লক্ষ্মীর পাঁচালী
Bangla Lakkhir Panchali was written by Barai Pandit in or about 1770 at the time of the great Bengal Famine, in the Kolkata Chitpur area. Several versions of লক্ষ্মী পাঁচালী are available in the local market, we put the most authentic version first in our edition. Below we shall mention some instances of Bengali Lakshmi Panchali (লক্ষ্মীর পাঁচালী)
Lakshmi Panchali
ইন্দ্রের প্রতি বলিদেহনির্গতা লক্ষ্মীর উপদেশ
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! দানবরাজ বলি (Bali) এই কথা কহিবামাত্র রাজলক্ষ্মী স্বীয় উজ্জ্বল রূপ ধারণপূৰ্ব্বক তাঁহার শরীর হইতে নির্গত হইলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহাকে অবলোকনপূর্ব্বক বিস্ময়োফুল্ললোচনে বলিকে সম্বোধনপূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘দানবরাজ! এই যে চূড়া-কেয়ূরধারিণী নারী তোমার দেহ হইতে নিঃসৃত হইয়া স্বীয়, তেজঃপ্রভাবে দেদীপ্যমান হইতেছেন, ইনি কে?’ বলি কহিলেন, ‘দেবরাজ! ইনি দেবী; আসুরী বা মানুষী নহেন। তোমার কিছু জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয়, ইহাকে জিজ্ঞাসা কর।’
“তখন ভগবান পাকশাসন (Indra) লক্ষ্মীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘আৰ্য্যে! আপনি কে? আর কি নিমিত্তই বা দৈত্যেশ্বরকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমাকে আশ্রয় করিতেছেন? আমি ইহা কিছুতেই বুঝিতে পারিতেছি না। আপনি অনুগ্রহ করিয়া উহার বিশেষ বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করুন।’
“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘সুররাজ! পূর্ব্বতন মহারাজ বিরোচন এবং এই বিরোচনপুত্র (Son of Virochan) বলি আমাকে জ্ঞাত হইতে পারে নাই। পণ্ডিতেরা আমাকে দুঃসহা, বিধিৎসা [বিধাত্রী], ভূতি [ঐশ্বৰ্য্য], লক্ষ্মী ও শ্ৰী (Sree) বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। তুমি ও অন্যান্য দেবগণ তোমরা কেহই আমাকে পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ নহে।’ [কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত -শান্তিপর্ব ( ২২৫)]
Lakshmi Panchali
অর্ধেক জীবন -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
“আমার মা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপুজো করতেন। তাও অতি যৎসামান্য উদ্যোগ যাকে বলে। দুটি মাত্র ঘর, তার একটিতে শুই আমি আর কাকা। অন্য ঘরটিতে আর তিন ভাই বোনকে নিয়ে মা আর বাবা। দিনের বেলা আমাদের ছোট ঘরটিই সব ভাই বোনদের পড়ার ঘর, আবার দৈবাৎ কোনও বাইরের লোক এসে গেলে, সেটাই তাঁদের বসবার ঘর, তখন আমাদের বাইরে চলে যেতে হত। মায়েদের ঘরখানি জিনিসপত্রে ঠাসা, তারই এক দেয়ালের তাকে একটি লক্ষ্মী ঠাকরুনের ছোট মূর্তি, আর কয়েকটা ছবি, সামান্য কিছু ফুল, কোষাকুষি। আর পেতলের রেকাবিতে প্রসাদের জন্য বরাদ্দ চার পয়সার বাতাসা বা গুজিয়া। বেস্পতিবার সন্ধেবেলা মা স্নান করে এসে নিজেই পুজো করতেন, পুজো মানে ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি ও ব্রতকথা’ নামে একটি পুস্তিকা পাঠ। কোনও কোনও বেম্পতিবারে সেই পুজোর ভার নিতে হত আমাকে, কারণ নারীরা রজঃস্বলা হলে কোনও পূজায় অংশগ্রহণ করতে নেই। আমি মাতৃভক্ত ছেলে, কারণ মায়ের কাছে কাকুতি-মিনতি করলে তবু দু’-চার পয়সা পাওয়া যায়, বাবার কাছে সে রকম কোনও দাবি উত্থাপনের সাহসই ছিল না। বাবাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করতাম। সেইসময় গ্রাম দেশে বাবাকে আপনি ও মাকে তুই বলার রেওয়াজ ছিল, বিদ্যাসাগর মশাই পর্যন্ত মাকে তুই বলতেন, আমরা অবশ্য মাকে তুমি বলতেই শিখেছি।
মায়ের দায়িত্বটি পালন করতে রাজি হলেও সন্ধেবেলা স্নান করা আমার ধাতে সয় না। বাইরের জামা প্যান্ট বদলে, মাথায় একটু গঙ্গাজলের ছিটে দিয়ে শুদ্ধ হয়ে বসে যেতাম তুলোর আসনে। দুলে দুলে পড়তাম লক্ষ্মীর পাঁচালি, এখনও তার অনেক পঙক্তি মনে আছে :
দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ
মৃদু মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস
মলয় পর্বতে বসি লক্ষ্মী নারায়ণ
মনোসুখে দুইজনে করে আলাপন…
এরপর ঋষি নারদ এসে লক্ষ্মীকে বললেন :
নরলোক পানে মাগো চাহ একবার
মর্ত্যবাসী অন্নাভাবে করে হাহাকার
বল মাগো কৃপা করি কী পাপের ফলে
মর্ত্যবাসী নরনারী সদা দুঃখে জ্বলে…
তা শুনে লক্ষ্মী দেবীর উত্তর :
লজ্জা আদি গুণ যত রমণীর আছে
ক্ষণিক সুখের লাগি বর্জন করেছে
স্বামীরে না মানে তারা না শুনে বচন।
ইচ্ছা মত হেথা সেথা করিছে ভ্রমণ…
কয়েক বার পাঠ করলেই পুরো চটি বইটি মুখস্থ হয়ে যায়। এর একটা বিশেষ উপকারিতা পেয়েছি পরবর্তী জীবনে। পুরো বর্ণনাই পয়ার ছন্দে, চোদ্দ মাত্রা। আমায় কেউ শিখিয়ে দেয়নি, অবচেতনেই ছন্দের কান তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। কাকে পর্ব বলে, কার নাম মাত্রা, কিছুই জানি না, তবু, কপালে না থাকে যদি লক্ষ্মী দিবে ধন’, এটা পড়তে গিয়ে কপালে না থাকে যদি’, এখানে একটু থামি, তারপর লক্ষ্মী দিবে ধন। অর্থাৎ আট ছয়, আট ছয়, পয়ারে যাহারে কয়। যেমন, মহাভারতের কথা/ অমৃত সমান।, কাশীরাম দাস ভণে/ শুনে পুণ্যবান,’! ওই লক্ষ্মীর পাঁচালির পদ্যকার ছন্দে খুব একটা দক্ষ নন, কেন না, তাতে এরকমও পংক্তি আছে, সাত ভাই দৈবকে বলে করিয়া বিনয়, এটা আমি বারবার উচ্চারণ করি আর আমার কানে খটকা লাগে। সাত ভাই দৈবকে বলে/করিয়া বিনয়, এর মধ্যে কিছু একটা বেশি হয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তি বোধ হয়, মাথা নাড়ি। রবীন্দ্রনাথ শিশু বয়সে প্রথম পাঠে জল পড়ে, পাতা নড়ে’ থেকেই ছন্দ-মিল চিনতে শিখেছিলেন, আর আমার ফাইভ-সিক্স স্কুল বয়েস থেকে লক্ষ্মীর পাঁচালি মুখস্থ করে ছন্দ শিক্ষা শুরু হয়”।
Lakshmi Panchali
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় – গণদেবতা (১৯৪২)
একদিন লক্ষ্মী-নারায়ণ চলিয়াছিলেন আকাশ-পথে। রাখালের কাতর কান্না আসিয়া পৌঁছিল। তাহাদের কানে। মা-লক্ষ্মীর কোমল হৃদয় ব্যথিত হইয়া উঠিল। দূর কর ঠাকুর, রাখালের দুঃখ। দূর কর!
নারায়ণ হাসিলেন। বলিলেন—এ দুঃখ দূর করিবার শক্তি তো আমার নাই লক্ষ্মী, সে শক্তি তোমার!
