সুকান্ত ভট্টাচার্য
15 August 1926 – 13 May 1947
দুর্মর
পূর্বাভাস
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলা দেশ
কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
সে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ
জলে ও মাটিতে ভাঙ্গনের বেগ আসে।
হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন,
জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান,
গত আকালের মৃত্যুকে মুছে
আবার এসেছে বাংলা দেশের প্রাণ
“হয় ধান নয় প্রাণ” এ শব্দে
সারা দেশ দিশাহারা,
একবার মরে ভুলে গেছে আজ
মৃত্যুর ভয় তারা।
সাবাস, বাংলা দেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়:
জ্বলে পুড়ে-মার ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
এবার লোকের ঘরে ঘরে যাবে
সোনালী নয়কো, রক্তে রঙিন ধান,
দেখবে সকলে সেখানে জ্বলছে
দাউ দাউ করে বাংলা দেশের প্রাণ॥
“নব জ্যামিতি”র ছড়া
অপ্রচলিত
সুকান্ত ভট্টাচার্য
Food Problem [একটি প্রাথমিক সম্পাদ্যের ছায়া অবলম্বনে]
সিদ্ধান্ত:
আজকে দেশে রব উঠেছে, দেশেতে নেই খাদ্য;
‘আছে’, সেটা প্রমাণ করাই অধুনা ‘সম্পাদ্য’।
কল্পনা:
মনে করো, আসছে জাপান অতি অবিলম্বে,
সাধারণকে রুখতে হবে অতি দৃঢ় ‘লম্বে’।
“খাদ্য নেই” এর প্রথম পাওয়া খুব ‘সরল রেখা’তে,
দেশরক্ষার ‘লম্ব’ তোলাই আজকে হবে শেখাতে।
অঙ্কন:
আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবীর ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে,
প্রতিরোধের বিন্দুতে নাও ঐক্য-রেখা এঁকে!
‘হিন্দু-মুসলমানে’র কেন্দ্রে, দুদিকের দুই ‘চাপে’
যুক্ত করো উভয়কে এক প্রতিরোধের ধাপে।
প্রতিরোধের বিন্দুতে দুই জাতি যদি মেলে,
সাথে সাথেই খাদ্য পাওয়ার হদিশ তুমি পেলে।
প্রমাণ:
খাদ্য এবং প্রতিরোধ উভয়েরই চাই,
হিন্দু এবং মুসলমান মিলন হবে তাই।
উভয়ের চাই স্বাধীনতা, উভয় দাবীই সমান,
দিকে দিকে ‘খাদ্যলাভ’ একতারই প্রমাণ।
প্রতিরোধের সঠিক পথে অগ্রসর যারা,
ঐক্যবদ্ধ পরস্পর খাদ্য পায় তারা॥
উদ্যোগ
পূর্বাভাস
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।
মূঢ় শত্রুকে হানো স্রোত রুখে, তন্দ্রাকে করো ছিন্ন,
একাগ্র দেশে শত্রুরা এসে হয়ে যাক নিশ্চিহ্ন।
ঘরে তোল ধান, বিপ্লবী প্রাণ প্রস্তুত রাখো কাস্তে,
গাও সারিগান, হাতিয়ারে শান দাও আজ উদয়াস্তে।
আজ দৃঢ় দাঁতে পুজিত হাতে প্রতিরোধ করো শক্ত,
প্রতি ঘাসে ঘাসে বিদ্যুৎ আসে জাগে সাড়া অব্যক্ত।
আজকে মজুর হাতুড়ির সুর ক্রমশই করে দৃপ্ত,
আসে সংহতি; শত্রুর প্রতি ঘৃণা হয় নিক্ষিপ্ত।
ভীরু অন্যায় প্রাণ-বন্যায় জেনো আজ উচ্ছেদ্য,
বিপন্ন দেশে তাই নিঃশেষে ঢালো প্রাণ দুর্ভেদ্য!
