্তু একে আমরা দুর্ব্বল, তাহাতে আবার অন্তরের কত শত্রু এবং বাহিরের কত শত্রু আমাদিগকে আক্রমণ করিতেছে, কায়মনোবাক্যে চেষ্টা ব্যতীত মনের পবিত্রতা ও আত্মার পবিত্রতা সম্পাদন করিতে কখনই সমর্থ হই না। যাহাদের ধর্ম্ম সরল আছে, ঈশ্বরম্পৃহা প্রবল আছে এবং আত্মা প্রকৃতিস্থ আছে, তাহারাও যখন মধ্যে মধ্যে ঈশ্বরের পথ হইতে স্খলিতপদ হয়; তথন তাহাদের কি দুর্দ্দশা, যাহারা স্বীয় কুপ্রবৃত্তির হস্তে আপনাকে অর্পণ করিয়া সংসার অরণ্যে বিচরণ করিতেছে। তাহাদের চিত্তভুজঙ্গ নিরন্তর কুটিলগামী হইয়া আপনার ও জন-সমাজের কত অনর্থই উৎপাদন করিতে থাকে।

ধর্ম্ম-রত্ন লাভ করিবার আন্তরিক ইচ্ছা চাই। আন্তরিক ইচ্ছা থাকিলে দুর্ব্বলতার অনেক পরিহার হয়। আমাদের অসৎ ইচ্ছা এক, আর দুর্ব্বলতা এক, দুই পৃথক্ বিষয়। যাহাদের সাধু ইচ্ছা, সাধু ব্যবহার, তাহাদের দুর্ব্বলতা জনিত পতন এক প্রকার; আর যাহাদের লোক রক্ষাই সর্ব্বস্ব এবং কপট ব্যবহারই পৃথিবীতে চলিবার উপায়, তাহাদের পাপ-প্রকাশ-জনিত পতন অন্য প্রকার। সাধু ব্যক্তি এক বার পতিত হইলে ঈশ্বরের প্রসাদে আবার উদ্ধার হইয়া আত্ম-প্রসাদ লাভ করেন। তাঁহার পাপজনিত অনুশোচনা এবং অনুশোচনা-জনিত ঈশ্বরের প্রকাশ, এই উভয় প্রকারেই তিনি পাপ হইতে মুক্ত হয়েন। পাপ হইতে মুক্ত হইলে ঈশ্বরের সহিত সহবাসের প্রার্থনা জন্মে, সেই প্রার্থনার সঙ্গে সঙ্গে আত্মস্পৃহা সমধিক উজ্জ্বল হয় এবং তৎপরে ঈশ্বর স্বীয় সন্তাপহারিণী মূর্ত্তি প্রকাশ করিয়া সকল সন্তাপ হরণ করেন। ঈশ্বরম্পৃহা সঞ্চারের পূর্ব্বে এই উপদেশ; পাপের সহিত যেন সংস্পর্শ না হয়। ঈশ্বর-স্পৃহার উদ্দীপন হইলে এই উপদেশ; পা পর সহিত যেন সংস্পর্শ না হয় এবং ঈশ্বরের প্রকাশ কালেও এই উপদেশ; পাপের সহিত যেন সংস্পর্শ না হয়। এই প্রকার পাপ হইতে দূরে থাকিবার যাহার আন্তরিক ইচ্ছা, ঈশ্বর তাহার সহায়। ঈশ্বরই দুর্ব্বলের বল—ঈশ্বরই পাপীর পরিত্রাতা।


[nextpage title=”চতুর্থ উপদেশ-ঈশ্বর সত্য-স্বরূপ”]

সত্য কাহাকে বলে? সত্যের প্রতিরূপ বস্তু কোথায়? কোন্ বিষয় এমন আছে যাহাকে সত্য বলা যাইতে পারে? সত্য কি বস্তু ও সত্যের স্বরূপ ও লক্ষণ কি? এই অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করিলে প্রতীতি হইবে যে ঈশ্বর যিনি তিনিই সত্য, এবং সত্যই ঈশ্বর।

