তর্পন

মম ইস দা বেস্ট
এখনকার বাচ্চারা প্রায় বলে , মাই মম ইস দা বেস্ট।আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন এ ভাবে বলার রেওয়াজ ছিল না।তা না থাকুক প্রত্যেকটা মানুষের কাছেই তার মা সবথেকে প্রিয়। এটা ভাইসি ভারসা, ঠিক তেমনি মায়ের কাছে তার সন্তান সর্বাধিক প্রিয়। এ চির সত্য। কিন্তু আমার জ্ঞান হলে মাকে আমি অন্য ভাবে দেখলাম , স্বতন্ত্র। আমরা তিন ভাই বোন আমি মিতালি চৈতালি অবশ্যই মায়ের কাছে প্রিয় ছিলাম । তবে শুধু আমরা নয়, পৃথিবীর সকলেই তার প্রিয়। এমন একটি মানুষ ও নেই যে তার অপ্রিয়। ঠিক তেমনি অন্যরাও মাকে খুব ভালোবাসতো, যে ভালোবাসা ছিল নিখাদ, আন্তরিক।
সেই শিশু বয়সে মায়ের এই অন্যদের জন্য এতো ভালোবাসা সময়ে সময়ে আমায় কষ্ট দিতো,ভাবতাম মা বোধহয় আমাকে কম ভালোবাসে। অনেক পরে বুঝেছি যার ভাড়ারে সমুদ্র প্রমাণ ভালোবাসা তা কি একজনকে বাঁটলে অন্যজনের কম পরে ? আজ খালি মায়ের কথা । মায়ের মন ছিল খুব বড়, উদার সংকীর্ণতা আর সংস্কার মুক্ত। ধর্মপ্রাণ ছিলেন , কিন্তু গোঁড়ামি ছিল না। দারুণ মিশুকে রসিক মজলিস প্রিয়। নিজে মাত্র ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ে ছিলেন, অথচ ছিলেন দারুণ শিক্ষানুরাগী সাহিত্য সঙ্গীত প্রেমী । আমাদের প্রাথমিক শিক্ষালাভ মায়ের কাছে ।
মা গল্প উপন্যাস পড়তে খুব ভালোবাসতো। খুব সুন্দর করে গল্প বলতো আমি হাঁ করে শুনতাম। মাঝে মাঝে গান করতো । একটা গান আমার খুব প্রিয় ছিল, কথা গুলো ভুলে গেছি , দুটো লাইন মনে আছে , “ ষষ্ঠীর দিন অধিবাসের লগ্ন এলে পরে / শতেক প্রদীপ ঘিরে মায়ের বরণ ঘরে ঘরে । ” বাবার [ অচল ভট্টাচার্য ] সাহিত্য সাধনা মাকে খুব আনন্দ দিতো। জ্ঞান হবার পর দেখলাম আমি জোড়াবাগানের ২০ / সি মাথুর সেন গার্ডেন লেনে। দোতলা বাড়ী, মাঝে উঠোন আর তাকে ঘিরে খুপড়ি খুপড়ি ঘর। পিল পিল করছে এক বাড়ী লোক। আমরা যে সব আলাদা আলাদা ভাড়াটে এটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগে ছিলো । আমি ভাবতাম গোটা বাড়ি একটাই পরিবার । মিলটা এতটাই আন্তরিক ছিল ।প্রত্যেকে মাকে খুব ভালোবাসতো। ঝগড়া বিবাদ সমস্যায় মায়ের কথাই শেষ কথা।দোতলায় থাকতো এক পিসি তার ফ্যামিলি নিয়ে। তার ছেলে, গৌরাঙ্গ দা, পিসতুতো দাদা, মাকে খুব ভালোবাসতো। দাদু ছিল প্রফেশনাল পুরোহিত। দাদা মাকে বলতো মাইমা আমার জন্য ভালো মিষ্টি রাখবে । মা আমাকে পাঠাতো যা এটা দিয়ে আয়।মা গৌরাঙ্গ দার কাছে নানা কারেন্ট খবরা খবর জেনে নিজেকে আপডেট করতো । তখন নকশাল আমল।গৌরাঙ্গ দা হটাৎ চলে গেলো বোম্বে ভর্তি হলো ফিল্ম ইনস্টিটিউশানে। যাওয়াটা সহজ ছিল না,আর্থিক বেপারটা তো ছিলই । তখন আমি অনেক ছোটো , তবু মনে আছে সেই সময়ে মা পিসির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল । গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী থেকে মিঠুন চক্রবর্তী সে অন্য ইতিহাস। অন্য কোনো দিন নয় সে গল্প হবে । ফিরে আসি মায়ের কথায় ।
জোড়াবাগানে