লক্ষ্মী বলিলেন—তুমি অনুমতি দাও।
নারায়ণের অনুমতি পাইয়া লক্ষ্মী আসিলেন মর্ত্যে। চারিদিক হাসিয়া উঠিল—সোনার বর্ণচ্ছটায়, বাতাস ভরিয়া উঠিল দেবীর দিব্যাঙ্গের অপরূপ সৌরভে। রাখাল অবাক হইয়া গেল। দেবী রাখালের কাছে আসিয়া বলিলেন দুঃখ তোমার দূর হইবে, তুমি আমার কথামত কাজ কর। এই লও ধানের বীজ; বর্ষার সময় মাঠে এইগুলি ছড়াইয়া দাও, বীজ হইতে গাছ হইবে। সেই গাছের বর্ণ যখন হইবে আমার দেহবর্ণের মত, আমার গাত্রগন্ধের মত, গন্ধে যখন ভরিয়া উঠিবে তাহার সর্বাঙ্গ, তখন সেগুলি কাটিয়া ঘরে তুলিবে।
রাখাল লক্ষ্মীকে প্রণাম করিল। বর্ষায় প্রান্তরের বুকে ছড়াইয়া দিল ধানের বীজ; দেখিতে দেখিতে সমস্ত মাঠ ভরিয়া গেল সবুজ ধানের গাছে। ক্ৰমে ক্ৰমে বর্ষা গেল—সবুজ ধানের ডগায় দেখা দিল শিষ। রাখাল নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিল, কিন্তু এখনও সেই ঠাকরুনের মত বর্ণ হয় না, সে গন্ধও উঠিতেছে না। রাখাল অপেক্ষা করিয়া রহিল। হেমন্তের শেষ অগ্রহায়ণে একদিন রাত্রে ঘরে শুইয়াই রাখাল পাইল সে গন্ধ। সকালে উঠিয়াই সে ছুটিয়া গেল মাঠে। অবাক হইয়া গেল। সোনার বর্ণে গোটা মাঠটা আলো হইয়া উঠিয়াছে, দিব্যগন্ধে আকাশ বাতাস আমোদিত। সোনার বর্ণে, দিব্যগন্ধে আকৃষ্ট হইয়া আকাশে নানাবিধ কীট-পতঙ্গ-পাখি উড়িতেছে-পশুরা, আসিয়া জুটিয়াছে চারিপাশে, সেই ঠাকরুন যেন তাহার দুঃখে বিগলিত হইয়া মাঠ জুড়িয়া অঙ্গ এলাইয়া বসিয়া আছেন। রাখাল ধান কাটিয়া ভারে ভারে ঘরে তুলিল।
দেশের রাজা সংবাদ পাইয়া আসিয়া সোনা দিয়া কিনিতে চাহিলেন সমস্ত ধান। রাজার ভাণ্ডারের সোনা ফুরাইয়া গেল কিন্তু রাখালের ধান অফুরন্ত। রাজার বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। তখন রাজা আপনার কন্যাকে আনিয়া দান করিলেন রাখালের হাতে। সম্মুখেই পৌষসংক্রান্তিতে রাখাল লক্ষ্মীদেবীকে পূজা করিল। ওই ধানকেই স্থাপিত করিল সিংহাসনে, সিন্দুর কজ্জলে বসনে-ভূষণে তাহাকে বিচিত্র শোভায় সাজাইল, সম্মুখেই স্থাপন করিল জলপূৰ্ণ ঘট, ঘটের মাথায় দিল ডাব-আমের পল্লব। রাজকন্যা ঐ ধান ভানিয়া চাল করিলেন, চাল হইতে প্রস্তুত হইল সেই নানাবিধ সুখাদ্য, ঘৃতে-অন্নে ঘৃতান্ন, দুধে-অন্নে মিষ্টান্ন-পায়সান্ন-পরমান্ন, হরেক রকমের পিঠা সরুচাকলি, তাহার সঙ্গে পঞ্চপুষ্পে ধূপে-দীপে-চন্দনে-গন্ধে দেবীর পূজা করিয়া রাখাল ও রাজকন্যা দেবীর ভোগ দিয়া সর্বাগ্রে দিলেন কৃষাণকে, রাখালকে নিজের স্বামীকে, ঘরের জনকে তাহার পর বিলাইলেন পাড়া-প্রতিবেশীকে, হেলে বলদ, গাই-গুরু, ছাগল-ভেড়া—এমনকি বাড়ির উচ্ছিষ্টভভাজী কুকুরটা পর্যন্ত প্রসাদ পাইল।
লক্ষ্মীদেবী মূর্তিমতী হইয়া দেখা দিলেন, আপন পরিচয় দিলেন, বর দিলেন, তোমার মত এই পৌষ সংক্রান্তিতে যে আমার পূজার্চনা করিবে তাহার ঘরে আমি অচলা হইয়া বাস। করিব। পৃথিবীতে তাহার কোনো অভাব বা কোনো দুঃখ থাকিবে না। পরলোকে সে করিবে বৈকুণ্ঠে বাস।
* * *
ব্ৰত-কথাটি মনে মনে স্মরণ করিতে করিতে আশা-আকাঙ্ক্ষায় বুক বাঁধিয়া পরিতুষ্ট মনেই পদ্ম লক্ষ্মীর আয়োজন আরম্ভ করিল। ঘর-দুয়ার, খামার হইতে গোয়াল পর্যন্ত আলপনা অ্যাঁকিয়া এবার সে যেন একটু বেশি বিচিত্রিত করিয়া তুলিল। দুয়ার হইতে আঙিনার মধ্যস্থল পর্যন্ত আলপনায় অ্যাঁকিল চরণ-চিহ্ন। ওই চরণ-চিহ্ন। ওই চরণ-চিহ্নে পা ফেলিয়া লক্ষ্মী ঘরে আসিবেন। ঘরের মধ্যস্থলে সিংহাসনের সম্মুখে অ্যাঁকিল প্রকাও এক পদ্ম। অপরূপ তাহার কারুকার্য। মা আসিয়া বিশ্রাম করিবেন। শখ ধুইল, ধূপ বাহির করিল, প্রদীপ মার্জনা করিল, সিন্দুর রাখিল, কাজল পাড়িল। এদিকের আয়োজন শেষ করিয়া গুড়ে-নারিকেলে, গুড়ে-তিলে মিষ্টান্ন প্রস্তুত করিবে, দুধ জ্বাল দিয়া ক্ষীর হইবে। কত কাজ, কত কাজ! কাজের কি অন্ত আছে! আজ যদি তাহার একটা ছোট মেয়ে থাকি, তবে সে-ই জিনিসপত্রগুলি হাতে হাতে আগাইয়া দিতে পারিত। সহসা তাহার মনে পড়িয়া গেল—আলপনার কাজে তাহার একটা ভুল হইয়া গিয়াছে। চণ্ডীমণ্ডপে পৌষ-আগলানোর আলপনা চাই সেটা দেওয়া হয় নাই।
Lakshmi Panchali
উর লক্ষ্মী কর দয়া।
ভারতচন্দ্র রায় – অন্নদামঙ্গল
লক্ষ্মী বন্দনা
বিষ্ণুর ঘরণী : ব্রহ্মার জননী : কমলা কমলালয়া।।
সনাল কমল : সনাল উৎপল : দুখানি করে শোভিত।
কমল আসন : কমল ভূষণ : কমলমাল ললিত।।
কমলচরণ : কমলবদন : কমলনাভি গভীর।
কমলদুকর : কমলঅধর : কমলময় শরীর।।
কমলকোরক : কদম্বনিন্দুক : সুধার কলস কুচ।
করিঅরিমাঝে : জিনি কবিরাজে : কুম্ভযুগ চারু উচ।।
সুধাময় হাস : সুধাময় ভাষ : দৃষ্টিতে সুধা প্রকাশ।
লাক্ষার কাঁচলি : চমকে বিজলী : বসন লক্ষ্মীবিলাস।।
রূপ গুণ গান : যত যত স্থান : তুমি সকলের শোভা।
সদা ভুঞ্জে সুখ : নাহি জানে দুখ : যে তব ভকতি লোভা।।
সদা পায় দুখ : নাহি জানে সুখ : তুমি হও যারে বাম।
সবে মন্দ কয় : নাম নাহি লয় : লক্ষ্মীছাড়া তার নাম।।
তব নাম লয়ে : লক্ষ্মীপতি হয়ে : ত্রিলোক পালেন হরি।
যাদোগণেশ্বর : হৈল রত্নাকর : তোমারে উদরে ধরি।।
যে আছে সৃষ্টিতে : নাম উচ্চারিতে : প্রথমে তোমার নাম।
তোমার কৃপায় : অনায়াসে পায় : ধর্ম্ম অর্থ মোক্ষ কাম।।
উর মহামায়া : দেহ পদচ্ছায়া : ভারতের স্তুতি লয়ে।
কৃষ্ণচন্দ্রবাসে : থাক সদা হাসে : রাজলক্ষ্মী স্থিরা হয়ে।।

শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর পাঁচালি (Lakshmi Panchali)
লক্ষ্মীদেবীর ধ্যান মন্ত্র
ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ সৃণিভির্যাম্য সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধায়েচ্চ শ্রীয়ং ত্রৈলোক্য মাতরং।।
গৌরবর্ণাং স্বরূপাঞ্চ সর্বালঙ্কারভূষিতাম্।
রৌক্নোপদ্মব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
শ্রীশ্রীলক্ষ্মী স্তোত্রম্
ত্রৈলোক্য পূজিতে দেবী কমলে বিষ্ণুবল্লভে।