ঈশ্বর হইতে সত্য ভিন্ন নহে, এবং সত্য হইতে ঈশ্বর ভিন্ন নহেন। ঈশ্বরেতেই সত্য শব্দ সম্পূর্ণ সংলগ্ন হয়। তিনি ভিন্ন আর কিছুতেই হয় না। জড় বস্তুকে কি সত্য বলা যাইতে পারে? যখন দেখি জড় বস্তুর চেতন নাই। জড় বস্তু মৃত বস্তু; জড় বস্তু আপনাকে আপনি জানে না। তখন তাহাকে সত্যের যোগ্য বস্তু বলিয়া বোধ হয় না। সত্যের যে ভাব, তাহার সঙ্গে চেতন-শূন্য মৃত বস্তুর মিল হয় না। আমরা জীবিত মনুষ্যকে যে প্রকার সত্য মনে করি, তাহার মৃত শরীরকেও কি সেই প্রকার জ্ঞান করিয়া থাকি? এই যে সন্মুখে অচল অটল স্তব্ধ মৃতুর রূপ প্রাচীর দেখা যাইতেছে, ইহা কি সত্য? না আমি যে প্রাচীরকে দেখিতেছি, সেই সত্য পদার্থ? জড় যদি সত্য না হয়, তবে কি আমাদের জীবাত্মাই সত্য? জড় হইতে জীবাত্মা সত্য, কেন না জীবাত্মার জ্ঞান আছে, চেতন আছে। কিন্তু জীবাত্মার জ্ঞানও আছে, অজ্ঞানও আছে—জীবাত্মা কতক দেখিতেছে, কতক দেখিতে পায় না—জীবাত্মা কখন জাগ্রৎ, কখন নিদ্রিত -জীবাত্মা এক সময়ে ছিল না এবং যে পূর্ণ-পুরুষের আশ্রয়ে থাকিয়া জীবিত রহিয়াছে, তাঁহার ইচ্ছা হইলে পরেও থাকিবেক না। জীবাত্মার সকল বিষয়েরই সীমা আছে,পরিমাণ আছে। এই প্রকার সীমাবিশিষ্ট পরিমিত বস্তু যে আমাদের জীবাত্মা, তাহাকে যদি সত্য বলা যাইতে পারে, তবে পূর্ণ জ্ঞান ঈশ্বর কেমন সত্য! যিনি সর্ব্বজ্ঞ—যিনি আন্তর্যামী—যিনি ভূত ভবিষ্যৎ বর্ত্তমান সকল কালের প্রতিই সমান রূপ দৃষ্টি করিতেছেন; সেই সত্য পুরুষের তুলনায় আমারদের এই জীবাত্মাকেও সত্য বসিয়া বোধ হয় না। ঈশ্বর যিনি তিনিই সত্য—সত্য যিনি তিনিই ঈশ্বর।

কিন্তু সত্য বস্তু—জ্ঞান বস্তু, প্রাণবিশিষ্ট কি প্রাণশূন্য, জীবিত কি মৃত? পূর্ণ-জ্ঞান-স্বরূপের জ্ঞানই প্রাণ। তিনি সত্যস্বরূপ- তিনি পূর্ণ-জ্ঞান; অথচ তিনি প্রাণ-শূন্য মৃত বস্তু; এ দুই পরস্পর বিরুদ্ধ বাক্য। যিনি সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, তাঁহার প্রাণ জগতের প্রাণ। তিনি জীবিত বস্তু—মৃত বস্তু নহেন। তাঁহার জীবন এক সময় আরম্ভও হয় নাই, তাঁহার জীবনের কখন শেষও হইবেক না, তিনি অমৃত। তাঁহার প্রাণের হ্রাস নাই, বৃদ্ধি নাই; ব্যয় নাই, ক্ষয় নাই—তিনি অমৃত। তিনি জ্ঞানস্বরূপ, চেতনাবান্, স্বপ্রকাশ। তিনি মৃত্যুর বিপরীত বস্তু—তিনি প্রাণ।

সত্য যে বস্তু, তাহা কি কিছুকাল স্থায়ী, কি অনন্তকাল স্থায়ী? অন্তবৎ বস্তু আর অনন্ত বস্তু, ইহার মধ্যে কাহাকে সত্য বলা যায়? আমরা ঐন্দ্রজালিক ব্যাপারে যে সকল অদ্ভুত ব্যাপার প্রত্যক্ষ করি, তাহাকে মিথ্যা কেন বলি। তাহার এক প্রধান হেতু এই যে তাহা অতি অল্প কাল স্থায়ী। অন্তবৎ বস্তুর সঙ্গে সত্য ভাবের সম্পূর্ণ মিলন হয় না। আমরা চতুর্দ্দিকে যে সমস্ত বস্তু বিরাজমান দেখিতেছি, সে সকল যদিও সৃষ্টিকাল হইতে বর্ত্তমান রহিয়াছে; তথাপি সৃষ্টির পূর্ব্বে তাহার কিছুই ছিল না এবং ঈশ্বরের ইচ্ছা হইলে পরেও থাকিবেক না; এই জন্য এ সমুদয়কে ঠিক সত্য বলা যায় না। যিনি অনন্ত—যিনি নিত্য—যিনি দেশ কালের অতীত পদার্থ— যিনি পূর্ব্বেও ছিলেন, অদ্যও আছেন, পরেও থাকিবেন; তিনিই সত্য। সত্যের ভাব কেবল সেই অনন্ত স্বরূপেতেই আছে। জড় বস্তু আদ্যন্তবৎ, আমাদের জীবাত্মাও আদ্যন্তবৎ, এই জন্য ইহারা তেমন সত্য নহে।

