প্রথম অধ্যায়
সৈন্যদর্শন ও অর্জুনবিষাদযোগ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! কৌরব ও পাণ্ডবগণ সংগ্রামভিলাষে ধর্মভূমি কুরুক্ষেত্রে সমবেত হইয়া কি করিয়াছিল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! রাজা দুর্য্যোধন পাণ্ডবসৈন্য ব্যূহিত অবলোকন করিয়া দ্রোণাচার্য্য-সমীপে গমনপূর্বক কহিলেন, “আচার্য্য! ঐ দেখুন, আপনার শিষ্য ধীমান ধৃষ্টদ্যুম্ন মহতী পাণ্ডবসেনা ব্যূহিত করিয়াছে।
যুযুধান, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্য্যবান্ কাশিরাজ, পুরুজিৎ কুন্তীভোজ, নরোত্তম শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, বীর উত্তমৌজা, অভিমন্যু ত্ত মহারথ দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, এই সকল শৌর্য্যশালী, মহারথ, ভীমার্জুন সমকক্ষ, মহাধনুর্দ্ধর বীরপুরুষগণ ঐ ব্যূহিত সেনামধ্যে সন্নিবিষ্ট আছে!
আমাদিগের যে সকল প্রধান সেনানায়ক আছেন, আপনাকে অবগত করাইবার নিমিত্ত তাঁহাদিগের নামও কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।
আপনি, ভীষ্ম, কর্ণ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সমদত্তপুত্র ভুরিশ্রবা ও জয়দ্রথ এবং অন্যান্য নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রসম্পন্ন যুদ্ধবিশারদ বীরপুরুষগণ আমার নিমিত্ত প্রাণদানে অধ্যবসায়ারূঢ় (উদ্যত) হইয়াছেন। আমাদিগের এই ভীষ্মপালিত সৈন্য অপরিমিত (অধিক হইলেও অল্প কার্য্যক্ষম); কিন্তু ভীমরক্ষিত পাণ্ডবসেনা পরিমিত (অপেক্ষাকৃত অল্প হলেও অধিক কার্য্যক্ষম)। এক্ষণে আপনারা সকলে স্ব স্ব বিভাগানুসারে সমুদয় ব্যূহদ্বারে অবস্থানপূর্বক পিতামহ ভীষ্মকে রক্ষা করুন।’
“তখন প্রতাপবান্ কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম রাজা দুর্য্যোধনের হর্ষবর্দ্ধনার্থ সিংহনাদ সহকারে উচ্চস্বরে শঙ্খধ্বনি করিলেন। পরক্ষণেই শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক ও গোমুখ (গোয়ুখাকৃতি শঙ্খসদৃশ বাদ্য) সকল বাদিত এবং তাহা হইতে তুমুল শব্দ প্রাদুর্ভূত হইল।
“এদিকে কৃষ্ণ ও অর্জুন শ্বেতাঙ্গযুক্ত রথে সমারহ হইলেন এবং বাসুদেব পাঞ্চজন্য শঙ্খ, অর্জুন দেবদত্ত শঙ্খ, ভীমকর্মা ভীমসেন পৌণ্ড্র নামে মহাশঙ্খ, রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় শঙ্খ, নকুল সুঘোষ শঙ্খ, সহদেব মণিপুষ্পক শঙ্খ এবং কাশিরাজ শিখণ্ডী, মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদেয়গণ ও অভিমন্যু–ইঁহারা সকলে পৃথক পৃথক শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন। এই তুমুল শব্দ ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া ধার্ত্ত্রাষ্ট্রগণের হৃদয় বিদারিত করিল।
