Mahabharat Mushala Parva
Translated by Kali Prasanna Simgha
মৌষলপর্ব্বাধ্যায়—যুধিষ্ঠিরের বিবিধ অনিষ্টদর্শন
নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর ষট্ত্রিংশ বৎসর সমুপস্থিত হইলে, ধৰ্ম্মরাজ বিবিধ দুর্নিমিত্তসমুদয় দর্শন করিতে লাগিলেন। চতুর্দ্দিকে কর্করমিশ্রিত নির্ঘাত বায়ু প্রবাহিত হইতে লাগিল। পক্ষিগণ দক্ষিণাবৰ্ত্তমণ্ডল নির্ম্মাণপূৰ্ব্বক আকাশে পরিমণ করিতে আরম্ভ করিল। মহানদীসমুদয় স্রোতবিহীন ও দিক্মুদয় নীহারজালে সমাচ্ছন্ন হইল। অঙ্গারসমাযুক্ত উল্কাসকল গগনমণ্ডল হইতে নিপতিত হইতে লাগিল। সূর্য্যকিরণ ধুলিজালে সমাচ্ছন্ন হইল। উদয়কালে সূর্য্যের প্রভা তিরোহিত ও সূৰ্য্যমণ্ডলে কবন্ধসমুদয় লক্ষিত হইতে লাগিল এবং সূৰ্য্য ও চন্দ্রের পরিধিমণ্ডল শ্যাম, অরুণ ও ধূসর এই ত্রিবিধবর্ণে রঞ্জিত হওয়াতে অতি ভয়ানক হইয়া উঠিল। তখন সেইসমুদয় ও অন্যান্য বিবিধপ্রকার দুর্লক্ষণদর্শনে যুধিষ্ঠিরের উদ্বেগের আর পরিসীম রহিল না।
যদুবংশধ্বংসশ্রবণে পাণ্ডবদিগের উদ্বেগ
কিয়দ্দিন পরে তিনি শুনিলেন, বৃষ্ণিবংশ মুষলপ্রভাবে বিনষ্ট হইয়াছে। বলদেব ও বাসুদেব উভয়েই ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন। তখন তিনি ভ্রাতৃগণকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “হে বীরগণ! ব্রহ্মশাপে বৃষ্ণিবংশ ত’ একবারে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে; এক্ষণে উপায় কি?”
যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে অন্যান্য পাণ্ডবগণ ঐ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া একান্ত দুঃখিত হইলেন। শার্ঙ্গপাণি [শৃঙ্গনির্ম্মিত-ধনুকধারী] বাসুদেবের মৃত্যু সমুদ্রশোষের [সাগর শুকাইয়া] ন্যায় নিতান্ত অসম্ভব বলিয়া তাঁহাদের বোধ হইতে লাগিল। তখন তাঁহারা সকলেই শোকে একান্ত অভিভত ও ইতিকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া বিষন্নবদনে অবস্থান করিতে লাগিলেন।
জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্! মহাত্মা বাসুদেব বিদ্যমান থাকিতে মহারথ অন্ধক, বৃষ্ণি ও ভোজবংশীয়েরা কি নিমিত্ত নিহত হইল?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভের পর ষট্ত্রিংশ বৎসর সমুপস্থিত হইলে, বৃষ্ণিবংশমধ্যে কালপ্রভাবে ঘোরতর দুর্নীতি সমুপস্থিত হইয়াছিল। তাহারা সেই দুর্নীতিনিবন্ধন পরস্পর পরস্পরের বিনাশসাধন করেন।
ঋষিশাপে যদুবংশধ্বংস-প্রসঙ্গ
জনমেজয় কহিলেন, ব্ৰহ্মন! বৃষ্ণি, অন্ধক ও ভোজবংশীয় মহাবীরগণ তৎকালে কাহার শাপে কালকবলে নিপতিত হইলেন, তাহা আপনি বিস্তারিতভাবে কীৰ্ত্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! একদা মহর্ষি বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও তপোধন নারদ দ্বারকানগরে গমন করেন। সারণ প্রভৃতি কতিপয় মহাবীর তাঁহাদিগকে দর্শন করিয়া দৈবদুর্ব্বিপাকবশতঃ শাম্বকে স্ত্রীবেশ ধারণ করাইয়া তাঁহাদিগের নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মহর্ষিগণ! ইনি অমিতপরাক্রম বভ্রুর পত্নী। মহাত্মা বভ্রু পুত্রলাভে নিতান্ত অভিলাষী হইয়াছেন। অতএব আপনারা বলুন, ইনি কি প্রসব করিবেন?”
সারণ প্রভৃতি বীরগণ এই কথা কহিলে, সেই সৰ্ব্বজ্ঞ ঋষিগণ আপনাদিগকে প্রতারিত বিবেচনা করিয়া রোষভরে তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “দূর্ব্বৃত্তগণ! এই বাসুদেবতনয় শাম্ব বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশবিনাশের নিমিত্ত ঘোরতর লৌহময় মুষল প্রসব করিবে। ঐ মুষলপ্রভাবে মহাত্মা বলদেব ও জনার্দ্দন ভিন্ন যদুবংশের আর সকলেই এককালে উৎসন্ন হইবে। মহাত্মা বলদেব যোগবলে কলেবর পরিত্যাগ করিয়া সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইবেন এবং বাসুদেব ভূতলে শয়ন করিয়া জরানামক ব্যাধের শরে বিদ্ধ হইয়া পরলোকে গমন করিবেন।”
মুনিগণ রোষারুণনেত্রে [ক্রোধরক্তবর্ণনেত্রে] সারণাদিকে [সারণ প্রভৃতি যাদবগণকে] এই কথা কহিয়া হৃষীকেশের নিকট সমুপস্থিত হইলেন। মহাত্মা মধুসূদন তাঁহাদিগের নিকট ঐ বৃত্তান্ত অবগত হইয়া উহা অবশ্যম্ভাবী বিবেচনা করিয়া বৃষ্ণিবংশীয়দিগকে কহিলেন যে, মুনিগণ যাহা কহিয়াছেন, নিশ্চয় তাহা ঘটিবে।’ এই কথা কহিয়া, তিনি সেই শাপনিবারণের কোন উপায় উদ্ভাবনে সচেষ্ট না হইয়া পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন।
অনন্তর পরদিন প্রভাতে শাম্ব বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের নাশক এক ঘোরতর মুষল প্রসব করিলেন। ঐ মুষল প্রসূত হইবামাত্র নরপতি সন্নিধানে সমানীত হইল। তখন তিনি রাজপুরুষগণদ্বারা সেই মুষল চূর্ণ করাইয়া সমুদ্রে নিক্ষেপ করাইলেন। ঐ সময় আহুক, জনার্দ্দন, বলদেব ও বভ্রুর বাক্যানুসারে নগরমধ্যে এই ঘোষণা হইলে যে, আজ অবধি নগরমধ্যে কোন ব্যক্তি সুরা প্রস্তুত করিতে পারিবে না। যে কেহ আমাদের অজ্ঞাতসারে সুরা প্রস্তুত করিবে, তাহাকে সবান্ধবে শূলে আরোপিত করা হইবে। এইরূপ ঘোষণা হইলে নগরবাসী লোকসমুদয় সেই শাসন শিরোধার্য্য করিয়া সুরা প্রস্তুতকরণে এককালে বিরত হইল।
যদুপুরে ধ্বংসসূচক উপদ্রব উপস্থিতি
বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! বৃষ্ণি ও অন্ধকগণ এইরূপে সাবধান হইয়া অবস্থান করিতে আরম্ভ করিলে, কৃষ্ণপিঙ্গলবর্ণ মুণ্ডিতশিরা বিকটাকার কালপুরুষ প্রতিনিয়ত তাঁহাদিগের গৃহে পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা কোন কোন সময়ে ঐ পুরুষকে দেখিতে পাইতেন এবং কখন কখন তিনি তাঁহাদিগের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইতেন। ঐ পুরুষ দৃষ্টিপথে নিপতিত হইলেই, তাঁহারা তাঁহার প্রতি অসংখ্য শরনিক্ষেপ করিতেন; কিন্তু কোনরূপেই তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে পারিতেন না।
