উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ – বামনদেব চক্রবর্তী
ভাষা
আমাদের মনে সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনা ক্রোধ-হর্য প্রভৃতি যে-সমস্ত ভাব জাগে, আমরা বিভিন্ন উপায়ে সেগুলি অন্যের কাছে প্রকাশ করিয়া থাকি। কান্নার মধ্য দিয়া অবোধ শিশু নিজের অভাব মাকে জানাইতে চায়; ইঙ্গিত-ইশারাই বাকশক্তিহীন বোবার ভাব-প্রকাশের একমাত্র উপায়; মনোলোকের ধ্যানলব্ধ অপরূপকে তুলির রেখায় রূপায়িত করিবার জন্যই শিল্পীর অতন্দ্র সাধনা। মানুষ আমরা, কথাবার্তার মধ্য দিয়াই মনোভাব প্রকাশের কাজটি সারিয়া লই। এই কথাবার্তার নাম ভাষা। ভাষার ব্যাকরণ-সম্মত একটি সংজ্ঞার্থ এইভাবে নির্দেশ করা যায়।–
১। ভাষা : মনোভাব-প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা সম্পাদিত, কোনও বিশিষ্ট জনসমাজে প্রচলিত, প্রয়োজনমতো বাক্যে প্রযুক্ত হইবার উপযোগী শব্দসমষ্টিকে ভাযা বলে।
এইভাবেই ক্রমবিবর্তনের পথে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জনসমাজে নানান ভাষার সৃষ্টি হইয়াছে। ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা ইংরেজী ভাষায়, জামান জাতি জার্মান ভাষায়, রুমানিয়ার অধিবাসিগণ রুমানিয়ান ভাষায়, বিহারীরা হিন্দী ভাষায়, অসমীয়ারা অসমীয়া ভাষায় কথাবার্তা বলেন। আমরা বাঙালী। শৈশবে সুমধুর ‘মা’ বুলির মধ্য দিয়া যে ভাষার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আরম্ভ হইয়াছে, সেই বাংলা ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। ব্যাকরণের রীতিসম্মত পথে বাংলা ভাষার সংজ্ঞার্থটি এইভাবে নির্দেশ করা চলে।
২। বাংলা ভাষা : মনের বিচিত্র ভাব-প্রকাশের জন্য বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা সম্পাদিত, বাঙলী-সমাজে প্রচলিত, প্রয়োজনমতো বাংলা বাক্যে প্রযুক্ত হইবার উপযোগী শব্দসমষ্টির নাম বাংলা ভাষা।
শুধু ভারতরাষ্ট্রের অন্তর্গত পশ্চিমবঙ্গেই নয়, পূর্ববঙ্গ (আধুনিক বাংলাদেশ), আসামের কতকাংশ, ত্রিপুরা, বিহারের সাঁওতাল পরগনা, মানভূম, সিংভূম, পূর্ব পুর্ণিয়া প্রভৃতি স্থানের প্রায় পনেরো কোটি লোকের মাতৃভাষা এই বাংলা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির মধ্যে উৎকর্ষের বিচারে বাংলা ষষ্ঠ স্থানাধিকারিণী।
প্রায় এক হাজার বৎসর পূর্বে মাগধী অপভ্রংশ হইতে যে বাংলা ভাষার অঙ্কুরোদ্গম হয়, তাহাই ক্রমবিবর্তনের মধ্য দিয়া বর্তমানে ফলপুষ্পে সুশোভিত এক স্নিগ্ধচ্ছায় মহীরুহে পরিণত হইয়াছে।
অবশ্য বাংলা ভাষার ঊষালগ্ন হইতে কবিতাই ছিল ভাবপ্রকাশের একমাত্র
বাহন। বাংলা গদ্যের সৃষ্টি হইয়াছে একেবারে আধুনিক যুগে–উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমের দিকে। সেই হিসাবে বাংলা গদ্যের বয়স মাত্র দুই শত বৎসর। অথচ এই অল্পদিনেই রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ শিল্পিগণের দৌলতে বাংলা কী অপূর্ব শৌর্য আর সৌকুমার্যই না পাইয়াছে! এই সম্পশালিনী বাংলা ভাষার গতি-প্রকৃতি জানিতে হইলে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ভালোভাবে আয়ত্ত করা আবশ্যক। বাংলা ব্যাকরণ কাহাকে বলে?