যথাস্তং সুস্থিরা কৃষ্ণে তথা ভবময়ি স্থিরা।।
ঈশ্বরী কমলা লক্ষ্মীশ্চলা ভূতি হরিপ্রিয়া।
পদ্মা পদ্মালয়া সম্পদ সৃষ্টি শ্রীপদ্মধারিণী।।
দ্বাদশৈতানি নামানি লক্ষ্মীং সম্পূজ্য যঃ পঠেত।
স্থিরা লক্ষ্মীর্ভবেৎ তস্য পুত্রদারারদিভিংসহ।।
লক্ষ্মীদেবীর স্তুতি
লক্ষ্মীস্তং সর্বদেবানাং যথাসম্ভব নিত্যশঃ।
স্থিরাভাব তথা দেবী মম জন্মনি জন্মনি।।
বন্দে বিষ্ণু প্রিয়াং দেবী দারিদ্র্য দুঃখনাশিনী।
ক্ষীরোদ সম্ভবাং দেবীং বিষ্ণুবক্ষ বিলাসিনীঃ।।
দোলপূর্ণিমা নিশীথে নির্মল আকাশ।
মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস।।
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।
কহিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।।
হেনকালে বীণাযন্ত্রে হরি গুণগান।
উপনীত হইলেন নারদ ধীমান।।
[Alternative reading-
দোল পূর্ণিমা নিশা নির্মল আকাশ
ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস
লক্ষ্মী দেবী বামে করি বসি নারায়ণ
কহিতেছে নানা কথা মুখে আলাপন
হেন কালে আসিলেন নারদ মুনিবর
হরিগুণ গানে মাতি হইয়া বিভোর ]
ধীরে ধীরে উভপদে করিয়া প্রণতি।
অতঃপর কহিলেন লক্ষ্মীদেবী প্রতি।।
শুন গো, মা নারায়ণি, চলো মর্ত্যপুরে।
তব আচরণে দুখ পাইনু অন্তরে।।
তব কৃপা বঞ্চিত হইয়া নরনারী।
ভুঞ্জিছে দুর্গতি কত বর্ণিবারে নারি।।
সতত কুকর্মে রত রহিয়া তাহারা।
দুর্ভিক্ষ অকালমৃত্যু রোগে শোকে সারা।।
অন্নাভাবে শীর্ণকায় রোগে মৃতপ্রায়।
আত্মহত্যা কেহ বা করিছে ঠেকে দায়।।
কেহ কেহ প্রাণাধিক পুত্রকন্যা সবে।
বেচে খায় হায় হায় অন্নের অভাবে।।
অন্নপূর্ণা অন্নরূপা ত্রিলোকজননী।
বল দেবি, তবু কেন হাহাকার শুনি।।
কেন লোকে লক্ষ্মীহীন সম্পদ অভাবে।
কেন লোকে লক্ষ্মীছাড়া কুকর্ম প্রভাবে।।
শুনিয়া নারদবাক্য লক্ষ্মী ঠাকুরানি।
সঘনে নিঃশ্বাস ত্যজি কহে মৃদুবাণী।।
সত্য বাছা, ইহা বড় দুঃখের বিষয়।
কারণ ইহার যাহা শোনো সমুদয়।।
আমি লক্ষ্মী কারো তরে নাহি করি রোষ।
মর্ত্যবাসী কষ্ট পায় ভুঞ্জি কর্মদোষ।।
মজাইলে অনাচারে সমস্ত সংসার।
কেমনে থাকিব আমি বল নির্বিকার।।
কামক্রোধ লোভ মোহ মদ অহংকার।
আলস্য কলহ মিথ্যা ঘিরিছে সংসার।।
তাহাতে হইয়া আমি ঘোর জ্বালাতন।
হয়েছি চঞ্চলা তাই ওহে বাছাধন।।
পরিপূর্ণ হিংসা দ্বেষ তাদের হৃদয়।
পরশ্রী হেরিয়া চিত্ত কলুষিত ময়।।
রসনার তৃপ্তি হেতু অখাদ্য ভক্ষণ।
ফল তার হের ঋষি অকাল মরণ।।
ঘরে ঘরে চলিয়াছে এই অবিচার।
অচলা হইয়া রব কোন সে প্রকার।।
এসব ছাড়িয়া যেবা করে সদাচার।
তার গৃহে চিরদিন বসতি আমার।।
এত শুনি ঋষিবর বলে, নারায়ণি।
অনাথের মাতা তুমি বিঘ্নবিনাশিনী।।
কিবা ভাবে পাবে সবে তোমা পদছায়া।
তুমি না রাখিলে ভক্তে কে করিবে দয়া।।
বিষ্ণুপ্রিয়া পদ্মাসনা ত্রিতাপহারিণী।
চঞ্চলা অচলা হও পাপনিবারণী।।
তোমার পদেতে মা মোর এ মিনতি।
দুখ নাশিবার তব আছে গো শকতি।।
কহ দেবি দয়া করে ইহার বিধান।
দুর্গতি হেরিয়া সব কাঁদে মোর প্রাণ।।
দেবর্ষির বাক্য শুনি কমলা উতলা।
তাহারে আশ্বাস দানে বিদায় করিলা।।
জীবের দুঃখ হেরি কাঁদে মাতৃপ্রাণ।
আমি আশু করিব গো ইহার বিধান।।
নারদ চলিয়া গেলে দেবী ভাবে মনে।
এত দুঃখ এত তাপ ঘুচাব কেমনে।।
তুমি মোরে উপদেশ দাও নারায়ণ।
যাহাতে নরের হয় দুঃখ বিমোচন।।
লক্ষ্মীবাণী শুনি প্রভু কহেন উত্তর।
ব্যথিত কি হেতু প্রিয়া বিকল অন্তর।।
যাহা বলি, শুন সতি, বচন আমার।
মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীব্রত করহ প্রচার।।
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে যত নারীগণ।
পূজা করি ব্রতকথা করিবে শ্রবণ।।
ধন ধান্য যশ মান বাড়িবে সবার।
অশান্তি ঘুচিয়া হবে সুখের সংসার।।
নারায়ণ বাক্যে লক্ষ্মী হরষ মনেতে।
ব্রত প্রচারণে যান ত্বরিত মর্তেতে।।
উপনীত হন দেবী অবন্তী নগরে।
তথায় হেরেন যাহা স্তম্ভিত অন্তরে।।
ধনেশ্বর রায় হয় নগর প্রধান।
অতুল ঐশ্বর্য তার কুবের সমান।।
হিংসা দ্বেষ বিজারিত সোনার সংসার।
নির্বিচারে পালিয়াছে পুত্র পরিবার।
একান্নতে সপ্তপুত্র রাখি ধনেশ্বর।
অবসান নরজন্ম যান লোকান্তর।।
পত্নীর কুচক্রে পড়ি সপ্ত সহোদর।
পৃথগন্ন হল সবে অল্প দিন পর।।
হিংসা দ্বেষ লক্ষ্মী ত্যাজে যত কিছু হয়।
একে একে আসি সবে গৃহে প্রবেশয়।।
এসব দেখিয়া লক্ষ্মী অতি ক্রুদ্ধা হল।
অবিলম্বে সেই গৃহ ত্যজিয়া চলিল।।
বৃদ্ধ রানি মরে হায় নিজ কর্মদোষে।
পুরীতে তিষ্ঠিতে নারে বধূদের রোষে।।
পরান ত্যজিতে যান নিবিড় কাননে।
চলিতে অশক্ত বৃদ্ধা অশ্রু দুনয়নে।।
ছদ্মবেশে লক্ষ্মীদেবী আসি হেন কালে।
উপনীত হইলেন সে ঘোর জঙ্গলে।।
সদয় কমলা তবে জিজ্ঞাসে বৃদ্ধারে।
কিবা হেতু উপনীত এ ঘোর কান্তারে।।
লক্ষ্মীবাক্যে বৃদ্ধা কহে শোন ওগো মাতা।
মন্দভাগ্য পতিহীনা করেছে বিধাতা।।
ধনবান ছিল পিতা মোর পতি আর।
লক্ষ্মী বাঁধা অঙ্গনেতে সতত আমার।।
সোনার সংসার মোর ছিল চারিভিতে।
পুত্র পুত্রবধূ ছিল আমারে সেবিতে।।
পতি হল স্বর্গবাসী সুখৈশ্বর্য যত।
একে একে যাহা কিছু হল তিরোহিত।।
ভিন্ন ভিন্ন হাঁড়ি সব হয়েছে এখন।
অবিরত বধূ যত করে জ্বালাতন।।
অসহ্য হয়েছে এবে তাদের যন্ত্রণা।
এ জীবন বিসর্জিতে করেছি বাসনা।।
বৃদ্ধা বাক্যে নারায়ণী কহেন তখন।
আত্মহত্যা মহাপাপ শাস্ত্রের বচন।।
ফিরে যাও ঘরে তুমি কর লক্ষ্মীব্রত।
সর্ব দুঃখ বিমোচিত পাবে সুখ যত।।
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে বধূগণ সাথে।
লক্ষ্মীব্রত কর সবে হরষ মনেতে।।
জলপূর্ণ ঘটে দিবে সিঁদুরের ফোঁটা।
আম্রশাখা দিবে তাহে লয়ে এক গোটা।।
গুয়াপান দিবে তাতে আসন সাজায়ে।
সিন্দূর গুলিয়া দিবে ভক্তিযুক্ত হয়ে।।
ধূপ দীপ জ্বালাইয়া সেইখানে দেবে।
দূর্বা লয়ে হাতে সবে কথা যে শুনিবে।।
লক্ষ্মীমূর্তি মানসেতে করিবেক ধ্যান।