অনন্তর দিনে দিনে সেই নগরমধ্যে যদুবংশের বিনাশসূচক ভয়ঙ্কর ঝঞ্ঝাবাত প্রবলবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল। পথিমধ্যে অসংখ্য মূষিক ও ভগ্ন মৃৎপাত্রসমুদয় দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। রাত্রিযোগে মূষিকেরা গৃহমধ্যে নিদ্রিত ব্যক্তিদিগের কেশ ও নখচ্ছেদনপূৰ্ব্বক ভক্ষণ করিতে লাগিল। গৃহস্বামিগণ দিবারাত্রি অপ্রীতিকর শব্দে রোদন করিতে লাগিল। সারসেরা উলূকের ন্যায় ও ছাগগণ শৃগালের ন্যায় চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। কালপ্রেরিত রক্তপাদ পাণ্ডুবর্ণ কপোতগণ সতত যাদবদিগের গৃহমধ্যে বিচরণ করিতে প্রবৃত্ত হইল এবং গাভীর গর্ভে রাসভ [গাধা], অশ্বতরীর [খচ্চরের] গর্ভে করভ [করি-শিশু], কুক্কুরীর গর্ভে বিড়াল ও নকুলীর [বেঁজীর] গর্ভে মূষিক উদ্ভূত হইতে লাগিল।
ঐ সময় কৃষ্ণ ও বলদেব ব্যতীত যদুবংশীয় আর সকলেই ব্রাহ্মণ, দেবতা ও পিতৃগণের দ্বেষ এবং লজ্জাভয়পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান ও গুরুজনকে অবজ্ঞা করিতে লাগিলেন। পত্নীগণ পতিসংসর্গ ও পতিগণ পত্নীসংসর্গ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। যাজককর্ত্তৃক প্রজ্বলিত হুতাশন নীল, লোহিত ও হরিদ্বর্ণ শিখা প্রকটিত করিয়া বামভাগে প্রবণ [উদ্দীপ্ত] হইতে লাগিলেন। সূর্য্যকে প্রতিদিন উদয় ও অস্তগমনসময়ে কবন্ধগণে পরিবৃত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। পাকশালামধ্যে সুসংস্কৃত অন্নসমুদয় আহার করিবার সময় তন্মধ্যে সহস্র সহস্র কীট লক্ষিত হইতে লাগিল। মহাত্মাদিগের জয় ও পুণ্যাহবাক্য কীৰ্ত্তন করিবার সময় অসংখ্য লোক সেই স্থান দিয়া ধাবমান হইতেছে বলিয়া বোধ হতে লাগিল; কিন্তু কেহই কাহারও দৃষ্টিপথে নিপতিত হইল না। যাদবগণ সকলেই নক্ষত্রসমুদয়কে পরস্পর নিপীড়িত দর্শন করিতে লাগিলেন; কিন্তু স্বীয় জন্মনক্ষত্র কাহারও দৃষ্টিগোচর হইল না, তাঁহাদিগের গৃহমধ্যে পাঞ্চজন্য নিনাদিত হইলে চতুর্দ্দিকে রাসভগণ ভয়ঙ্কর শব্দে চীৎকার করিতে লাগিল।
ঐ সময় একদা এয়োদশীতে অমাবস্যার সংযোগ হইলে মহাত্মা বাসুদেব উহা নিতান্ত দুর্লক্ষণ বিবেচনা করিয়া বৃষ্ণিগণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে বীরগণ! ভারত-যুদ্ধকালে রাহু যেরূপ দিনে দিবাকরকে গ্রাস করিয়াছিলেন, এক্ষণে আমাদিগের ক্ষয়ের নিমিত্ত সেইরূপ দিন সমুপস্থিত হইয়াছে।” তিনি তাঁহাদিগকে এই কথা কহিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, এতদিনের পর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধাবসানে ষট্ত্রিংশ বর্ষ পরিপূর্ণ হইল। পূৰ্ব্বে গান্ধারী পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া যাহা কহিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা সফল হইবার উপক্রম হইয়াছে। সৈন্যসমুদয় ব্যহিত হইলে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভয়ঙ্কর দুর্নিমিত্তদর্শনে যাহা কহিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহার অনুরূপ ঘটনা দর্শন করিতেছি।”
মহাত্মা মধুসূদন মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া যদুকূল ধ্বংস করার বাসনায় বৃঞ্চিগণকে প্রভাসতীর্থে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন। তখন বৃষ্ণিগণও বাসুদেবের আজ্ঞানুসারে সকলকে প্রভাসতীর্থে গমন করিতে হইবে বলিয়া নগরের চতুর্দ্দিকে ঘোষণা করিতে লাগিলেন।
যাদবনরনারীর দুর্লক্ষণ দুঃস্বপ্ন-দর্শন
বৈশম্পায়ন, বলিলেন, হে মহারাজ! ঐ সময় প্রতিদিন রজনীযোগে বৃঞ্চিবংশীয়দিগের দুঃস্বপ্ন-দর্শন হইতে লাগিল। কামিনীগণ নিদ্রিতাবস্থায় দেখিতে লাগিলেন যেন, এক শুভ্রদশনা কৃষ্ণবর্ণা রমণী হাস্য করিতে করিতে তাঁহাদের মঙ্গলসূত্র অপহরণপূর্ব্বক ধাবমান হইতেছে এবং পুরুষগণ দেখিতে লাগিলেন যেন, ভয়ঙ্কর গৃধ্রগণ অগ্নিহোত্ৰগৃহ ও বাসগৃহমধ্যে তাঁহাদিগকে ভক্ষণ করিতেছে। এইরূপ দুঃস্বপ্নদর্শনে তাঁহাদের চিন্তার আর পরিসীমা রহিল না। অনন্তর ভীষণাকার রাক্ষসগণ তাঁহাদিগের অলঙ্কার, ছত্র, ধ্বজ ও কবচসমুদয় অপহরণ করিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। বাসুদেবের অগ্নিদত্ত বজ্রতুল্য চক্র সকলের সমক্ষেই আকাশে গমন করিল। উঁহার অশ্বসমুদয় দারুকের সমক্ষেই আদিত্যবর্ণ রথ লইয়া সাগরের উপরিভাগ দিয়া প্রস্থান করিল এবং অপ্সরাগণ বলদেবের তালধ্বজ ও বাসুদেবের গরুড়ধ্বজ অপহরণপূৰ্ব্বক দিবারাত্রি যাদবগণকে তীর্থযাত্রা করিতে আদেশ করিতে লাগিল।
যাদবদিগের প্রভাসযাত্রা—মদ্যপানমত্ততা
এইরূপ দুর্নিমিত্তসমুদয় উপস্থিত হইলে, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় বীরগণ সকলেই সপরিবারে তীর্থযাত্রা করিতে ইচ্ছা করিয়া বিবিধ ভক্ষ্য, ভোজ্য, পানীয় ও মদ্য-মাংস প্রস্তুত করিতে লাগিলেন এবং অচিরাৎ হস্তী, অশ্ব ও রথারোহী অসংখ্য সৈন্যে পরিবৃত হইয়া নগর হইতে বহির্গত হইলেন। তৎকালে তাঁহাদের ও তাঁহাদের সৈন্যসমুদয়ের শোভার আর পরিসীমা রহিল না। অনন্তর তাঁহারা সকলে সেই প্রভাসতীর্থে সমুপস্থিত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন গৃহে অবস্থানপূর্ব্বক স্ত্রীগণের সহিত অনবরত পানভোজন করিতে লাগিলেন।
ঐ সময় যোগবিদ্ অর্থতত্ত্ববিশারদ মহাত্মা উদ্ধব যাদবগণকে প্রভাসতীর্থে অবস্থিত অবগত হইয়া, তথায় গমনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে সম্ভাষণ করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেব কালবিপর্য্যয়নিবন্ধন তাঁহাকে নিবারণ করা অকৰ্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন। মহাত্মা উদ্ধব বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপে সম্মানিত হইয়া, তেজোদ্বারা শূন্যমাৰ্গ আচ্ছাদনপূৰ্ব্বক তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। তৎপরে মহারথ যাদবগণ কালের বশীভূত হইয়া ব্রাহ্মণের নিমিত্ত সমাহৃত অন্নসমুদয় সুরামিশ্রিত করিয়া বানরদিগকে প্রদান করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে প্রভাসতীর্থ নট, নর্ত্তক ও মত্ত ব্যক্তিগণে পরিপূর্ণ এবং অসংখ্য তূরীশব্দে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। বলদেব, সাত্যকি, গদ, বভ্রু ও কৃতবর্ম্মা বাসুদেবের সমক্ষেই সুরাপান করিতে আরম্ভ করিলেন। পরিশেষে সাত্যকি সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক মত্ত হইয়া কৃতবর্ম্মাকে উপহাস ও অবমাননা করিয়া কহিলেন, “হার্দ্দিক! ক্ষত্রিয়মধ্যে কেহই এরূপ নির্দ্দয় নাই যে, নিদ্রিত ব্যক্তিদিগকে বিনাশ করিতে পারে। অতএব তুমি যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ, যাদবগণ কখনই তাহা সহ্য করিবেন না।”