যাহা কিছু সত্য বলা যায়, তাহা নার সঙ্গে যোগ থাকিলে হইবেক না। এত কাল আছে, এত কাল নাই— সত্যের স্বরূপ এ প্রকার নয়। এতটুকু দেশে আছে, এত টুকু দেশে নাই—এ প্রকার বস্তু সত্য নহে। কতক জ্ঞান, কতক অন—কতক সদ্ভাব কতক অসদ্ভাব—কতক শক্তি কতক ত্রুটি; এপ্রকার জ্ঞান-বস্তুও সত্য নহে। অভাববিশিষ্ট পদার্থ প্রয়োগ হইলে সৎ শব্দের অর্থই হয় না। পূর্ণ বস্তুই সত্য। এই হেতু ঈশ্বর ভিন্ন সত্যের সঙ্গে আর কোন বস্তুরই মিল পাওয়া যায় না। কতক আছে, কতক নাই—আছে আর নাই—এই দুই একত্র হইলে, সকল বস্তু সীমাবদ্ধ হয়। এ বস্তু এক সময় আছে, এক সময় ছিল না; ইহা বলিলেই তাহার কালেতে সীমা হইল। এ ব্যক্তির কতক জ্ঞান, কতক অজ্ঞান; ইহা বলিলে তাহার জ্ঞানেতে সীমা হইল। যিনি দেশেতে অনন্ত, কালেতে অনন্ত, মঙ্গল ভাবে অনন্ত—যাঁহার অনন্ত জ্ঞান, অনন্ত প্রাণ, তিনিই একমাত্র সত্য পদার্থ। তিনিই সত্যের বিষয়—সত্যের আয়তন—সত্যের ভূমি। এই এক সত্য শব্দ তাঁহার সকল তত্ত্বের সমষ্টি-স্থান। সত্য ভাব পরিস্ফুটিত হইলে তাঁহার সকল স্বরূপ প্রকশ পায়। সত্যের মধ্যে জ্ঞান—প্রাণ— অনন্ত ভাব অন্তর্ভুত রহিয়াছে। তিনি সত্য স্বরূপ—তাঁহার কতক সাধু ভাব, কতক অসাধু ভাব; কতক মঙ্গল ভাব, কতক অমঙ্গল ভাব; এমত নহে; তিনি পরিপূর্ণ মঙ্গল স্বরূপ। বিনি নির্দ্দোষ, নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক, পবিত্র-স্বরূপ, তাঁহার অপেক্ষা, সুন্দর বস্তু আর কি আছে। তিনিই “সত্যং শিবং সুন্দরং”।

সত্য শব্দ ঈশ্বরেতেই সম্পূর্ণ সংলগ্ন হয়। সত্যের সঙ্গে অন্যান্য বস্তুর কোন বিষয়ে মিল দেখিয়া তাহাকে সত্য। বলি। জড় বস্তুর অস্তিত্ব এবং শক্তিমাত্র দেখিয়া তাহাকে সত্য বলি। জীবাত্মার জ্ঞান ও চেতন শক্তি দেখিয়া জীবাত্মাকে সত্য বলি। কিন্তু এসমুদয় বস্তুরই আদি আছে, অন্ত আছে। দেশ, কাল, গুণ, সকল বিষয়েই জীবাত্মার সীমা করা যায়। কিন্তু যিনি অনাদনন্ত পূর্ণ-জ্ঞান—পূর্ণ-মঙ্গল তিনিই সত্য। এই সমুদয় জগৎ সংসারকে আপেক্ষিক সত্য বলা যাইতে পারে,কিন্তু ঈশ্বরই কুটস্থ সত্য। এ সমুদয় আপেক্ষিক সত্য, কেন না অল্পকাল স্থায়ী বস্তু অপেক্ষা দীর্ঘ কাল স্থায়ী বস্তু সত্য; জড় বস্তু অপেক্ষা জ্ঞান বস্তু সত্য; মৃত বস্তু অপেক্ষা সচেতন বস্তু সত্য। কিন্তু পারমার্থিক সত্য পদার্থ কেবল তিনিই। এই বলিয়াই যে জগৎসংসার ভ্রান্তি-মূলক মিথ্যা, তাহা নহে। এসমুদায় মায়াও নহে, স্বপ্নও নহে। যেহেতু ইহার মূল যিনি, তিনি সত্য। এই জগৎ সংসার সত্য-মূলক। আমারদিগের বুদ্ধিতে জগতের অস্তিত্ব, জীবাত্মার অস্তিত্ব, এবং পরমাত্মার অস্তিত্ব প্রকাশ পাইতেছে, ইহার মধ্যে যদি কোন এক অস্তিত্বকে স্বপ্নের প্রতীয়মান বস্তুবৎ মিথ্যা বলা হয়। তবে অন্য অন্য সকল অস্তিত্বকেই তাহার ন্যায় মিথ্যা বলিতে হয়। মূল সত্য হইতে নিঃসৃত জগৎকে মিথ্যা না বলিয়া আপেক্ষিক সত্য বলা উচিত। এই সমুদয় জগৎ সকল সময়েতেই যে বিদ্যমান আছে, তাহা নহে—এক সময়ে ছিল না; যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হয়, তবে এক সময়ে থাকিবেক না। যাঁহার অস্তিত্ব সকল অস্তিত্বের মূলীভূত, তিনিই পরম সত্য নিত্য পদার্থ। আমরা এখানে যে কোন পদার্থ দেখিতে পাই, সকলই আশ্রিত পরিমিত অন্তবৎ পদার্থ। কিন্তু যিনি সর্ব্বশ্রয় অপরিমেয় অনন্ত পদার্থ, তিনিই সত্য। সকল সৃষ্ট বস্তুরই কোন না কোন বিষয়ে অভাব আছে, কিন্তু যাঁহার অভাব নাই, যিনি পরিপূর্ণ, তিনিই পারমার্থিক সত্য বস্তু। ঈশ্বরের প্রতি লক্ষ্য করিয়াই সত্য বলা উচিত। এই এক শব্দে তাঁহার সকল তত্ত্বের উদ্বোধন হয়। সত্যের ভাব সকলেরই বুদ্ধি-ভূমিতে নিহিত আছে—সেই ভাব পরিস্ফুটিত হইলে দেখা যায় যে কেবল একমাত্র ঈশ্বরই সেই সত্য ভাবের বিষয়; ঈশ্বর ভিন্ন আর কোথাও সত্য শব্দ সংলগ্ন হয় না—সত্যের পর্যাপ্তি হয়। আমরা সত্যের যে সকল লক্ষণ প্রাপ্ত হইতেছি, তাহার সমুদয় লক্ষণ কেবল ঈশ্বরেতেই প্রাপ্ত হইতেছি।