সব প্রস্তুত যুদ্ধের দূত হানা দেয় পুব-দরজায়,
ফেণী ও আসামে, চট্টগ্রামে ক্ষীপ্ত জনতা গর্জায়।
বন্ধু, তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত,
বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত॥
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের—
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব— তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গিকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস॥
রবীন্দ্রনাথের প্রতি
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি,
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি,
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি,
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি।
এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে,
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।
এখনো স্বগত ভাবাবেগে,
মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে।
তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সাম্রাজ্য গড়ে তোলে,
গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে;
যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে
এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।
তবুও নিশ্চিত উপবাস
আমার মনের প্রান্তে নিয়ত ছড়ায় দীর্ঘশ্বাস—
আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি,
প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়,
আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন ডেকে যায়,
আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে,
আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।
তাই আজ আমারো বিশ্বাস,
“শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।”
তাই আমি চেয়ে দেখি প্রতিজ্ঞা প্রস্তুত ঘরে ঘরে,
দানবের সাথে আজ সংগ্রামের তরে॥
একটি মোরগের কাহিনী
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল
বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে,
ভাঙা প্যাকিং বাক্সের গাদায়—
আরো দু’তিনটি মুরগীর সঙ্গে।
আশ্রয় যদিও মিলল,
উপযুক্ত আহার মিলল না।
সুতীক্ষ্ণ চিৎকারে প্রতিবাদ জানিয়ে
গলা ফাটাল সেই মোরগ
ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত—
তবুও সহানুভূতি জানাল না সেই বিরাট শক্ত ইমারত।
তারপর শুরু হল তার আঁস্তাকুড়ে আনাগোনা:
আশ্চর্য! সেখানে প্রতিদিন মিলতে লাগল
ফেলে দেওয়া ভাত-রুটির চমৎকার প্রচুর খাবার!
তারপর একসময় আস্তাকুঁড়েও এল অংশীদার—
ময়লা ছেড়া ন্যাকড়া পরা দু’তিনটে মানুষ;
কাজেই দুর্বলতর মোরগের খাবার গেল বন্ধ হয়ে।
খাবার! খাবার! খানিকটা খাবার!
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বার বার চেষ্টা ক’রল প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেকবারই তাড়া খেল প্রচণ্ড।
ছোট্ট মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে—
‘প্রাসাদের ভেতর রাশি রাশি খাবার’!
তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধব্ধপে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবর টেবিলে;
অবশ্য খাবার খেতে নয়—
খাবার হিসেবে॥
সিঁড়ি
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আমরা সিঁড়ি,
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরেও তাকাও না পেছনের দিকে;
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।
তোমরাও তা জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।
তবু আমরা জানি,
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।
আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্খলন॥
অনুভব
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
১৯৪০
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি।
অবাক পৃথিবী! আমরা যে পরাধীন
অবাক, কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;
অবাক পৃথিবী! অবাক করলে আরো—
দেখি এই দেশে অন্ন নেইকো কারো।
অবাক পৃথিবী! অবাক যে বারবার
দেখি এই দেশে মৃত্যুরই কারবার।
হিসাবের খাতা যখনি নিয়েছি হাতে
দেখেছি লিখিত— ‘রক্ত খরচ’ তাতে;
এদেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম,
অবাক পৃথিবী! সেলাম, তোমাকে সেলাম!
১৯৪৭
বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে,
আমি যাই তারি দিন-পঞ্জিকা লিখে,
এত বিদ্রোহ কখনো দেখেনি কেউ,
দিকে দিকে ওঠে অবাধ্যতার ঢেউ;
স্বপ্ন-চূড়ার থেকে নেমে এসো সব—
শুনেছ? শুনছ উদ্দাম কলরব?
নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট,
রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদ-পট।
প্রত্যহ যারা ঘৃণিত ও পদানত,
দেখ আজ তারা সবেগে সমুদ্যত;
তাদেরই দলের পিছনে আমিও আছি,
তাদেরই মধ্যে আমিও যে মরি-বাঁচি।
তাইতো চলেছি দিন-পঞ্জিকা লিখে—
বিদ্রোহ আজ! বিপ্লব চারিদিকে॥
দেশলাই কাঠি
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না;
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
মনে আছে সেদিন হুলুস্থুল বেধেছিল?
ঘরের কোণে জ্বলে উঠেছিল আগুন—
আমাকে অবজ্ঞাভরে না-নিভিয়ে ছুঁড়ে ফেলায়!
কত ঘরকে দিয়েছি পুড়িয়ে,
কত প্রাসাদকে করেছি ধূলিসাৎ
আমি একাই— ছোট্ট একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
এমনি বহু নগর, বহু রাজ্যকে দিতে পারি ছারখার করে
তবুও অবজ্ঞা করবে আমাদের?