৩। বাংলা ব্যাকরণ : যে শাস্ত্রপাঠে বাংলা ভাষার স্বরূপটি বিশ্লেষণ করিয়া বুঝিতে পারা যায় এবং লিখন-পঠনে ও আলোচন-আলাপনে সেই বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে প্রয়োগ করিতে পারা যায়, সেই শাস্ত্রকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।
ভাষা ও উপভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক
১) ভাষা একটি বৃহৎ অঞ্চলে প্রচলিত; উপভাষা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অঞ্চলে প্রচলিত।
২) ভাষার একটি সর্বজনীন আদর্শ রূপ থাকে; উপভাষা সেই আদর্শ ভাষার (Standard Language) আঞ্চলিক রূপ।
৩) ভাষায় কালজয়ী সাহিত্যকীর্তি রচিত হয়; উপভাষায় সাধারণত লোকগীতি বা লোকসাহিত্যই রচিত হয়, উচ্চাঙ্গের সাহিত্য বিশেষ রচিত হয় না।
৪) ভাষার নির্দিষ্ট ব্যাকরণ থাকে, বৈয়াকরণরা সেই ব্যাকরণ গ্রন্থাকারে রচনা করেন; উপভাষায় সাধারণত কোনো ব্যাকরণ লিখিত হয় না।
৫) একটি আদর্শ ভাষার এলাকার মধ্যে লেখ্য রূপটি এক হইলেও একাধিক উপভাষা প্রচলিত থাকে; তাই জনগণের মুখের ভাষা অঞ্চলভেদে বিভিন্ন হয়।
৬) ধ্বনি, রূপ এবং বাগধারার ব্যবহারে ভাষার সহিত উপভাষার বিশেষ ধরনের পার্থক্য দেখা যায়।
৭) একই ভাষা হইতে বিভিন্ন কারণে একাধিক উপভাষার সৃষ্টি হয়; উপভাষায় মননশীল সাহিত্য-ব্যাকরণ-চর্চার কারণে উপভাষা স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পায়।
একই ভাষাভাষী এলাকার অন্তর্গত একাধিক অঞ্চলের ভাষায় আঞ্চলিক রূপগুলির মধ্যে যতদিন পর্যন্ত পারস্পরিক বোধগম্যতা (mutual intelligibility), থাকে, অর্থাৎ এক উপভাষার শ্রোতা যখন অন্য উপভাষার বক্তার কথা বুঝিতে পারেন, ততদিন পর্যন্ত সেই আঞ্চলিক রূপগুলিকে উপভাষা বলা হয়। কিন্তু আঞ্চলিক রূপগুলি পৃথক্ হইতে হইতে পারস্পরিক বোধগম্যতার সীমা অতিক্রম করিয়া গেলে তাহাদের আলাদা ভাষার উপভাষা বলা হয়। কিন্তু এই সাধারণ মানদণ্ডটির ব্যতিক্রমও দেখা যায়। যেমন, নোয়াখালি বা চট্টগ্রামের বাঙালী নিজস্ব বাচনভঙ্গিমায় দ্রুত কথা বলিলে কলকাতা-হাওড়ার বাঙালী তাহার প্রায় কিছুই বুঝিতে পারিবেন না–যদিও বঙ্গালী ও রাঢ়ী একই বাংলা ভাষার দুইটি উপভাষা। অথচ উড়িষ্যা রাজ্যের ও পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের লোকেরা পরস্পরের মুখের ভাষা ভালোই বুঝিতে পারেন, যদিও বাংলা ও ওড়িয়া ভিন্ন ভাষা। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরা বেতারে পঠিত অসমিয়া ভাষার সংবাদ শুনিয়া বা দূরদর্শনে প্রদর্শিত সংবাদ, নাটক ইত্যাদি দেখিয়া মোটামুটি বুঝিতে পারেন, কিন্তু বাংলা ও অসমিয়া আলাদা ভাষা।
তাহা হইলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে–দুই প্রান্তবর্তী উপভাষা পরস্পর সুবোধ্য না হইলে কিংবা সুবোধ্য হইলে কীভাবে বুঝা যাইবে তাহারা একই ভাষার অন্তর্গত কিনা। এক্ষেত্রে বক্তাকে প্রশ্ন করিয়া জানিতে হইবে–তিনি কোন্ ভাষায় কথা বলিতেছেন। দীঘার মানুষটি বলিবেন যে তিনি বাংলা ভাষায় কথা বলিতেছেন, কিন্তু চন্দনেশ্বরের ব্যক্তিটি জানাইবেন যে তিনি ওড়িয়া ভাষায় কথা বলিতেছেন। এক্ষেত্রে পাশাপাশি দুটি অঞ্চলের মানুষ একে অন্যের কথা ভালোভাবে বুঝিতে পারিলেও তাহাদের কথ্য উপভাষা দুটি ভিন্ন ভাষার অন্তর্গত। অপরপক্ষে, মৈমনসিংহের ও বর্ধমানের দুজন বক্তাই জানাইবেন যে, তাহারা বাংলা ভাষায় কথা বলিতেছেন, যদিও উভয়ের পারস্পরিক বোধগম্যতা প্রায় নাই বলিলেই চলে। সুতরাং, বক্তার নিজস্ব ভাষা-ধারণাটিই ভাষা-উপভাষা সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