সত্য যে বস্তু, তাহা কখন জড়বৎ মৃত বস্তু নহে; অতএব অমৃত চেতা ঈশ্বরই সত্য। সত্য যে বস্তু, তাহা কোন সময়ে আছে, কোন সময়ে নাই, এমত নহে; অতএব নিত্য পরমেশ্বরই সত্য। সত্য যে বস্তু তাহার উপরে কালের অধিকার নাই; কালেতে করিয়া তাহার ক্ষয় হয় না, তাহার পরিবর্ত্তন হয় না; অতএব অপরিবর্ত্তনীয় ধ্রুব ঈশ্বরই সত্য। সত্যের উপরে দেশের অধিকার নাই, দেশ তাঁহাকে সীমাবদ্ধ করিতে পারে না; অতএব সর্ব্বব্যাপী তাপরিসীম ঈশ্বরই সত্য। সত্য যে বস্তু, তাহা কতক ভাল কতক মন্দ,তাহার কতক সদ্ভাব কতক অসদ্ভাব, এপ্রকার নহে; অতএব পূর্ণ-মঙ্গল-ভাব পরমেশ্বরই সত্য। সত্য যে বস্তু, তাহা আশ্রিত ও পরতন্ত্র বস্তু নহে, তাহ। কাহারও ইচ্ছার অধীন নহে; তাহার জনকও নাই, নিয়স্তাও নাই; অতএব স্বপ্রকাশস্বরূপ স্বতন্ত্র পরমেশ্বরই সত্য। সত্যের সঙ্গে অভাবের সঙ্গে যোগ নাই; অতএব পরিপূর্ণ ঈশ্বরই সত্য। সত্যের যে মহান্ ভাব আমারদের বুদ্ধিতে নিহিত আছে; তাহা সেই পূর্ণ পুরুষ ভিন্ন আর কোথাও চরিতার্থ হয় না। আমাদের বুদ্ধিতে যে ধর্ম্মের ভাব আছে, তাহার মত যেমন ধার্ম্মিক পাওয়া যায় না; সেই প্রকার আমারদের সত্য ভাবের সহিত দৃশ্যমান কোন বস্তুরই ঐক্য দেখা যায় না। ঈশ্বরের লক্ষণ এবং সত্যের লক্ষণে সম্পর্ণ ঐক্য দেখিয়া ঈশ্বরকেই সত্য বলি। তিনি “সত্যজ্যোতীরসোহমৃতং।”


ব্রহ্মেতে অনুরাগ ভিন্ন ব্রহ্মদর্শন নিষ্ফল। অনুরাগের আলোকে ঈশ্বর আমারদিগের নিকটে যদ্রূপ প্রকাশিত হয়েন, এমন আর কিছুতেই হন না। অনুরাগের এরূপ প্রভা যে যে জ্ঞান প্রচ্ছন্ন ভাবে থাকে, তাহা সমুজ্জ্বলিত হয়—যে সত্য ছায়ার ন্যায় মনে হয়, তাহা প্রদীপ্ত হয়— যে ধর্ম্ম আয়াস সাধ্য অতি কঠোর, তাহাও মধুস্বরূপ প্রতীয়মান হয়। ঈশ্বরই আমাদের সেই অনুরাগের প্রেরয়িতা এবং তিনি নিজেই তাহার বিষয়। তাঁহার জন্য ক্ষুধা তৃষ্ণা হইলে তিনি স্বয়ং আমাদের অন্নপান হয়েন। তাঁহার প্রতি অনুরাগ দৃঢ়তর হওয়া আমারদের সমুদায় ধর্ম্ম কার্য্যের অব্যর্থ ফল; আমরা বিষয়াকর্ষণকে বল-পূর্ব্বক নিরস্ত করিয়া যে অপূর্ব্ব ধর্মশিক্ষা লাভ করি, সে শিক্ষা কেবল ইহারই জন্য যে আমরা সেই সর্ব্বাতীত পরমেশ্বরের সহবাস লাভের যোগ্য হই। আমরা আমাদিগের দুর্ব্বিনীত প্রকৃতিকে বশীভূত করিয়া যে ধর্ম্মবল উপার্জন করি, তাহাতে কেবল আমাদের ঈশ্বরের পথে যাইবার শিক্ষা হয়। আমরা সে মুক্তি লাভের জন্য অনন্ত ভাবী কালের প্রতি দৃষ্টি করিতেছি, ধর্ম্ম আমারদের এই জীবদ্দশাতেই সেই মুক্তির সোপান প্রদর্শন করিতেছেন।

