Geographical area and linguistic identity of Bengali dialects
বাংলা উপভাষাগুলির ভৌগোলিক এলাকা ও ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয়
বামনদেব চক্রবর্তী-1973
(১) রাঢ়ী উপভাষা (Rari)
মধ্য-পশ্চিম বাংলার এই উপভাষাটির ভৌগোলিক এলাকা বৃহত্তম। নিম্ন-দামোদর অঞ্চল হইতে ভাগীরথীর পূর্ব তীরের অঞ্চল পর্যন্ত এই উপভাষার স্থান। এই কথ্য উপভাষাটি সাধারণত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলার অধিবাসীরা ব্যবহার করেন।
এক-একটি উপভাষার অভ্যন্তরেও আবার নানা আঞ্চলিক পার্থক্য গড়িয়া উঠিতে পারে। উপভাষার (Dialect) মধ্যে গড়িয়া উঠা পৃথক্ আঞ্চলিক রূপকে বিভাষা (Sub-dialect) বলে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের প্রধান উপভাষা রাঢ়ী; বিশাল ভৌগোলিক অঞ্চল ধরিয়া বিরাজ করার ফলে এই উপভাষাটির ভিতরও আবার অঞ্চল-বিশেষের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়–বর্ধমান-বীরভূমের লোকেরা যেভাবে কথা বলেন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসিন্দা ঠিক সেইভাবে বলেন না; পূর্ব মেদিনীপুরের কথ্য ভাষাটির সহিত কলকাতা-হাওড়ার মানুষের কথ্য ভাষার বেশ ফারাক দেখা যায়।
যদিও রাঢ়ী উপভাষাটির পূর্ব ও পশ্চিম–এই দুটি প্রধান বিভাগ রহিয়াছে, তবু সূক্ষ্মভাবে বিচার করিলে এই উপভাষাটিকে চারিটি ভাগে ভাগ করা হয়। সেগুলি ভৌগোলিক অঞ্চলসহ উল্লিখিত হইল?
ক) পূর্ব-মধ্য রাঢ়ী ও কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা।
খ) পশ্চিম-মধ্য রাঢ়ী : বর্ধমান, বীরভূম, পূর্ব বাঁকুড়া, হুগলী।
গ) উত্তর-মধ্য রাঢ়ীঃ নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণ মালদহ।
ঘ) দক্ষিণ-মধ্য রাঢ়ী ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর।
রাঢ়ী উপভাষাগুচ্ছের কেন্দ্রীয় উপভাষা হইতে আধুনিক বাংলা চলিত ভাষার উদ্ভব হইয়াছে।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) আদ্য অ-কারের বিকৃত উচ্চারণ–অ-কারের পরে কিংবা পরবর্তী ব্যঞ্জনে ই ঈ উ ঊ ঋ য-ফলা থাকিলে, অথবা পরবর্তী ব্যঞ্জনটি ক্ষ (খিয়) বা জ্ঞ (গঁ) হইলে শব্দের আদিতে স্থিত ‘অ’-এর উচ্চারণ ‘ও’ হয়। যেমন : রবি (রোবি), অতি (ওতি), নদী (নোদি), মধু (মোর্ধ), বক্ষ (বোকখো ), সত্য (সোত), লক্ষ (লোখো), সন্ধ্যা (সোর্ধ), অরুণ (ওরুন্), অতুল (ওতুল), অমিত (ওমি)।
একদল (Mono-syllabic) শব্দের শেষে ন থাকিলে শব্দের আদিতে স্থিত ‘অ’ ‘ও’-কারের মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : মন (মোন), জন (জো), বন (বোন্), ধন (ধোন্)।
(২) শব্দের মধ্যে বা শেষে স্থিত ব্যঞ্জনযুক্ত ই’ বা ‘উ’ বর্তমান বাংলাদেশের বঙ্গালী উপভাষায় ব্যঞ্জনটির অব্যবহিত পূর্বে উচ্চারিত হয়। এই প্রক্রিয়াকে অপিনিহিতি বলে। [ পৃঃ ১১০-১১১ দেখ ] যেমন : দেখিয়া > দেইখ্যা, করিয়া > কইর্যা, রাখিয়া > রাইখ্যা, শুনিয়া > শুইন্যা। পশ্চিমবঙ্গের রাঢ়ী উপভাষায় এই অপিনিহিতিরই পরবর্তী স্তর অভিশ্রুতি দেখা যায় [ পৃঃ ১১১-১১২ দেখ ]–অপিনিহিতি-জাত ই’ বা ‘উ’ ঠিক পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির সহিত মিশিয়া যায়, পরবর্তী স্বরটিকেও পরিবর্তিত করে। যেমন : দেইখ্যা > দেখে, কইর্যা > করে, রাইখ্যা > রেখে, শুইন্যা > শুনে, আইল > এল। এই অভিশ্রুতি রাঢ়ী উপভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(৩) স্বরসঙ্গতির [ পৃঃ ১০৯-১১০ দেখ ] ফলে শব্দের মধ্যে পাশাপাশি বা কাছাকাছি অবস্থিত ভিন্ন স্বরধ্বনি একই স্বরধ্বনিতে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। যেমন : দেশি দিশি, বিলাতি–বিলিতি।