যাদবগণের পরস্পর কলহসূচনা
সাত্যকি এই কথা কহিলে মহারথ প্রদ্যুম্নও কৃতবর্ম্মাকে অবজ্ঞা করিয়া সাত্যকির বাক্যের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কৃতবর্ম্মা অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া বামহস্ত সঞ্চালনদ্বারা সাত্যকির ঐ বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “শৈনেয়! মহারাজ ভূরিশ্রবা ছিন্নবাহু হইয়া সংগ্রামে প্রায়োপবেশন করিলে যখন তুমি তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিয়াছ, তখন তোমার তুল্য নৃশংস আর কেহই নাই।” কৃতবর্ম্মা এই কথা কহিলে, মহাত্মা বাসুদেব তাঁহার বাক্যশ্রবণে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তির্য্যগভাবে তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। তখন সাত্যকি স্যমন্তকমণির অপহরণবৃত্তান্ত উল্লেখ করিয়া, কৃতবর্ম্মা অক্রূরদ্বারা যেরূপ মহারাজ সত্রাজিতের বিনাশসাধন করিয়াছিলেন, তাহা আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতে লাগিলেন। সত্রাজিতের দুহিতা সত্যভামা সাত্যকির মুখে সেই পিতৃবধবৃত্তান্ত শ্রবণ করিবামাত্র কোপাবিষ্টচিত্তে রোদন করিতে করিতে বাসুদেবের ক্রোড়ে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহার কোপানল উদ্দীপিত করিলেন। তখন সাত্যকি সহসা গাত্রোত্থান করিয়া সত্যভামাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভদ্রে! আমি শপথ করিয়া কহিতেছি, আজ ঐ পাপপরায়ণ কৃতবর্ম্মাকে দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর পথের পথিক করিব। পূৰ্ব্বে ঐ দুরাত্মা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাকে সহায় করিয়া শিবিরমধ্যে নিদ্রিত ব্যক্তিদিগকে নিহত করিয়াছিল। সেই পাপে আজ ইহার আয়ু ও যশঃ নিঃশেষিত হইয়াছে।”
মহাবীর সাত্যকি এই বলিয়া বাসুদেবের সমক্ষেই খড়গদ্বারা কৃতবর্ম্মার মস্তকচ্ছেদনপূর্ব্বক অন্যান্য বীরগণকে প্রহার করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেব তাঁহাকে নিবারণ করিবার নিমিত্ত তাঁহার নিকট ধাবমান হইলেন। ঐ সময় সেই মদমত্ত ভোজ ও অন্ধকবংশীয়গণ কালপ্রভাবে বিমোহিত হইয়া সাত্যকিকে পরিবেষ্টন করিলেন। মহাত্মা বাসুদেব কালের গতি বিবেচনা করিয়া তদ্দর্শনে কিছুমাত্র ক্রুদ্ধ হইলেন না। তখন তাঁহারা সকলে সমবেত হইয়া উচ্ছিষ্টপাত্ৰদ্বারা সাত্যকিকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন।
যাদবগণের পরস্পর যুদ্ধ—ধ্বংস
মহাবীর সাত্যকি এইরূপে ভোজ ও অন্ধকগণকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইলে, রুক্মিণীনন্দন মহারথ প্রদ্যুম্ন যুযুধানের পরিত্রাণার্থ সংগ্রামস্থলে সমুপস্থিত হইয়া বাহ্বাস্ফোটনপূৰ্ব্বক ভোজদিগের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। মহাবীর সাত্যকিও বাহ্বাস্ফোটনপূৰ্ব্বক অন্ধকদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ সময় ভোজ ও অন্ধকদিগের সংখ্যা অধিক ছিল বলিয়া মহাবীর প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকি তাঁহাদিগকে কোনক্রমে পরাজিত করিতে পারিলেন না। ঐ বীরদ্বয় কিয়ৎক্ষণমাত্র সংগ্রাম করিয়া পরিশেষে বাসুদেবের সমক্ষেই সেই ভোজ ও অন্ধকগণকর্ত্তৃক নিহত হইয়া ভূতলে শয়ন করিলেন।
তখন মহাত্মা বাসুদেব স্বীয় পুত্র প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে বিনষ্ট দেখিয়া কোপাবিষ্টচিত্তে একমুষ্টি এরকা [শরতৃণ] গ্রহণ করিলেন। বাসুদেব এরকা-মুষ্টি গ্রহণ করিবামাত্র উহা মুষলরূপে পরিণত হইল। তখন তিনি তদ্বারা সম্মুখবর্ত্তী ভোজ ও অন্ধকগণকে নিপাতিত করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় অন্ধক, ভোজ, শৈনেয় ও বৃষ্ণিগণও কালবশতঃ পরস্পর সেই এরকাঘাতে বিনষ্ট হইতে লাগিলেন। তৎকালে কোন ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হইয়া একটিমাত্র এরকা গ্রহণ করিলেও উহা বজ্রের ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিল। ফলতঃ ঐ স্থানের সমুদয় এরকাই ব্রহ্মশাপপ্রভাবে মুষলরূপে পরিণত হইয়াছিল। ঐ সময় বীরগণ কোপাবিষ্ট হইয়া যেসকল এরকা নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন, তৎসমুদয় মুষল ও বজ্রস্বরূপ হইয়া অভেদ্য পদার্থ ভেদ করিতে লাগিল। পিতা পুত্রকে ও পুত্র পিতাকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলেন।
কুকুর ও অন্ধকবংশীয় বীরগণ মত্ত হইয়া অনলে নিপতিত পতঙ্গের ন্যায় প্রাণত্যাগ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তথা হইতে পলায়ন করিতে কাহারও প্রবৃত্তি হইল না। ঐ সময় মহাত্মা মধুসূদন কালের গতি পরিজ্ঞাত হইয়া মুসলীভূত এরকা গ্রহণপূর্ব্বক সেই ঘোরতর হত্যাকাণ্ড দর্শন করিতে লাগিলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁহার সমক্ষেই এরকাঘাতে শাম্ব, চারুদেষ্ণ, অনিরুদ্ধ ও গদের প্রাণবিয়োগ হইল। তখন তিনি স্বচক্ষে তাঁহাদের মৃত্যু দর্শন করিয়া কোপাবিষ্টচিত্তে তত্রত্য সমুদয় বীরের প্রাণসংহার করিলেন। ঐ সময় মহাত্মা বস্তু ও দারুক মহামতি মধুসূদনের সমীপে দণ্ডায়মান ছিলেন। তাঁহারা সেই বীরসমুদয়কে নিহত দেখিয়া দুঃখিতচিত্তে বাসুদেবকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “জনার্দ্দন! এক্ষণে ত’ আপনি অসংখ্য লোকের প্রাণসংহার করিলেন। অনন্তর চলুন, আমরা তিনজনে মহাত্মা বলভদ্রের নিকট গমন করি।”