ব্রতকথা শ্রবণান্তে শান্ত করে প্রাণ।।
কথা অন্তে ভক্তিভরে প্রণাম করিবে।
অতঃপর এয়োগণ সিঁদুর পরাবে।।
প্রতি গুরুবারে পূজা যে রমণী করে।
নিষ্পাপ হইবে সে কমলার বরে।।
বার মাস পূজা হয় যে গৃহেতে।
অচলা থাকেন লক্ষ্মী সেই সে স্থানেতে।।
পূর্ণিমা উদয় হয় যদি গুরুবারে।
যেই নারী এই ব্রত করে অনাহারে।।
কমলা বাসনা তার পুরান অচিরে।
মহাসুখে থাকে সেই সেই পুত্রপরিবারে।।
লক্ষ্মীর হাঁড়ি এক স্থাপিয়া গৃহেতে।
তণ্ডুল রাখিবে দিন মুঠা প্রমাণেতে।।
এই রূপে নিত্য যেবা সঞ্চয় করিবে।
অসময়ে উপকার তাহার হইবে।।
সেথায় প্রসন্না দেবী কহিলাম সার।
যাও গৃহে ফিরে কর লক্ষ্মীর প্রচার।।
কথা শেষ করে দেবী নিজ মূর্তি ধরে।
বৃদ্ধারে দিলেন দেখা অতি কৃপা ভরে।।
লক্ষ্মী হেরি বৃদ্ধা আনন্দে বিভোর।
ভূমিষ্ট প্রণাম করে আকুল অন্তর।।
ব্রত প্রচারিয়া দেবি অদৃশ্য হইল।
আনন্দ হিল্লোলে ভেসে বৃদ্ধা ঘরে গেল।।
বধূগণে আসি বৃদ্ধা বর্ণনা করিল।
যে রূপেতে বনমাঝে দেবীরে হেরিল।।
ব্রতের পদ্ধতি যাহা কহিল সবারে।
নিয়ম যা কিছু লক্ষ্মী বলেছে তাহারে।।
বধূগণ এক হয়ে করে লক্ষ্মীব্রত।
স্বার্থ দ্বেষ হিংসা যত হইল দূরিত।।
ব্রতফলে এক হল সপ্ত সহোদর।
দুঃখ কষ্ট ঘুচে যায় অভাব সত্বর।।
কমলা আসিয়া পুনঃ আসন পাতিল।
লক্ষ্মীহীন সেই গৃহে লক্ষ্মী অধিষ্ঠিল।।
দৈবযোগে একদিন বৃদ্ধার গৃহেতে।
আসিল যে এক নারী ব্রত সময়েতে।।
লক্ষ্মীকথা শুনি মন ভক্তিতে পুরিল।
লক্ষ্মীব্রত করিবে সে মানত করিল।।
কুষ্ঠরোগগ্রস্থ পতি ভিক্ষা করি খায়।
তাহার আরোগ্য আশে পূজে কমলায়।।
ভক্তিভরে এয়ো লয়ে যায় পূজিবারে।
কমলার বরে সব দুঃখ গেল দূরে।।
পতির আরোগ্য হল জন্মিল তনয়।
ঐশ্বর্যে পুরিল তার শান্তির আলয়।।
লক্ষ্মীব্রত এই রূপে প্রতি ঘরে ঘরে।
প্রচারিত হইল যে অবন্তী নগরে।।
অতঃপর শুন এক অপূর্ব ঘটন।
ব্রতের মাহাত্ম্য কিসে হয় প্রচলন।।
একদিন গুরুবারে অবন্তীনগরে।
মিলি সবে এয়োগন লক্ষ্মীব্রত করে।।
শ্রীনগরবাসী এক বণিক নন্দন।
দৈবযোগে সেই দেশে উপনীত হন।।
লক্ষ্মীপূজা হেরি কহে বণিক তনয়।
কহে, এ কি পূজা কর, কিবা ফল হয়।।
বণিকের কথা শুনি বলে নারীগণ।
লক্ষ্মীব্রত ইহা ইথে মানসপূরণ।।
ভক্তিভরে যেই নর লক্ষ্মীব্রত করে।
মনের আশা তার পুরিবে অচিরে।।
সদাগর এই শুনি বলে অহংকারে।।
অভাগী জনেতে হায় পূজে হে উহারে।।
ধনজনসুখ যত সব আছে মোর।
ভোগেতে সদাই আমি রহি নিরন্তর।।
ভাগ্যে না থাকিলে লক্ষ্মী দিবে কিবা ধন।
একথা বিশ্বাস কভু করি না এমন।।
হেন বাক্য নারায়ণী সহিতে না পারে।
অহংকার দোষে দেবী ত্যজিলা তাহারে।।
বৈভবেতে পূর্ণ তরী বাণিজ্যেতে গেলে।
ডুবিল বাণিজ্যতরী সাগরের জলে।
প্রাসাদ সম্পদ যত ছিল তার।
বজ্র সঙ্গে হয়ে গেল সব ছারখার।।
ভিক্ষাঝুলি স্কন্ধে করি ফিরে দ্বারে দ্বারে।
ক্ষুধার জ্বালায় ঘোরে দেশ দেশান্তরে।।
বণিকের দশা যেই মা লক্ষ্মী দেখিল।
কমলা করুণাময়ী সকলি ভুলিল।।
কৌশল করিয়া দেবী দুঃখ ঘুচাবারে।
ভিক্ষায় পাঠান তারে অবন্তী নগরে।।
হেরি সেথা লক্ষ্মীব্রত রতা নারীগণে।
বিপদ কারণ তার আসিল স্মরণে।।
ভক্তিভরে করজোড়ে হয়ে একমন।
লক্ষ্মীর বন্দনা করে বণিক নন্দন।।
ক্ষমা কর মোরে মাগো সর্ব অপরাধ।
তোমারে হেলা করি যত পরমাদ।।
অধম সন্তানে মাগো কর তুমি দয়া।
সন্তান কাঁদিয়া মরে দাও পদছায়া।।
জগৎ জননী তুমি পরমা প্রকৃতি।
জগৎ ঈশ্বরী তবে পূজি নারায়ণী।।
মহালক্ষ্মী মাতা তুমি ত্রিলোক মণ্ডলে।
গৃহলক্ষ্মী তুমি মাগো হও গো ভূতলে।।
রাস অধিষ্ঠাত্রী তুমি দেবী রাসেশ্বরী।
তব অংশভূতা যত পৃথিবীর নারী।।
তুমিই তুলসী গঙ্গা কলুষনাশিনী।
সারদা বিজ্ঞানদাত্রী ত্রিতাপহারিণী।।
স্তব করে এইরূপে ভক্তিযুক্ত মনে।
ভূমেতে পড়িয়া সাধু প্রণমে সে স্থানে।।
ব্রতের মানত করি নিজ গৃহে গেল।
গৃহিণীরে গৃহে গিয়া আদ্যান্ত কহিল।।
সাধু কথা শুনি তবে যত নারীগণ।
ভক্তিভরে করে তারা লক্ষ্মীর পূজন।।
সদয় হলেন লক্ষ্মী তাহার উপরে।
পুনরায় কৃপাদৃষ্টি দেন সদাগরে।।
সপ্ততরী জল হতে ভাসিয়া উঠিল।
আনন্দেতে সকলের অন্তর পূরিল।।
দারিদ্র অভাব দূর হইল তখন।
আবার সংসার হল শান্তি নিকেতন।।
এইরূপে ব্রতকথা মর্ত্যেতে প্রচার।
সদা মনে রেখো সবে লক্ষ্মীব্রত সার।।
এই ব্রত যেই জনে করে এক মনে।
লক্ষ্মীর কৃপায় সেই বাড়ে ধনে জনে।।
করজোড় করি সবে ভক্তিযুক্ত মনে।
লক্ষ্মীরে প্রণাম কর যে থাক যেখানে।।
[Alternative reading
লক্ষ্মীর ব্রতের কথা হল সমাপন
ভক্তিভরে বর যাচ যার যাহা মন
সিঁদুর সিঁথিতে দাও সব এয়ো মিলে
হরিধ্বনি কর সব অতি কৌতূহলে ]
ব্রতকথা যেবা পড়ে যেবা রাখে ঘরে।
লক্ষ্মীর কৃপায় তার মনোবাঞ্ছা পুরে।।
লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড়ো মধুময়।
প্রণাম করিয়া যাও যে যার আলয়।।
লক্ষ্মীব্রতকথা হেথা হৈল সমাপন।
আনন্দ অন্তরে বল লক্ষ্মী-নারায়ণ।।
পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র
নমস্তে সর্বদেবানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে।
যা গতিস্তং প্রপন্নানাং সা মে ভূয়াত্বদর্চবাৎ।।
শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর প্রণাম মন্ত্র
ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী নমোহস্তু তে।।
Lakshmi Panchali
শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর পাঁচালি (Lakshmi Panchali: Alternative version-1)
দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ ।
ধীরে ধীরে বইতেছে মলয় বাতাস ।।
বৈকুন্ঠেতে একাসনে লক্ষ্মী নারায়ন ।
করিতেছে কত কথা সুখে আলাপন ।।
সৃষ্টিতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব কত কথা হয় ।
শুনিয়া পুলকিত হয় দেবীর হৃদয় ।।
অকস্মাৎ দেবর্ষি নারায়ন স্বরে ।
আসিলেন ভক্তি চিত্তে বৈকুন্ঠ নগরে ।।
