Quran Sherif: First Bengali Translation by Bhai Girish Chandra Sen (1936)

Print Friendly, PDF & Email

আরব্য-ভাষার প্রণালী বঙ্গীয়-ভাষার প্রণালীর সম্পূর্ণ বিপরীত। বাঙ্গলা বাম দিক হইতে লিখিত হইয়া থাকে, আরবী ঠিক তাহার বিপরীত দক্ষিণ দিক্ হইতে লিখিত হয়। বচন-বিন্যাস প্রণালীও সেইরূপ। সাধারণতঃ কর্তৃপদ পূর্বে স্থাপিত ও সমাপিকা ক্রিয়া অস্তে সংযুক্ত হইয়া বাঙ্গলা ভাষার বাক্য সমাপ্ত হইয়া থাকে, কিন্তু প্রায়শ: আরব্য বাক্যের আরম্ভে সমাপিকা ক্রিয়ার ও অন্তে কর্তৃপদের প্রয়োগ হয়। অনেক স্বলে বঙ্গ-ভাষার কর্তৃকারক ব্যক্ত ক্রিয়াপদ উহ্য থাকে, আরব্য-ভাষায় তাহার বিপরীত

Print Friendly, PDF & Email

গিরিশ চন্দ্র সেন (জন্ম: ১৮৩৪ – মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ১৯১০)

কোরআন শরীফ –ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন অনুদিত

ভূমিকা

 

পৃথিবীর যাবতীয় সভ্য ভাষায় বাইবেল(Bible) পুস্তক অনুবাদিত হইয়া সর্বত্র সকল জাতির মধ্যে প্রচার হওয়ায় সাধারণের পক্ষে তাহা যাহার পর নাই সুলভ হইয়াছে। তজ্জন্যই দেবাত্মা ঈসার দেবচরিত্র ও তাহার স্বর্গীয় জীবন-প্রদ উপদেশ সকল বাইবেলে সহজে পাঠ করিতে পারিয়া নানা দেশের নানা জাতীয় অগণ্য লোক আলোক ও জীবন লাভ করিয়াছে। কিন্তু বিধানমণ্ডলীভুক্ত ভূমণ্ডলের একটি প্রধান ও পরাক্রাস্ত জাতি মোসলমান, তাহদের মূল বিধান-পুস্তক কোরআন শরীফ শুদ্ধ তাঁহাদের মধ্যেই দুরূহ আরব্য ভাষারূপ দুর্ভেদ্য দুর্গের ভিতরে বদ্ধ রহিয়াছে। অন্য জাতির নিকট মোসলমানেরা কোরআন বিক্রয় পর্যন্ত করেন না, অপর লোকে তাহ পড়িবে দূরে থাকুক স্পর্শ করিতেও পায় না। অন্য জাতির মধ্যে আরব্য ভাষার চর্চাও বিরল।

কেহ কোরআন হস্তগত করিতে পারিলেও ভাষাজ্ঞানের অভাবে তাহার মর্ম কিছুই অবধারণ করিতে সমর্থ হয় না। সুতরাং ইহা কতিপয় মোসলমান মৌলবীর একচেটিয়া সম্পত্তি হইয়া রহিয়াছে। মৌলবী শাহ্র ফিয়োদ্দীন উর্দু ভাষায় এবং শাহ্ আলী আল্লাহ্ ফতেহোর রহমান নামে পারস্য ভাষায় কোরআনের অনুবাদ করিয়া প্রচার করিয়াছেন; কিন্তু তাহা মূল পুস্তকের সঙ্গে একত্র সংবদ্ধ আছে, স্বতন্ত্র পুস্তকাকারে পাওয়া যায় না। সেই অনুবাদিত পুস্তকদ্বয় স্বপ্রাপ্য হইলেও উর্দু ও পারস্য ভাষানভিজ্ঞ বাঙ্গালীর পক্ষে তাহা অন্ধজনের পক্ষে দর্পণের ন্যায় নিষ্ফল। ইংরাজী ভাষায় কোরআনের অনুবাদ প্রচার হইয়াছে সত্য; কিন্তু এ-দেশে তাহা সচরাচর প্রাপ্য নহে। অপিচ যাহারা ইংরাজী জানেন না তাঁহাদের পক্ষে উহা প্রাপ্ত হওয়া না হওয়া তুল্য। আমি আরব্য ভাষা শিক্ষায় প্রবৃত্ত্ব হইলে অনেক বন্ধু বঙ্গভাষায় মূল কোরআন অনুবাদ করিয়া প্রচার করিতে আমাকে অনুরোধ করেন, এ বিষয়ে আমি কোন কোন মোসলমান বন্ধু কর্তৃকও বিশেষরূপে অনুরুদ্ধ হই। কোরআন অধ্যয়ন ও তাহা অনুবাদ করাই আরব্য-ভাষা শিক্ষায় প্রবৃত্ত হওয়ার আমার প্রধান উদ্দেশ্য। বন্ধুদিগের আগ্রহে ও স্বীয় কর্তব্যানুরোধে ঈশ্বর কৃপায় আমি এক্ষণ কোরআন বঙ্গভাষায় অনুবাদ করিয়া প্রকটন করিয়াছি