(৪) শব্দমধ্যস্থ নাসিক্য ব্যঞ্জন লুপ্ত হইয়া পূর্ববর্তী হ্রস্বস্বরটি দীর্ঘস্বর ও অনুনাসিক হইয়াছে। যেমন–চন্দ্র > চাঁদ, বন্ধ > বাঁধ; ইহাকে নাসিকীভবন [পৃঃ ৯৩ দেখ] বলে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাসিক্যব্যঞ্জনের লোপ না হইলেও স্বরধ্বনিটি সানুনাসিক হইয়াছে। ইহা স্বতোনাসিকীভবন। [ পৃঃ ৯৩-৯৪ দেখ ] যেমন : পুস্তক > পুথি > পুঁথি; দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তের (বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মানভুম, বীরভূম অঞ্চলে) বিভাষায় অস্থানে এমন অনুনাসিকের প্রচুর আগম দেখা যায়। যেমন : চা > চাঁ, কুকুর > কুঁকুর, খোকা > খোকা, সাপ > সাঁপ, কাঁচ > কাঁচ, ঘোড়া > ঘোড়া, হয়েছে ১ হইছে, হাসপাতাল > হাসপাতাল, হাসি > হাঁসি, ঘুড়ি > খুঁড়ি, টাকশাল > টাকশাল ইত্যাদি।
(৫) শব্দের প্রথম স্বরধ্বনিতে স্পষ্টভাবে শ্বাসাঘাত থাকিলে শব্দের শেষে অবস্থিত ব্যঞ্জনটির মহাপ্রাণ ধ্বনি (বর্গের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বর্ণ) অল্পপ্রাণ ধ্বনিতে (বর্গের প্রথম ও তৃতীয় বর্ণ) পরিবর্তিত হইয়া যায়। যেমন : দুধ > দুদ, মাছ > মাছ, বাঘ ১ বাগ, সাঁঝ > সাঁজ, অবধি > অবদি, ধাই > দাই, মধু > মদু।
(৬) কখনও কখনও ঘোষধ্বনি (বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম বর্ণ) অঘোষধ্বনিতে (বর্গের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ণ) পরিণত হয়। যেমন : ফারসী গুলাব > গোলাপ, ইংরেজী লর্ড (Lord) > লাড় > লাট।
আবার কোনো কোনো সময় শব্দের অন্তে অবস্থিত অঘোষধ্বনি ঘোষধ্বনিতে পরিবর্তিত হইয়া যায়। যেমন : ছত্র > ছাত > ছাদ, কাক > কাগ, শাক > শাগ।
(৭) ‘ল’ কোথাও কোথাও ‘ন’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : লেবু > নেবু, লঙ্কা > নঙ্কা, লুচি > নুচি, লবণ > নুন, লোহা > নোয়া, লাউ > নাউ।
(৮) শব্দমধ্যস্থ ‘র’ পরবর্তী ‘ল’-এর প্রভাবে ‘ল্’-এ পরিবর্তিত হয়। যেমন : সরল (উচ্চারণ–সোরলো) > সল, করল (কোরলো) > কল, ধরল > ধল, পারলাম > পাল্লাম, করলাম > কলাম, পারলে > পালে।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) কর্তৃকারকের বহুবচনে ‘গুলি’ ‘গুলো’ ‘গুলা’ প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। যেমন : ছেলেগুলো পুকুরে সাঁতার কাটছে। মেয়েগুলো চমৎকার নাচছিল। কিন্তু কর্তৃকারক ছাড়া অন্যান্য কারকের বহুবচনে ‘দের বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : কর্মকারক–তিনি আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেন। করণকারক–তোদের দ্বারা একাজ হবে না। অপাদান–কথাটা তাদের কাছে শুনলাম।
(২) দ্বিকর্মিক ক্রিয়ার দুইটি করিয়া কর্ম থাকে–প্রাণিবাচক কর্মটিকে গৌণ কর্ম এবং বস্তুবাচক কর্মটিকে মুখ্য কর্ম বলে। ক্রিয়াটিকে কাহাকে প্রশ্ন করিয়া যে উত্তর পাই তাহা গৌণ কর্ম, আর কী প্রশ্ন করিয়া পাওয়া উত্তরটি মুখ্য কর্ম। রাঢ়ীতে গৌণ কর্মটি ‘কে’ বিভক্তিযুক্ত হয়, কিন্তু মুখ্য কর্মটি শুন্য বিভক্তিযুক্ত থাকে। যেমন : বিপ্লববাবু অর্পিতাকে (গৌণ) কলমটি (মুখ্য) দিলেন। শান্তনু সংগীতাকে (গৌণ) ক্যামেরা (মুখ্য) দেখাল।
সম্প্রদানকারকেও ‘কে’ বিভক্তির প্রয়োগ হয়। যেমন : ভিখারীকে ভিক্ষা দাও। দীনদুঃখীকে অন্নবস্ত্র দিলাম।
(৩) অধিকরণকারকে ‘এ’ ও ‘তে’ বিভক্তির প্রয়োগ হয়। যেমন : “ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।” ছেলের ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে বাবা ঘরে বসে দুশ্চিন্তা করছেন, আর মা দরজায় উদ্বিগ্নমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