জোড়াবাগানে সবাই মাকে ডাকতো আলোকের মা। পড়শীরা প্রায় আসতো মায়ের কাছে সাহায্যর জন্য, চাল ডাল তেল নুন থেকে অর্থ । বাড়ন্ত না হলে মা কাউকে না বলতে পারতে না। আমার যখন দশ বছর বয়স তখন হাওড়া শিবপুরে বাবা কাকা মা আমি দুই বোন চলে এলাম হাওড়ায় । আসার সে দিনটা খুব মনে। পাড়ার লোক সব বিষণ্ণ, মন তাদের ভাড়াকান্ত। কয়েকজন তো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই ফেললো। কাকা মজার মানুষ বললো আরে বাবা আমরা কি রাম লক্ষণ এর মতো বনবাসে যাচ্ছি। শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব হাওড়া চ্যাপ্টার। ফুল যেখানে ফোটে সেখানেই সে গন্ধে আমোদ করে। দুদিনেই হাওড়া হয়ে গেলো মায়ের নিজের শহর হাওড়ার লোক নিজের লোক। পাড়ার প্রত্যেকটা মানুষের সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক । মা নিজে যেচে কুশল বিনিময় করতো। ঠিক আগের মতোই পড়শী দের দিকে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিতো। শিবপুরে আসার পর ফ্যামিলি মেম্বার বাড়লো। কাকিমা এলো তারপর বোন ডালিয়া ভাই টুকলু। ওদের দুজনের যতো অত্যাচার আবদার মান অভিমান ভালোবাসা সব ওদের জেঠিমার ওপর। শুনেছি কাকা তার জ্ঞান হবার আগেই তার মা গত হয়েছিল । মা যখন এলো তখন কাকা নিতান্তই বালক । বৌদির মধ্যেই সে মাকে পেয়েছিলো । আমার পিসিরা আর তাদের ছেলে মেয়ে সকলেই আঁকড়ে থাকতো মাকে। মায়ের কথা কিছুই বলা হলো না, যদি না শিয়াখালার কথা বলি । তখন জোড়াবাগানে থাকি । সূর্য ওঠার আগেই মা তিনজনকে টেনে তুলতো। তখনও আলো ফোটেনি, উঠে পড়লাম রিকশায়। বড়োরাস্তায় এসে বাবা ট্যাক্সি ধরতো , হাওড়া ময়দান । মার্টিন ট্রেনে চেপে শিয়াখালা ।কোনা জগদীশপুর চন্ডিতলা হয়ে নেড়ো গেজে ছুটছে মার্টিন ট্রেন, কয়লার ইঞ্জিন থেকে ভস ভস করে বেরোচ্ছে কয়লার কালো ধুঁয়া। সহযাত্রীরা কথায় কথায় জানালো তারা চলেছে শিয়াখালার বিখ্যাত জোতিষী বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় এর কাছে গণনা করতে। মা হেঁসে বলতো আমি তার বড় মেয়ে। ট্রেন থেকে নেমে রিক্সা, যেতে হবে শ্রীপতিপুর কারকুনবাটী। রিক্সা অস্বথ তলা আসতেই আকাশ বাতাস মুখরিত করে রব উঠল দিদি এসেছে দিদি এসেছে, পিল পিল করে ছুটে আসছে ছোটো ছোটো মামা মাসিরা।ততক্ষনে খবর চলে গেছে অন্দরে। দিদিমা সদরে ,— আমার মন বলছিলো দিপু আজ ঠিক আসবে। মায়েরা আট ভাইবোন। মায়ের তিন কাকা তাদের ছেলে মেয়ে নিয়ে অনেক ভাই বোন। মা সকলেরই বড়দি। সকলের আবদার দিদির কাছে।বাড়ীর লোকেদের কথা ছেড়ে দিলাম, সারা গ্রামের সকলেই মাকে খুব ভালোবাসতো।
ভাইফোঁটা
একবার ভাইফোঁটাতে মায়ের সাথে মামার বাড়ী গেছি । বাড়ীর যতো ভাই আছে রকে সব পর পর বসেছে মা ফোটা দিয়ে যাচ্ছে। একজন আমায় বললো গুনে যা, গুনছি …. বারো তেরো চোদ্দ পনেরো ষোলো, ধেৎ আমি পারছি না গুলিয়ে যাচ্ছে। হটাৎ মারা গেলো দিদিমা তার কয়েক মাস পরে দাদু। পাঁচের শেষ দুজন বটুন মামা আর টুকুন মামা ছোটো , তারওপরে জগবন্ধু মামা আবার একটু অসুস্থ । তাদের আগলে রাখার জন্য মা প্রাণ পণ চেষ্টা করতো । মায়ের মুখে তখন দুটো নাম বটুন টুকুন। বাপ মা মরা দুই ছোটো ভাইকে বুক দিয়ে আগলে রাখতো.। টুকুন মামার লেখা পড়া শেখার জন্য মা খুব চেষ্টা করেছিল। তবে ওর লেখা পড়ায় মন ছিল না। অভিজ্ঞতা ছাড়াই ব্যবসা করতে নামলো। ফল যা হবার তাই হলো । প্রায় ও আসতো মায়ের কাছে , লেবার পেমেন্ট করতে হবে টাকার দরকার । মা ছোটো ভাই কে ফেরাতে পারতো না। মনে আছে যেদিন টুকুন মামা মিলিটারিতে চাকরি পেয়ে শিবপুর থেকে দিল্লি পারি দিলো, মা আর কাকিমা হাওড়া স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে এসেছিলো । টুকুনমামার চাকরি পাওয়াতে সবথেকে আনন্দ পেয়ে ছিল মা। সেসব কথা কি টুকুন মামার মনে আছে?