 যাহাতে কোরআনের মূল ‘‘আয়ত” (প্রবচন) সকলের অবিকল অনুবাদ হয়, তদ্বিষয়ে যথোচিত যত্ন করা হইয়াছে। তদনুরোধে বঙ্গ ভাষার লালিত্য রক্ষার প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখিতে পারা যায় নাই। কিন্তু আরব্য-ভাষার প্রণালী বঙ্গীয়-ভাষার প্রণালীর সম্পূর্ণ বিপরীত। বাঙ্গলা বাম দিক হইতে লিখিত হইয়া থাকে, আরবী ঠিক তাহার বিপরীত দক্ষিণ দিক্ হইতে লিখিত হয়। বচন-বিন্যাস প্রণালীও সেইরূপ। সাধারণতঃ কর্তৃপদ পূর্বে স্থাপিত ও সমাপিকা ক্রিয়া অস্তে সংযুক্ত হইয়া বাঙ্গলা ভাষার বাক্য সমাপ্ত হইয়া থাকে, কিন্তু প্রায়শ: আরব্য বাক্যের আরম্ভে সমাপিকা ক্রিয়ার ও অন্তে কর্তৃপদের প্রয়োগ হয়। অনেক স্বলে বঙ্গ-ভাষার কর্তৃকারক ব্যক্ত ক্রিয়াপদ উহ্য থাকে, আরব্য-ভাষায় তাহার বিপরীত; অর্থাৎ কর্তৃকারক অব্যক্ত ক্রিয়াপদ ব্যক্ত হইয়া থাকে; ক্রিয়া পদের পুরুষ, লিঙ্গ ও বচনের চিহ্ন দ্বারা কর্তা নির্ণয় করিতে হয়।

অল্প কথায় বিস্তৃত ভাব ব্যক্ত করিতে আরব্য ভাষা যেরূপ অনুকুল, এমন পূর্ণ ভাষা যে সংস্কৃত তদ্বিষয়ে অনেক স্থলে পরাস্ত। আরবীয় একটি কথার ভাব ব্যক্ত করিতে বাঙ্গলা ভাষায় প্রায় তাহার দ্বিগুণ ত্রিগুণ কথা প্রয়োগ করতে হয়। এই উভয় ভাষার পদ-বিন্যাস প্রণালী ইত্যাদির বহু বিভিন্নতাহেতু কোরআনের প্রবচন সকল আরবী ভাষার রীতি অনুসারে বাঙ্গলা ভাষায় আক্ষরিক অনুবাদ করিতে গেলে তাহা নিতান্ত শ্রুতিকটু ও দুর্বোধ হইয় উঠে, অতএব আমাকে অনুবাদে বঙ্গ-ভাষার বচন-বিন্যাস প্রণালীর অনুসরণ করিতে হইয়াছে। বিশদরূপে ভাব। প্রকাশ করিবার জন্য যে-যে স্থানে দুই-একটি অতিরিক্ত শব্দের প্রয়োগ কর। হইয়াছে, তাহা () এই চিহ্নের মধ্যে ব্যবস্থাপিত করা গিয়াছে। দুরূহ বাক্যের টীকা ও ঐতিহাসিক তত্ত্ব সকল প্রায়ই কোরআনের পারস্য ভাষ্য-পুস্তক “তফসীর হোসেনী” এবং ‘শাহ আরদোল কাদেরের’ উদু-ভাষ্য অবলম্বন করিয়া লিখিত হইয়াছে। আমি কোরআনোক্ত বাক্যের অর্থবোধ ও অনুবাদে এই দুই ভাষ্য হইতে অনেক সাহায্য পাইয়াছি।