“হে রাজন! অনন্তর ধনঞ্জয় এই সমারদ্ধ যুদ্ধে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের যথাযোগ্যরূপে অবস্থিত দেখিয়া নিজে শরাসন উত্তোলনপূর্বক বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে অচ্যুত! উভয়ে সেনার মধ্যস্থলে রথ স্থাপন কর; দুর্বুদ্ধি দুর্য্যোধনের প্রিয়াচরণবাসনায় যে সকল ব্যক্তি আগমন করিয়াছেন, তাহাদিগের মধ্যে কাহারা যুদ্ধ করিবেন, আমাকে কাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে হইবে এবং কে যুদ্ধাভিলাষী হইয়া অবস্থান করিতেছেন, তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণ করিব’।”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে ভারত! অর্জুনের এই কথা শুনিয়া হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যস্থলে ভীষ্ম, দ্রোণ ও সমস্ত নৃপতিগণের সম্মুখে রথস্থাপন করিয়া কহিলেন, ‘হে পার্থ! ঐ সমস্ত কৌরবগণ সমবেত হইয়াছেন, অবলোকন কর।’
“ধনঞ্জয় উভয় সেনার মধ্যে তাঁহার পিতৃব্য (পিতার সহোদয় বা জ্ঞাতি ভ্রাতা–জ্যাঠা-খুড়া), পিতামহ, আচার্য্য (গুরু–অস্ত্রগুরু), মাতুল, ভ্রাতা, পুত্র, পৌত্র, সখা (সহচর–মিত্র), শ্বশুর ও মিত্রগণ অবস্থান করিতেছেন দেখিলেন। অর্জুন সেই সমস্ত বন্ধুগণকে অবলোকন করিবামাত্র কারুণ্যরসবশংবদ (করুণার বশবর্তী) ও বিষণ্ণ হইয়া বাসুদেবকে কহিলেন, ‘হে মধুসূদন! এই সমস্ত আত্মীয়গণ যুদ্ধার্থী হইয়া আগমন করিয়াছেন দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন, কম্পিত ও রোমাঞ্চিত হইতেছে; মুখ শুষ্ক হইয়া যাইতেছে; গাণ্ডীব হস্ত হইতে স্রস্ত (স্খলিত) হইয়া পতিত হইতেছে; সমুদয় ত্বক দগ্ধ হইতেছে; আমার আর অবস্থান করিবার সামর্থ নাই; চিত্ত যেন উদভ্রান্ত (অত্যন্ত বিচলিত) হইতেছে; আমি কেবল দুর্নিমিত্তই নিরীক্ষণ করিতেছি।
এই সমস্ত আত্নীয়গণকে নিহত করা শ্রেয়স্কর (মঙ্গলজনক) বোধ হইতেছে না। হে কৃষ্ণ! আমি আর জয়, রাজ্য ও সুখের আকাঙ্খা করি না। যাঁহাদিগের নিমিত্ত রাজ্য, ভোগ ও সুখের কামনা করিতে হয়, সেই আচার্য্য, পিতা, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও সম্বন্ধিগণ সকলেই এই যুদ্ধে জীবন ও ধন পরিত্যাগে কৃতসঙ্কল্প হইয়া অবস্থান করিতেছেন; তবে আমাদিগের আর রাজ্য, ধন ও জীবনে প্রয়োজন কি? ইঁহারা আমাদিগকে বধ কইলেও আমি ইঁহাদিগকে বিনাশ করিতে ইচ্ছা করি না; পৃথিবীর কথা দূরে থাকুক,ত্রৈলোক্যরাজ্য লাভ হইলেও আমি ইঁহাদিগকে বিনাশ করিতে ইচ্ছা করি না।
হে জনার্দ্দন! ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগকে নিহত করিলে আমাদিগের কী প্রীতি হইবে? এই আততায়ীদিগকে বিনাশ করিলে আমাদিগকেই পাপভাগী হইতে হইবে; অতএব সবান্ধবে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণকে বধ করা কোনক্রমেই আমাদিগের কর্তব্য নহে। হে মাধব! আত্মীয়গণকে বিনাশ করিয়া আমরা কী প্রকারে সুখী হইব? ইহাদিগের চিত্ত লোভ দ্বারা অভিভূত হইয়াছে বলিয়া ইহারাই যেন কুলক্ষয়জনিত দোষ ও মিত্রদ্রোহজনিত (বান্ধবহিংসাজনিত) পাতক দেখিতেছে না; কিন্তু আমরা কুলক্ষয়ের দোষ দর্শন করিয়াও কি নিমিত্ত এই পাপবুদ্ধি হইতে নিবৃত্ত হইব না?