(৪) সদ্য অতীত কালে প্রথমপুরুষের অকর্মক ক্রিয়াপদে ‘ল’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন : সে গেল। পাখিটা ছিল। তারা পেল। কিন্তু সকর্মক ক্রিয়াপদে ‘-লে’ বিভক্তি যুক্ত হয়। মেয়েরা বলে। ছেলেরা দিলে। তারপরে সবাই মজা করে খাবারগুলো খেলে।
(৫) সদ্য অতীতকালে উত্তমপুরুষের পদে ‘-লুম > -নু’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : আমরা দেখলাম। আমি বললুম (বানু)। আমরা করলুম (করনু)। ‘-লাম’, ‘-লেম’ বিভক্তিও প্রযুক্ত হয়। যেমন : আমরা অবাক হয়ে দেখলাম; এইমাত্তর খবরটা শুনলেম। “এলেম আমি কোথা থেকে।” “ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা।”
(৬) যৌগিক ক্রিয়াপদে মূল ধাতুর সহিত ‘আছ’ ধাতু যোগ করিয়া তাহার সহিত ক্রিয়ার কাল ও পুরুষের বিভক্তি যোগ করিয়া ঘটমান বর্তমান ও ঘটমান অতীতের রূপ গঠন করা হয়। যেমন : (কর + ইতে) + (আছ + ই) = করিতেছি > করছি। আমরা করছি। (ক + ইতে) + (আছ + ইল) = করিতেছিল > করছিল। সে করছিল।
(৭) মূল ক্রিয়ার অসমাপিকার রূপের সহিত ‘আছ’ ধাতু যোগ করিয়া তাহার সহিত ক্রিয়ার কাল এবং পুরুষবাচক বিভক্তি যোগ করিয়া পুরাঘটিত বর্তমান ও পুরাঘটিত অতীতের ক্রিয়ারূপ গঠন করা হয়। যেমন : (ক + ইয়া) + (আছ । + এ = করিয়াছে > করেছে। তারা করেছে। (ক + ইয়া) + (আছ + ইল)। = করিয়াছিল > করেছিল। সে করেছিল।
(২) বঙ্গালী উপভাষা (Bangali)
এটি প্রধানত পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের উপভাষা হইলেও সাধারণভাবে সমগ্র পূর্ববঙ্গেরই উপভাষা। এই উপভাষাটি রাঢ়ী উপভাষার মতোই অনেকখানি ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়িয়া বিরাজ করিতেছে। এটি বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান উপভাষা।
বঙ্গালীর দুইটি বিভাষা–(ক) বিশুদ্ধ বঙ্গালী, যেটি ঢাকা, ফরিদপুর, মৈমনসিংহ, বরিশাল, খুলনা, যশোহর অঞ্চলে প্রচলিত এবং (খ) চাটিগ্রামী, যেটি চট্টগ্রাম ও নোয়াখালি এলাকায় প্রচলিত। ইহা ছাড়া সন্দীপ, শ্রীহট্ট, কাছাড়, ত্রিপুরা ও চাকমা অঞ্চলেও এই উপভাষাটি প্রচলিত আছে।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) বঙ্গালী উপভাষায় অপিনিহিতির প্রাচুর্য দেখা যায়, যেখানে শব্দমধ্যস্থ বা শেষস্থ ‘ই’ বা ‘উ’ তাহার পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনটির ঠিক পূর্বে উচ্চারিত হয়। অভিশ্রুতি ও স্বরসঙ্গতি নাই বলিয়া সরিয়া-আসা স্বরধ্বনিতে প্রাচীনত্ব খানিকটা রক্ষিত আছে। যেমন : আজি > আইজ (আ + জ + ই > আ + ই + জ), রাখিয়া > রাইখ্যা, করিয়া > কইর্যা, দেখিয়া > দেইখ্যা। ইহা ছাড়া–ফলা-যুক্ত ব্যঞ্জন, জ্ঞ ও ক্ষ-এর পূর্বেও অপিনিহিতির মতো একটি ই-গরের আগম হয়। যেমন : বাক্য > বাইক, যজ্ঞ > ইগ্গোঁ, কাব্য > কাইব্ব, সত্য > সইত্ত, ব্রাহ্ম > ব্রাইন্ম, রাক্ষস> রাইখ, লক্ষ > লইখো, গদ্য > গইল, পদ্য > পইদ্দ।
(২) নাসিক্য ব্যঞ্জনধ্বনির (ঙ, ন, ম্ ইত্যাদির) লোপ হয় না, ফলে এই লোপের প্রভাবে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনির নাসিক্যীভবনের প্রক্রিয়া রাঢ়ী উপভাষার মতো বঙ্গালী উপভাষায় দেখিতে পাওয়া যায় না। রাঢ়ী উপভাষার চন্দ্রবিন্দু এই উপভাষায় ন-কারে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। যেমন : বন্ধন (তৎসম) > বাঁধন (রাঢ়ী) > বান্ধন (বঙ্গালী), চন্দ্র > চাঁদ > চান্দ, ক্ৰন্দন > কাঁদন > কান্দন, রন্ধন > রাঁধন ১ রান্ধন।