আমার মামার বাড়ী যেন জমিদার বাড়ী। বিশাল বাড়ী বিশাল উঠোন , দূর্গাদালান চন্ডী মন্দির নারায়ণ ঘর, পুকুর মাঠ ঘাট । জোড়াবাগানের দশ বাই আট ঘর থেকে ওখানে গিয়ে আমি দিশে হারা যেতাম। মনে হতো আমি যেন রাজার নাতি।যতো ছোটো ছোটো মাসিগুলো ছিল আমার খেলার সাথী । এই আমার দোষ, বলতে বসলাম মায়ের কথা আর বলে যাচ্ছি নিজের কথা ।
মামার বাড়ী
মামার বাড়ীর প্রায় সকলেই নাচ গান বাজনা অভিনয় আঁকা খেলা এই সবে দারুণ একসপার্ট ছিল । টুকুন মামা খুব ভালো গান করতো , মাউথ অর্গান বাজাতে পারতো। ওর গলাতে শোর ছবির সেই গানটা, “ এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়…..জিন্দেগী কুছ ভি নেহি, তেরি মেরি কাহানী হ্যায়…. ” মায়ের খুব প্রিয় ছিল । দুর্গাপুজোর সময় দুর্গাদালানে সন্ধ্যায় যে আসর বসতো তা আজ শুধুই স্মৃতি। এতো কথা যখন হলো তখন দেশটা আর বাকি থাকে কেন ? বর্ধমান কর্ড লাইনে জৌগ্রাম স্টেশন, নেমে গরুর গাড়ী,কুলীন গ্রাম। এখন গরুর গাড়ী শুধু ছবিতে । দেশে মাটির ঘর খড়ের চাল । রকে বসে মাটির উনুনে কয়লার আঁচে মা রান্না করতো । মায়ের থিওরি ছিল যেখানে যেমন সেখানে তেমন । হয়েন উ আর ইন রোম উ আর রোমান। গ্রামের প্রত্যেকটা লোক ছিল মায়ের চেনা । প্রত্যেকের আবারিত দ্বার, আপ্পায়ন এর জন্য চা মুড়ি।শীতকালটা মা দেশে কাটাতে খুব ভালোবাসতো।
চির ঘুমের দেশে
একবার সন্ধ্যাবেলা দেশ থেকে ফোন এলো মা সেখানে হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে । একটা গাড়ী জোগাড় করে ঝড়ের বেগে গেলাম। মা তখন অচেতন । মুহূর্ত বিলম্ব না করে সেই গাড়িতে মাকে নিয়ে ফিরলাম সরাসরি জৈন হসপিটালে । সেই রাতেই বসলো পেসমেকার। সে যাত্রায় প্রাণ রক্ষা হলো কিন্তু সুস্থ হলো তা বলতে পারিনা। তারপর আরো অনেকবার নার্সিং হোমে ভর্তি করতে হয়েছে । ক্রমে ক্রমে মায়ের শরীর জীর্ণ হয়ে এলো। কিন্তু কি আশ্চর্য কখনো মা বলতো না খারাপ আছি কি শরীরে কোনো কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তার বাবু এলে মা জিজ্ঞাসা করতো —– ডাক্তারবাবু কেমন আছেন ? আসি শেষের সে দিনে। কোর্ট থেকে ফিরে দেখলাম মা নির্জীব আচ্ছন্ন। সন্ধ্যায় চেম্বারে যাবার আগে বললাম — মা আমি চেম্বার থেকে ঘুরে আসি। হয়তো চেষ্টা করলো প্রতিদিনের মতো বলতে ঠিক আছে । পারলো না । শুধু ঘোলাটে চোখে দেখলো । একঘন্টা পর স্ত্রীর ফোন — এক্ষুনি চলে এসো মা কিরাম করছে । ছুটে এলাম। কিন্তু ধরতে পারলাম না। চলে গেছে চির ঘুমের দেশে।
যেখানে শুধুই শান্তি।
দিপালী ভট্টাচাৰ্য
প্রয়াণ ৪ সেপ্টেম্বর ২০১২
কোর্ট থেকে ফিরে দেখলাম মা নির্জীব আচ্ছন্ন। সন্ধ্যায় চেম্বারে যাবার আগে বললাম — মা আমি চেম্বার থেকে ঘুরে আসি। হয়তো চেষ্টা করলো প্রতিদিনের মতো বলতে ঠিক আছে । পারলো না । শুধু ঘোলাটে চোখে দেখলো । একঘন্টা পর স্ত্রীর ফোন — এক্ষুনি চলে এসো মা কিরাম করছে । ছুটে এলাম। কিন্তু ধরতে পারলাম না। চলে গেছে চির ঘুমের দেশে।
You must be logged in to post a comment.