কুলক্ষয় হইলে সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হয়; কুলধর্ম বিনষ্ট হইলে সমস্ত কুল অধর্মে পরিপূর্ণ হইয়া উঠে; কুল অধর্মপূর্ণ হইলে কুলস্ত্রীগণ ব্যভিচার দোষে দূষিত হয়; কুলস্ত্রীগণ দূষিত হইলে বর্ণশঙ্কর (নীচজাতি) সমুৎপন্ন হয়; এই বর্ণশঙ্কর কুল ও কুলনাশকদিগকে নিরয়গামী (নরকগামী) করে; কুলনাশকদিগের পিতৃগণের পিণ্ড ও উদকক্রিয়া (শ্রাদ্ধতর্পণাদি) বিলুপ্ত হয়; সুতরাং তাঁহারা পতিত হইয়া থাকেন।
কুলনাশক ব্যক্তিদিগের বর্ণসঙ্করের হেতুভূত এই সমস্ত দোষে জাতিধর্ম ও সনাতন কুলধর্ম বিনষ্ট হইলে মনুষ্যগণকে চিরকাল নরকে বাস করিতে হয়। হা! কি কষ্ট! আমরা এই মহাপাপের অনুষ্ঠানে অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়া রাজ্যসুখের লোভে আত্মীয়দিগকে বিনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছি। আমি প্রতীকারপরাঙ্মুখ (প্রতিবিধানে পশ্চাৎপদ) ও শস্ত্রহীন হইলে যদি রাজ্যসুখলোভে স্বজনবিনাশসমুদ্যত শস্ত্রপাণি (শস্ত্রধারী) ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ আমাকে যুদ্ধে বিনাশ করে, তাহাও আমার কল্যাণকর হইবে’।”
সঞ্জয় কহিলেন, “ধনঞ্জয় এইরূপ কহিয়া শর ও শরাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক শোকাকুলিতচিত্তে রথে উপবেশন করিলেন।”
Read also
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা প্রথম অধ্যায় (অর্জুনবিষাদযোগ:)-জগদীশচন্দ্র ঘোষ
দ্বিতীয় অধ্যায়
সাংখ্যযোগ
সঞ্জয় কহিলেন, “ভগবান্, বাসুদেব কৃপাবশংবদ, অশ্রুপূর্ণলোচন, বিষন্নবদন অর্জুনকে কহিলেন, ‘অর্জুন! ঈদৃশ বিষম সময়ে কি নিমিত্ত তোমার এই অনার্য্যসেবিত, স্বর্গপ্রতিরোধক (স্বর্গগমনে বাধাজনক), অকীর্তিকর মোহ উপস্থিত হইল? হে পার্থ! তুমি ক্লীবতা (কাপুরুষতা–দৌর্বল্য) অবলম্বন করিও না; ইহা তোমার উপযুক্ত নয়। হে পরন্তপ! অতিতুচ্ছ হৃদয়দৌর্বল্য দূরীভূত করিয়া উত্থিত হও।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি কী প্রকারে পূজনীয় ভীষ্ম ও দ্রোণের সহিত শরজাল দ্বারা প্রতিযুদ্ধ করিব? মহানুভব গুরুজনদিগকে বধ না করিয়া যদি ইহলোকে ভিক্ষান্ন ভোজন করিতে হয়, তাহাও শ্রেয়ঃ; কিন্তু ইহাদিগকে বধ করিলে ইহকালেই রুধিরলিপ্ত অর্থ ও কাম উপভোগ করিতে হইবে। ফলতঃ এই যুদ্ধে জয় ও পরাজয়ের মধ্যে কোন্টির গৌরব অধিক, তাহাও বুঝিতে পারিতেছি না, কেন না, যাঁহাদিগকে বিনষ্ট করিয়া আমরা স্বয়ং জীবিত থাকিতে অভিলাষ করি না, সেই ধার্ত্তরাষ্ট্রগণই সম্মুখে উপস্থিত।