(৩) উচ্চ-মধ্য অর্ধ-সংবৃত সম্মুখ স্বরধ্বনি ‘এ’ বঙ্গালীতে নিম্ন-মধ্য অর্ধ-বিবৃত সম্মুখ স্বরধ্বনি অ্যা’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : দেশ (এ-কারের স্বাভাবিক উচ্চারণ) > দ্যাশ, শেষ > শ্যা, মেঘ > ম্যাঘ, নেতা > ন্যাতা, লেখা > ল্যাখা, রেখা > র্যাখা, সেতু > স্যাতু, কেন > ক্যান, তেল > ত্যাল।
(৪) উচ্চ-মধ্য অর্ধ-সংবৃত পশ্চাৎ স্বরধ্বনি ‘ও’ উচ্চ-সংবৃত পশ্চাৎ স্বরধ্বনি ‘উ’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : লোক > লুক, ভোর > ভুর, দোষ > দুষ, চোর .. > চুর, বোন > বুন, সোদপুর > সুদপুর, পোলা > পুলা, ঘোড়া > ঘুড়া।
(৫) সঘোষ মহাপ্রাণ বর্ণ (বর্গের চতুর্থ বর্ণ ঘ,,,, ভ) সঘোষ অল্পপ্রাণ (বর্গের তৃতীয় বর্ণ গ, জ, জু, দ, ব) রূপে উচ্চারিত হয়। এগুলি উচ্চারণকালে স্বরতন্ত্রী-দুটি যুক্ত হইয়া স্বরপথ রুদ্ধ করিয়া দেয় এবং বাহির হইতে বায়ু আকর্ষণ করিয়া উচ্চারণ করিতে হয়। এইজন্য এগুলি রুদ্ধস্বরপথ-চালিত অন্তর্মুখী ধ্বনি; কেহ কেহ এগুলিকে কণ্ঠনালীয় স্পর্শযুক্ত অবরুদ্ধ-ধ্বনিও বলিয়াছেন। যেমন : ভাই > বাই, ভাত > বাত, ঘর > গর, ঘা > গা’, ঘোড়া > ঘুড়া > গুড়া।
(৬) তাড়িত ধ্বনি ড’, ‘ঢ় কম্পিত ধ্বনি ‘র’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : বাড়ি > বারি, বড় > বর, ঘোড়া > ঘোরা।
(৭) চ, ছ, জ প্রভৃতি ঘৃষ্টধ্বনি বালীতে প্রায় উষ্মধ্বনিরূপে উচ্চারিত হয়। বর্ণগুলি উচ্চারণকালে বাতাসে বাগ্যঙ্কের সামান্য ঘর্ষণে উষ্মধ্বনির স্পর্শ লাগে বলিয়া চ্’ ছ’ ও ‘জ’ যথাক্রমে ‘ৎস্, স্’ এবং ইংরেজী Z-এর মতো উচ্চারিত হয়। যেমন : কিছু > কিৎসু (কি), গাছতলা > গাতলা, খেয়েছে > খাইসে, করছে > করসে, যাও > Zও, জানতে : ZIন্তি, শুনছে > শুনসে।
(৮) শব্দের আদিতে ও মধ্যে স্থিত হকার লুপ্ত হইয়া অ-কার উচ্চারিত হয়। যেমন : হয় > অয়, শহর > শর, কাহন > কাওন।
(৯) স ও শ-স্থানে হ উচ্চারিত হয়। যেমন : শাক > হাগ, বসো > বহা, সে > হে, সকল > হগল, শালা > হালা, শুন > হুন।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য : (১) শব্দরূপে কর্তৃকারকে সর্বত্র ‘এ’ বিভক্তি হয়। যেমন : রামে গেছে। শ্যামে খাইছে। মাযে ডাকে। রহিমে দেখে। বাপে কলো।
(২) গৌণ কর্মে এবং সম্প্রদানকারকে ‘-রে’ বিভক্তি যোগ হয়। যেমন : আমাবে বাত দাও। অগোরে খাইতে দাও। শ্যামেরে কইসি। গরিব মানূসেরে ক’টা টাকা দাও।
(৩) অধিকরণকারকে ‘-ত’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : বাড়িত থাকুম। হাঁড়িত ভাত।
(৪) কর্তৃকারক ছাড়া অন্য কারকে বহুবচনে ‘-গো’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। যেমন : আমাগো খাইতে দিবা। তোমাগো বাত দিবা কি? অগো দশটা টাকা দিবা। আমাগোর (আমাদের), তোমাগোর (তোমাদিগের)।
(৫) রাঢ়ী উপভাষায় যাহা সাধারণ বর্তমানের ক্রিয়ারূপ, বঙ্গালী উপভাষায় তাহাই ঘটমান বর্তমান অর্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন : মায়ে ডাকে (ডাকিতেছে)। বাপে কয় (বলিতেছে)।
(৬) সদ্য অতীতে উত্তমপুরুষের ক্রিয়ায় ‘-লাম’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : আমরা দেখিলাম। আমি খাইলাম। আমরা পাইলাম।
(৭) রাঢ়ীতে ঘটমান বর্তমানের যাহা বিভক্তি, তাহাই বঙ্গালীতে পুরাঘটিত বর্তমানের বিভক্তিরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন : আমি করসি (< করছি) [ আমি করিয়াছি অর্থে ]। রাঢ়ীতে করছিশব্দের অর্থ করিতেছি, কিন্তু করসি’বঙ্গালীতে করিয়াছি’ বোঝায়।
(৮) মধ্যমপুরুষের সাধারণ ভবিষ্যৎ কালে ‘-বা’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। তুমি বাড়ি যাবা। তোমরা খাবা না?