অৰ্জ্জুননিকটে কৃষ্ণের যাদবধ্বংসসংবাদ-প্রেরণ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহাত্মা বভ্রু ও দারুক এই কথা কহিলে মহামহিম বাসুদেব তাঁহাদের বাক্যে সম্মত হইয়া তাঁহাদিগের সহিত অমিতপরাক্রম বলভদ্রের উদ্দেশে গমন করিয়া ইতস্ততঃ বিচরণ করিতে করিতে দেখিলেন, ঐ মহাবীর অতিনির্জ্জন প্রদেশে বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট হইয়া চিন্তা করিতেছেন। মহাত্মা হৃষীকেশ বলভদ্রকে তদবস্থ দেখিয়া দারুককে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “সারথে! তুমি সত্বর হস্তিনানগরে গমন করিয়া অৰ্জ্জুনের নিকট যাদবদিগের বিনাশবৃত্তান্তসমুদয় নিবেদন কর। তাহা হইলে তিনি অবিলম্বে দ্বারকায় আগমন করিবেন।” বাসুদেব এইরূপ আদেশ করিলে দারুক অবিলম্বে রথারোহণে কৌরবরাজধানীতে প্রস্থান করিলেন।
পুরনারীরক্ষাৰ্থ কৃষ্ণের ব্যবস্থা
তখন মহাত্মা কেশব সমীপস্থ বসুকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভদ্র! তুমি অবিলম্বে অন্তঃপুরকামিনীগণের রক্ষার্থ গমন কর। দস্যুগণ যেন ধনলোভে তাহাদিগের হিংসা না করে।”
মহাবীর বভ্রু ঐ সময় মদমত্ত ও জ্ঞাতিবধনিবন্ধন নিতান্ত দুঃখিত হইয়া জনার্দ্দনের নিকট উপবেশনপূর্ব্বক বিশ্রাম করিতেছিলেন। মহাত্মা মধুসূদন এই কথা কহিবামাত্র তিনি যেমন স্ত্রীগণের রক্ষণার্থ ধাবমান হইলেন, অমনি সেই ব্রহ্মশাপসম্ভূত মুষল এক ব্যাধের লৌহময় মুদগরে আবির্ভূত ও তাঁহার গাত্রে নিপতিত হইয়া তাহার প্রাণসংহার করিল। তখন মহাত্মা হৃষীকেশ বভ্রুকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া স্বীয় অগ্রজ বলভদ্রকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহাত্মন্। আমি যেকাল পর্য্যন্ত কাহারও প্রতি স্ত্রীগণের রক্ষণাবেক্ষণের ভার সমর্পণ করিয়া প্রত্যাগমন না করি, সেই কাল পর্য্যন্ত আপনি এই স্থানে আমার প্রতীক্ষা করুন।”
এই কথা কহিয়া বাসুদেব অচিরাৎ নগরমধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক পিতাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “মহাশয়! যে পৰ্য্যন্ত ধনঞ্জয় এখানে আগমন না করেন, সেই পৰ্য্যন্ত আপনি অন্তঃপুরস্থ কামিনীদিগকে রক্ষা করুন। জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলদেব বনমধ্যে আমার নিমিত্ত প্রতীক্ষা করিতেছেন, অতএব আমি এক্ষণে তাঁহার নিকট চলিলাম। পূৰ্ব্বে আমি কুরুপাণ্ডবযুদ্ধে কৌরব ও অন্যান্য নরপতিগণের নিধন দর্শন করিয়াছি, এক্ষণে আবার আমাকে যদুবংশের নিধনও প্রত্যক্ষ করিতে হইল। আজ যাদবগণের বিরহে এই পুরী আমার চক্ষুর শল্যস্বরূপ বোধ হইতেছে। অতএব আমি অচিরাৎ বনগমন করিয়া বলদেবের সহিত তীব্রতর তপানুষ্ঠান করি।”
বলদেবের অন্তর্দ্ধান
মহামতি বাসুদেব এই কথা কহিয়া, পিতার চরণবন্দনপূর্ব্বক অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন। তিনি বহির্গত হইবামাত্র অন্তঃপুরমধ্যে বালক ও বনিতাদিগের ঘোরতর আর্ত্তনাদ সমুত্থিত হইল। তখন ধীমান বাসুদেব অবলাগণের রোদনশব্দশ্রবণে পুনরায় প্রতিনিবৃত্ত হইয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, “হে সীমন্তিনীগণ! মহাত্মা ধনঞ্জয় এই নগরে আগমন করিতেছেন। তিনি তোমাদিগের দুঃখমোচন করিবেন। অতএব তোমরা আর রোদন করিও না।”
এই কথা কহিয়া মহামতি মধুসূদন অবিলম্বে নির্জ্জন বনপ্রদেশে গমন করিয়া দেখিলেন, বলদেব যোগাসনে আসীন রহিয়াছেন এবং তাঁহার মুখমণ্ডল হইতে এক বৃহদাকার শ্বেতবর্ণ সর্প বিনির্গত হইতেছে। ঐ সর্পের মস্তক সহস্ৰসংখ্যক ও মুখ রক্তবর্ণ। সর্প দেখিতে দেখিতে বলদেবের মুখ হইতে বহির্গত হইয়া সমুদ্রাভিমুখে ধাবমান হইল। তখন সাগর, দিব্যনদীসমুদয়, জলাধিপতি বরুণ এবং কর্কোটক, বাসুকি, তক্ষক, পৃথুশ্ৰবা, বরুণ, কুঞ্জর, মিশ্রী, শঙ্খ, কুমুদ, পুণ্ডরীক, ধৃতরাষ্ট্র, হ্রাদ, ক্রাধ, শিতিকণ্ঠ, উগ্রতেজা, চক্রমন্দ, অতিযণ্ড, দুর্ম্মুখ ও অম্বরীষ প্রভৃতি নাগগণ সেই সর্পকে প্রত্যুদগমনপূর্ব্বক স্বাগতপ্রশ্ন ও পাদ্য-অর্ঘ্যাদিদ্বারা অর্চ্চনা করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই সৰ্প বলদেবের মুখ হইতে বহির্গত হইলে তাঁহার দেহ নিতান্ত নিশ্চেষ্ট হইল। তখন সর্ব্বজ্ঞ দিব্যচক্ষু ভগবান্ বাসুদেব জ্যেষ্ঠভ্রাতা দেহত্যাগ করিলেন বিবেচনা করিয়া, চিন্তাকুলিতচিত্তে সেই বিজনবনে পরিভ্রমণ করিতে করিতে ভূতলে উপবেশন করিলেন।
ব্যাধবাণে আহত কৃষ্ণের অন্তর্দ্ধান
ঐ সময় পূর্ব্বে গান্ধারী তাঁহাকে যাহা কহিয়াছিলেন এবং তিনি উচ্ছিষ্ট পায়স পদতলে লিপ্ত না করাতে দুর্ব্বাসা যেসমুদয় বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিলেন, সেইসমুদয় তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইল। তখন তিনি নারদ, দুর্ব্বাসা ও কণ্বের বাক্যপ্রতিপালন, তাঁহার স্বর্গগমন-বিষয়ে দেবতাদিগের সন্দেহভঞ্জন, ত্রিলোকপালন করিবার নিমিত্ত তাঁহাকে মর্ত্যলোক পরিত্যাগ করিতে হইবে বিবেচনা করিয়া ইন্দ্রিয়সংযম ও মহাযোগ অবলম্বনপূর্ব্বক ভূতলে শয়ন করিলেন। ঐ সময় জরানামক ব্যাধ মৃগবিনাশবাসনায় সেই স্থানে সমাগত হইয়া দূর হইতে যোগাসনে শয়ান কেশবকে অবলোকনপূর্ব্বক মৃগ জ্ঞান করিয়া, তাঁহার প্রতি শর নিক্ষেপ করিল। ওই শর নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র উহাদ্বারা হৃষীকেশের পদতল বিধা হইল। তখন সেই ব্যাধ মৃগগ্রহণ-বাসনায় সত্বর তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিল, এক অনেকবাহুসম্পন্ন, পীতাম্বরধারী, যোগাসনে শয়ান পুরুষ তাহার শরে বিদ্ধ হইয়াছেন। লুব্ধক তাঁহাকে দর্শন করিবামাত্র আপনাকে অপরাধী বিবেচনা করিয়া শঙ্কিতমনে তাঁহার চরণে নিপতিত হইল। তখন মহাত্মা মধুসূদন তাহাকে আশ্বাসপ্রদানপূর্ব্বক অচিরাৎ আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া স্বর্গে গমন করিলেন।
ঐ সময় ইন্দ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং রুদ্র, আদিত্য, বসু, বিশ্বদেব, মুনি, সিদ্ধ, গন্ধৰ্ব্ব ও অপ্সরাগণ তাঁহার প্রত্যুদ্গমনার্থ নির্গত হইলেন, তখন ভগবান্ নারায়ণ তাঁহাদের কর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া তাঁহাদের সহিত স্বীয় অপ্রমেয় স্থানে সমুপস্থিত হইলেন। দেবতা, মহর্ষি, সিদ্ধ, চারণ, গন্ধৰ্ব্ব, অপ্সরা ও সাধ্যগণ তাঁহার যথোচিত পূজা করিতে লাগিলেন, মুনিগণ ঋগ্বেদপাঠ ও গন্ধকগণ সঙ্গীতদ্বারা তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্র আহ্লাদিতচিত্তে তাঁহার অভিনন্দনে প্রবৃত্ত হইলেন।