কাতরতা ও অবশ্যম্ভাবী কূলক্ষয়জনিত দোষে আমার স্বাভাবিক শৌর্য্যাদি অভিভূত ও আমার চিত্ত ধর্মান্ধ (ধর্মানুরোধে বহির্দৃষ্টিরহিত) হইয়াছে। এই নিমিত্ত তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি, যাহা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর হয় বল, আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাপন্ন হইয়াছি, আমাকে উপদেশ প্রদান কর। ভূমণ্ডলে অকণ্টক (বাধাবিহীন) সুসমৃদ্ধ রাজ্য ও সুরগণের আধিপত্য প্রাপ্ত হইলেও আমার ইন্দ্রিয়গণ এই শোকে পরিশুষ্ক হইবে। আমি এমন কিছুই দেখিতেছি না, যাহাতে আমার শোকাপনোদ হইতে পারে’।”
সঞ্জয় কহিলেন, “অতএব আমি যুদ্ধ করিব না’ শত্রুতাপন গুড়াকেশ (ইন্দ্রিয়জয়ী) অর্জুন হৃষীকেশ-সম্মুখে এই বলিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন।
“হে ভারত! তখন হৃষীকেশ সহাস্য উভয় সেনার মধ্যবর্তী বিষণ্ণবদন অর্জুনকে কহিলেন, ‘হে অর্জুন! তোমার মুখ হইতে পণ্ডিতগণের ন্যায় বাক্য সকল বিনির্গত হইতেছে, অথচ তুমি অশোচ্য বন্ধুগণের নিমিত্ত শোক করিয়া মূর্খতা প্রদর্শন করিতেছ।
পণ্ডিতগণ, কি জীবিত, কি মৃত কাহারও নিমিত্ত অনুশোচনা (শোকের অযোগ্য) করে না। আমি পূর্বে যে কখনও ছিলাম না, এমন নহে; এই রাজগণও ছিলেন না, এমন নহে; অতঃপর আমরা সকলে থাকিব না, এমনও নহে। এই দেহ যেমন কৌমার, যৌবন ও জরা প্রাপ্ত হয়, জীবাত্মাও তদ্রূপ দেহান্তর প্রাপ্ত হইয়া থাকেন; ধীরব্যক্তি তদ্বিষয়ে মুগ্ধ হয়েন না। বিষয়ের সহিত ইন্দ্রিয়গণের যে সম্বন্ধ, তাহাই শীত, উষ্ণ ও সুখ-দুঃখের কারণ; সেই সম্বন্ধ কখন উৎপন্ন হয়, কখন বিনষ্ট হয়, অতএব তুমি এই অনিত্য সম্বন্ধ-সকল সহ্য কর। এই সম্বন্ধ-সকল যাঁহাকে ব্যথিত করিতে পারে না, সেই সমদুঃখসুখ (সুখ-সুঃখে তুল্যজ্ঞানী) ধীর পুরুষ মোক্ষলাভের যোগ্য। যাহা কখন ছিল না, যাহা কখন হয় না এবং যাহা বিদ্যমান আছে, তাহারও কখন অভাব হয় না, তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতগণ ভাব ও অভাবের এইরূপ নির্ণয় করিয়াছেন। যিনি এই দেহাদিতে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন, তাঁহার বিনাশ নাই; কোন ব্যক্তি সেই অব্যয় পুরুষকে বিনাশ করিতে সমর্থ হয় না। হে ভারত! তত্ত্বদর্শীপণ্ডিতগণ কহিয়াছেন, এই সকল শরীর অনিত্য; কিন্তু শরীরী জীবাত্মা নিত্য, অবিনাশী (বিনাশহীন) ও অপ্রেমেয়; অতএব তুমি যুদ্ধ কর। যিনি মনে করেন, এই জীবাত্মা অন্যকে বিনাশ করে এবং যিনি মনে করেন, অন্যে এই জীবাত্মাকে বিনাশ করে, তাঁহারা উভয়েই অনভিজ্ঞ; কেন না, জীবাত্মা কাহাকেও বিনাশ করেন না এবং জীবাত্মাকেও কেহ বিনাশ করিতে পারে না। ইঁহার জন্ম নাই, মৃত্যু নাই; ইনি পুনঃ পুনঃ উৎপন্ন ও বর্দ্ধিত হয়েন না; ইনি অজ (জন্মরহিত), নিত্য, শাশ্বত (অক্ষয়) ও পুরাণ; শরীর বিনষ্ট হইলে ইনি