(৯) উত্তমপুরুষে সাধারণ ভবিষ্যৎ কালে ‘-মু’ ও ‘-উম’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন : আমি খামু (খাইব অর্থে)। আমরা খেলুম (খেলিব)। আমি দেখুম (দেখিব না। আমরা রাতে যামু (যাইব)।
(১০) রাঢ়ীতে অতীত কালের ক্রিয়ার সহিত যুক্ত নঞর্থক অব্যয়টি ‘নি’, কিন্তু বঙ্গালীতে তাহা ‘নাই’। যেমন : আমরা খাই নাই (খাইনি অর্থে)। তুমি যাও নাই (যাওনি)? আমি দেখি নাই (দেখিনি)।
(১১) অসমাপিকার সাহায্যে গঠিত যৌগিক ক্রিয়ায় সম্পন্ন কালের মূল ক্রিয়াটি আগে বসে, অসমাপিকা ক্রিয়াটি পরে বসে। যেমন : শ্যাম পাসে গিয়া (চলিয়া গিয়াছে অর্থে)।
(১২) বঙ্গালীর প্রধান বিভাষা চাটিগ্রামীতে সৃষ্ট ব্যঞ্জনে ব্যাপক উষ্মীভবন লক্ষণীয়। যেমন : কালীপূজা > খালীফুজা।
(১৩) ক্রিয়ার ঘটমান বর্তমানের রূপ—’ত্যাছি’, ‘-ত্যাছ’, ‘-ত্যাহে’ দ্বারা নিষ্পন্ন হয়। আমরা কইত্যাছি (করিতেছি অর্থে)। তুমি খাইত্যাছ (খাইতেছ)। তারা ঘুমাইত্যাছে (ঘুমাইতেছে)।
(৩) বরেন্দ্রী উপভাষা (Barendree)
পশ্চিমবঙ্গের উপভাষা রাঢ়ী এবং উত্তরবঙ্গের উপভাষা বরেন্দ্রীর মধ্যে খুব অল্প পার্থক্য দেখা যায়, কারণ ইহারা মূলত একই উপভাষা ছিল। পরবর্তীকালে পূর্ববঙ্গের উপভাষা বঙ্গালী এবং বিহারের ভাষা বিহারী উত্তরবঙ্গের ভাষার সহিত কিছুটা মিশিয়া যাওয়ায় ইহাদের প্রভাবে এই উপভাষাটিতে কিছু স্বাতন্ত্র্য গড়িয়া উঠে। ফলে বরেন্দ্রী একটি স্বতন্ত্র উপভাষায় পরিণত হয়।
এই উপভাষাটি বরেন্দ্রভূমি অর্থাৎ উত্তরবঙ্গেই প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া ইত্যাদি অঞ্চলে এই উপভাষাটির প্রচলন আছে।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) বরেন্দ্রীর স্বরধ্বনি অনেকাংশে রাঢ়ীরই মতো; রাঢ়ীর মতো বরেন্দ্ৰীতেও অনুনাসিক স্বরধ্বনি রক্ষিত আছে। তবে ‘এ’ স্থানে ‘অ্যা’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : দ্যাও, দ্যান, দ্যাশ, ত্যাল, ম্যাগ।
(২) সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি (বর্গের চতুর্থ বর্ণ ঘূ, ঝ, ঢ, ধ, ভ) কেবলমাত্র শব্দের আদিতে বজায় থাকিলেও শব্দের মধ্য ও অন্ত্য অবস্থানে প্রায়ই অল্পপ্রাণ হইয়া গিয়াছে। যেমন : বাঘ > বাগ, বিঘ্ন > বিগ্ন, আধখানা > আদখানা, মেঘ > ম্যাগ।
(৩) রাঢ়ীতে শ্বাসাঘাত সাধারণত শব্দের আদিতে পড়ে, বরেন্দ্ৰীতে শ্বাসাঘাতের কোনো সুনির্দিষ্ট স্থান নাই।
(৪) বঙ্গালী উপভাষার প্রভাবে বরেন্দ্ৰীতে জ প্রায়ই Z-এর মতো উচ্চারিত হয়।
(৫) শব্দের আদিতে যেখানে ‘র’ থাকিবার কথা নয়, সেইখানে ‘র’-এর আগম হয়। যেমন : আম > রাম, ইন্দুর > র্যান্দুর।
আবার, যেখানে ‘র’ থাকিবার কথা, সেইখানে র-এর লোপ হয়। রক্ত > অক্ত, রং > অং, রস > অস, রাস্তা > আস্তা। ইহার ফলে ‘আমের রস’ উত্তরবঙ্গের উচ্চারণে রামের (র-কারের আগম) অস’ (র-কারের লোপ) হইয়া দাঁড়ায়।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) শব্দ ও ধাতুরূপে বরেন্দ্র মোটামুটি রাঢ়ীরই মতো, তবে অধিকরণ কারকে কখনও-কখনও ‘-ত’ বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : ঘরত (ঘরে) থাক। বাড়িত (বাড়িতে) আছে। ঘরভ গেলাম। বনত বাগ আসে।
(২) সামান্য অতীতকালে উত্তমপুরুষে ‘লাম’ বিভক্তি যোগ হয়। যেমন : আমরা দেখলাম। আমি গেলাম। কলা (গাছ) গাড়লাম।
(৩) অতীতকালবাচক ক্রিয়াপদের প্রথমপুরুষে ‘-ল’ প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন : আইল (আসিল বা এল), খাইল (খাইল বা খেল)।
(৪) পুরাঘটিত বর্তমান কালের ক্রিয়ায় অন্তিম ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হয়। যেমন : আইচ্চে (আসিয়াছে বা এসেছে), খাইচ্চে (খাইয়াছে বা খেয়েছে)।
(৫) গৌণকর্মে ‘কে’ ‘ক’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। হামাক (আমাকে) দাও। (৬) অসমাপিকা ক্রিয়ার অভিশ্রুতি হয়। করিয়া > করে, দেখিয়া > দেখে।
(৭) সম্বন্ধপদে বহুবচনে ‘-দের’ বিভক্তির প্রয়োগ হয়। আমাদের, তাদের, তোমাদের।
.