মনে নেই? এই সেদিন—
আমরা সবাই জ্বলে উঠেছিলাম একই বাক্সে;
চমকে উঠেছিলে—
আমরা শুনেছিলাম তোমাদের বিবর্ণ মুখের আর্তনাদ।
আমাদের কী অসীম শক্তি
তা তো অনুভব করেছো বারংবার;
তবু কেন বোঝো না,
আমরা বন্দী থাকবো না তোমাদের পকেটে পকেটে,
আমরা বেরিয়ে পড়ব, আমরা ছড়িয়ে পড়ব
শহরে, গঞ্জে, গ্রামে— দিগন্ত থেকে দিগন্তে।
আমরা বার বার জ্বলি, নিতান্ত অবহেলায়—
তা তো তোমরা জানোই!
কিন্তু তোমরা তো জানো না:
কবে আমরা জ্বলে উঠব—
সবাই— শেষবারের মতো!
কনভয়
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হঠাৎ ধুলো উড়িয়ে ছুটে গেল
যুদ্ধফেরত এক কনভয়:
ক্ষেপে ওঠা পঙ্গপালের মতো
রাজপথ সচকিত ক’রে
আগে আগে কামান উঁচিয়ে,
পেছনে নিয়ে খাদ্য আর রসদের সম্ভার।
ইতিহাসের ছাত্র আমি,
জানালা থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম
ইতিহাসের দিকে।
সেখানেও দেখি উন্মত্ত এক কনভয়
ছুটে আসছে যুগযুগান্তের রাজপথ বেয়ে
সামনে ধূম-উদ্গীরণরত কামান,
পেছনে খাদ্যশস্য আঁকড়ে-ধরা জনতা—
কামানের ধোঁয়ার আড়ালে আড়ালে দেখলাম,
মানুষ।
আর দেখলাম ফসলের প্রতি তাদের পুরুষানুক্রমিক
মমতা।
অনেক যুগ, অনেক অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র পেরিয়ে
তারা এগিয়ে আসছে: ঝল্সানো কঠোর মুখে॥
আঠারো বছর বয়স
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়—
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।
আঠারো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।
আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।
আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়—
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে॥
হে মহাজীবন
ছাড়পত্র
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হে-মহাজীবন, আর এ কাব্য নয়
এবার কঠিন, কঠোর গদ্যে আনো,
পদ-লালিত্য-ঝঙ্কার মুছে যাক
গদ্যের কড়া হাতুড়িকে আজ হানো!
প্রয়োজন নেই, কবিতার স্নিগ্ধতা—
কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি,
ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়:
পূর্ণিমা-চাঁদ যেন ঝল্সানো রুটি॥
ভেজাল
মিঠেকড়া
সুকান্ত ভট্টাচার্য
ভেজাল, ভেজাল ভেজাল রে ভাই, ভেজাল সারা দেশটায়,
ভেজাল ছাড়া খাঁটি জিনিষ মিলবে নাকো চেষ্টায়!
ভেজাল তেল আর ভেজাল চাল, ভেজাল ঘি আর ময়দা,
‘কৌন ছোড়ে গা ভেজাল ভেইয়া, ভেজালসে হ্যায় ফয়দা।’
ভেজাল পোশাক ভেজাল খাবার, ভেজাল লোকের ভাবনা,
ভেজালেরই রাজত্ব এ পাটনা থেকে পাবনা।
ভেজাল কথা— বাংলাতে ইংরেজী ভেজাল চলছে,
ভেজাল দেওয়া সত্যি কথা লোকেরা আজ বলছে।
‘খাঁটি জিনিষ’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে,
‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে।
কলিতে ভাই ‘ভেজাল’ সত্য ভেজাল ছাড়া গতি নেই,
ছড়াটাতেও ভেজাল দিলাম, ভেজাল দিলে ক্ষতি নেই॥
বিয়ে বাড়ির মজা
মিঠেকড়া
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বিয়ে বাড়ি: বাজছে সানাই, বাজছে নানান বাদ্য
একটি ধারে তৈরী হচ্ছে নানা রকম খাদ্য;
হৈ-চৈ আর চেঁচামেচি, আসছে লুচির গন্ধ,
আলোয় আলোয় খুলি সবাই, কান্নাকাটি বন্ধ,
বাসরঘরে সাজছে ক’নে, সবাই উৎফুল্ল,
লোকজনকে আসতে দেখে কর্তার মুখ খুলল:
“আসুন, আসুন— বসুন সবাই, আজকে হলাম ধন্য,
যৎসামান্য এই আয়োজন আপনাদেরই জন্য;
মাংস, পোলাও, চপ-কাটলেট, লুচি এবং মিষ্টি
খাবার সময় এদের প্রতি দেবেন একটু দৃষ্টি।”
বর আসেনি, তাই সকলে ব্যস্ত এবং উৎসুক,
আনন্দে আজ বুক সকলের নাচছে কেবল ধুক-ধুক,
‘হুলু’ দিতে তৈরি সবাই, শাঁক হাতে সব প্রস্তুত,
সময় চলে যাচ্ছে ব’লে মনটা করছে খুঁত-খুঁত!