ধর্ম্ম যেমন আমারদিগকে ব্রহ্মধামে লইয়া যান,সেই রূপ এই পৃথিবী-লোকেও ধর্ম্ম আমারদের মন্ত্রী ও সহায়। কি বিষয়ী ব্যক্তি কি ঈশ্বরানুরাগী; ধর্ম্ম সকলেরই সুহৃৎ ও রক্ষক। যাহারা কেবল বিষয়সুখকেই প্রার্থনা করে, ধর্ম্মপথে থাকিলেই তাহাদের মঙ্গল—এবং যাঁহারা ঈশ্বরকে প্রার্থনা করেন, তাঁহারাও ধর্ম্মকেই অবলম্বন করিয়া তাঁহাকে লাভ করিতে পারেন। এক দিকে শ্রেয়ঃ এক দিকে প্রেয়; এক দিকে সংসার, এক দিকে ঈশ্বর—এ দুয়েতেই সমান অনুরাগ হয় না। যাহাদের সংসারে অনুরাগ, তাহাদের ঈশ্বরে বিরাগ—যাহাদের ঈশ্বরে অনুরাগ তাহাদের সংসারে বিরাগ। গৃহত্যাগী হইয়া অরণ্যে বাস করাতেই যে বৈরাগ্য হয়, তাহা নহে। ঈশ্বরে অনুরাগই যথার্থ বৈরাগ্যপথ। ধর্মই সেই পথের প্রদর্শক। আমরা কুপ্রবৃত্তির উপরে ধর্ম্মকে যত বার জয়ী হইতে দিই—ধর্ম্মের সুতীব্র ভর্ৎসনাতে স্বার্থপরতার কুটিল মন্ত্রণাকে যতবার নিরস্ত করি; ততই আমরা বল পাই, ততই আমারদের শিক্ষা হয়—বিষয়ের প্রতিস্রোতে যাইবার জন্য ততই প্রস্তুত হই। বিষয়-বন্ধন হইতে মুক্ত হওয়াই আমারদের। মুক্তি। পাপ হইতে দূরে থাকিবার যে চেষ্টা, সেই চেষ্টাই আমারদের উৎকৃষ্ট শিক্ষা। ঈশ্বরে যে অটল অনুরাগ, সেই অনুরাগই আমারদের প্রকৃত বৈরাগ্য।

ঈশ্বরানুরাগের যে প্রকার স্বর্গীয় ভাব,—ধর্ম্মের যে প্রকার মাহাত্ম্য, তাহাতেই সুস্পষ্ট প্রতীতি হয় যে তাহা কেবল ইহ লোকের জন্য নহে। গর্ভস্থিত বালকের সুচারু অঙ্গসৌষ্ঠব ও কর্ম্মক্ষম ইন্দ্রিয় সকল দেখিলে যেমন তাহাকে চিরকাল গর্ভে থাকিবারই উপযুক্ত বোধ হয় না, কিন্তু এই কর্ম্মক্ষেত্র পৃথিবীর উপযুক্ত বলিয়া মনে হয়। সেইরূপ মনুষ্যের নিষ্কাম ধর্ম্মের অনুষ্ঠান—ঈশ্বরে নিস্বার্থ অনুরাগ দেখিয়া তাহাকে ভাবী কালের মহত্তর উচ্চতর অবস্থার উপযুক্ত বোধ হয়। এই সকল ভাব পৃথিবীর ভাব হইতে এত উচ্চতর, যে এখানে তাহাদের সম্যক্ চরিতার্থতা কখনই হয় না। বিষয়-সুখ অকাতরে বিসর্জন দেওয়া—পৃথিবীর খ্যাতি প্রতিপত্তিকে তুচ্ছ করা—কেবল এই পৃথিবীর জীবের পক্ষে কখনই সম্ভব হয় না।