অর্জ্জুনের আগমন—দ্বারকা দুর্দ্দশাদর্শনে বিলাপ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, এদিকে কৃষওসারথি দারুক হস্তিনায় সমুপস্থিত হইয়া পাণ্ডবগণের নিকট যদুকুলের নিধনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিলে, পাণ্ডবগণ উহা শ্রবণ করিয়া নিতান্ত শোকসন্তপ্ত ও ব্যাকুলিতচিত্ত হইলেন। তখন বাসুদেবের প্রিয়সখা মহাবীর ধনঞ্জয় ভ্রাতৃগণকে আমন্ত্রণপূৰ্ব্বক, মাতুল বসুদেবের সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত দারুকের সহিত দ্বারকাভিমুখে যাত্রা করিলেন। অনন্তর তিনি দ্বারকায় সমুপস্থিত হইয়া দেখিলেন, ঐ নগরী অনাথা রমণীর ন্যায় নিতান্ত হীনদশা প্রাপ্ত হইয়াছে। ঐ সময় বাসুদেবের অন্তঃপুরস্থ রমণীগণ তাঁহার বিরহে নিতান্ত কাতর হইয়াছিলেন, তাঁহারা অৰ্জ্জুনকে দর্শন করিবামাত্র উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে লাগিলেন। বাসুদেবের যে ষোড়শসহস্র মহিষী ছিলেন, তাঁহারা অৰ্জ্জুনকে সমাগত দেখিয়া হাহাকার করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই পতিপুত্রবিহীনা রমণীগণের আৰ্তনাদবণে অর্জ্জুনের নয়নযুগল বাষ্পবারিতে পরিপূর্ণ হওয়াতে তিনি তৎকালে কিছুমাত্র দর্শন করিতে সমর্থ হইলেন না।
যাদবগণের দুর্দ্দশাদর্শনে অর্জ্জুনের বিলাপ
ঐ সময় সেই বীরশূন্যা দ্বারকাপুরীকে বৈতরণী নদীর ন্যায় তাঁহার বোধ হইতে লাগিল। তিনি বৃষ্ণি ও অন্ধকগণকে উহার জল, অশ্বসমুদয়কে মৎস্য, রথসমুদয়কে উডুপ , বাদিত্র [বাদ্য] ও রথনির্ঘোষকে তরঙ্গ, গৃহসোপানসমুদয়কে মহাহ্রদ, রত্নসমুদয়কে শৈবাল [শেওলা], পথসমুদয়কে আবর্ত্ত [জলঘূর্ণী], চত্বর সমুদয়কে স্তিমিত হ্রদ এবং বলদেব ও বাসুদেবকে মহানক্র বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি সেই দ্বারকাপুরী ও বাসুদেবের বনিতাদিগকে হেমন্তকালীন নলিনীর ন্যায় নিতান্ত শ্রীভ্রষ্ট ও প্রভাশূন্য দর্শন করিয়া বাষ্পকুলিতলোচনে রোদন করিতে করিতে ধরাতলে নিপতিত হইলেন। তখন বাসুদেবমহিষী সত্যভামা, রুক্মিণী ও অন্যান্য রমণীগণ অর্জ্জুনের নিকট বেগে ধাবমান হইয়া তাঁহাকে পরিবেষ্টনপূৰ্ব্বক কিয়ৎক্ষণ রোদন করিলেন এবং তৎপরে তাঁহাকে ধরাতল হইতে উত্থাপনপূৰ্ব্বক কাঞ্চনময় পীঠে উপবেশন করাইয়া তাঁহার চতুর্দ্দিকে অবস্থান করিতে লাগিলেন ।
যদুবংশধ্বংসে বসুদেবের বিলাপ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর মহাত্মা অৰ্জ্জুন মনে মনে বাসুদেবের স্তব করিয়া স্ত্রীগণকে আশ্বাসপ্রদানপূৰ্ব্বক মাতুলের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে তাঁহার গৃহে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, মহাত্মা বসুদেব পুত্রশোকে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া শয়ান রহিয়াছেন। তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া ধনঞ্জয়ের দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। তখন তিনি বাষ্পপূর্ণনয়নে রোদন করিতে করিতে তাঁহার চরণযুগল বন্দনা করিলেন।
মহাত্মা বসুদেব ভাগিনেয় অর্জ্জুনকে সমাগত দেখিয়া নিতান্ত দৌর্ব্বল্যনিবন্ধন তাঁহার মস্তকাঘ্রাণ করিতে সমর্থ না হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক পুত্র, পৌত্র, দৌহিত্র ও বান্ধবগণের নিমিত্ত রোদন করিতে করিতে কহিলেন, “ধনঞ্জয়! যাহারা অসংখ্য ভূপতি ও দানবগণকে পরাজিত করিয়াছিল, আজ আমি তাহাদিগকে না দেখিয়াও জীবিত রহিয়াছি। তুমি যে প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে প্রিয়শিষ্য বলিয়া সৰ্ব্বদা প্রশংসা করিতে এবং যাহারা বৃষ্ণিবংশের অতিরথ বলিয়া বিখ্যাত ও বাসুদেবের নিতান্ত প্রিয়পাত্র ছিল, এক্ষণে তাহাদিগেরই দুর্নীতিনিবন্ধন এই যদুকুলের ক্ষয়-হইয়াছে। অথবা উহাদের এ বিষয়ে দোষ কি? ব্রহ্মশাপই ইহার মূল কারণ।
“পূৰ্ব্বে যে কৃষ্ণ মহাবলপরাক্রান্ত কেশী, কংস, শিশুপাল, নিষাদরাজ একলব্য, কাশীরাজ, কালিঙ্গগণ, মাগধগণ, গান্ধারগণ এবং প্রাচ্য, দাক্ষিণাত্য ও পার্ব্বতীয় ভূপালগণকে নিহত করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনিও এই যদুকুল ক্ষয় হইতে দেখিয়া উপেক্ষা করিয়াছেন। তুমি, দেবর্ষি নারদ ও অন্যান্য মহর্ষিগণ তোমরা সকলেই যাঁহাকে সনাতন দেবদেব বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাক, তিনি এক্ষণে স্বচক্ষে জ্ঞাতিবধ প্রত্যক্ষ করিয়া উপেক্ষা করিলেন। বোধ হয়, গান্ধারী ও ঋষিগণের বাক্য অন্যথা করিতে তাঁহার বাসনা হয় নাই।
“তোমার পৌত্র পরীক্ষিৎ অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্ৰদ্বারা দগ্ধ হইলে তিনিই তাঁহার জীবন দান করিয়াছিলেন, কিন্তু এক্ষণে স্বীয় পরিজনদিগকে রক্ষা করিতে তাঁহার বাসনা হইল না। তাঁহার পুত্র, পৌত্র, সখা ও ভ্রাতৃগণ সকলে নিহত হইলে, তিনি আমার নিকট আগমনপূর্ব্বক আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, পিতঃ! আজ এই যদুকুল একেবারে নিঃশেষিত হইল। আমার প্রিয়সখা অর্জ্জুন দ্বারকায় আগমন করিলে আপনি তাঁহার নিকট এই কুলক্ষয়ের বিষয় আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিবেন। আমি অর্জ্জুনের নিকট দূত প্রেরণ করিয়াছি। তিনি এই নিদারুণ সংবাদ শ্রবণ করিলে কখনই হস্তিনায় অবস্থান করিতে পারিবেন না। অর্জ্জুনের সহিত আমার কিছুমাত্র প্রভেদ নাই। অতএব ঐ মহাত্মা এ স্থানে আগমন করিয়া যাহা কহিবেন, আপনি অবিচারিতচিত্তে তাহার অনুষ্ঠান করিবেন। তাঁহাদ্বারাই আপনার ঔর্দ্ধদেহিক কাৰ্য্য সম্পন্ন এবং এই বালক ও রমণীগণের রক্ষা হইবে। তিনি এই স্থান হইতে প্রতিগমন করিবামাত্র এই অসংখ্য প্রাচীর ও অট্টালিকাসম্পন্ন দ্বারকাপুরী সমুদ্রজলে প্লাবিত হইয়া যাইবে। আমি এক্ষণে বলদেবের সহিত কোন পবিত্রস্থানে সমুপস্থিত হইয়া কালপ্রতীক্ষায় অবস্থান করিব।’
“অচিন্ত্যপরাক্রম মহাত্মা হৃষীকেশ এই বলিয়া আমাকে বালকগণের সহিত এই স্থানে রাখিয়া যে কোথায় গমন করিয়াছেন, কিছুই বলিতে পারি না। আমি নিতান্ত শোকাকুল হইয়া দিবারাত্রি বলদেব, বাসুদেব ও জ্ঞাতিগণকে স্মরণপূর্ব্বক অনাহারে কালহরণ করিতেছি। আর আমার জীবনধারণ ও ভোজন করিতে প্রবৃত্তি নাই। এক্ষণে সৌভাগ্যবশতঃ তোমার সহিত আমার সাক্ষাৎকারলাভ হইল। অতএব তুমি অবিলম্বে বাসুদেবের বাক্যানুরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান কর। এক্ষণে এই রাজ্য, স্ত্রী ও রত্নসমুদয় তোমারই অধিকৃত হইল; আমি অচিরাৎ তোমার সমক্ষেই প্রাণত্যাগ করিব।”
অর্জ্জুনকর্ত্তৃক যাদব-নরনারীরক্ষা-ব্যবস্থা
মহাত্মা বাসুদেব এই কথা কহিলে, শত্রুতাপন মহাবীর ধনঞ্জয় একান্ত বিমনায়মান হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মাতুল! আমি কোনক্রমেই এই কেশব ও অন্যান্য বীরগণপরিশূন্য রাজপুরীদর্শনে সমর্থ হইতেছি না। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, নকুল, সহদেব, দ্রৌপদী ও আমি আমরা সকলেই এক আত্মা। এই যদুকুলক্ষয় শ্রবণ করিলে আমার ন্যায় তাঁহাদেরও যারপরনাই ক্লেশ হইবে। এক্ষণে মহারাজ যুধিষ্ঠিরেরও মর্ত্যলোক হইতে প্রস্থানসময় সমুপস্থিত হইয়াছে। অতএব আর এ স্থানে অধিকদিন অবস্থান করা আমার উচিত নহে। আমি অচিরাৎ বৃষ্ণিবংশীয় বালক ও বনিতাদিগকে লইয়া ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিব।”
মহাবীর ধনঞ্জয় মাতুলকে এই কথা কহিয়া দারুককে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “দারুক! আমি বৃষ্ণিবংশীয় অমাত্যদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতে বাসনা করি, অতএব তুমি সত্বর আমাকে তাঁহাদের নিকট লইয়া চল।” এই কথা কহিয়া তিনি দারুকের সহিত মহারথ যাদবগণের নিমিত্ত শোক করিতে করিতে তাঁহাদের সভায় সমুপস্থিত হইলেন। অনন্তর তিনি তথায় আসনপরিগ্রহ করিলে অমাত্যগণ, প্রকৃতিমণ্ডল এবং ব্রাহ্মণগণ তাঁহাকে পরিবেষ্টন করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন সেই দীনচিত্ত মৃতকল্প ব্যক্তিদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ! আমি অন্ধকদিগের পরিবারদিগকে লইয়া ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিব। কৃষ্ণের পৌত্র বজ্র ঐ নগরে রাজা হইয়া তোমাদিগকে প্রতিপালন করিবেন। এই নগর অচিরাৎ সমুদ্রজলে প্লাবিত হইবে। অতএব তোমরা অবিলম্বে যান ও রত্নসমুদয় সুসজ্জিত কর। সপ্তমদিবসে সূর্য্যোদয়সময়ে আমাদিগকে এই নগরের বহির্ভাগে অবস্থান করিতে হইবে। অতএব তোমরা আর বিলম্ব করিও না, শীঘ্র সুসজ্জিত হও।”
বসুদেবের মৃত্যু—দেবকী প্রভৃতির সহমরণ
মহাত্মা ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে, তাঁহারা সকলেই সত্বর সুসজ্জিত হইতে লাগিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন শোকে একান্ত অভিভূত হইয়া কৃষ্ণের গৃহে সেই রজনী অতিবাহিত করিলেন। পরদিন প্রাতঃকালে প্রবল প্রতাপ মহাত্মা বসুদেব যোগাবলম্বনপূর্ব্বক কলেবর পরিত্যাগ করিয়া উৎকৃষ্ট গতি লাভ করিলেন। তখন তাঁহার অন্তঃপুরমধ্যে ঘোরতর ক্রন্দনশব্দ সমুত্থিত হইয়া সমুদয় পুরী প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। কামিনীগণ মাল্য ও আভরণ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আলুলায়িতকেশে বক্ষঃস্থলে করাঘাত করিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা অর্জ্জুন সেই বসুদেবের মৃতদেহ বহুমূল্য নরযানে আরোপিত করিয়া অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলেন। দ্বারকাবাসিগণ দুঃখশোকে একান্ত অভিভূত হইয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল। ভৃত্যগণ শ্বেতচ্ছত্র ও যাজকগণ প্রদীপ্ত পাবক লইয়া সেই শিবিকাযানের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। দেবকী, ভদ্রা, রোহিণী ও মদিরা নামে বসুদেবের পত্নীচতুষ্টয় তাঁহার সহমৃতা হইবার মানসে দিব্য অলঙ্কান বিভূশিত ও অসংখ্য কামিনীগণে পরিবেষ্টিত হইয়া তাঁহার অনুগামিনী হইলেন। ঐ সময়ে জীবদ্দশায় যে স্থান বসুদেবের মনোরম ছিল, বান্ধবগণ সেই স্থানে তাঁহাকে উপনীত করিয়া তাঁহার প্রেতকৃত্য সম্পাদন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন তাঁহার দেবকী প্রভৃতি পত্নীচতুষ্টয় তাঁহাকে প্রজ্বলিত চিতাতে আরোপিত দেখিয়া তদুপরি সমারূঢ় হইলেন।
বসুদেব ও রামকৃষ্ণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
মহাত্মা অর্জ্জুন চন্দনাদি বিবিধ সুগন্ধকাষ্ঠদ্বারা পত্নীসমবেত বসুদেদের দাহকাৰ্য্য সম্পাদন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় সেই প্রজ্বলিত চিতানলের শব্দ সামবেত্তাদিগের বেদাধ্যয়ন ও অন্যান্য মানবগণ রোদনধ্বনিপ্রভাবে পরিবর্দ্ধিত হইয়া সেই স্থান প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। অনন্তর তিনি বজ্র প্রভৃতি যদুবংশীয় কুমারগণ ও কামিনীগণের সহিত সমবেত হইয়া বসুদেবের উদকক্রিয়া সম্পাদন করিলেন।
এইরূপে বসুদেবের ঔর্দ্ধদেহিক কাৰ্য্য সম্পাদিত হইলে, পরমধার্ম্মিক ধনঞ্জয় যে স্থানে বৃষ্ণিবংশীয়েরা বিনষ্ট হইয়াছিলেন, সেই স্থানে সমুপস্থিত হইলেন। তখন সেই ব্ৰহ্মশাপগ্রস্ত মুষলনিহত বৃষ্ণিগণকে নিপতিত সন্দর্শন করিয়া তাঁহার দুঃখের আর পরিসীমা রহিল না। তখন তিনি জ্যেষ্ঠতানুসারে তাঁহাদিগের সকলের উদকক্রিয়া সম্পাদন করিয়া অন্বেষণদ্বারা বলদেবের ও বাসুদেবের শরীরদ্বয় আহরণপূর্ব্বক চিতানলে ভস্মসাৎ করিলেন।
যাদবনারীগণসহ অর্জ্জুনের হস্তিনাযাত্রা
মহাত্মা অৰ্জ্জুন এইরূপে শাস্ত্রানুসারে বৃষ্ণিবংশীয়দিগের প্রেতকাৰ্য্যসম্পাদন করিয়া সপ্তমদিবসে রথারোহণে ইন্দ্রপ্রস্থাভিমুখে যাত্রা করিলেন। তখন বৃষ্ণিবংশীয় কামিনীগণ শোকার্ত্ত হইয়া রোদন করিতে করিতে অশ্ব, গো, গর্দ্দভ ও উষ্ট্রসমাযুক্ত রথে আরোহণপূর্ব্বক তাঁহার অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন। ভৃত্য, অশ্বারোহী ও রথিগণ এবং পুরবাসী ও জনপদবাসী লোকসমুদয় অর্জ্জুনের আজ্ঞানুসারে বৃদ্ধ, বালক ও কামিনীগণকে পরিবেষ্টন করিয়া গমন করিতে লাগিল। গজারোহিগণ পর্ব্বতাকার গজসমুদয়ে আরোহণপূৰ্ব্বক ধাবমান হইল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় বালকগণ বাসুদেবের ষোড়শসহস্র পত্নী ও পৌত্র বজ্রকে অগ্রসর করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের যে কত অনাথা কামিনী পার্থের সহিত গমন করিয়াছিলেন, তাহার আর সংখ্যা নাই। এইরূপে মহারথ অর্জ্জুন সেই যদুবংশীয় অসংখ্য লোকসমভিব্যাহারে দ্বারকানগরী হইতে বহির্গত হইলেন।
সমুদ্রের দ্বারকাপুরীগ্রাস
দ্বারকাবাসী লোসমুদয় নগর হইতে নির্গত হইলে পর মহাত্মা অর্জ্জুন উহাদের সহিত ঐ বিবিধ রত্নপরিপূর্ণ নগরের যে যে অংশ অতিক্রম করিতে লাগিলেন, সেই সেই অংশ অচিরাৎ সমুদ্রজলে প্লাবিত হইতে লাগিল। তখন দ্বারকাবাসী লোকসমুদয় সেই অদ্ভুত ব্যাপারসন্দর্শনে নিতান্ত চমৎকৃত হইয়া ‘দৈবের কি আশ্চর্য্য ঘটনা’ এই কথা বলিতে বলিতে দ্রুতপদে ধাবমান হইল। অনন্তর মহাবীর ধনঞ্জয় সেই যদুবংশীয় কামিনীগণ ও অন্যান্য যোধগণসমভিব্যাহারে ক্রমে ক্রমে নদীতীর, রমণীয় কানন ও পর্ব্বতপ্রদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দিন পরে তিনি অতিসমৃদ্ধিসম্পন্ন পঞ্চনদদেশে সমুপস্থিত হইয়া পশু ও ধান্যপরিপূর্ণ প্রদেশে অবস্থিতি করিলেন। ঐ স্থানে দস্যুগণ, ধনঞ্জয় একাকী সেই অনাথা যদুকুলকামিনীগণকে লইয়া যাইতেছেন দেখিয়া, অর্থলোভে তাঁহাদিগকে আক্রমণ করিতে বাসনা করিয়া পরস্পর এইরূপ মন্ত্রণা কহিল, “ধনঞ্জয় একাকী কতকগুলি বৃদ্ধ, বালক ও বনিতাসমভিব্যাহারে গমন করিতেছেন। উহার অনুগামী যোধগণেরও তাঁদৃশ ক্ষমতা নাই। অতএব চল, আমরা উহাদিগকে আক্ৰমণ করিয়া উহাদের ধনরত্নসমুদয় অপহরণ করি।”
দস্যুগণকর্ত্তৃক দ্বারকারমণী-আক্রমণ
এইরূপ পরামর্শ করিয়া সেই দস্যুগণ লগুড়হস্তে সিংহনাদশব্দে দ্বারকাবাসী লোকদিগকে বিভ্রাসিত করিয়া তথায় উপস্থিত হইল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় অনুচরগণের সহিত তাহাদের অভিমুখীন হইয়া সহাস্যবদনে তাহাদিগকে কহিলেন, “দস্যুগণ! যদি তোমাদিগের জীবিত থাকিবার বাসনা থাকে, তাহা হইলে অচিরাৎ প্রতিনিবৃত্ত হও, নচেৎ আমি নিশ্চয়ই শরনিকরদ্বারা তোমাদিগকে নিহত করিব।” পাণ্ডুনন্দন এইরূপে তাহাদিগকে ভয়প্রদর্শন করিলেও তাহারা তাঁহার বাক্য অগ্রাহ্য করিয়া দ্বারকাবাসী লোকদিগকে আক্রমণ করিল।
রমণীগণের উদ্ধারে অর্জ্জুনের অসামর্থ্য
তখন মহাবীর ধনঞ্জয় রোষভরে স্বীয় গাণ্ডীবরাসনে জ্যারোপণ করিতে উদ্যত হইলেন, কিন্তু তৎকালে ঐ কাৰ্য্য তাঁহার নিতান্ত কষ্টকর বোধ হইতে লাগিল। পরিশেষে তিনি অতিকষ্টে সেই শরাসনে জ্যারোপণ করিয়া দিব্যাস্ত্রসমুদয় চিন্তা করিতে লাগিলেন, কিন্তু ঐ সময় কোনক্রমে সেই অস্ত্রসমুদয় তাঁহার স্মৃতিপথে সমুদিত হইল না। তখন তিনি স্বীয় ভুজবীর্য্যের হানি ও দিব্যাস্ত্রসমুদয়ের অস্মরণনিবন্ধন নিতান্ত লজ্জিত হইলেন। ঐ সময় বৃষ্ণিবংশীয়দিগের হস্তী, অশ্ব ও রথারোহী যোধগণ সেই দস্যুগণকে নিবারণ করিবার নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করিতে লাগিল, কিন্তু কোনক্রমেই কৃতকার্য্য হইতে সমর্থ হইল না। দস্যুগণ যে দিকে গমন করিতে লাগিল, মহাবীর অর্জ্জুন যত্নপূৰ্ব্বক সেই দিক রক্ষা করিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগকে নিবারণ করিতে পারিলেন না।
অনন্তর দস্যুগণ সৈন্যগণের সমক্ষেই অবলাদিগকে অপহরণ করিতে লাগিল এবং কোন কোন কামিনী ইচ্ছাপূৰ্ব্বক তাহাদিগের সহিত গমন করিতে আরম্ভ করিল। মহাত্মা অৰ্জ্জুন তদ্দর্শনে নিতান্ত উদ্বিগ্ন বৃষ্ণিবংশীয়দিগের ভৃত্যগণের সহিত মিলিত হইয়া তূণীর হইতে শরসমুদয় নিষ্কাশনপূৰ্ব্বক দস্যুগণের প্রতি নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তখন তাহার অক্ষয় তূণীরের মধ্যস্থ বাণসমূহও ক্ষণকালের মধ্যে ক্ষয়প্রাপ্ত হইল। শরসমুদয় নিঃশেষ হইলে, পাণ্ডুনন্দন নিতান্ত দুঃখিত হইয়া শাসনের অগ্রভাগদ্বারা দস্যুগণকে প্রহার করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই তাহাদিগকে নিরাকৃত করিতে পারিলেন না। পরিশেষে সেই দস্যুগণ তাহার সম্মুখ হইতেই বৃষ্ণি ও অন্ধকদিগের অতি উৎকৃষ্ট কামিনীগণকে অপহরণ করিয়া পলায়ন করিল। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় দিব্যাস্ত্র, ভুজবীৰ্য্য ও তূণীরস্থ শরসমুদয়ের ক্ষয়নিবন্ধন নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া দৈবদুৰ্ব্বিপাক স্মরণপূৰ্ব্বক প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।
বজ্রের হস্তে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার-অর্পণ
অনন্তর তিনি সেই হৃতাবশিষ্ট কামিনীগণ ও রত্নরাশিসমভিব্যাহারে কুরুক্ষেত্রে সমুপস্থিত হইয়া হার্দ্দিক্যতনয় ও ভোজকুলকামিনীগণকে মার্ত্তিকাবতনগরে, অবশিষ্ট বালক, বৃদ্ধ ও বনিতাগণকে ইন্দ্রপ্রস্থে এবং সাত্যকিপুত্রকে সরস্বতীনগরে সন্নিবেশিত করিলেন। ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যভার কৃষ্ণের পৌত্র বজ্রের প্রতি সমর্পিত হইল। ঐ সময় অক্রূরের পত্নীগণ প্রব্রজ্যাগ্রহণে উদ্যত হইলে, বজ্র বারংবার তাঁহাদিগকে নিষেধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই তাঁহারা প্রতিনিবৃত্ত হইলেন না। রুক্মিণী, গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও দেবী জাম্ববতী ইঁহারা সকলে হুতাশনে প্রবেশপূৰ্ব্বক প্রাণত্যাগ করিলেন। সত্যভামা প্রভৃতি কৃষ্ণের অন্যান্য পত্নীগণ তপস্যা করিবার মানসে অরণ্যে প্রবিষ্ট হইয়া ফলমূল ভোজনপূৰ্ব্বক হিমালয় অতিক্রম করিয়া কলাপগ্রামে উপস্থিত হইলেন। অনন্তর মহাত্মা ধনঞ্জয় দ্বারকাবাসী লোকদিগকে যথোপযুক্ত স্থানবিভাগ প্রদান করিয়া বজ্রের হস্তে সমৰ্পণ করিলেন।
আশ্রমাগত অর্জ্জুনের প্রতি ব্যাসের স্বাগত প্রশ্ন
বৈশম্পায়ন বলিলেন, এইরূপে সমুদয় কার্য্য সম্পাদন করিয়া মহাত্মা ধনঞ্জয় বেদব্যাসের আশ্রমে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, মহর্ষি ধ্যানে নিমগ্ন রহিয়াছেন। তখন তিনি তাঁহার নিকট গমন করিয়া ‘মহর্ষে! আমি অর্জ্জুন, আপনার নিকট আগমন করিয়াছি’ বলিয়া আত্মপরিচয় প্রদান করিলেন। মহর্ষি পাণ্ডুনন্দনকে অবলোকনপূর্ব্বক স্বাগত প্রশ্ন ও আসনপরিগ্রহ করিতে আদেশ করিয়া তাঁহাকে একান্ত দুঃখিত ও দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া কহিলেন, “বৎস! কেহ কি তোমার গাত্রে নখ, কেশ, বস্ত্রাঞ্চল বা কুম্ভমূখস্থিত সলিল প্রক্ষেপ করিয়াছে? তুমি কি রজঃস্বলাগমন বা ব্রহ্মহত্যা করিয়াছ? যুদ্ধে কি কেহ তোমাকে পরাজয় করিয়াছে? আজ তোমাকে এমন শ্রীবিহীন দেখিতেছি কেন? তুমি ত’ কাহারও নিকট কখনও পরাজিত হও নাই। যাহা হউক, যদি প্রকাশ করিবার কোন বাধা না থাকে, তাহা হইলে কি নিমিত্ত আজ তোমার এরূপ শ্রীভ্রংশ হইয়াছে, তাহা অবিলম্বে কীৰ্ত্তন কর।”
অর্জ্জুনের যাদবধ্বংসসহ নিজ পরাজয়জ্ঞাপন
তখন অর্জ্জুন কহিলেন, “ভগবন্! সেই নবজলধরসদৃশ নীলকলেবর পঙ্কজলোচন পীতাম্বর ও বলদেব উভয়েই কলেবর পরিত্যাগ করিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন। ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশে যেসকল মহাত্মারা সিংহতুল্য মহাবলপরাক্রান্ত ছিলেন, ব্রহ্মশাপনিবন্ধন প্রভাসে পরস্পর পরস্পরের প্রতি মুসলীভূত এরকাপ্রহারপূৰ্ব্বক পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়াছেন। কালের কি আশ্চৰ্য্য গতি, যাঁহারা পূৰ্ব্বে অনায়াসে গদা, পরিঘ ও শক্তির প্রহার সহ্য করিতেন, এক্ষণে তাঁহারা সামান্য তৃণপ্রহারে নিহত হইলেন। এইরূপে সৰ্ব্বসমেত পাঁচলক্ষ লোক বিনষ্ট হইয়াছে। আর আমি বারংবার সেই প্রবল প্রতাপ যদুবংশীয়দিগের, বিশেষতঃ যশস্বী কৃষ্ণের, বিনাশবৃত্তান্ত স্মরণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। মহাত্মা বাসুদেব বিনাশ, সমুদ্রশোষ , পর্ব্বতসঞ্চালন , আকাশপতন এবং অগ্নির শৈত্যপ্রভাবের ন্যায় নিতান্ত অবিশ্বাস্য বলিয়া বোধ হয়। এক্ষণে বাসুদেব ব্যতীত আর ক্ষণকাল জীবনধারণ করিতে আমার বাসনা নাই।
কৃষ্ণনাশে সবিশেষ বিষণ্ন অর্জ্জুনের কর্ত্তব্যপ্রশ্ন
“হে তপোধন! আমি এক্ষণে যাহা কহিলাম, ইহা অপেক্ষাও ক্লেশকর আর একটি বিষয় চিন্তা করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। এক্ষণে আমি সেই বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। যদুবংশ ক্ষয় হইবার পর আমি দ্বারকায় গমনপূর্ব্বক তথা হইতে যাদবকুলকামিনীগণকে লইয়া আগমন করিতেছিলাম। পঞ্চনদদেশে দস্যুগণ আমাকে আক্রমণ করিয়া আমার সমক্ষেই অরণ্যে কামিনীগণকে অপহরণ করিয়াছে। তৎকালে আমি গাণ্ডীবশাসন ধারণ করিয়াও তাহাদিগকে পরাস্ত করিতে পারিলাম না। ঐ সময় আমার পূর্ব্বের ন্যায় বাহুবল রহিল না। আমি দিব্যাশাস্ত্ৰসমুদয় এককালে বিস্মৃত হইলাম। ক্ষণকালের মধ্যে আমার তূণীরস্থিত শরসমুদয় নিঃশেষিত হইল এবং যে শঙ্খচক্রগদাধায় চতুর্ভুজ পীতাম্বর পুরুষ আমার রথের অগ্রে অগ্রে ধাবমান হইয়া শত্রুসৈন্যসমুদয়কে দগ্ধ করিতেন, আমি আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। ঐ মহাপুরুষ পুৰ্ব্বে অরাতিসৈন্যগণকে দগ্ধ করাতেই আমি তাহাদিগকে গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত শরনিকরে বিনাশ করিয়াছিলাম। এক্ষণে ঐ মহাত্মার অদর্শনে আমি নিতান্ত অবসন্ন হইয়াছি এবং আমার সর্ব্বশরীর ঘূর্ণিত হইতেছে। এক্ষণে কিছুতেই আমি শান্তিলাভে সমর্থ হইতেছি না। সেই বীরবর জনার্দ্দন ব্যতিরেকে আর ক্ষণকাল আমার জীবিত থাকিবার বাসনা নাই। নারায়ণ ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন শ্রবণ করিয়া অবধি আমার দিক্কল শূন্যময় বোধ হইতেছে। এক্ষণে আমি বীর্য্যবিহীন ও শুন্যহৃদয় হইয়া পরিভ্রমণ করিতেছি। অতএব অতঃপর আমার কর্ত্তব্য কি, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
কৃষ্ণতত্ত্ব-প্রকাশ—মহাপ্রস্থানে ব্যাসের উপদেশ
মহাবীর ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “পার্থ! বৃষি ও অন্ধকবংশীয় মহারথগণ ব্ৰহ্মশাপে দগ্ধ হইয়াছেন, অতএব তাঁহাদিগের নিমিত্ত শোক করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। ঐ বীরগণের নিধন অবশ্যম্ভাবী বলিয়াই মহাত্মা বাসুদেব উহা নিবারণে সমর্থ হইয়াও উপেক্ষা করিয়াছেন। তিনি মনে করিলে মহর্ষি-শাপখণ্ডনের কথা দূরে থাকুক, এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্বসংসারকেও অন্যরূপে নির্ম্মাণ করিতে পারেন। সেই পুরাতন মহর্ষি কেবল পৃথিবীর ভারাবতরণ করিবার নিমিত্তই বসুদেবের গৃহে উৎপন্ন হইয়াছিলেন। তিনিও তোমার প্রতি স্নেহনিবন্ধন তোমার রথের অগ্রে অগ্রে গমন করিতেন। এক্ষণে পৃথিবীর ভারাবতরণ করা হইয়াছে বিবেচনা করিয়া তিনি কলেবর পরিত্যাগ করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিয়াছেন।
“তুমি ও ভীমসেন, নকুল ও সহদেবের সাহায্যে গুরুতর দেবকাৰ্য্য সংসাধন করিয়াছ। এক্ষণে তোমরা সকলেই কৃতকাৰ্য্য হইয়াছ, অতএব অতঃপর ইহলোক হইতে প্রস্থান করাই তোমাদিগের শ্রেয়ঃ। লোকের মঙ্গললাভের সময় সমুপস্থিত হইলেই সুবুদ্ধি, তেজ ও অনাগতদর্শন প্রভৃতি উপস্থিত হইয়া থাকে, আবার অমঙ্গলসময় হইলেই তৎসমুদয়ের ক্ষয় হইয়া যায়। ফলতঃ কালই জগতের বীজস্বরূপ। কালপ্রভাবেই সমুদয় সমুৎপন্ন ও বিলীন হইয়া থাকে। কালই বলবান্ হইয়া আবার দুর্ব্বল এবং ঈশ্বর হইয়াও অন্যের আজ্ঞাবহ হয়। এক্ষণে তোমার অস্ত্রসমুদয়ের কার্য্য শেষ হইয়াছে বলিয়াই উহারা যে স্থান হইতে আগমন করিয়াছিল, সেই স্থানে প্রতিগমন করিয়াছে। আবার যখন উহাদের কার্য্যকাল সমুপস্থিত হইবে, তখন উহারা পুনরায় তোমার হস্তগত হইবে। এক্ষণে তোমাদিগের স্বর্গগমন সময় সমুপস্থিত হইয়াছে, অতএব তদ্বিষয়ে যত্নবান হওয়াই তোমাদিগের শ্রেয়ঃ।”
মহর্ষি বেদব্যাস এই কথা কহিলে, মহাত্মা অৰ্জ্জুন তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক হস্তিনানগরে গমন করিয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়দিগের ক্ষয়বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিলেন।
মৌষলপরর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত
Mahabharata of Krishna-Dwaipayana Vyasa- महाभारत:
Tagged: Mahabharata