(৪) কামরূপী (রাজবংশী- Raja Vamshi) উপভাষা
এটি উত্তর-পূর্ব বঙ্গের উপভাষা। বরেন্দ্রী উত্তরবঙ্গের উপভাষা বলিয়া আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, বরেন্দ্রী উপভাষার সহিত কামরূপের ভাষাতাত্ত্বিক সাদৃশ্য বেশী থাকিবার সম্ভাবনা, কারণ এই দুইটি উপভাষার অঞ্চলের ভৌগোলিক নৈকট্য অন্যান্যদের তুলনায় বেশী। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেখা যায়, কামরূপীর সহিত বরেন্দ্রীর সাদৃশ্য খুব কমই আছে, কারণ বরেন্দ্রী প্রধানত রাঢ়ী উপভাষা হইতেই সৃষ্ট হইয়াছে। কামরূপী উপভাষাটি বরেন্দ্রী ও বঙ্গালী উপভাষাদ্বয়ের মধ্যবর্তী কতকগুলি বৈশিষ্ট্যে ইহা উত্তরবঙ্গের এবং কোনো কোনো বৈশিষ্ট্যে পূর্ববঙ্গের উপভাষার অনুরূপ। তবে, বঙ্গালীর সহিতই কামরূপী উপভাষার সাদৃশ্য বেশী রহিয়াছে। কামরূপী উপভাষাটিকে কামরূপের (অসমের) নিকটবর্তী অঞ্চলে বঙ্গালী উপভাষার রূপান্তর বলা যায়। কামরূপী উপভাষার পূর্ব অঞ্চলের বৈচিত্র্য হইতে অসমিয়া ভাষাটির উদ্ভব ও বিকাশ হইয়াছে।
জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দক্ষিণ দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, রংপুর, শ্রীহট্ট, কাছাড়, ত্রিপুরা, পশ্চিম গোয়ালপাড়া অঞ্চলে এই উপভাষাটি প্রচলিত।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) সঘোষ মহাপ্রাণ ধ্বনি (বর্গের চতুর্থ বর্ণ ঘূ, ঝ, ঢ, ধ, ভ) শব্দের আদিতে বজায় থাকিলেও মধ্য ও অন্ত্য অবস্থানে প্রায়ই অল্পপ্রাণ (বর্গের তৃতীয় বর্ণ) হইয়া যায়। সমঝা > সজা, বোঝা > বোজা।
(2) শ্বসাঘাতের তেমন নির্দিষ্ট স্থান নাই। তবে শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাতের জন্য ‘অ’ ‘আ’ হইয়া যায়। যেমন : অসুখ > আসুখ, অনল > আনল, অতি > আতি, কথা > কাথা।
(৩) বঙ্গালীর মতো কামরূপীতেও ‘ড’ ও ‘ঢ’ পরিবর্তিত হইয়া যথাক্রমে ‘র’ ও ‘রহু’-তে পরিণত হইয়াছে। যেমন : বাড়ি > বারি, আষাঢ় > আসার, শাড়ি > শারি। তবে কোচবিহারের উচ্চারণে ‘ড়’ অপরিবর্তিতই আছে।
(৪) শব্দের আদিতে স্থিত ‘ও কখনও কখনও ‘উ’-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : গোপাল > গুপাল, সোনালী > সুনালি, তোমার > তুমার, কোন্ > কুন্। তবে উচ্চারণের এই পরিবর্তনও উপভাষা অঞ্চলটির সর্বত্র প্রচলিত নয়; কেননা, কোচবিহার, গোয়ালপাড়া প্রভৃতি জায়গায় ‘কোন্ উচ্চারণই চালু।
(৫) শব্দের অন্তে অবস্থিত ‘অ’ ধ্বনি ও-রূপে উচ্চারিত হয়। যেমন : হইত > অইতো, বসিত >বইতো। কখনও কখনও শব্দের শেষস্থ ‘অ’ ধ্বনি উ’-রূপেও উচ্চারিত হয়। যেমন : দুঃখ > দুখু, তুচ্ছ > তুচ্ছ।
(৬) জু’ z-এর মতে, ‘ছ’ স-এর মতে, ‘ছ’ স-এর মতো এবং শ, ষ, স’ হ-এর মতো উচ্চারিত হয়। কিন্তু এই উচ্চারণ-বৈশিষ্ট্যটিও উপভাষা অঞ্চলের সর্বত্রই দেখা যায় না; দিনাজপুরে ‘‘ এবং গোয়ালপাড়া রংপুর এলাকায় ‘স’-এর উচ্চারণ অপরিবর্তিতই আছে।
রূপাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) গৌণকর্মে ও সম্প্রদানকারকে ‘ক’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। মোক ভুলালি। হামা আমাকে) দাও। মোক খিদান লাগিছে। বাপ (বাবাকে) দাও।
(২) অধিকরণকারকে-ত’ বিভক্তির প্রয়োগ হয়। যেমন : পাছৎ (পশ্চাতে), ঘরৎ (ঘরে), ঘরগুলাৎ (ঘরগুলোতে), বারিৎ (বাড়িতে)।
(৩) ক্রিয়াপদের আগে নঞর্থক উপসর্গের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন :–যাও, না-লেখিম। . . .