যাহারা কেবল বিষয়-সুখের প্রতি লক্ষ্য করিয়া স্বর্গীয় ধর্ম্মকে প্রার্থনা করে, তাহাদের অতি নীচ লক্ষ্য। স্বোপর্জিত দুর্ল্লভ ধর্ম্ম-রত্নের বিনিময়ে ক্ষুদ্র বিষয়-সুখ কদাপি প্রার্থনীয় হইতে পারে না। ধর্ম্মের উপযুক্ত লক্ষ্য, ধর্ম্মের যোগ্য পুরস্কার, কেবল সেই ধর্ম্মাবহ একমাত্র পরমেশ্বর। ধর্ম্মপথ মধ্য পথ। ধর্ম্ম সংসার-বন্ধন রক্ষা করেল, ধর্ম্ম মোক্ষের সেতু হইয়া ঈশ্বরের নিকটে লইয়া যান। বিষয়সুখ ভোগের জন্য যে ধর্ম্ম, তাহা অতি নিকৃষ্ট—ঈশ্বরের জন্য যে ধর্ম্ম, তাহাই উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম। আমরা প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া যে ধর্ম্মকে উপার্জন ও রক্ষা করি; পার্থিব কোন বস্তু তাহার সম্যক্ লক্ষ্য কখনই হইতে পারে না। বিষয়-সুখের জন্য কে প্রাণ দিতে পারে? কিন্তু ধর্ম্মের জন্যই প্রাণ দেওয়া যায়। বিষয়-সুখকে যদি ধর্ম্মের পুরস্কার মনে করা যায়—স্বার্থপরতার চরিতার্থতা যদি ধর্ম্ম সাধনের উদ্দেশ্য হয়; তবে সে ধর্ম্ম রক্ষা করা বিষম দায়। বহু আয়াসে, বহু দিবসে, বহু কষ্টে, যদি সে ধর্ম্ম কিছু রক্ষা হয়; তবে পরম সৌভাগ্য। ধর্মকে যাহারা কেবল বিষয় উপভোগের উপায় করে, তাহারদের নিকটে ধর্ম্ম রক্ষার কত ব্যাঘাত, কত প্রতিবন্ধক। যখন ধর্ম্মের সঙ্গে সুখের সঙ্গে বিরোধ উপস্থিত হয়; তখন সেই সুখ বিসজন তাহাদের কি কষ্ট। ধর্ম্ম যখন গম্ভীরস্বরে ত্যাগের আদেশ প্রদান করে, তখন বিষয় ত্যাগ তাহাদের কি তক্ত বোধ হয়। তাহাদের লক্ষ্য কেবল সুখ, ধর্ম্ম কেবল তাহাদের উপায় মাত্র; এই হেতু ধর্ম্ম রক্ষা তাহাদের অতীব কষ্টদায়ক। ধর্ম্মের মূর্ত্তি তাহাদের নিকটে কখনই সৌন্দর্যময়ী হয় না, কিন্তু সর্ব্বদাই বিরস দেখায়। ধর্ম্মের পথ তাহারা কখনই সরল জ্ঞান করে না, কিন্তু কন্টকাবৃতই বোধ করিয়া থাকে।

এই জন্য ধর্ম্মের প্রাণ ঈশ্বরে অনুরাগ। ঈশ্বর-লাভের জন্যই ধর্ম্ম শ্রেষ্ঠ উপায়; বিষয়-সুখের জন্য তাহা অতি কনিষ্ঠ উপায়। ঈশ্বর যিনি মহীয়ান্, তাঁহাকে পাইবার জন্যই ধর্ম্ম আমাদের সহায়; বিষয় সুখ যে কণীয়ান্, ধর্ম্ম তাহার যোগ্য বস্তু হইতে পারে না। এক দিকে সংসার, এক দিকে ঈশ্বর, মধ্যে ধর্ম্ম। এ দিকের মঙ্গলের জন্যও ধর্ম্ম অবশ্যক; ঈশ্বরের দিকে যাইবার জন্যও ধর্ম্ম সহায়। যাহারা ধর্ম্মকে পরিত্যাগ করিয়া সাংসারিক সুখ ভোগে রত থাকে; এখানে তাহারদের কথা হইতেছে। এখানে মনুষ্যের বিষয়ে বলা যাইতেছে; পশুতুল্য লোকের বিষয় নহে। সংসারের প্রতি লক্ষ্য করিয়া যাহারা ধর্ম্ম উপার্জন করে, ধর্ম্ম তাহারদের উপরের শ্রেণীতে থাকে; ঈশ্বরের প্রতি যাহাদের লক্ষ্য থাকে, ধর্ম্ম তাহাদের আশ্রয় ভূমিস্বরূপ। ধর্ম্মের প্রথম পুরস্কার ঈশ্বরে অনুরাগ সঞ্চার হওয়া; তাহার শেষ পুরস্কার ঈশ্বরকে লাভ করা। ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ হইলে ধর্ম্মের পথ আপনা হইতে সহজ হইয়া যায়। যাহাদিগের পবিত্র হৃদয়ে সেই বিশুদ্ধ অনুরাগ প্রথমেই প্রদীপ্ত হইয়াছে, ধর্ম্ম শিক্ষা যে দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষা, তাহা তাহাদের সহজেই সম্পন্ন হয়। কিন্তু যাহাদের প্রথমেই ঈশ্বরে অনুরাগ অনুভব না হয়, ধর্ম্মই ক্রমে তাহাদের মনে সেই অনুরাগ উদ্দীপন করেন। স্বার্থপরতার বিপরীত ভাব ঈশ্বরে অনুরাগ—ধর্ম্ম মধ্যবর্ত্তী শিক্ষা গুরু।