প্রনাম করি দেবর্ষি বলেন বচন ।
মর্ত্যে দুর্ভিক্ষ মাগো কি ভীষন ।।
ঋষি বলে মা তুমি চঞ্চলা মন ।
সর্বদা ঘোরো ভবন হতে ভবন ।।
তাই মর্ত্যবাসী কষ্ট কত পায় ।
দেখি তাহা কেমনে মম প্রানে সয় ।।
অন্নাভাবে লোকে কত কষ্ট ভোগে ।
মরিতেছে অনাহারে কৃশকায় রোগে ।।
ধর্মাধর্ম লোকে সবে ত্যাগ করি দেয় ।
স্ত্রী কন্যা বিক্রি করে ক্ষুধার জ্বালায় ।।
দুর্ভিক্ষে হইলো শেষ মরে জীবগন ।
দয়া করে মাগো তুমি করো নিবারন ।।
এই দুর্দশা দেখি প্রানে নাহি সয় ।
করো নিবারন মাগো হইয়া সদয় ।।
নারদের বাক্য শুনি কহেন হরিপ্রিয়া ।
বিশ্বমাতা আমি দেবী বিষ্ণুজায়া ।।
যে যেমন করে সে তেমন পায় ।
সে দোষে কর্মফল, করে হায় হায় ।।
মহামায়ার স্বরূপে নারী সত্যবচন ।
মর্ত্যবাসী না মানে এই কথন ।।
সদাচার কুল শীল দিয়া বিসর্জন ।
ঘরের লক্ষ্মীকে করে সদা বর্জন ।।
এমন মনুষ্যজাতি মহাপাপ করে ।
কর্ম দোষে লক্ষ্মী ত্যাজে তাহারে ।।
নারীর পরম গতি স্বামী ভিন্ন কেবা ।
ভুলেও না করে নারী পতি পদসেবা ।।
যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেড়ায় ।
গুরুজনে নানা কটুবাক্য শোনায় ।।
সর্বদা হিংসা করে না মানে আচার ।
হিংসাতে তার মজে সংসার ।।
ছড়া নাহি দেয়, প্রভাতকালে ।
লক্ষ্মী সে স্থান ছাড়িয়া চলে ।।
অতিথি যদি উপস্থিত হয় দ্বারে ।
দূর দূর করি তারায় তাহাড়ে ।।
যেবা গুরু, ব্রাহ্মণ দেখি ভক্তি নাহি করে।
মম নিবাস কভু নহে সেই ঘরে ।।
এঁয়োতির চিহ্ন সিঁদুর শাখা না দেয় ।
বাসী কাপড়ে যথা তথা বেড়ায় ।।
স্নান নিত্য নাহি করে যে মনুষ্য গণ ।
ত্যাজিয়া তাহারে, করি অন্যত্র গমন ।।
তিথি ভেদে যেবা নিষিদ্ধ দ্রব্য খায় ।
হই না কভু তার ওপর সহায় ।।
যে মনুষ্য ভক্তিভাবে একদশী না করে ।
কদাপি নাহি থাকি তাহার ঘরে ।।
উচ্চহাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে ।
গুরুজন দেখি ঘোমটা না টানে ।।
বয়োজ্যেষ্ঠ দেখি যারা প্রনাম না করে ।
সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি দেয় ঘরে ।।
ঠাকুর দেবতা আদি কভু না পূজে ।
সাধু সন্ন্যাসী দেখি হাসাহাসি করে ।।
এমন নারী যে গৃহেতে বসতি রয় ।
লক্ষ্মী ত্যাজে তাহাকে জানিবে নিশ্চয় ।।
এত বলি লক্ষ্মী দেবী বলেন মুনিকে ।
কর্মদোষে মনুষ্য নিজ ফল ভোগে ।।
ঋষি বলে মাগো তুমি জগতজননী ।
সন্তান কে করো ক্ষমা হে সনাতনী ।।
দূর করি দাও মা ভীষন মহামার ।
বর দিয়ে জীবেরে করহ নিস্তার ।।
এই বলি বিদায় হইলেন মহামুনি ।
চিন্তিত হইয়া কহেন নারায়নী ।।
কহ কহ কৃপাময় প্রভু নারায়ন ।
কিরূপে নিস্কৃতি পাইবে জীবগণ ।।
লক্ষ্মীদেবীর কথা শুনি কহেন জনার্দন ।
শুন দেবী মন দিয়া আমার বচন ।।
তুমি যে পরমা প্রকৃতি দেবী ভগবতী ।
তোমার কৃপায় দূর হইবে অনাসৃষ্টি ।।
যে জন গুরুবারে লক্ষ্মী ব্রত করে ।
সুখে জীবন কাটাইবে তোমার বরে ।।
লক্ষ্মী কভু নাহি ছাড়িবে তাহারে ।
জীবনান্তে আসিবে সে বৈকুন্ঠ নগরে ।।
মর্ত্যে গিয়া কর এই ব্রত প্রচার ।
তোমার কৃপায় দূর হইবে অনাচার ।।
গমন করেন দেবী শুনি হরির কথা ।
পেঁচকে মর্ত্যে আইলেন জগতমাতা ।।
অবন্তী নামক নগরী পাশে এক বন ।
তথা আসি মা কমলা উপস্থিত হন ।।
হেথায় ছিল ব্যবসায়ী ধনেশ্বর রায় ।
অগাধ ধন, চৌদ্দ কূল বসি খায় ।।
পত্নী সুমতি ছিল সাত কুমার ।
সংসার ছিল তার লক্ষ্মীর ভান্ডার ।।
যথাকালে ধনেশ্বর করিল গমন ।
বিধবা হইলো পত্নী- ভাগ্যের লিখন ।।
সর্বদা কলহ করে সপ্ত বধূ গণ ।
মারমার কাটকাট হইত সর্বক্ষণ ।।
সংসার রচিল যে যার মতো যার ।
সুখের পরিবার হইল ছারখার ।।
এই দুঃখে ধনেশ্বর পত্নী ভীষন শোকে ।
বনে গমন করিল জীবন ত্যাজিতে ।।
সেই বনে বৃদ্ধা বসি করে হায় হায় ।
এই বুঝি লেখা ছিল বিধাতার খাতায় ।।
এই দেখি হরিপ্রিয়া বৃদ্ধা রূপ ধরে ।
ছদ্দবেশে দেখা দিলেন ধনেশ্বর ভার্যারে ।।
দেবী কহেন কে তুমি দাহ পরিচয় ।
কোথা হতে আসিলে বলোহ আমায় ।।
স্থান বড় ভয়ানক নির্জন বন ।
হেথা হোথা নানা জন্তু করে বিচরণ ।
বুড়ি বলে মাগো পোড়া কপাল আমার ।
ভয় আমি করি না আর মরিবার ।।
এত বলি বৃদ্ধা সব কথা কন ।
শুনিয়া দুঃখিত হইলো কমলার মন ।।
বৃদ্ধা প্রতি বিষ্ণুপ্রিয়া কহেন বচন ।
আত্মহত্যা মহাপাপ শাস্ত্রের লিখন ।।
যাও তুমি গৃহে ফিরি করো লক্ষ্মী ব্রত ।
অবশ্যই আসিবে সুখ পূর্বের মতো ।।
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি এঁয়োগন ।
ব্রতের সকল কিছু করিবে আয়োজন ।।
আসন পাতি তাহে লক্ষ্মী মূর্তি বসাইবে ।
আম্র পল্লব, গোটা ফলে ঘট সাজিবে ।।
বিবিধ পুস্প, বিল্বপত্র নৈবদ্য সকল ।
দিবে কলা, শর্করা আতপ তণ্ডুল ।।
একটি করে মুদ্রা রাখিবে লক্ষ্মী ঘটে ।
একমুষ্টি তণ্ডুল জমাইবে লক্ষ্মী ভাঁড়ে ।।
আম্র পল্লবে করিবে সিঁদুর তৈলে গোলা।
চাল বাটি লক্ষ্মী সম্মুখে দিবে আলিপনা ।।
ধূপ দীপ জালি সম্মুখে রাখিবে ।
আসন পাতি লক্ষ্মী পূজায় বসিবে ।।
একমনে পূজা দিবে লক্ষ্মী নারায়ন ।
পূজাশেষে ব্রত কথা করিবে পাঠন ।।
না করিয়ো পূজায় ঘণ্টা বাদন ।
পূজান্তে উলু দিবে মিলি এঁয়োগন ।।
এই ভাবে যেই জন লক্ষ্মী ব্রত করে ।
কোন দুঃখ তার আর নাহি রহিবে ।।
শুনিয়া বৃদ্ধা কহিল আনন্দিত মনে ।
কে মা তুমি কহো পরিচয় দানে ।।
এই শুনি লক্ষ্মী দেবী স্ব মূর্তি ধরে ।
ভক্তি চিত্তে বৃদ্ধা কাঁদে ভূমি ওপর পড়ে ।।
লক্ষ্মী বলে যাহ তুমি নিজের ভবন ।
গুরুবারে আমাকে পূজিবে নিয়ম মতোন ।।
এত বলি বিদায় লইল সাগর
নন্দিনী ( মা লক্ষ্মী সাগর রাজার কন্যা ) ।
ঘরে ফিরি আসিল ধনেশ্বর পত্নী ।।
বধূ গনে কহিল লক্ষ্মীর ব্রতের কথন ।
গুরুবারে লক্ষ্মী ভজে সপ্ত বধূ গণ ।।
ধীরে ধীরে হইল সুখের ভবন ।
যেমন আছিল ঘর পূর্বের মতোন ।।
সপ্ত ভাই মিলে মিশে কলহ বিসর্জন ।
সংসার হইলো যেন স্বর্গের দেবভবন ।।
এই দেখি এক রমণী পূজা মানত করে ।