বিনষ্ট হয়েন না। যে পুরুষ ইঁহাকে অবিনাশী, নিত্য , অজ ও অব্যয় বলিয়া জানেন, তিনি কি কাহাকে বধ করেন, না বধ করিতে আদেশ করেন? যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ দেহী (আত্মা) জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করিয়া অভিনব (নূতন) দেহান্তর পরিগ্রহ করেন। ইহা শস্ত্রে ছেদিত (ছিন্ন), অগ্নিতে দগ্ধ, জলে ক্লেদিত (ক্লিণ্ণ–ক্লেদযুদ্ধ) বা বায়ুতে শোষিত (শুষ্ক) হন না। ইনি নিত্য, সর্বগত, স্থিরভাব, অচল ও অনাদি; অতএব অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোষ্য। ইনি চক্ষুরাদির অগোচর, মনের অবিষয় (অনুভব) ও কর্মেন্দ্রিয়ের অগ্রাহ্য। অতএব তুমি এই জীবাত্মাকে এবম্প্রকার (এইরূপ) অবগত হইয়া অনুশোচনা পরিত্যাগ কর।
“হে মহাবাহো! যদি জীবাত্মা সর্বদা জন্মগ্রহণ ও মৃত্যুমুখে প্রবেশ করিয়া থাকেন বলিয়া তাঁহাকে জাত ও মৃত বোধ কর, তাহা হইলে ত ইহার নিমিত্ত শোক করা কর্তব্যই নহে; কেন না, জাত ব্যক্তির মৃত্যু ও মৃত ব্যক্তির জন্ম অবশ্যম্ভাবী ও অপরিহার্য্য; অতএব ঈদৃশ বিষয়ে শোকাকুল হওয়া তোমার উচিত নয়। ভূতসকল উৎপত্তির পূর্বে অব্যক্ত (অপ্রকাশ) ছিল; ধ্বংসসময়েও অব্যক্ত হইয়া থাকে; কেবল জন্মমরণের অন্তরালসময়ে (মধ্যাবস্থায়–মধ্য সময়ে) প্রকাশিত হয়; অতএব তদ্বিষয়ে পরিবেদনা (শোক) কী? কেহ এই জীবাত্মাকে বিস্ময়ের সহিত বর্ণন করেন, কেহ বিস্ময়ের সহিত শ্রবণ করেন, কেহ শ্রবণ করিয়াও বুঝিতে পারে না। হে ভারত! জীবাত্মা সর্বদা সকলের দেহে অবধ্যরূপে অবস্থান করেন, অতএব কোন প্রাণীর নিমিত্ত শোক করা উচিত নয়।
“তুমি স্বধর্মের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে আর এ প্রকার বিকম্পিত (বিচলিত) হইবে না; ধর্মযুদ্ধ ব্যতীত ক্ষত্রিয়ের আর শ্রেয়স্কর কর্ম নাই। হে পার্থ! যে সকল ক্ষত্রিয় যদৃচ্ছাক্রমে (স্বেচ্ছায়) উপস্থিত অনাবৃত(মুক্ত) স্বর্গদ্বারস্বরূপ ঈদৃশ যুদ্ধ লাভ করে, তাহারাই সুখী। যদি তুমি এই ধর্মযুদ্ধ (ধর্মসঙ্গত যুদ্ধ) না কর, তাহা হইলে স্বধর্ম ও কীর্তি হইতে পরিভ্রষ্ট ও পাপভাগী হইবে; লোকে চিরকাল তোমার অকীর্তি কীর্তন করিবে; সম্ভাবিত (প্রথিতযশা–সম্মানিত) ব্যক্তির অকীর্তি মরণ অপেক্ষাও অধিকতর দুঃসহ। যে সকল মহারথ তোমাকে বহুমান (যথেষ্ট সম্মান) করিয়া থাকেন, তাঁহাদিগের নিকট তোমার গৌরব থাকিবে না; তাঁহারা মনে করিবেন, তুমি ভয়প্রযুক্ত সংগ্রাম-পরাঙ্মুখ হইয়াছ। তাঁহারা তোমার কত অবক্তব্য কথা কহিবেন এবং তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিবেন; ইহা অপেক্ষা অধিকরত দুঃখ আর কী আছে? সমরে বিনষ্ট হইলে স্বর্গ প্রাপ্ত হইবে; জয়লাভ করিলে পৃথিবী ভোগ করিবে; অতএব যুদ্ধের নিমিত্ত কৃতনিশ্চয় (কর্তব্য-বিষয়ে) হইয়া উত্থান (উদ্যম) কর; সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ ও জয়-পরাজয় তুল্য জ্ঞান করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও; তাহা হইলে পাপভাগী হইবে না।
