স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়ার ভূমিকা-Role of Howrah District in Independence Movement

স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়ার ভূমিকা
বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না, যে এই শিরোনামে যথার্থ আলোচনা অনায়াসে মহাভারত প্রমাণ গ্রন্থের আকার নেবে। দু চার কথায় এই প্রসঙ্গে আলোচনা আর বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন দুই এক। তবু সে চেষ্টাই করছি । স্বাধীনতা আন্দোলনের ভরকেন্দ্র অবশই ছিল অবিভক্ত বাংলার প্রাণকেন্দ্র কলকাতা । আর হাওড়া, কলকাতার সবথেকে নিকটে হওয়ার সুবাদে আন্দোলনের তাপ উত্তাপ সর্বাগ্রে আছাড় খেত এখানে । তারই কিছু ঝলক নিবেদন করছি। স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। হাওড়ার সঙ্গে ওনার বিশেষ যোগ। উনি ছিলেন রিপন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক। হাওড়ার বহু মানুষ ছিল ওনার অনুগামী। ১৮৯১ সালে হাওড়া টাউন হলে কংগ্রেসের বিশেষ সভা হয়। সভাপতি ছিলেন সাঁতরাগাছির কেদার নাথ ভট্টাচার্য । বক্তা সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়। ১৮৯১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর স্টেটসম্যান পত্রিকা তার রিপোর্ট করেছিল । বঙ্গভঙ্গ প্রতিবাদে ১৯০৫ সালে টাউন হলে হয় নাগরিক প্রতিবাদ সভা । হাওড়া ছিল তদকালীন কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি। হাওড়ার বহু মানুষ গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশ নিয়েছিলেন ।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন হাওড়া কংগ্রেসের সভাপতি । শরৎ বাবু ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের বিশেষ ভক্ত । সে সময় শরৎ বাবু থাকতেন হাওড়ার শিবপুরে। খুব আশ্চর্য লাগে তিনি নিজে কংগ্রেসী হলেও সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে ওনার ঘনিষ্ট যোগ ছিল, নানা ভাবে তিনি তাদের সাহায্য করতেন । ওনার পথের দাবী সে সময় বিপ্লবীদের দারুণ ভাবে উদ্বুদ্ধ করে ছিল, তা আমাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে শরণ করা উচিত । শিবপুরের আরো অনেক মানুষ অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আধ্যাপক শ্রী বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচাৰ্য । তিনি ছিলেন বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা, গান্ধীজি অনুগামী । লবন আন্দোলন, বিদেশী বস্ত্র বর্জন, অসহযোগ আন্দোলনে তিনি ছিলেন হাওড়ার নেতা। ১৯৩০ সালের ৪ এপ্রিল হাওড়া থেকে শুরু হয় লবন সত্যাগ্রহ অভিযান, তিনি ছিলেন তার পুরোধা । ১৯৩০ সালের ২৬ এপ্রিল হাওড়া মঙ্গলাহাট এ বিদেশী বস্ত্র বর্জন আন্দোলনে জমায়াত আন্দোলনকারী দের ওপর নির্বিচারে লাঠি চার্জ করে ইংরেজ সরকারের পুলিশ, গ্রেপ্তার হন বিজয় কৃষ্ণ ভট্টাচাৰ্য সহ অনেকে । পরদিন হয় হাওড়া হরতাল । যে দারোগা লাঠি চার্জের আদেশ দিয়েছিলো সে উচিত শিক্ষা পেয়েছিলো ১৯৩০ সালের ১৬ মে।
শিবপুরের ভবানন্দ বন্দোপাধ্যায়, কানাইলাল বন্দোপাধ্যায় মনমোহন অধিকারী সেই দারোগের বাড়ীতে বোমা নিক্ষেপ করে ।শিবপুরের আরো দু এক জন নেতার নাম উল্লেখ করছি, সুশীল মুখার্জী ,অগম শরণ দত্ত, গুরুদাস দত্ত, বেণীচরণ দত্ত, গণেশ মিত্র, জীবন মাইতি। এছাড়া আরো অনেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাপিয়ে পড়েছিলেন । ঠিক শিবপুরের মতো সালকিয়া ছিল সে কালে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণ কেন্দ্র । এবং গুপ্ত ঘাঁটি । যা ইংরেজ পুলিশের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছিলো । বিশিষ্ট আইনজীবী বরোদা প্রসন্ন পাইন ছিলেন কংগ্রেস নেতা এবং নেতাজীর খুব কাছের লোক, তাঁর আইনি পরামর্শ দাতা। ওনার পিতা অমৃতলাল পাইন তিনিও ছিলেন কংগ্রেস নেতা । আরো যারা অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে প্রবোধচন্দ্র বসু, বীরেন্দ্র বসু, মৃতুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় খেগেন্দ্র নাথ গাঙ্গুলী উলুবেড়িয়ার বিভূতি ঘোষ সালকিয়ার শম্ভু চরণ পাল হরেন্দ্র নাথ ঘোষ শিবপুরের সুশীল মুখার্জী ও তার পরিবার ( যিনি পরবর্তী কালে স্বধারণত্ন্তী নামে দল করেছিলেন ) আইনজীবী পুলিন বন্দ্যোপাধ্যায়, বালির নলীন চন্দ্র মিশ্র, প্রমুখ । একটা সময়ে সারা হওড়া উত্তাল হয়ে উঠেছিল অসহযোগ আন্দোলনে, তাই আন্দোলনকারীদের নাম বলে শেষ করা যাবে না ।