ভাবছে সবাই কেমন ক’রে বরকে করবে জব্দ;
হঠাৎ পাওয়া গেল পথের মোড়ে গাড়ির শব্দ:
হুলুধ্বনি উঠল মেতে, শাঁক বাজল জোরে,
বরকে সবাই এগিয়ে নিতে গেল পথের মোড়ে।
কোথায় বরের সাজসজ্জা, কোথায় ফুলের মালা?
সবাই হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে, পালা, পালা, পালা।
বর নয়কো, লাল-পাগড়ি পুলিশ আসছে নেমে।
বিয়েবাড়ির লোকগুলো সব হঠাৎ উঠল ঘেমে,
বললে পুলিশ: এই কি কর্তা, ক্ষুদ্র আয়োজন?
পঞ্চাশ জনে কোথায়? এ যে দেখছি হাজার জন!
এমনি করে চাল নষ্ট দুর্ভিক্ষের কালে?
থানায় চলো, কাজ কি এখন এইখানে গোলমালে?
কর্তা হলেন কাঁদো কাঁদো, চোখেতে জল আসে,
গেটের পাশে জড়ো-হওয়া কাঙালীরা হাসে॥
মেয়েদের পদবী
মিঠেকড়া
সুকান্ত ভট্টাচার্য
মেয়েদের পদবীতে গোলমাল ভারী,
অনেকের নামে তাই দেখি বাড়াবাড়ি;
‘আ’কার অন্ত দিয়ে মহিলা করার
চেষ্টা হাসির। তাই ভূমিকা ছড়ার।
‘গুপ্ত’ ‘গুপ্তা’ হয় মেয়েদের নামে,
দেখছি অনেক চিঠি, পোস্টকার্ড, খামে।
সে নিয়মে যদি আজ ‘ঘোষ’ হয় ‘ঘোষা’,
তা হলে অনেক মেয়ে করবেই গোসা,
‘পালিত’ ‘পালিতা’ হলে ‘পাল’ হলে ‘পালা’
নির্ঘাৎ বাড়বেই মেয়েদের জ্বালা;
‘মল্লিক’ ‘মল্লিকা’, ‘দাস’ হলে ‘দাসা’,
শোনাবে পদবীগুলো অতিশয় খাসা;
‘কর’ যদি ‘করা’ হয়, ‘ধর’ হয় ‘ধরা’
মেয়েরা দেখবে এই পৃথিবীটা— “সরা”,
‘নাগ’ যদি ‘নাগা’ হয় ‘সেন’ হয় ‘সেনা’,
বড়ই কঠিন হবে মেয়েদের চেনা॥
অতি কিশোরের ছড়া
মিঠেকড়া
সুকান্ত ভট্টাচার্য
তোমরা আমায় নিন্দে ক’রে দাও না যতই গালি,
আমি কিন্তু মাখছি আমার গালেতে চুনকালি,
কোনো কাজটাই পারি নাকো বলতে পারি ছড়া,
পাশের পড়া পড়ি না ছাই পড়ি ফেলের পড়া।
তেতো ওষুধ গিলি নাকো, মিষ্টি এবং টক
খাওয়ার দিকেই জেনো আমার চিরকালের সখ।
বাবা-দাদা সবার কাছেই গোঁয়ার এবং মন্দ,
ভাল হয়ে থাকার সঙ্গে লেগেই আছে দ্বন্দ্ব।
পড়তে ব’সে থাকে আমার পথের দিকে চোখ,
পথের চেয়ে পথের লোকের দিকেই বেশী ঝোঁক।
হুলের কেয়ার করি নাকো মধুর জন্য ছুটি,
যেখানে ভিড় সেখানেতেই লাগাই ছোটাছুটি।
পন্ডিত এবং বিজ্ঞজনের দেখলে মাথা নাড়া,
ভাবি উপদেশের ষাড়ে করলে বুঝি তারা।
তাইতো ফিরি ভয়ে ভয়ে, দেখলে পরে তর্ক,
বুঝি কেবল গোময় সেটা,— নয়কো মধুপর্ক।
ভুল করি ভাই যখন তখন, শোধরাবার আহ্লাদে
খেয়ালমতো কাজ ক’রে যাই, কষ্ট পাই কি সাধে?