ধর্ম্মেতে যাঁহারদিগের শ্রদ্ধা জন্মিয়াছে; ধর্ম্মের নৈসগিক সৌন্দর্য্য ও পাপের স্বাভাবিক মলিনত্ব যাঁহার প্রতীতি করিয়াছেন; তাঁহারা যে ঈশ্বরের পথেরই অভিমুখী, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। বিষয় ত্যাগ, বিষয় বিসর্জন, প্রথমে ধর্ম্মের উপদেশে এসকলের শিক্ষা হয়। ধর্ম্মের অনুরোধে যত টুকু ত্যাগ স্বীকার করিতে পারি—বিষয়ের যত প্রতিকুলগামী হই—ঈশ্বরের পথে ততই অগ্রসর হইতে থাকি; ঈশ্বরের নিকটে যাইবার জন্য ততই বল পাই। বিষয় হইতে মন যত আকৃষ্ট হয়, বিষয়ের অতীত পদার্থের প্রতি ততই ধাবমান হয়। এদিকে যে পরিমাণে বিরাগ উপস্থিত হয়, ঈশ্বরে অনুরাগ সেই পরিমাণে উজ্জ্বল হইতে থাকে। ঈশ্বরে অনুরাগ যেমন প্রবল হইতে থাকে, তেমনি ধর্ম্মবল আরো বৃদ্ধি হয়, বিষয়াকর্ষণ আরো ক্ষীণ হয়। অতএব প্রথমে যাঁহার ধর্ম্মের প্রতি, কর্ত্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধা হয়, ইহা নিশ্চয়, যে ঈশ্বর তাঁহার অনুরাগ শীঘ্রই তাঁহার মনে উদ্দীপন করেন। ঈশ্বর তো সর্ব্বত্রই তাঁহার ক্রোড় প্রসারিত করিয়া রাখিয়াছেন এবং প্রতিক্ষণেই আমারদিগকে আহ্বান করিতেছেন; আমরা তাঁহার সন্নিধানের উপযুক্ত হইলেই তিনি আমারদিগকে গ্রহণ করেন। তাঁহার নিকটে লইয়া যাইবার জন্য ধর্ম্মই প্রথমে আমাদের সহায় হয়েন।

বিষয়-সুখ যদি ধর্ম্মের লক্ষ্য হয়,তবে সে বিপরীত লক্ষ্য; সে লক্ষ্য সিদ্ধিতেও বিস্তর ব্যাঘাত। বিষয়-সুখ বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত হইয়াই ধর্ম্ম-পথে গমন করিতে হয়; আনুষঙ্গিক যদি বিষয়-মুখ রক্ষা পায়, তবে ভালই। ধর্ম্ম কিছু বিষয়-সুখের অনুচর নহে—কিন্তু ধর্মের অনুচর যদি বিষয়সুখ হয়, তবে তাহা অবশ্য সেব্য। আমরা আত্মসুখের জন্য ধর্ম্মকে প্রার্থনা করিলে সে কেবল স্বার্থপরতা মাত্র। স্বর্গের লোভে বা নরকের ভয়ে নিরাহারে দিন যাপন করাতে ধর্ম্ম হয় না। ধর্ম্মের ভাব নিঃস্বার্থ ভাব। বিষয়সুখ যে ধর্ম্মের অব্যর্থ পুরস্কার তাহা নহে; কিন্তু সুবিমল আত্ম-প্রসাদই ধর্ম্মের পুরস্কার,ঈশ্বর ধর্ম্মের শেষ পুরস্কার। ধর্ম্মের স্বর্গীয় জ্যোতির নিকটে স্বর্ণ রৌপ্য হীরকের পার্থিব জ্যোতি কোথায় থাকে? কেবল এক লক্ষ্যের দোষে ধর্ম্মকেও দূষিত মনে হয়। বিষয়-সুখই যাহার লক্ষ্য থাকে, সে পৃথিবীতে ধর্ম্মের হীনাবস্থা ও পাপের স্ফীতভাব দেথিয়া ঈশ্বরের অখণ্ড মঙ্গল স্বরূপেতেও দোষারোপ করিতে প্রবৃত্ত হয়। সে হয়তো এই মনে করে যে আমি সত্যের পথে ধর্মের পথে থাকিয়া কেবল লোকের নিকট হইতে নিষ্ঠুর আঘাত সহ্য করিতেছি; আর পাপী ব্যক্তি ধন মান প্রভুত্ব বর্দ্ধন করিয়া কেমন সুখে কাল যাপন করিতেছে অতএব ঈশ্বরের রাজ্যে কিছুই বিচার নাই। ধর্ম্মকে যাহার সুখের উপায়স্বরূপ জ্ঞান করে, তাহাদের মুখ হইতে এই রূপ অক্ষেপোক্তি অনেক সময় শ্রবণ করা যায়।