স্বামী চিররোগী, উপার্জন হীন সংসারে ।।
ভক্তি ভরে সেই নারী লক্ষ্মী দেবী ভজে ।
হরিপ্রিয়ার কৃপায় তাহার দুঃখ সকল ঘোচে ।।
রোগ ছাড়ি তার স্বামী সুস্থ হইল।
এই ভাবে সকল দুঃখ তার ঘুচিল ।।
আনন্দে দিনে জন্মিল তাঁহাদের সুন্দর নন্দন ।
লক্ষ্মীর কৃপায় তার বাড়িল ধন জন ।।
এই ভাবে লক্ষ্মী ব্রত ছড়ায় দেশ দেশান্তরে ।
সকলে শুনি লক্ষ্মী দেবীর পূজা করে ।।
লক্ষ্মী কৃপায় সকলের দুঃখ চলি যায় ।
কমলার কৃপা সকলের ওপর বর্ষায় ।।
একদিন লক্ষ্মী পূজা করে বামাগন ।
আসিল এক বনিক তাঁহাদের সদন ।।
বনিক কহে কোন দেবী কি পরিচয় ।
করিলে পূজা দেবীর, কি ফল হয় ।।
বামারা বলে ইনি লক্ষ্মী দেবী জগত জননী ।
লক্ষ্মী কৃপায় সুখে রহে ব্রতিনী ।।
গুরুবারে যে জন লক্ষ্মী পূজা করে ।
অবশ্যই থাকিবে সুখে কমলার বরে ।।
এই বাক্য শুনে হাসে বনিক মহাশয় ।
মানিনা এই সত্য তব কথায় ।।
কপালে যদি না থাকে ধনের লিখন ।
কিরূপে দিবে লক্ষ্মী বর- ধন- জন ।।
শুধু শুধু লক্ষ্মী পূজা করি কি হয় ।
বৃথা কাটাইতেছো কমলা পূজায় ।।
গর্বে ভরা বাক্য লক্ষ্মী সইতে নারে ।
ধীরে ধীরে মা কমলা ছাড়িল তাহারে ।।
ঝড় উঠি তার নৌকা জলে ডোবে ।
ধন জন আদি গেলো নানা রোগে ভোগে ।।
মড়কে রোগে তার গৃহ হইল ছারখার ।
ভিখারী হইয়া বনিক ঘোরে দ্বারে দ্বার ।।
এককালে সে থাকিত রাজার হালে ।
আজ সে ভিখারী, পথে কষ্টে চলে ।।
এই ভাবে বহু দেশ ঘোরে সদাগর ।
একদিন আইলো সে অবন্তী নগর ।।
সেই স্থানে ব্রত করে যতেক বামাগনে ।
বসি তারা মন দেয় লক্ষ্মীর ভজনে ।।
এই দেখি পূর্ব কথা হইলো স্মরণ ।
এই স্থানে দেবীরে করিছে অবমানন ।।
সেই পাপে সব ধ্বংস হইলো তার ।
ভূমিতে লোটাইয়ে সদাগর কান্দে বারবার ।।
এই স্থানে করেছি মাগো বহু অহঙ্কার ।
সেই পাপে সব কিছু হইলো ছারখার ।।
ধন গর্বে মত্ত হয়ে করিনু অবহেলা ।
সেই অপরাধে মা তুমি মোরে ত্যাজিলা ।।
ক্ষুধার জ্বালায় মাগো ঘুরি দেশ দেশান্তরে ।
ধন- জন- আত্মীয় গেলা আমাকে ছেড়ে ।।
তুমি মাতা দয়াময়ী বিষ্ণু বক্ষ বিলাসিনী ।
তুমি মাতা ভগবতী জগত পালিনী ।।
তুমি যারে রক্ষা করো কিসের তার ভয় ।
তুমি যারে ত্যাজি যাও, সে সব হারায় ।।
তুমি যারে কৃপা কর, সেই ধন্য হয় ।
তোমার আশিসে মাগো সর্ব সিদ্ধি হয় ।।
এই ভাবে সদাগর লক্ষ্মী স্তব করে ।
কমলার কৃপা দৃষ্টি বনিকের উপর পড়ে ।।
লক্ষ্মীর কৃপায় বনিক সব ফিরি পায় ।
গৃহে ফিরি মন দেয় লক্ষ্মীর পূজায় ।।
লক্ষ্মীর কৃপায় তাহার ধন জন বাড়ে ।
এই ভাবে ব্রত প্রচার হয় দেশ দেশান্তরে ।
এই ভাবে সকলে লক্ষ্মী পূজা করে ।
ধনে জনে বাড়িল কমলার বরে ।।
খাদ্য ধন জন বাড়িল লক্ষ্মীর কৃপায় ।
হরি হরি বল তুলিয়া হস্ত দ্বয় ।।
যেই জন ভক্তি ভরি লক্ষ্মী পূজিবে ।
অবশ্যই তাহার দুঃখ সকল ঘুচিবে ।।
যে পড়ে ব্রত কথা, আর যেবা করে শ্রবন ।
অবশ্যই পাইবে সে মা লক্ষ্মীর চরণ ।।
ব্রত কথা শুনিবে অবশ্যই ভক্তি মনে ।
লক্ষ্মীর কৃপায় বাড়িবে ধনে জনে ।।
জয় জয় ব্রহ্মময়ী, মা নারায়নী ।
তোমার কৃপায় শেষ করিনু গ্রন্থ খানি ।।
Lakshmi Panchali
শ্রীশ্রীলক্ষ্মীদেবীর পাঁচালি (Lakshmi Panchali: Alternative version-2)
শরৎ পূর্ণিমার নিশি নির্মল গগন।
মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় পবন।।
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।
বৈকুন্ঠধামেতে বসি করে আলাপন।।
হেনকালে বীণা হাতে আসি মুনিবর।
হরিগুণগানে মত্ত হইয়া বিভোর।।
গান সম্বরিয়া উভে বন্দনা করিল।
বসিতে আসন তারে নারায়ণ দিল।।
মধুর বচনে লক্ষ্মী জিজ্ঞাসিল তায়।
কিবা মনে করি মুনি আসিলে হেথায়।।
কহে মুনি তুমি চিন্ত জগতের হিত।
সবার অবস্থা আছে তোমার বিদিত।।
সুখেতে আছয়ে যত মর্ত্যবাসীগণ।
বিস্তারিয়া মোর কাছে করহ বর্ণন।।
লক্ষ্মীমার হেন কথা শুনি মুনিবর।
কহিতে লাগিলা তারে জুড়ি দুই কর।।
অপার করুণা তোমার আমি ভাগ্যবান।
মর্ত্যলোকে নাহি দেখি কাহার কল্যাণ।।
সেথায় নাই মা আর সুখ শান্তি লেশ।
দুর্ভিক্ষ অনলে মাগো পুড়িতেছে দেশ।।
রোগ-শোক নানা ব্যাধি কলিতে সবায়।
ভুগিতেছে সকলেতে করে হায় হায়।।
অন্ন-বস্ত্র অভাবেতে আত্মহত্যা করে।
স্ত্রী-পুত্র ত্যাজি সবাই যায় দেশান্তরে।।
স্ত্রী-পুরুষ সবে করে ধর্ম পরিহার।
সদা চুরি প্রবঞ্চনা মিথ্যা অনাচার।।
তুমি মাগো জগতের সর্বহিতকারী।
সুখ-শান্তি সম্পত্তির তুমি অধিকারী।।
স্থির হয়ে রহ যদি প্রতি ঘরে ঘরে।
তবে কি জীবের এত দুঃখ হতে পারে?
নারদের বাক্য শুনি লক্ষ্মী বিষাদিতা।
কহিলেন মুনি প্রতি দোষ দাও বৃথা।।
নিজ কর্মফলে সবে করে দুঃখভোগ।
অকারণে মোর প্রতি কর অনুযোগ।।
শুন হে নারদ বলি যথার্থ তোমায়।
মম অংশে জন্ম লয় নারী সমুদয়।।
তারা যদি নিজ ধর্ম রক্ষা নাহি করে।
তবে কি অশান্তি হয় প্রতি ঘরে ঘরে।।
লক্ষ্মীর বচন শুনি মুনি কহে ক্ষুণ্ন মনে।
কেমনে প্রসন্ন মাতা হবে নারীগণে।।
কিভাবেতে পাবে তারা তব পদছায়া।
দয়াময়ী তুমি মাগো না করিলে দয়া।।
মুনির বাক্যে লক্ষ্মীর দয়া উপজিল।
মধুর বচনে তারে বিদায় করিল।।
নারীদের সর্বদুঃখ যে প্রকারে যায়।
কহ তুমি নারায়ণ তাহার উপায়।।
শুনিয়া লক্ষ্মীর বচন কহে লক্ষ্মীপতি।
কি হেতু উতলা প্রিয়ে স্থির কর মতি।।
প্রতি গুরুবারে মিলি যত বামাগণে।
করিবে তোমার ব্রত ভক্তিযুক্ত মনে।।
নারায়ণের বাক্যে লক্ষ্মী অতি হৃষ্টমন।
ব্রত প্রচারিতে মর্ত্যে করিল গমন।।
মর্ত্যে আসি ছদ্মবেশে ভ্রমে নারায়ণী।
দেখিলেন বনমধ্যে বৃদ্ধা এক বসিয়া আপনি।।
সদয় হইয়া লক্ষ্মী জিজ্ঞাসিল তারে।
কহ মাগো কি হেতু এ ঘোর কান্তারে।।
বৃদ্ধা কহে শোন মাতা আমি অভাগিনী।
কহিল সে লক্ষ্মী প্রতি আপন কাহিনী।।
পতি-পুত্র ছিল মোর লক্ষ্মীযুক্ত ঘর।
এখন সব ছিন্নভিন্ন যাতনাই সার।।
যাতনা সহিতে নারি এসেছি কানন।
ত্যাজিব জীবন আজি করেছি মনন।।