 কোরআন শব্দের অর্থ পাঠ,—কোরআনের অপর নাম “কলামাল্লাহ্” (ঈশ্বর-বাণী)। সময়ে সময়ে মহাপুরুষ মোহম্মদ জগতের কল্যাণার্থ প্রচার করিতে যে সকল প্রত্যাদেশ লাভ করিয়াছিলেন তাঁহাই পুস্তকে একত্র সংবদ্ধ হইয়া কোরআন নাম প্রাপ্ত হইয়াছে। মোসলমানেরা ঈশ্বরের বাক্য বলিয়া, কোরআনকে অত্যন্ত সম্মান করেন। কোরআন অধ্যয়ন ও শ্রবণে বহু পুণ্য লিখিত আছে। সমুদায় মোসলমান কোরআনের মতানুসারে চলিতে বাধ্য। কোরআনকে কোনরূপ অতিক্রম করিলে মহাপাতকী হইতে হয়। কোরআন পাঠকালে পাঠকের নিম্নলিখিত নীতি সকল পালন করা বিধেয়। যথা—দন্তধাবন, ওজু (বিশেষ নিয়মানুসারে হস্তপদ মুখাদি প্রক্ষালন) করিয়া অব্যেতা শুদ্ধ ভূমিতে শুদ্ধ সঙ্কল্প সহকারে পশ্চিমাভিমুখে বসিবেন। তিনি মসজেদে বসিতে পারিলে উত্তম হয়। কোরআন শরীফকে বিশুদ্ধ উচ্চা সনের উপর অর্থাৎ রহল ইত্যাদির উপর সংস্থাপন করিবেন।

প্রথমত: “অউজ বেল্লাহ্”(ঈশ্বরের শরণাপন্ন হই) ও “বেসমাল্লাহু” (ঈশ্বরের নামে প্রবৃত্ত হইতেছি) উচ্চারণ করিয়া দীনভাবে ও বিনীত অন্তরে শুদ্ধরূপে পড়িবেন। অধ্যেতা “সূরা তওবা” ব্যতীত প্রত্যেক “সূরার” (অধ্যায়ের) পূর্বে ‘বেসমাল্লাহু” বলিবেন, এবং অধ্যয়ন কালে অন্য কোন কথা উচ্চারণ করিলে পুনবার পাঠারম্ভ করার পূর্বে “বেহমাল্লাহ্” বলিবেন এবং ইহা বোধ করিবেন যে, তিনি পরমেশ্বরের সহিত কথা কহিতেছেন ও যেন তাহাকে দেখিতেছেন। যদি এরূপ অবস্থা না হয় তবে তিনি মনে করিবেন যে, ঈশ্বর তাঁহাকে দেখিতেছেন ও নিষেধ বিধি করিতেছেন; সুসংবাদজনক প্রবচন পাঠে প্রফুল্ল হইবেন, এবং ভীতিজনক প্রবচন অধ্যয়নকালে ভীত ও রোরুদ্যমান হইবেন।

 মূল কোরআন শুদ্ধরূপে উচ্চারণ করিবার জন্য ত্রিশ বত্রিশ প্রকার আক্ষরিক চিহ্ন ব্যবহৃত হইয়া থাকে। কোরআনের বঙ্গীয় অনুবাদ পুস্তকে আরবীয় সেই সকল আক্ষরিক চিহ্ন ব্যবহারে প্রয়োজনাভাব বলিয়া তাহার প্রয়োগ হইল না। প্রত্যেক আয়তের অন্তে বিরাম চিহ্ন ব্যবহৃত হইয়াছে। কোরআনের প্রত্যেক সূরার অন্তর্গত আয়ত সকলের সংখ্যা ১, ২, ৩ করিয়া প্রত্যেক আয়তের অস্তে ও সমুদায় আয়তের সংখ্যার সমষ্টি সূরার আরম্ভে লিখিত আছে। কোরআন অধ্যয়নকালে বিশেষ বিশেষ আয়তে মস্তক অবনত করিয়া কিয়ৎক্ষণ বিরত থাকিতে হয়। এইরূপ নমন কার্যকে “রকু” বলে। কোরআন পাঠের বা নামাজে ব্যবচ্ছেদরূপে “রকু” ব্যবহৃত হয়। সূরা সকলের প্রারম্ভে প্রত্যেক সূরার “রকুর”সমষ্টি লিখিত আছে। কোরআনের ভিন্ন ভিন্ন সূরার অন্তর্গত নিদিষ্ট ১২টি আয়তে সেজদার (নমস্কারের) বিধি আছে।