ধর্ম্ম যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া ঈশ্বরের পথে অগ্রসর হইতে হইলে ত্যাগ তো স্বীকার করিতেই হইবে—বিষয়-সুখ হইতে তো অনেক সময় পরিচ্যুত হইতেই হইবে—কুপ্রবৃত্তির বিপরীত পথে তো অনেকবার গমন করিতেই হইবে। আমারদের যদি মূলধন সঞ্চিত থাকে, তবে অতিরিক্ত ধনের ক্ষতিতে তেমন বিশেষ ক্ষতি বোধ হয় না। ঈশ্বরকে যিনি মূলধন রূপে সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছেন, বিষয় ত্যাগে তাহার ক্ষতির সম্ভাবনা নাই। যিনি সকল সম্পদের সমুদ্রকে প্রাপ্ত হইয়াছেন, বিষয় বিপদকে তাঁহার বিপদ বোধ হয় না। তিনি সুখের সময় সেই সর্ব্বসুখদাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হইয়া সেই সুখকে দ্বিগুণিত করেন, এবং বিপদের সময় তিনি সেই সর্ব্বাশ্রয় পরমেশ্বরের আশ্রয়ে থাকিয়া নির্ভয়ে বিচরণ করেন। পাপই তাঁহার নিকটে অমঙ্গল; দুঃখও বাস্তবিক অমঙ্গল নহে, বিপদও বাস্তবিক অমঙ্গল নহে। আত্মার কিসে আত্ম-প্রসাদ থাকে—ঈশ্বর কিসে নিরন্তর জ্ঞান-চক্ষে প্রকাশিত থাকেন; ইচ্ছাতেই তাঁহার প্রাণগত যত্ন—এবং তদনুরূপ আচরণে তৎপর থাকেন। কিসে লোকে মান্য হইব, এজন্য তাঁহাকে কষ্ট পাইতে হয় না, ঈশ্বর হইতে পাছে বিচ্যুতি হয়, এই ভয়েই তিনি পাপ হইতে দূরে থাকেন; লোকেরা পাছে মন্দ বলে, ইহারই প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া তাঁহার কপটতা কুটিলতা ছদ্মতা অভ্যাস করিতে হয় না।

যাঁহারা ধর্ম্মেতে অনেক সময় বিষয়-সুখের হানি দেখিয়া ঈশ্বরের মঙ্গল-স্বরূপে দোষারোপ করেন, তাঁহারা ধার্ম্মিকদিগের বৃদ্ধ-বয়সে যৌবন কালের বল বীর্য উদ্যমের হ্রাস দেখিয়াও তো সেই রূপ বলিতে পারেন? বিষয়-সুখ যদি ধর্ম্মের যথার্থ বিষয় হইত, তবে ধার্ম্মিক ব্যক্তিরাই অধিক বিষয়ী হইত; তবে ধর্ম্মের যত উপার্জন হইত, ইন্দ্রিয় সকল ততই বিবৃত দ্বার হইত, বিষয় লালসা ততই বৃদ্ধি হইত, ভোগের শক্তি ততই প্রবলা হইত। কিন্তু বাস্তবিক ঠিক তাহার বিপরীত। ব্রহ্ম-রসগ্রহ ধার্ম্মিক বৃদ্ধ দিন দিন আপনাকে স্বীয় গম্য স্থানের নিকট জানিয়া সর্ব্বদাই প্রসন্ন ও হৃষ্ট থাকেন; বিষয়-ভোগের লালসা তাঁহাকে আর সুখ বা দুঃখ দিতে পারে না।

ধর্ম্মপরায়ণ সাধু ব্যক্তিরা বিষয়-সুখ হইতে বিরত হন বলিয়া যে পাপী ব্যক্তি নির্ব্বিঘ্নে থাকে, এমত নহে। পাপীর যে যন্ত্রণা সে সেই পাপী জানে, আর সেই অন্তর্যামী পুরুষই জানেন। তাহাদের যদি ধন, মান, ঐশর্য্য; অশ্ব, রথ, গজ, পর্য্যঙ্ক থাকে, তাহাতেই বা কি? তাহারা নরক সমান স্বকীয় হৃদয় জ্বালাতেই সর্ব্বদা অস্থির, তাহাদের কোন সুখ উপভোগের ক্ষমতাই থাকে না। তাহাদের নিকটে এই জগৎ দাব-দাহময় হয়। তথাপি করুণা-সিন্ধু পরমেশ্বর তাহারদিগকে পরিত্যাগ করেন না। তাহারদিগকে আপনিই দণ্ড বিধান দ্বারা বিপথ হইতে স্বপথে আহ্বান করেন।


Read also