নারায়ণী বলে শুন আমার বচন।
আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন।।
যাও মা গৃহেতে ফিরি কর লক্ষ্মী ব্রত।
আবার আসিবে সুখ তব পূর্ব মত।।
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি এয়োগণ।
করিবে লক্ষ্মীর ব্রত করি এক মন।।
কহি বাছা পূজা হেতু যাহা প্রয়োজন।
মন দিয়া শুনি লও আমার বচন।।
জলপূর্ণ ঘটে দিবে সিঁদুরের ফোঁটা।
আম্রের পল্লব দিবে তাহে এক গোটা।।
আসন সাজায়ে দিবে তাতে গুয়া-পান।
সিঁদুর গুলিয়া দিবে ব্রতের বিধান।।
ধূপ-দীপ জ্বালাইয়া রাখিবে ধারেতে।
শুনিবে পাঁচালী কথা দূর্বা লয়ে হাতে।।
একমনে ব্রত কথা করিবে শ্রবণ।
সতত লক্ষ্মীর মূর্তি করিবে চিন্তন।।
ব্রত শেষে হুলুধ্বনি দিয়ে প্রণাম করিবে।
এয়োগণে সবে মিলি সিঁদুর পরিবে।।
দৈবযোগে একদিন ব্রতের সময়।
দীন দুঃখী নারী একজন আসি উপনীত হয়।।
পতি তার চির রুগ্ন অক্ষম অর্জনে।
ভিক্ষা করি অতি কষ্টে খায় দুই জনে।।
অন্তরে দেবীরে বলে আমি অতি দীনা।
স্বামীরে কর মা সুস্থ আমি ভক্তি হীনা।।
লক্ষ্মীর প্রসাদে দুঃখ দূর হৈল তার।
নীরোগ হইল স্বামী ঐশ্বর্য অপার।।
কালক্রমে শুভক্ষণে জন্মিল তনয়।
হইল সংসার তার সুখের আলয়।।
এইরূপে লক্ষ্মীব্রত করি ঘরে ঘরে
ক্রমে প্রচারিত হল দেশ দেশান্তরে।।
এই ব্রত করিতে যেবা দেয় উপদেশ।
লক্ষ্মীদেবী তার প্রতি তুষ্ট সবিশেষ।।
এই ব্রত দেখি যে বা করে উপহাস।
লক্ষ্মীর কোপেতে তার হয় সর্বনাশ।।
পরিশেষে হল এক অপুর্ব ব্যাপার।
যে ভাবে ব্রতের হয় মাহাত্ম্য প্রচার।।
বিদর্ভ নগরে এক গৃহস্থ ভবনে।
নিয়োজিত বামাগণ ব্রতের সাধনে।।
ভিন দেশবাসী এক বণিক তনয়।
সি উপস্থিত হল ব্রতের সময়।।
বহুল সম্পত্তি তার ভাই পাঁচজন।
পরস্পর অনুগত ছিল সর্বক্ষণ।।
ব্রত দেখি হেলা করি সাধুর তনয়।
বলে এ কিসের ব্রত এতে কিবা ফলোদয়।।
বামাগণ বলে শুনি সাধুর বচন।
লক্ষ্মীব্রত করি সবে সৌভাগ্য কারণ।।
সদাগর শুনি ইহা বলে অহঙ্কারে।
অভাবে থাকিলে তবে পূজিব উহারে।।
ধনজন সুখভোগ যা কিছু সম্ভব।
সকল আমার আছে আর কিবা অভাব।।
কপালে না থাকে যদি লক্ষ্মী দিবে ধন।
হেন বাক্য কভু আমি না করি শ্রবণ।।
ধনমদে মত্ত হয়ে লক্ষ্মী করি হেলা।
নানা দ্রব্যে পূর্ণ তরি বানিজ্যেতে গেলা।।
গর্বিত জনেরে লক্ষ্মী সইতে না পারে।
সর্ব দুঃখে দুঃখী মাগো করেন তাহারে।।
বাড়ি গেল, ঘর গেল, ডুবিল পূর্ণ তরি,
চলে গেল ভ্রাতৃভাব হল যে ভিখারী।।
কি দোষ পাইয়া বিধি করিলে এমন।
অধম সন্তান আমি অতি অভাজন।।
সাধুর অবস্থা দেখি দয়াময়ী ভাবে।
বুঝাইব কেমনে ইহা মনে মনে ভাবে।।
নানা স্থানে নানা ছলে ঘুরাইয়া ঘানি।
অবশেষে লক্ষ্মীর ব্রতের স্থানে দিলেন আনি।।
মনেতে উদয় হল কেন সে ভিখারী।
অপরাধ ক্ষম মাগো কুপুত্র ভাবিয়া।।
অহঙ্কার দোষে দেবী শিক্ষা দিলা মোরে।
অপার করুণা তাই বুঝালে দীনেরে।।
বুঝালে যদি বা মাগো রাখগো চরণে।
ক্ষমা কর ক্ষমাময়ী আশ্রিত জনেরে।।
সত্যরূপিনী তুমি কমলা তুমি যে মা।
ক্ষমাময়ী নাম তব দীনে করি ক্ষমা।।
তুমি বিনা গতি নাই এ তিন ভুবনে।
স্বর্গেতে স্বর্গের লক্ষ্মী ত্রিবিধ মঙ্গলে।
তুমি মা মঙ্গলা দেবী সকল ঘরেতে।
বিরাজিছ মা তুমি লক্ষ্মী রূপে ভূতলে।।
দেব-নর সকলের সম্পদরূপিনী।
জগৎ সর্বস্ব তুমি ঐশ্বর্যদায়িনী।।
সর্বত্র পূজিতা তুমি ত্রিলোক পালিনী।
সাবিত্রী বিরিঞ্চিপুরে বেদের জননী।।
ক্ষমা কর এ দাসের অপরাধ যত।
তোমা পদে মতি যেন থাকে অবিরত।।
শ্রেষ্ঠ হতে শ্রেষ্ট তারা পরমা প্রকৃতি।
কোপাদি বর্জিতা তুমি মূর্তিমতি ধৃতি।
সতী সাধ্বী রমণীর তুমি মা উপমা।।
দেবগণ ভক্তি মনে পূজে সবে তোমা।।
রাস অধিষ্ঠাত্রী দেবী তুমি রাসেশ্বরী।
সকলেই তব অংশ যত আছে নারী।।
কৃষ্ণ প্রেমময়ী তুমি কৃষ্ণ প্রাণাধিকা।
তুমি যে ছিলে মাগো দ্বাপরে রাধিকা।।
প্রস্ফুটিত পদ্মবনে তুমি পদ্মাবতী।
মালতি কুসুমগুচ্ছে তুমি মা মালতি।।
বনের মাঝারে তুমি মাগো বনরাণী।
শত শৃঙ্গ শৈলোপরি শোভিত সুন্দরী।
রাজলক্ষ্মী তুমি মাগো নরপতি পুরে।
সকলের গৃহে লক্ষ্মী তুমি ঘরে ঘরে।
দয়াময়ী ক্ষেমঙ্করী অধমতারিণী।
অপরাধ ক্ষমা কর দারিদ্র্যবারিণী।।
পতিত উদ্ধার কর পতিতপাবনী।
অজ্ঞান সন্তানে কষ্ট না দিও জননী।।
অন্নদা বরদা মাতা বিপদনাশিনী।
দয়া কর এবে মোরে মাধব ঘরণী।।
এই রূপে স্তব করি ভক্তিপূর্ণ মনে।
একাগ্র মনেতে সাধু ব্রত কথা শোনে।।
ব্রতের শেষে নত শিরে করিয়া প্রণাম।
মনেতে বাসনা করি আসে নিজধাম।।
গৃহেতে আসিয়া বলে লক্ষ্মীব্রত সার।
সবে মিলি ব্রত কর প্রতি গুরুবারে।।
বধুরা অতি তুষ্ট সাধুর বাক্যেতে।
ব্রত আচরণ করে সভক্তি মনেতে।।
নাশিল সাধুর ছিল যত দুষ্ট সহচর।
দেবীর কৃপায় সম্পদ লভিল প্রচুর।।
আনন্দে পূর্ণিত দেখে সাধুর অন্তর।
পূর্ণতরী উঠে ভাসি জলের উপর।।
সাধুর সংসার হল শান্তি ভরপুর।
মিলিল সকলে পুনঃ ঐশ্বর্য প্রচুর।।
এভাবে নরলোকে হয় ব্রতের প্রচার।
মনে রেখ সংসারেতে লক্ষ্মীব্রত সার।।
এ ব্রত যে রমণী করে এক মনে।
দেবীর কৃপায় তার পূর্ণ ধনে জনে।।
অপুত্রার পুত্র হয় নির্ধনের ধন।
ইহলোকে সুখী অন্তে বৈকুন্ঠে গমন।।
লক্ষ্মীর ব্রতের কথা বড়ই মধুর।
অতি যতনেতে রাখ তাহা আসন উপর।
যে জন ব্রতের শেষে স্তব পাঠ করে।
অভাব ঘুচিয়া যায় লক্ষ্মীদেবীর বরে।।
লক্ষ্মীর পাঁচালী কথা হল সমাপন।
ভক্তি করি বর মাগো যার যাহা মন।।
সিঁথিতে সিঁদুর দাও সব এয়োমিলে।
হুলুধ্বনি কর সবে অতি কৌতুহলে।।
দুই হাত জোড় করি ভক্তিযুক্ত মনে।
নমস্কার করহ সবে দেবীর চরণে।।
Lakshmi Panchali
বিত্থোৎপত্তি ও তার মাহাত্ম্য
শিব মহাপুরাণ by পৃথ্বীরাজ সেন
বৈকুণ্ঠপুরীতে একদিন লক্ষ্মী নারায়ণ বসে আছেন সিংহাসনে। একসময় দেবী লক্ষ্মী নারায়ণকে জিজ্ঞাসা করলেন –তুমি আমাকে খুব ভালবাস, কিন্তু আমার চেয়েও কি তোমার কোনো প্রিয় ভক্ত আছে? এ জগতে তোমার সবচেয়ে প্রিয় কে?