কোরআন শরীফ ত্রিশ ভাগে বিভক্ত, সেই এক এক ভাগের নাম “সিপারা “প্রত্যেক ভাগকে আবার চারি অংশে পৃথক করা হইয়াছে। প্রত্যেক অংশের শেষ ভাগে ক্রমে “রোবা” ও “নোসফা’ এবং “সোলোসা”(চতুর্থাংশ, অর্ধাংশ এবং তৃতীয়াংশ)এরূপ লিখিত আছে। যে-যে বচন হইতে “সিপারা” সকলের আরম্ভ, সেই সেই বচনের প্রথম শব্দানুসারে সেই সমস্ত সিপারার নাম হইয়াছে। যথা, “আলক্ষ্মা”, “সইয়কুলু” ও “তেলুকরোপোলো”। নরপতি হোজ্জাজের রাজত্বকালে তাহার আদেশে কোরআনের এইরূপ বিভাগ হয়। আবার সমগ্র কোরআন ৬০ ভাগে বিভক্ত, এই প্রত্যেক ভাগের নাম “খৰ্ব”; এবং আরও অষ্টাদশ ভাগে বিভক্ত হইয়াছে, তাহাকে “মানকা” বলে। কোরআন পাঠ ও তাহা ক্রমে মুখস্থ করিবার সুবিধার জন্য এই সকল বিভাগ হইয়াছে। নুন্যকল্পে তিন দিন ও অনধিক চল্লিশ দিনের মধ্যে কোরআন সম্পূর্ণ পাঠ করা বিধি।



Home Forums Quran Sherif: First Bengali Translation by Bhai Girish Chandra Sen (1936)

Tagged: ,

Viewing 0 reply threads
  • Author
    Posts
    • #218519
      advtanmoy
      Keymaster

      আরব্য-ভাষার প্রণালী বঙ্গীয়-ভাষার প্রণালীর সম্পূর্ণ বিপরীত। বাঙ্গলা বাম দিক হইতে লিখিত হইয়া থাকে, আরবী ঠিক তাহার বিপরীত দক্ষিণ দিক্ হইতে লিখিত হয়। বচন-বিন্যাস প্রণালীও সেইরূপ। সাধারণতঃ কর্তৃপদ পূর্বে স্থাপিত ও সমাপিকা ক্রিয়া অস্তে সংযুক্ত হইয়া বাঙ্গলা ভাষার বাক্য সমাপ্ত হইয়া থাকে, কিন্তু প্রায়শ: আরব্য বাক্যের আরম্ভে সমাপিকা ক্রিয়ার ও অন্তে কর্তৃপদের প্রয়োগ হয়। অনেক স্বলে বঙ্গ-ভাষার কর্তৃকারক ব্যক্ত ক্রিয়াপদ উহ্য থাকে, আরব্য-ভাষায় তাহার বিপরীত

      [See the full post at: Quran Sherif: First Bengali Translation by Bhai Girish Chandra Sen (1936)]

Viewing 0 reply threads
  • You must be logged in to reply to this topic.

Next Post

Mymensingh in 1905

Fri Jul 21 , 2023
ইংরাজ যখন প্রথমে আমাদের এদেশে আসে, তখন নানা কারণে আমাদের জাতীয় জীবন দুর্ব্বলতার আধার হইয়াছিল। তখন আমাদের ধর্ম্ম একেবারেই নিস্তেজ হইয়া পড়িয়াছিল, এদিকে চির পুরাতন চিরশক্তির আকর সনাতন হিন্দু ধর্ম্ম কেবল মাত্র মৌখিক আবৃত্তি ও আড়ম্বরের মধ্যে আপনার শিবশক্তিকে হারাইয়া ফেলিয়াছিল ও অপর দিকে যে অপূর্ব প্রেমধর্ম্মের বলে মহা প্রভু সমস্ত বাঙ্গলা দেশকে জয় করিয়াছিলেন, সেই প্রেমধর্ম্মের অনন্ত মহিমা ও প্রাণ-সঞ্চারিণী শক্তি কেবল মাত্র তিলককাটা ও মালা ঠকঠকানিতেই নিঃশেষিত হইয়া যাইতেছিল। বাঙ্গলার হিন্দুর সমগ্র ধর্ম্মক্ষেত্র শক্তিহীন শাক্ত ও প্রেমশূন্য বৈষ্ণবের ধর্ম্মশূন্য কলহে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তখন নবদ্বীপের চিরকীর্ত্তিময় জ্ঞানগৌরব কেবল মাত্র ইতিহাসের কথা, অতীত কাহিনী, বাঙ্গালী জীবনের সঙ্গে তাহার কোন সম্বন্ধ ছিল না, এই রূপে কি ধর্ম্মে, কি জ্ঞানে বাঙ্গালার হিন্দু তখন সর্ব্ববিষয়ে প্রাণহীন হইয়া পড়িয়াছিল।

You May Like

Recent Updates

%d bloggers like this: