নন্দকুমারের বিচার ও ফাঁসি
Trial and execution of Nandakumar
আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী (১৯৫৭)
অতুল সুর
১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৫ আগস্ট তারিখ কলকাতার ইতিহাসে একটা স্মরণীয় দিন। ওই দিন ইংরেজগণ কতৃক কলকাতায় প্ৰথম অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্ৰহ্মহত্যা। হিন্দুর দৃষ্টিতে ব্ৰহ্মহত্যা মহাপাপ। পাছে ব্ৰহ্মহত্যার পাপ তাদের স্পর্শ করে, সেজন্য ৫ আগস্ট তারিখে প্ৰত্যুষেই কলকাতার লোকেরা শহর ছেড়ে গঙ্গার অপর পারে চলে গিয়েছিল।
যাকে নিয়ে এই ব্ৰহ্মহত্যা ঘটেছিল, তিনি হচ্ছেন মহারাজ নন্দকুমার রায়। আগেই বলেছি (পৃ. ৭৩) যে ওয়ারেন হেষ্টিংস ষড়যন্ত্র করে মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসি ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু এ সম্বন্ধে ব্যাপারটা বিশদভাবে অনেকেরই জানা নেই। সেটাই এখানে বলছি।
নন্দকুমারের পৈতৃক বাসস্থান ছিল বীরভূম জেলার ভদ্রপুর গ্রামে। পিতার নাম পদ্মনাভ রায়। তিনি ছিলেন মুরশিদকুলি খাঁর আমিন। নন্দকুমার ফারসী, সংস্কৃত, বাংলা ও পিতার রাজস্ব-সংক্রান্ত কাজ শিখে আলিবর্দী খাঁর আমলে প্ৰথমে হিজলি ও মহিষাদল পরগনার রাজস্ব আদায়ের আমিন ও পরে হুগলীর ফৌজদারের দেওয়ান পদে নিযুক্ত হন। পলাশী যুদ্ধের পর নন্দকুমার নানা উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন। এই সময় বর্ধমানের খাজনা আদায়ের কতৃত্ব নিয়ে ওয়ারেন হেষ্টিংস-এর সঙ্গে তার বিরোধের সূত্রপাত হয়। হেষ্টিংস তখন কোম্পানির রেসিডেণ্ট ছিলেন।
উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়ে পরে নন্দকুমার কলকাতায় আসেন। কলকাতায় তিনি একজন খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে দাঁড়ান। তিনি প্ৰতিভাশালী ব্যক্তিও ছিলেন। তাঁর নানা রকম গুণে মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ শাহ আলম তীকে ‘মহারাজ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। দেশের লোককে রেজা খাঁর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য দেশের লোকেরাও তিনি প্রিয় হয়েছিলেন। তিনি কোনরূপণ অত্যাচার সহ করতে পারতেন না, এবং সব সময় অত্যাচারিতের পক্ষ নিয়ে দণ্ডধারণ করতেন। তা ছাড়া, বীডন স্কোয়ারের নিকট তার বাড়ির দ্বার সব সময়েই দরিদ্র দেশবাসীর জন্য উন্মুক্ত থাকত। প্রত্যহ এক বিরাট জনতা তাঁর বাড়িতে ভোজন করত।
এহেন নন্দকুমারের মত ব্যক্তির বিচার পৃথিবীর নবম আশ্চৰ্যরূপে পরিগণিত হয়েছিল। হেষ্টিংস ও তাঁর কাউনসিলের সঙ্গে নন্দকুমারের বনিবনা ছিল না। তিনি হেষ্টিংস-এর রোহিলা যুদ্ধ ও ফৈজাবাদের সন্ধির তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। হেষ্টিংস-এর সঙ্গে তার বিরোধ চরমে ওঠে যখন ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দে বর্ধমানের রাণী অভিযোগ করেন যে হেষ্টিংস তার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন। ওই ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দেই নন্দকুমার অভিযোগ করেন যে, হেষ্ট্রিংস মুনি বেগমের কাছ থেকে ৩,৫৪,১০৫ টাকা ঘুষ নিয়ে তাঁকে নাবলিক নবাবের অভিভাবক নিযুক্ত করেছেন। হেষ্টিংস প্ৰত্যাভিযোগ আনেন যে, নন্দকুমার কামালউদ্দিন নামে (কামালউদ্দিন হেষ্টিংস-এরই আশ্রিত লোক) এক ব্যক্তিকে প্ররোচিত করেছেন হেষ্টিংস-এর বিরুদ্ধে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ আনবার জন্য। নন্দকুমার এ মামলায় সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হন। তখন হেষ্টিংস কামালউদ্দিন ও মোহনপ্ৰসাদ নামক আর এক ব্যক্তি দ্বারা নন্দকুমারের বিরুদ্ধে এক জালিয়াতির মামলা আনেন। এই মামলাতেই নন্দকুমারের ফাঁসি হয়।
মামলার বিষয়বস্তু ছিল একগাছা মোতির মালা ও কয়েকটি অন্যান্য অলঙ্কার। ১১৬৫ বঙ্গাব্দের (ইংরেজি ১৭৫৮ খ্রীস্টাব্দের) আষাঢ় মাসে মহারাজ নন্দকুমার এই মোতির হার ও অলঙ্কারগুলি মুরশিদাবাদে বলাকীদাস নামে এক ব্যক্তির কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেন বিক্রয়ের জন্য। মীরকাশিমের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধের সময় মুরশিদাবাদে যে বিশৃঙ্খল অবস্থার উদ্ভব হয়েছিল, সে সময় বলাকীদাসের বাড়ি থেকে এগুলি লুষ্ঠিত হয়। ১১৭২ বঙ্গাব্দে (১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে) বলাকীদাস যখন কলকাতায় আসেন, নন্দকুমার তখন এগুলি তার কাছ থেকে ফেরত চান। বলাকীদাস এগুলি ফেরত দিতে অসমর্থ হয়ে, নন্দকুমারের আনুকূল্যে একখানা দলিল তৈরী করে দেন। বলাকীদাস ওই দলিলে লিখে দেন যে, কোম্পানির ঢাকায় অবস্থিত খাজাঞ্চিখানায় তার যে রোক টাকা আছে, তা ফেরত পেলে তিনি নন্দকুমারের ওই মোতির হার প্রভৃতির মূল্য বাবদ ৪৮,০২১ সিঙ্কা টাকা মুল্য হিসাবে এবং তার ওপর টাকায় চার আনা হিসাবে অতিরিক্ত ব্যাজ দেবে। এই দলিল সম্পাদনের চার বছর পরে ১৭৬৯ খ্রীস্টাব্দের জুন মাসে বলাকীদাসের মৃত্যু ঘটে। বলাকীদাস। তাঁর মৃত্যুশয্যায় নন্দকুমারকে ডেকে বলেন—‘আমি আমার স্ত্রী ও কন্যারা ভার আপনার ওপর সমৰ্পণ করে যাচ্ছি। আমি আশা করি এতদিন অপনি আমার প্রতি যেরূপ আচরণ করেছেন, আমার স্ত্রী ও কন্যার সঙ্গেও সেরূপ আচরণ করবেন।’ এর কিছুদিন পরে যখন বলাকীদাসের বিষয়সম্পত্তি ও দেনাপাওনার নিম্পত্তি হয়, তখন নিম্পত্তিকারীরা নন্দকুমারের প্রাপ্য টাকা তাকে দিয়ে দেন। তখন বলাকীদাসের উক্ত দলিল বাতিল করা অবস্থায় কলকাতার মেয়র আদালতের ফেজখানায় জমা পড়ে এবং সেখান সেখানেই থেকে যায়।
হেষ্টিংস নন্দকুমারের বিরুদ্ধে প্ৰতিশোধ নেবার জন্য, মেয়র আদালতের ফেজখানা থেকে ওই দলিলটা উদ্ধার করেন এবং ওরই ভিত্তিতে এক মামলা রুজু করে বলেন যে দলিলখানা জাল।
১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৬ মে তারিখে কলকাতাবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। যখন তারা শুনল যে নন্দকুমারের ন্যায় ব্যক্তির বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা আনা হয়েছে, এবং তাঁকে সাধারণ কয়েদীদের রাখার জন্য নির্দিষ্ট জেলখানায় রাখা হয়েছে। সরকারের কাছে আরজি পেশ করা হল যে, নন্দকুমারের ন্যায় শ্রেষ্ঠ ও নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণকে সাধারণ জেলখানায় রাখলে তাঁর ধর্ম নষ্ট হবে। কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। হেষ্টিংস-এর প্ররোচনায় বিচারকরা সকলে একমত হয়ে রায় দিলেন। যে ‘শেরিফ যেন নন্দকুমারকে সাধারণ জেলখানাতেই রাখে।’
৮ মে তারিখে নন্দকুমার প্রধান বিচারপতির কাছে এক আবেদন পত্রে বলেন যে, ‘তাঁকে যদি সাধারণ জেলখানায় রাখা হয়, তা হলে তাঁকে জাতিচু্যুত হবার আশঙ্কায় আহার-স্নান প্রভৃতি পরিহার করতে হবে। সেজন্য তাকে এমন কোন বাড়িতে বন্দী করে রাখা হোক যা কোনদিন ক্রীশ্চন বা মুসলমান কতৃক কলুষিত হয়নি, এবং তাকে প্ৰতিদিন একবার করে গঙ্গায় স্নান করতে যেতে দেওয়া হোক।’ কিন্তু বিচারকরা আবার একবাক্যে বললেন- ‘কয়েদীর এরকম আবদার কখনই মেনে নেওয়া যেতে পারে না।’
নন্দকুমার গোড়া থেকেই জেলখানায় আহার ত্যাগ করেছিলেন। সেজন্য ১০ মে তারিখে প্ৰধান বিচারপতি ইমপে (হেষ্টিংস-এর প্রাণের বন্ধু) নন্দকুমারের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবার জন্য একজন চিকিৎসককে পাঠিয়ে দেন। চিকিৎসক মন্তব্য করেন, ‘অনশন হেতু নন্দকুমারের এরূপ শারীরিক অবনতি ঘটেছে যে পরদিন প্রাতের পূর্বেই নন্দকুমারকে খাওয়ানো দরকার।’ সেজন্য বিচারকরা অনুমতি দিলেন যে, প্রতিদিন প্রাতে একবার করে তাঁকে যেন জেলখানার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু নন্দকুমার সে অনুমতি প্ৰত্যাখ্যান করেন। সেজন্য জেলখানার প্রাঙ্গণে একটা তাবু খাটিয়ে সেখানে নন্দকুমারের অবস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। নন্দকুমার সেখানে মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছু গ্ৰহণ করতেন না।
বর্তমান রাইটার্স-বিল্ডিংস-এর পূবদিকে এখন যেখানে সেণ্ট এণ্ডজ গির্জা অবস্থিত, সেখানেই তখন সুপ্রীম কোর্ট ছিল। এখানেই ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৮ জুন তারিখে নন্দকুমারের বিরুদ্ধে আনীত মামলার বিচার শুরু হয়। যে বিচারকমণ্ডলী নন্দকুমারের বিচার করেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ইমপে, হাইড, চ্যাম্বারস ও লেমেস্টার। সরকারী পক্ষের উকিল ছিলেন ডারহাম, আর নন্দকুমারের পক্ষে ফারার। এই মামলায় দশজন ইওরোপীয় ও দুজন ইওরেশিয়ান জুরি নিযুক্ত হয়। দোভাষী ছিলেন হেষ্টিংস ও ইমপে-র বন্ধু আলেকজাণ্ডার ইলিয়ট। তার নাম প্ৰস্তাবিত হওয়া মাত্ৰই, ফারার আপত্তি তুলে বলেন যে, তাঁর মক্কেল একে শক্রিপক্ষের লোক বলে মনে করেন। কিন্তু ফারারের এ আপত্তি নাকচ হয়ে যায়। তারপর ফারার বলেন যে, তাঁর মক্কেলকে কাঠগড়ায় না পুরে যেন তাঁর উকিলের কাছে বসতে দেওয়া হয়, এবং তাকে যেন হাতজোড় করে দাঁড়ানো থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু আদালত ফারারের এসব আবেদনও নাকচ করে দেয়।
তারপর আইনের লড়াই চলে। বিচারক চ্যাম্বারস মত প্ৰকাশ করেন যে বিলাতের আইন কলকাতায় চলতে পারে না। সুতরাং এ মামলা বিচার করার ক্ষমতা আদালতের এলাকার বাইরে। কিন্তু প্ৰধান বিচারপতি (ইমপে) ও অন্য বিচারকরা এর বিপরীত মত প্ৰকাশ করেন। সুতরাং মামলা চলতে থাকে।
নন্দকুমারকে তখন সওয়াল করতে বলা হয়। নন্দকুমার আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেকে ‘নির্দোষ’ বলে ঘোষণা করেন। তাঁকে আবার জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কার দ্বারা আপনি আপনার বিচার হওয়া উচিত মনে করেন?’ নন্দকুমার উত্তর দেন। -’ঈশ্বর ও তার সমতুল্য ব্যক্তি দ্বারা।’ বিচারকরা নন্দকুমারকে জিজ্ঞাসা করেন–‘কাকে আপনি সমতুল্য মনে করেন?’ ফারার উত্তরে বলেন—‘এটা তিনি আদালতের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিতে চান।’
সমস্ত বিচারটাই হল একটা প্ৰহসন মাত্ৰ। মীর আসাদ আলি, শেখ ইয়ার মহম্মদ ও কৃষ্ণজীবন দাস প্রভৃতি অনেকে নন্দকুমারের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন যে, তারা স্বচক্ষে বলাকীদাসের ওই দলিল সম্পাদন হতে দেখেছেন। কিন্তু তা সত্বেও ১৮ জুন তারিখে আদালত জুরিদের প্রতি তাঁদের অভিমত প্ৰকাশ করতে বলে। তঁরা সকলেই একবাক্যে বলেন- ‘নন্দকুমার দোষী, এবং তাঁর প্রতি কোনরূপ দিয়া প্ৰদৰ্শন করবার সুপারিশ আমরা করতে পারি না।’ আদালত নন্দকুমারের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয় (তখনকার বিলাতী আইন অনুযায়ী জালিয়াতি অপরাধে প্রাণদণ্ড হত)। শুধু তাই নয়। নন্দকুমারের সমর্থনে যার সাক্ষী দিয়েছিল, তাদের অভিযুক্ত করবারও আদেশ দেয়।
কলকাতাবাসীর পক্ষ থেকে নন্দকুমারকে বাঁচাবার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। কেননা, বিলাতে রাজার নিকট ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনে জুরিদের অনুমোদন থাকা চাই। জুরিরা সে অনুমোদন দেননি।
১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দের ৫ আগস্ট তারিখে খিদিরপুরের কাছে কুলিবাজারের ফাঁসিমঞ্চে নন্দকুমারকে তোলা হল। অত্যন্ত প্ৰশান্ত মুখে ইষ্টদেবতার নাম করতে করতে নন্দকুমার ফাঁসিমঞ্চে ওঠেন। ইংরেজ-বিচারের যুপকাষ্ঠে বলি হলেন বাঙলার একজন নিষ্ঠাবান ব্ৰাহ্মণ। সব শেষ হয়ে গেলে গঙ্গার অপর পারে সমবেত হিন্দু নরনারী ‘বাপরে বাপ’ বলে চীৎকার করতে করতে গঙ্গায় ঝাপিয়ে পড়ল তাদের পাপক্ষালনের জন্য।
› Forums › Trial and execution of Nandakumar – নন্দকুমারের বিচার ও ফাঁসি
› Forums › Trial and execution of Nandakumar – নন্দকুমারের বিচার ও ফাঁসি
© Advocatetanmoy Law Library
› Forums › Trial and execution of Nandakumar – নন্দকুমারের বিচার ও ফাঁসি
© Advocatetanmoy Law Library