দেবীর প্রশ্ন শুনে শ্রীহরি হাসলেন এবং বললেন, তুমি আমার প্রাণপ্রিয়া। কিন্তু যে জন ভক্তিভরে সর্বদাই আমার কথা চিন্তা করে সেই জনই আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়। আমি তার হৃদয়ে সব সময় বিরাজ করি। যদি সে কখনো আমাকে ভুলে যায়, তবুও আমি তাকে ত্যাগ করি না। এমন ভক্তি একমাত্র শিবের আছে। তাই শিবই আমার সবচেয়ে প্রিয়।
আর যিনি শিবের পূজা করেন, তিনি আমার কাছে শিবের চেয়েও প্রিয়। যে শিবপূজা করে না তাকে আমি অতিশয় দুর্জন মনে করি। তার উপর সব সময় ক্রোধিত হয়ে থাকি। সে জপ, তপ, পূজা যাই করুক না কেন, সে কোনো কিছুতেই ফল পাবেনা। শিবকে পূজা করলে মঙ্গল হবে, তা না হলেই বিপদ আসবে।
হরির মুখে লক্ষ্মীদেবী সব কথা শুনলেন এবং তিনি নিজেকে অভাগিনী মনে করলেন। বললেন, আমার জীবন বিফলে গেল। আমি কখনই শিবকে পূজা করিনি। আমার বেঁচে থেকে লাভ কি?
শ্রীহরি দেবী লক্ষ্মীকে বললেন, দুঃখ করো না। এতে তোমার কোনো দোষ নেই। আমি তোমার কাছে কখনও শিবের মাহাত্ম কীর্তন করিনি, তাহলে তুমি জানবে কি করে। এবার থেকে রোজ তুমি শিবের পূজা করো। যদি পদ্মফুল দিয়ে শিবের পূজা কর তাহলে শিব তুষ্ট হবেন। শিব তুষ্ট হলে অন্যান্য দেবতারাও তুষ্ট হবেন। শিবের অর্চনা করলে সবার অর্চনা করা হয়।
নারায়ণের কথামতো লক্ষ্মীদেবী প্রত্যেকদিন শিবের পূজা করলেন। তিনি একশো পদ্মফুল দিয়ে একবছর ধরে পূজা করবেন ঠিক করলেন। দেবী নিজে প্রত্যেকদিন শত পদ্ম গুণে আনেন এবং তা গঙ্গাজলে ধুয়ে নিয়ে তা দিয়ে ভক্তিভরে পূজা করেন। এইভাবে একদিন বছরের শেষ দিন এল। প্রত্যেকদিনের মত দেবী শত পদ্মফুল তিনবার ধরে গুণে নিয়ে গঙ্গাজলে ধুয়ে পূজায় বসলেন।
লক্ষ্মীদেবীকে পরীক্ষা করার জন্য ত্রিলোচন দুটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন।
এদিকে এক একটি করে পদ্মফুল লক্ষ্মীদেবী শিবলিঙ্গের উপরে স্থাপন করে পূজা করছেন।
হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন দুটি ফুল কম পড়ছে। তখন তিনি মনে মনে ভাবলেন, কে আমার পূজার পদ্ম চুরি করে নিল? তাহলে কি আমি গোণার সময় অন্যমনস্ক ছিলাম। আমার এই পূজা বিফল হবে। এখন দুটো পদ্ম কোথায় পাব? আর যদি পাওয়া যায় তাহলে অন্যের দ্বারা আনাতে হবে। প্রত্যেকদিন আমি নিজের হাতে ফুল তুলেছি, আমাকে ব্রতের শেষ দিন অন্যের দ্বারা চয়নিত ফুল পূজায় ব্যবহার করব? আর আমি যদি আসন ছেড়ে উঠি, তাতে পূজায় বিঘ্ন হবে। তাহলে এখন কি করা যায়।
তারপরে লক্ষ্মীদেবীর একটা কথা মনে পড়ে গেল। একদিন শ্রীহরি বলেছিলেন, লক্ষ্মীদেবী যেন একটি ফুল্লসরোবর। আর এই সরোবরে তোমার দুটি স্তন যেন দুটি কমল। শ্রীহরি কখনো মিথ্যা বলতে পারেন না। কাজেই এই দুই স্তনপদ্মে আমি শিবের পূজা করব।
এই কথা ভেবে দেবী ছুরিকা নিলেন। সেই দৃশ্য দেখে স্তনদ্বয় যেন বলছে তব অঙ্গে জন্মে আমাদের জীবন ধন্য হয়েছে, আবার যদি আমাদের দিয়ে শিব পূজা কর তাহলেও আমাদের জীবন সার্থক হবে।
দেবী স্তনদ্বয়ের অন্তরের কথা শুনে বললেন–হরি আর শঙ্করের যেমন কোনো ভেদ নেই, তেমনি পদ্মের সঙ্গে তোমাদেরও কোনো পার্থক্য নেই।
এই বলে দেবী বামহাতে স্তন ধরলেন, এবং ডান হাতে ছুরি দিয়ে তা কেটে ফেললেন। এবং তা শিবলিঙ্গের উপর দিলেন। তিনি পঞ্চাশর মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজা করলেন। তারপর অন্য স্তনটিও ছেদন করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন তখন অকস্মাৎ শিব দিব্যমূর্তি ধারণ করে সেই সোনার লিঙ্গের উপর দাঁড়িয়ে দর্শন দিলেন দেবীকে।
তাঁর সারা গায়ে ভস্ম মাখা, ত্রিলোচন, নীলকণ্ঠ শিবের জটাজুট, এবং সহাস্যবদন, কটিতটে ব্যাঘ্রচর্ম নাস-যজ্ঞ উপবীত, হাতে ত্রিশূল তুলে দেবী লক্ষ্মীকে তিনি বললেন–দেবী তুমি তোমার স্তন ছেদন করো না। তোমার অন্তরে যে আমার প্রতি ভক্তি আছে তা আমি আগেই বুঝেছি, তোমার ছেদন করা স্তনটি আবার আগের মত হয়ে যাবে। আর আমার লিঙ্গের উপর যে, স্তন দিয়ে তুমি পূজা করেছ, তা বৃক্ষরূপে জন্মাবে তার নাম হবে শ্রীফল। যতদিন ধরাতলে চন্দ্র সূর্য উদয় হবে, ততদিন ধরে গোটা জগৎবাসী তোমার গুণগান করবে।
শ্রীফল অর্থাৎ বিপত্রে আমার পূজা করলে আমি সন্তুষ্ট হব। আমার স্বর্ণলিঙ্গ তৈরি করে সোনা, রুপো, মুক্তো দ্বারা পূজা করলে আমি সন্তুষ্ট হব না। কিন্তু কেউ যদি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করে তাহলে আমি তুষ্ট হবো। আমার লিঙ্গের উপর ভক্তিভরে কেউ যদি বিল্বপত্র দেয় এবং পূজা করে, তাহলে তাকে আমি মোক্ষ প্রদান করবো।
দেবী শঙ্করের স্তব-স্তুতি করলেন। শিব তখন দেবীকে বললেন, তোমার পূজায় আমি তুষ্ট এখন তুমি কি বর চাও বলো।
লক্ষ্মীদেবী শঙ্করকে বললেন, ভাগ্যবলে আপনার দেখা পেলাম, আর কোনো বরের প্রয়োজন নেই। আপনার কাছে একটি বর চাই, সারাজীবন আপনাতে যেন আমার ভক্তি অটুট থাকে।
শিব বললেন, তাই হবে। তিনি লক্ষ্মীদেবীর কাটা স্তনটি নিয়ে ত্রিশূলের দ্বারা মাটিতে পুঁতে দিলেন। তারপর সেখান থেকে অন্তর্হিত হলেন।
স্তন পদ্মবীজ আস্তে আস্তে অঙ্কুরিত হল। সেটি ক্রমে বৃক্ষরূপ ধারণ করে। অপূর্ব সুন্দর তার পাতা, একটি বৃন্তে তিনটি পাতা।
সেই বৃক্ষকে দেখবার জন্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এবং সকল দেবতাগণ এলেন। সকলে সেই বিল্বপত্রকে প্রণাম করলেন।
নারায়ণ সকলকে বললেন, এই বিপত্রের উপরের পত্রটি স্বয়ং শিব, বামপত্রে ব্রহ্মা আর দক্ষিণ পত্রে আমার অধিষ্ঠান। এই বিপত্রে কেউ পা দিলে বা স্পর্শ বা লঙ্ঘন করলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। সূর্য ও গণেশের পূজা এই পত্র দিয়ে করা যাবে না। যেখানে এই বৃক্ষ থাকবে তা বারাণসী সমান পুণ্যস্থান হবে। সেখানে মহেশ্বরের সঙ্গে উমা বিরাজ করবেন। বিল্বপত্র দিয়ে শিব পূজা করলে লক্ষ ধেনুদানের ফল পাওয়া যাবে। বিল্ববৃক্ষ কখনও ছেদন করা যাবে না বা একে পোড়ানো চলবেনা। চৈত্র থেকে চার মাস বিল্বপত্র এবং জল দান করলে পিতৃকুল পরিতৃপ্ত হয়।
বিপত্রের মাহাত্ম্য বর্ণনা করলেন জনার্দন। পরে ব্রহ্মা ও আদি দেবতাগণ সেই বিপত্রের দ্বারা মহেশ্বরের পূজা করলেন। তারপর যে যার নিজ স্থানে চলে গেলেন।

Eso Ma Lokkhi Boso Ghore (এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে)
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে
শঙ্খ বাজিয়ে তোমায় ঘরে এনেছি
সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি
শঙ্খ বাজিয়ে তোমায় ঘরে এনেছি
সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি
প্রদীপ জ্বেলে নিলাম তোমায় বরণ করে
জনম জনম থাক আমার এ ঘরে
প্রদীপ জ্বেলে নিলাম তোমায় বরণ করে
জনম জনম থাক আমার এ ঘরে
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে
এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে
আমার এ ঘরে থাকো আলো করে…
(From popular Bengali movie ‘Daabi’-Singer: Sandhya Mukherjee)
Tagged: 1770, Bangla Bhasha