কর্মযোগ প্রশংসা
“হে পার্থ! যে জ্ঞান দ্বারা আত্মতত্ত্ব সম্যক্ প্রকাশিত হয়, তাহা তোমার নিকট কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে কর্মযোগবিষয়িণী (কর্মযোগসম্পর্কিত) বুদ্ধি অবগত হও; এই বুদ্ধি প্রাপ্ত হইলে তুমি কর্মরূপ বন্ধন হইতে বিমুক্ত হইবে। কর্মযোগের অনুষ্ঠান বিফল হয় না। তাহাতে প্রত্যাবায়ও (পাপ) নাই, ধর্মের অত্যল্প অংশও মহদ্ভয় হইতে পরিত্রাণ করে।
হে কুরুনন্দন! কর্মযোগবিষয়ে সংশয়রহিত বুদ্ধি একমাত্র (একাগ্র–একরূপ) হইয়া থাকে; কিন্তু প্রমাণজনিত (বেদোক্ত কর্মকাণ্ডত্মক বিধিনিষেধের অধীন) বিবেকরহিত ব্যক্তিদিগের বুদ্ধি অনন্ত ও বহুশাখাবিশিষ্ট। যাহারা আপাত-মনোহর (বর্তমান রম্য–উপস্থিত উপাদেয়) শ্রবণরমণীয় বাক্যে অনুরক্ত, বহুবিধ ফলপ্রকাশক বেদবাক্যই যাহাদিগের প্রীতিকর, যাহারা স্বর্গাদি ফলসাধন কর্ম ভিন্ন অন্য কিছুই স্বীকার করে না, যাহারা কামপরায়ণ, স্বর্গই যাহাদিগের পরমপুরুষার্থ, জন্ম, কর্ম ও ফলপ্রদ, ভোগ ও ঐশ্বর্য্যলাভের সাধনভূত নানাবিধ ক্রিয়াপ্রকাশক বাক্যে যাহাদিগের চিত্ত অপহৃত হইয়াছে এবং যাহারা ভোগ ও ঐশ্বর্য্যে একান্ত সংসক্ত (অত্যন্ত আসক্ত), সেই বিবেকবিহীন মূঢ় ব্যক্তিদিগের বুদ্ধি সমাধি বিষয়ে সংশয়শূন্য হয় না। হে অর্জুন! বেদসকল সকাম ব্যক্তিদিগের কর্মফল-প্রতিপাদক; অতএব তুমি শীতোষ্ণ ও সুখদুঃখাদি-দ্বন্দ্বসহিষ্ণু (রাগ-বিরাগ সহনশীল) ধৈর্য্যশালী, যোগক্ষেমরহিত ও অপ্রমাদী নইয়া নিষ্কাম হও।
যেমন কূপ, বাপী, তড়াগ প্রভৃতি জলাশয়ে যেমন প্রয়োজন সিদ্ধ হয়, একমাত্র মহাহ্রদে সেই সকল প্রয়োজন সম্পন্ন হইয়া থাকে, সেইরূপ সমুদয় বেদে সে সকল কর্মফল বর্ণিত আছে, সংশয়রহিত বুদ্ধিবিশিষ্ট ব্রহ্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ একমাত্র ব্রহ্মে তৎসমুদয়ই প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। কর্মেই তোমার অধিকার হউক, কর্মফলে যেন কামনা না হয়; কর্মফল যেন তোমার প্রবৃত্তির হেতু না হয় এবং কর্মপরিত্যাগে তোমার আসক্তি না হউক। হে ধনঞ্জয়! তুমি আসক্তি পরিত্যাগ পূর্ব্বক একান্ত ঈশ্বরপরায়ণ (ঈশ্বরনিষ্ঠ) হইয়া সিদ্ধি ও অসিদ্ধি উভয়ই তুল্য জ্ঞান করিয়া কর্মসকল অনুষ্ঠান কর, পণ্ডিতেরা সিদ্ধি ও অসিদ্ধি উভয়ের তুল্যজ্ঞানই যোগ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন। সংশয়রহিত