কে না জানে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম পষ্টতো দু ভাগে বিভক্ত ছিল , এক আহিংস অসহযোগ আন্দোনল দুই সশস্ত্র সংগ্রাম । এই সশস্ত্র আন্দোলনের মানচিত্রে হাওড়ার স্থান অতি উজ্জ্বল। সালকিয়া ছিল এই আন্দোলনকারীদের গুপ্ত ডেরা। খুব সহজেই বিপ্লবীরা গঙ্গা পেরিয়ে সালকিয়া তে আত্মগোপন করতেন । স্থান সালকিয়ার বাবু ডাঙ্গা, কাল ১৯১৬, পাত্র, যতীন্দ্র নাথ মুখোপাধ্যায়, বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী [ ইনি শরৎ চন্দ্র এর মামা ] উল্লাস্কর দত্ত প্রমুখ । চলছে গুপ্ত সভা । কিন্তু সে খবর ফাঁস হয়ে গেছে ইংরেজ পুলিশের কাছে । টেগার্ড সাহেব তার বাহিনী নিয়ে ঘিরে ফেলেছে এলাকা । শুরু গুলি বিনিময় । মুহুর মুহুর শব্দে কেঁপে উঠলো এলাকা, ধরা পড়লো উল্লাস্কর দত্ত, বিচারে হলো দ্বীপান্তর আন্দামান সেলুলার জেল। সেখানে অমানুসিক অত্যাচারে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন । এই সালকিয়াতেই তৈরী হতো লোহার বোমার খোল, যা বোমা তৈরী তে লাগতো। আর তৈরি হতো দেশি পিস্তল । যা ছড়িয়ে পড়তো ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিপ্লবীদের হাতে । এই বোমা ছুড়ে ছিল বিপ্লবী ভকত সিং , সালকের বটুকেশ্বর দত্ত । হয়েছিল বিখ্যাত মামলা সালকিয়া বোমা কেস, সাল ১৯২৭। বিপ্লবী ভকত সিং এর সঙ্গে সালকিয়ার বিশেষ যোগ ছিল বটুকেশ্বর দত্তর মাধ্যমে । তবে এর অনেক আগেই হাওড়ায় শুরু হয়ে গেছে স্বদেশী গুপ্ত বাহিনীর কাজ । ১৯০৮ সালে শিবপুরে ঘটে বড় ধরণের স্বদেশী ডাকাতি। হাওড়া আদালতে শুরু মামলা হাওড়া গ্যাং কেস, সে সময় আলোড়ন ফেলেছিলো । এ ঘটনা কে না জানে, কলকাতা শহরে রাডা কোম্পানির গোডাউনএ যাবার পথে উধাও হয়ে গেলো এক গরুর গাড়ী মাইসার পিস্তল। যা সিনেমার চিত্র নাট্যকেও হার মানায়। সেই ঘটনার অন্যতম নায়ক হাওড়া রসপুর ( ছোটো কলকাতার ) শ্রীশচন্দ্র মিত্র ওরফে হাবু। ২৬ অগাস্ট ১৯১৪।
হাওড়ার এই তরুণ বিপ্লবী পুলিশের গুলিতে মারা যায়। কি করে ভুলি বাংলার প্রথম মহিলা রাজবন্দিনী হাওড়ার বালী গ্রামের ননীবালা র কথা । তিনি বালী গ্রামের এক বাল বিধবা । তিনি ছদ্দবেশে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন । ধরা পড়ার পর,অকথ্য অত্যাচার সহ্য করেও এতটুকু জেদ তার কমেনি । ইংরেজ পুলিশের অন্যায় ব্যবহারে কষিয়ে দিয়েছিলেন তার গালে সজোরে থাপ্পর । যা ইংরেজ সমাজকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ছিল । তার জীবনী নিয়ে অনায়াসে একটা নভেল লিখে ফেলা যায়। সালকিয়া বাবুডাঙ্গার বিজন বন্দোপাধ্যায় মাত্র ১৫ বছর বয়েসে রাজদ্রোহ অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছিল । ১৯২৩-২৪ সালের ঘটনা ইস্টর্ন বেঙ্গল রেলে স্বদেশী ডাকাতি করে গণেশ ঘোষ , সূর্য সেন দেবেন্দ্র নাথ দে লুকিয়ে ছিল সালকের বাবুডাঙ্গায় সাধারণ গৃহস্থ বাড়ী। এর থেকেই প্রমাণ হয় হাওড়ার সাধারণ মানুষ কতটা স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে ছিল । সে সময় হাওড়ার একাধিক ক্লাব গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতো । বাংলার বীর বিপ্লবীরা হাওড়াতে আসতেন সভা করতে , কখনো সে সভা প্রকাশ্য কখনো গুপ্ত। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র হাওড়া টাউন হলে এসেছিলেন সভা করতে। বিপ্লবী অরবিন্দ সেখানেই সভা করেছেন ১৯০৯ সালের ২৭ জুন । সারা হাওড়া জুড়ে এরকম বহু সভা সমিতি হয়েছে । যা বললাম তার থেকে বহু গুন রয়ে গেলো না বলা কথা । সারা হাওড়া জুড়ে কত বিপ্লবীর কত কান্ড ! আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছরে হাওড়ার সেই সব স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জানাই শত প্রণাম । গাই সেই মন্ত্র, বন্দেমাতরম ।
তথ্য সংগ্রহ ও ঋণ স্বীকার :– হাওড়া শহরের ইতিবিত্ত, ২য় খন্ড, অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায়া ।
› Forums › স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়ার ভূমিকা-Role of Howrah District in Independence Movement
Tagged: Alak Bhattacharya, Howrah
› Forums › স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়ার ভূমিকা-Role of Howrah District in Independence Movement
© Advocatetanmoy Law Library
› Forums › স্বাধীনতা আন্দোলনে হাওড়ার ভূমিকা-Role of Howrah District in Independence Movement
© Advocatetanmoy Law Library