সোজাসুজি যা হয় বুঝি, হায় অদৃষ্ট চক্র!
আমার কথা বোঝে না কেউ পৃথিবীটাই বক্র॥
পুরনো ধাঁধাঁ
মিঠেকড়া
সুকান্ত ভট্টাচার্য
বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে?
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
বড় মানুষ ভোজের পাতে ফেলে লুচি-মিষ্টি,
গরীবরা পায় খোলামকুচি, একি অনাসৃষ্টি?
বলতে পার ধনীর বাড়ি তৈরি যারা করছে,
কুঁড়েঘরেই তারা কেন মাছির মতো মরছে?
ধনীর মেয়ের দামী পুতুল হরেক রকম খেলনা,
গরীব মেয়ে পায় না আদর, সবার কাছে ফ্যালনা।
বলতে পার ধনীর মুখে যারা যোগায় খাদ্য,
ধনীর পায়ের তলায় তারা থাকতে কেন বাধ্য?
‘হিং-টিং-ছট্’ প্রশ্ন এসব, মাথার মধ্যে কামড়ায়,
বড়লোকের ঢাক তৈরী গরীব লোকের চামড়ায়॥
সিপাহী বিদ্রোহ
মিঠেকড়া
সুকান্ত ভট্টাচার্য
হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ— “হো-হো, হো-হো, হো-হো”
চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে— সিপাহী বিদ্রোহ!
আগুন হয়ে সারাটা দেশ ফেটে পড়ল রাগে,
ছেলে বুড়ো জেগে উঠল নব্বই সন আগে:
একশো বছর গোলামিতে সবাই তখন ক্ষিপ্ত,
বিদেশীদের রক্ত পেলে তবেই হবে তৃপ্ত!
নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী—
সবার হাতে অস্ত্র, নাচে বনের পশু-পক্ষী।
কেবল ধনী, জমিদার আর আগের রাজার ভক্ত
যোগ দিল, তা নয়কো, দিল গরীবেরাও রক্ত!
সবাই জীবন তুচ্ছ করে, মুসলমান ও হিন্দু,
সবাই দিতে রাজি তাদের প্রতি রক্তবিন্দু;
ইতিহাসের পাতায় তোমরা পড় কেবল মিথ্যে,
বিদেশীরা ভুল বোঝাতে চায় তোমাদের চিত্তে।
অত্যাচারী নয়কো তারা, অত্যাচারীর মুণ্ড
চেয়েছিল ফেলতে ছিঁড়ে জ্বালিয়ে অগ্নিকুণ্ড।
নানা জাতের নানান সেপাই গরীব এবং মূর্খ:
সবাই তারা বুঝেছিল অধীনতার দুঃখ;
তাইতো তারা স্বাধীনতার প্রথম লড়াই লড়তে
এগিয়েছিল, এগিয়েছিল মরণ বরণ করতে!
আজকে যখন স্বাধীন হবার শেষ লড়াইয়ের ডঙ্কা
উঠছে বেজে, কোনোদিকেই নেইকো কোনো শঙ্কা;
জব্বলপুরে সেপাইদেরও উঠছে বেজে বাদ্য
নতুন ক’রে বিদ্রোহ আজ, কেউ নয়কো বাধ্য,
তখন এঁদের স্মরণ করো, স্মরণ করো নিত্য—
এঁদের নামে, এঁদের পণে শানিয়ে তোলো চিত্ত।
নানাসাহেব, তাঁতিয়াটোপি, ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী,
এঁদের নামে, দৃপ্ত কিশোর, খুলবে তোমার চোখ কি?
front page › Forums › Poetry of Sukanta Bhattacharya
Tagged: bengali