বুদ্ধি দ্বারা অনুষ্ঠিত কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ; কাম্যকর্মসমুদয় সাতিশয় অপকৃষ্ট (হীন), অতএব তুমি কর্মযোগের অনুষ্ঠান কর; সকাম ব্যক্তিরা অতি দীন। যাঁহার কর্মযোগ বিষয়িণী বুদ্ধি উপস্থিত হয়, তিনি ইহজন্মেই পরমেশ্বরপ্রসাদে সুকৃত ও দুষ্কৃত উভয় পরিত্যাগ করেন। অতএব তুমি কর্মযোগের নিমিত্ত যত্ন কর।
ঈশ্বরের আরাধনা দ্বারা বন্ধনহেতু কর্মসকলের মোক্ষসাধনতাসম্পাদক (মুক্তি-সাধনশক্তি সংসাধক) চাতুর্য্যই (নিপূনতাই) যোগ। কর্মযোগবিশিষ্ট মনীষিগণ (বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ) কর্মজনিত ফল পরিত্যাগ করেন; সুতরাং জন্মবন্ধন হইতে বিনির্ম্মুক্ত হইয়া অনাময়পদ (দুঃখাদিরহিতপদ) প্রাপ্ত হয়েন। যখন তোমার বুদ্ধি অতি গহণ (দুস্ত্যজ্য) মোহ হইতে উত্তীর্ণ হইবে, তখন তুমি শ্রোতব্য (শ্রবণযোগ্য) ও শ্রুত বিষয়ে বৈরাগ্য লাভ করিবে; তৎসম্বন্ধে তোমার আর কিছুই জিজ্ঞাস্য থাকিবে না। তোমার বুদ্ধি নানাবিধ বৈদিক ও লৌকিক বিষয়শ্রবণে উদ্ভ্রান্ত হইয়া আছে; যখন উহা বিষয়ান্তরে আকৃষ্ট না হইয়া স্থিরভাবে পরমেশ্বরে অবস্থান করিবে, তখনই তুমি তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিবে।’
“অর্জুন কহিলেন, ‘হে কেশব! সমাধিস্থ (পরমেশ্বরে নিবিষ্টচিত্ত) স্থিতপ্রজ্ঞ (স্থিরবুদ্ধি) ব্যক্তির লক্ষণ কী? তাঁহার বাক্য, অবস্থান ও গতি কী প্রকার?’
“কৃষ্ণ কহিলেন, ‘হে পার্থ! যিনি সর্বপ্রকার মনোগত কামনা পরিত্যাগ করেন, যাঁহার আত্মা আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। যিনি দুঃখে অক্ষুব্ধচিত্ত, সুখে স্পৃহাশূন্য এবং অনুরাগ, ভয় ও ক্রোধ-বিবর্জিত, সেই মুনি স্থিতপ্রজ্ঞ। যিনি পুত্র, মিত্র প্রভৃতি সকলের প্রতি স্নেহশূন্য, যিনি অনুকূল বিষয়ে অভিনন্দন (অনুরাগ) ও প্রতিকূল বিষয়ে দ্বেষ করে না, তাঁহারই প্রজ্ঞা নিশ্চলা ও তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। কূর্ম (কচ্ছপ) যেমন আপন অঙ্গসকল সঙ্কোচন করে (ভিতরের দিকে গুটাইয়া লয়), সেইরূপ যিনি বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়গণকে প্রত্যাহরণ (প্রত্যানয়ন) করেন, তাঁহারই প্রজ্ঞা নিশ্চলা ও তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।