(৪) কর্মকারকে ‘রে’ বিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : চাকররে, তারে। (৫) সামান্য অতীতকালে ক্রিয়াপদের উত্তমপুরুষে নু’ বিভক্তি দেখা যায়। যেমন : সেবা কমু (করিলাম)। বারি গেনু (যাইলাম)।
অতীতকালে মধ্যমপুরুষে এবং ভবিষ্যৎকালে ক্রিয়াপদে ‘উ’ বিভক্তি যুক্ত হয়। যেমন : মুই করল (আমি করিলাম)। তুই করবু (করিবি)
অতীতকালে প্রথমপুরুষে ‘-ল’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : কইল্ (বলিল), জিঘাইল্ (জিজ্ঞাসা করিল), ধরিল্, আইল্।
(৬) উত্তমপুরুষের একবচনের সর্বনামে ‘আমি’-র পরিবর্তে ‘মুই’ ও ‘হাম’ ব্যবহৃত হয়।
(৭) সম্বন্ধপদে ‘-র’ ‘-ক’ বিভক্তি হয়। যেমন : বাপোক (বাপের), ছাগলের।
(৫) ঝাড়খণ্ডী উপভাষা (Jhar khandi)
দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত বঙ্গ এবং বিহারের কিছু অংশের এই উপভাষাগুচ্ছ তিনটি প্রধান স্তবকে বিভক্ত। দুই মেদিনীপুর জেলার উত্তর ও উত্তর-পূর্বাংশের কথ্যভাষাটি রাঢ়ীর অন্তর্গত, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের কথ্য ভাষাগুলিকে দণ্ডভুক্তীয় স্তবক বলা হয়, এবং মেদিনীপুরের পশ্চিম প্রান্তের ধলভূমের ও মানভূমের কথ্য ভাষাগুলিকে কেন্দ্রীয় ঝাড়খণ্ডী বলা যায়।
মোটামুটিভাবে সাঁওতাল পরগনা, পশ্চিম বীরভূম, পশ্চিম বর্ধমান, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম মেদিনীপুর, ধলভূম, মানভূম, সিংভূম অঞ্চলে এই উপভাষার প্রচলন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে এই ঘন বনজঙ্গল-সমাকীর্ণ অঞ্চলকে ‘ঝারিখণ্ড’ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। ভাষা-বিজ্ঞানীদের অভিমত-অনুসারে, বাংলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে প্রায় আড়াই হাজার বর্গমাইল জুড়িয়া এই উপভাষাটি প্রচলিত।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) সানুনাসিক স্বরধ্বনি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়; কোনো নাসিক্যবর্ণের (ঙ্, ঞ্, ণ্, ন্, ম্) লোপ না হওয়া সত্ত্বেও স্বলোনাসিকীভবনের প্রচুর উদাহরণ এই উপভাষায় পাওয়া যায়। যেমন : চাঁ, উঁট, আঁটা, খোঁকা, হঁইছে, কুঁকুর, ঘোঁড়া, সাঁবান, দুঁধ, সাঁপ, পারলিঁ।
(২) শব্দের আদিতে স্থিত ও-কারকে অ-কার-রূপে উচ্চারণের বহুল প্রবণতা দেখা যায়। মোর > মর্, লোক > লক্, শোক > শক্, তোর > তর্, চোর > চর্।
(৩) শব্দের আদিতে শ্বাসাঘাতের ফলে কখনও কখনও মধ্যস্বর লুপ্ত হয়। এবং অন্তস্থিত ব্যঞ্জনটির দ্বিত্ব হয়। যেমন : দুইটা > দুট্টা (ই লুপ্ত, ট > ট্ট), বড় > বড্ড।
(৪) শব্দের অল্পপ্রাণ ধ্বনিকে মহাপ্রাণ ধ্বনিতে পরিণত করার প্রবণতা দেখা যায়। যেমন : পুকুর > পুখুর, শালিক > শালিখ, পতাকা > ফৎকা, দূর > ধুর।
(৫) অপিনিহিতি ও বিপর্যাসের ফলে শব্দের মধ্যে নবাগত কিংবা বিপর্যস্ত স্বরধ্বনিটির ক্ষীণ স্বর থাকিয়া যায়, তাহার লোপ হয় না, অভিশ্রুতিজনিত পরিবর্তনও হয় না। যেমন : রাতি > রাইত, কালি > কাইল, সন্ধ্যা > সাঁইঝ।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য :
(১) নামধাতুর ব্যাপক ও বিচিত্র প্রয়োগ ঝাড়খণ্ডী উপভাষার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেমন : আজ রাতকে ভারি জাড়াবে। পখুরের জলটা গঁধাচ্ছে। হমর ঘরে চর সাঁদাইছিল। মাঠটা খুব ঘাঁসাবে। হাতটা খুব ব্যথাচ্ছে। জলটা ঘোলাচ্ছে।
(২) ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়াপদে স্বার্থিক ‘-ক’ প্রত্যয়ের বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : সে বাড়ি যাবেক নাই। তুমি খাবেক। সে মারবেক।
(৩) ক্রিয়াপদে ‘আছ’ ধাতুর পরিবর্তে বটু’ ধাতুর প্রয়োগ হয়। যেমন : কে বটে লকটি? উটা মাঠ বটে। যাই বটে। কে বট আপনি? ই, মিছা কথা বটে।
(৪) নিমিত্তার্থে ‘কে’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়; রাঢ়ী উপভাষার মতো হেতু, নিমিত্ত, জন্য ইত্যাদি অনুসর্গ ব্যবহৃত হয় না—“বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্” (জলের নিমিত্ত অর্থে = জল আনিতে)। ঘাসকে গেল্ছে।
সম্প্রদানকারকেও ‘কে’ বিভক্তির ব্যবহার দেখা যায়। যেমন : “বাড়ীকে বিদায় হইল পবন কুঙর।”
অধিকরণকারকেও ‘কে’ বিভক্তি প্রযুক্ত হয়। যেমন : জলকে (জলে অর্থে) যাবি নি? আইজ রাইতকে (রাতে) ভারি জাড়াবে (শীত পড়বে)।
(৫) অপাদানকারকে ‘-নু’, ‘-লে’, ‘-রু’ বিভক্তি ব্যবহৃত হয়। মায়ের-লে মাউসীর দরদ (মায়ের চেয়ে মাসির দরদ)।
(৬) নেতিবাচক বাক্যে নঞর্থক অব্যয় সমাপিকা ক্রিয়ার আগে বসে। মায়কে রাখতে নাই পারলি (পারলাম না)। চুনটুকু কেনে নাই দিলি (দিলি না)?
(৭) সম্বন্ধপদে শূন্যবিভক্তির প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন : “ঘাটশিলা (ঘাটশিলার) শাড়ী কুনি (কুনির) মনে নাই লাগে।”
অধিকরণেও শূন্যবিভক্তি প্রযুক্ত হয়। “রাইত (রাতে) ছিলি ঘাটশিলা টাঁইড়ে।”
(৮) বহুবচন বুঝাইতে ‘গুলা’ ও ‘গুলান’ ব্যবহৃত হয়। যেমন : পাথরগুলা, লোকগুলান, মুনিশগুলান।
এখন শ্রদ্ধেয় ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের অনুসরণে একখানি ছোট্ট অনুচ্ছেদ উপরি-উক্ত পাঁচটি উপভাষায় কীভাবে পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে, তাহারই নিদর্শন দেখাইতেছি।–
রাঢ়ী (কলকাতা ও তাহার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে কথ্য) : “একজন লোকের দুটি ছেলে ছিল। তাদের মধ্যে ছোটোটি বাপকে বলে—”বাবা, আপনার বিষয়ের মধ্যে যে ভাগ আমি পাবো, তা আমাকে দিন। তাতে তাদের বাপ তার বিষয়-আশয় তাদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন।”
বঙ্গালী (ঢাকা-মানিকগঞ্জ অঞ্চলে কথ্য) : “য়্যাক্ জনের দুইডী ছাওয়াল আছিলো। তাগো মৈদ্দে ছোটডি তার বাপেরে কৈলো—’বাবা, আমার বাগে যে বিত্তি-ব্যাসাদ পরে, তা আমারে দ্যাও।’ তাতে তিনি তা বিষয়-সোম্পত্তি তাগো মৈদ্দে বাইটা দিল্যান্।”
এই উপভাষাই চট্টগ্রাম অঞ্চলে কথিত হইলে পরপৃষ্ঠায় লিখিতভাবে পরিবর্তিত হইয়া যায় :
“ওগ্গোয়া মাইনষের দুয়া পোয়া আছিল্। তার মৈদ্দে ছোড়ুয়া তার বা-যে কইল্-–বা-জি, অঁওনর সম্পত্তির মৈদ্দে যেই অংশ আঁই পাইয়ম্, হেইইন আঁরে দেওক।’ ত-অন, তারার বাপ তারার মৈদ্দে নিজের সম্পত্তি ভাগ করি দিল্।”
বরেন্দ্রী (মালদহে কথ্য) : “য়্যাক্ ঝোন্ মানুসের দুটো ব্যাটা আছলো। তার ঘোর বিচে ছোট্কা আপ্র বাবা কহলে, বাব ধন্-করির যে হিস্যা হামি পামু, সে হামা দে। তাৎ তাই তারঘোরকে মাল-মাত্তা সব বাটা দিলে।”
কামরূপী (কোচবিহারে কথ্য) : “এক জনা মান্সির্ দুই কোনা বেটা আছিল্। তার মদ্দে ছোট জন উয়ার বাপোক্ কইল্, ‘বা, সম্পত্তির যে হিস্যা মুই পাইম্, তাক্ মোক্ দেন। তাতে তাঁয় তার মালমাত্তা দোনো ব্যাটা বাটিয়া-চিরিয়া দিল্।”
ঝাড়খণ্ডী (মানভূমে কথিত) : এক লোকের দুটা বেটা ছিল; তাদের মাঝে ছুটু বেটা তার বাপকে বল্লেক, বাপ্ হে, আমাদের দৌলতের যা হিস্বা আমি পাব, তা আমাকে দাও। এতে তার বাপ আপন দৌলৎ বাখরা করে তার হিস্বা তাকে দিলেক।”
front page › Forums › Geographical area and linguistic identity of Bengali dialects
© Advocatetanmoy Law Library
© Advocatetanmoy Law Library