যিনি ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয় গ্রহণ না করেন, বিষয়সকল তাঁহার নিকট হইতে নিবৃত্ত হইতে পারে; বিষয়াভিলাষ নিবৃত্ত হয় না; কিন্তু স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি পরমেশ্বরকে দর্শন করিয়া বিষয়বাসনা হইতে বিনির্মুক্ত হইয়া থাকেন। হে কৌন্তেয়! ক্ষোভজনক ইন্দ্রিয়গণ যত্নশীল বিবেকী পুরুষের চিত্তকেও বলপূর্বক হরণ করে; এই নিমিত্ত যোগশীল ব্যক্তি তাহাদিগকে সংযমপূর্বক মৎপরায়ণ (ভগবানে একান্ত নিষ্ঠ) হইয়া থাকিবেন। এইরূপে ইন্দ্রিয়গণ যাঁহার বশীভূত থাকে, তাঁহারই প্রগা নিশ্চলা ও তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। প্রথমে বিষয়চিন্তা, চিন্তা হইতে আসক্তি, আসক্তি হইতে অভিলাষ, অভিলাষ হইতে ক্রোধ, ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ উপস্থিত হয়। যিনি আত্মাকে বশীভূত করিয়াছেন, তিনি রাগদ্বেষবর্জ্জিত আত্মপ্রসাদ লাভ করেন, আত্মপ্রসাদ থাকিলে সকল দুঃখ বিনষ্ট হয়। প্রসন্নাত্নার বুদ্ধিই আশু নিশ্চল হইয়া উঠে।
অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তির বুদ্ধি নাই; সুতরাং সে চিন্তা করিতেও পারে না; চিন্তা করিতে না পারিলে শান্তি হয় না; শান্তিহীন ব্যক্তির সুখ কোথায়? যে চিত্ত স্বেচ্ছাচারী ইন্দ্রিয়গণের বশীভূত হয়, সেই চিত্ত বায়ু কর্তৃক সমুদ্রে ইতস্ততঃ-বিঘূর্ণিত নৌকার ন্যায় জীবাত্মার বুদ্ধিকে বিষয়ে বিক্ষিপ্ত করে। অতএব হে মহাবাহো! যাঁহার ইন্দ্রিয়গণ বিষয় হইতে নিগৃহীত (সংযমবলে বিমুখ) হইয়াছে, সেই ব্যক্তিরই প্রজ্ঞা নিশ্চলা ও তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। অজ্ঞান-তিমিরাবৃতমতি ব্যক্তিদিগের নিশাস্বরূপ ব্রহ্মনিষ্ঠাতে জিতেন্দ্রিয় যোগিগণ জাগরিত থাকেন এবং প্রাণিগণ যে বিষয়নিষ্ঠাস্বরূপ দিবায় প্রবোধিত থাকে, আত্মতত্ত্বদর্শী যোগীদিগের সেই রাত্রি। (রাত্রিতে নিদ্রা ও দিনে জাগরণ, ইহা লোকের স্বাভাবিক। অজ্ঞানরূপ অন্ধকারে যাহাদের বুদ্ধি আবৃত, ব্রহ্মনিষ্ঠা তাহাদের পক্ষে রাত্রি, তাহাতে তাহারা নিদ্রিত, সুতরাং দেখিতে পায় না। যোগিগণের তথাবিধ রাত্রি দিবাস্বরূপ হয়, তাহাতে তাঁহারা জাগরিত; সুতরাং দর্শনে সমর্থ। প্রাণিগণ বিষয় নিষ্ঠারূপ দিবাতে জাগরিত–বিষয়ভোগে ব্যাপৃত থাকে; আর আত্মদর্শীরা তাহাতে নিদ্রিত, ভোগবিরত থাকেন।) যেমন নদী-সকল সর্বদা পরিপূর্ণ স্থিরপ্রতিষ্ঠ (চাঞ্চল্য রহিত) সমুদ্রে প্রবেশ করে, ভোগ সকল সেইরূপে যাহাকে আশ্রয় করিয়া লীন হইয়া যায়, তিনিই মোক্ষ লাভ করেন; ভোগার্থী ব্যক্তি তাহা প্রাপ্ত হইতে পারে না।
যিনি কামনা-সকল পরিত্যাগপূর্বক নিস্পৃহ, নিরহঙ্কার ও মমতাবিহীন হইয়া ভোগ্য বস্তুসমুদয় উপভোগ করেন, তিনি মুক্তিলাভ করিয়া থাকেন। হে পার্থ! ব্রহ্মজ্ঞাননিষ্ঠা এই প্রকার; ইহা প্রাপ্ত হইলে সংসারে আর মুগ্ধ হইতে হয় না। যিনি চরমসময়েও এই ব্রহ্মজ্ঞাননিষ্ঠায় অবস্থান করেন, তিনিও পরব্রহ্মে লয় প্রাপ্ত হয়েন।’”
Tagged: GitaBangla
© Advocatetanmoy Law Library
© Advocatetanmoy Law Library