একই ভাষার অন্তর্গত দুটি ভিন্ন উপভাষার মানুষ সভা-সমিতিতে, কোনো গণমাধ্যমে কিংবা কোনো অনুষ্ঠানে সর্বজনবোধ্য একটি সাধারণ ভাষাছাঁদ ব্যবহার করেন। যশোহরের বাসিন্দা ঘরোয়া কথাবার্তায় বঙ্গালী উপভাষা ব্যবহার করেন, পুরুলিয়ার অধিবাসী ঝাড়খণ্ডী উপভাষা ব্যবহার করেন, কিন্তু শিষ্ট সমাজে বাগবিনিময়ে কিংবা লেখায় তাহারা উভয়েই মান্য বাংলা উপভাষাটিই ব্যবহার করিয়া থাকেন।
আমাদের বাংলা ভাষায় বেতার-দূরদর্শনের নানা অনুষ্ঠানে, সংবাদপত্রের সংবাদ-পরিবেশনে, বক্তৃতা-ভাষণে ভাগীরথী নদীর উভয় তীরবর্তী কলকাতা হাওড়া ও সন্নিহিত অঞ্চলের মানুষের মার্জিত মৌখিক ভাষা ব্যবহৃত হয়। এই কথ্যভাষাটি পূর্ব ও দক্ষিণ রাঢ়ী উপভাষার অংশ। রাজনীতিক, আর্থনীতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক দিক্ হইতে গুরুত্বপূর্ণ কলকাতা ও তৎসন্নিহিত এলাকা; দেশের নানা স্থানের জনগণকে, এমনকি বিদেশীদেরও বিভিন্ন কাজের প্রয়োজনে এই জায়গায় আসিতে হয়; স্বাভাবিকভাবেই এই প্রভাবশালী অঞ্চলের কথ্য উপভাষাটিই সমগ্ৰ উপভাষা-অঞ্চলের মান্য উপভাষা হইয়া গিয়াছে।
পৃথিবীর প্রাচীন ও আধুনিক অন্যান্য সব ভাষার মতো বাংলা ভাষারও উপভাষা রহিয়াছে (যাহাদের সংখ্যা পাঁচ)। এইবার সেগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় গ্রহণ করিব।
Contents
সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা
পৃথিবীর সকল উন্নত ভাষার মতোই বাংলা গদ্যেরও দুইটি রূপ–সাহিত্যিক রূপ ও মৌখিক রূপ। বাংলা ভাষার যে রূপটির আশ্রয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম হইতেই বাংলা গদ্য-গ্রন্থাদি রচিত হইয়া আসিতেছে, সেই সাহিত্যিক রূপটির নাম সাধু ভাষা। আর বাংলা ভাষার যে রূপটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া জনসাধারণের মুখে মুখে ফিরিয়া দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত আটপৌরে প্রয়োজন মিটাইয়া থাকে, সেই মৌখিক পটির নাম চলিত ভাষা। এই ভাষা আমাদের একেবারে মুখের ভাষা–মায়ের মুখ হইতে শেখা ভাষা। এই ভাষাতেই আমরা আমাদের বুকের সমস্তরকম কথা–কী হাসিকান্নার, কী আনন্দ-বেদনার, কী ভয়ভাবনার–সহজেই প্রকাশ করিয়া থাকি। কিন্তু চলিত ভাষা ও কথ্য ভাষা কদাপি এক নয়–কথাটি মনে রাখিও।
বর্ণের শ্রেণীবিভাগ (বর্ণ ও ধ্বনি-প্রকরণ)
ণত্ব-বিধান ও ষত্ব-বিধান
সন্ধি
পাশাপাশি দুইটি পদ থাকিলে দ্রুত উচ্চারণ করিবার ফলে প্রথমপদটির শেষবর্ণ ও পরপদটির প্রথমবর্ণ পরস্পরের সন্নিহিত থাকায় উভয়ের মধ্যে মিলন ঘটে। ইহার ফলে কখনও বর্ণ দুইটির যেকোনো একটির, কখনও-বা দুইটি বর্ণেরই কিছু কিছু পরিবর্তন হয়। পরস্পর সন্নিহিত দুইটি বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে। বাংলা ভাষায় বহু তৎসম (খাঁটী সংস্কৃত) শব্দ প্রবেশলাভ করিয়াছে। লিখন-পঠনে এইসমস্ত শব্দের শুদ্ধতা রক্ষা করিবার জন্য সংস্কৃত সন্ধি-সম্বন্ধে সম্যক্ ধারণা থাকা একান্ত আবশ্যক। সুতরাং প্রথমেই আমরা সংস্কৃত সন্ধির আলোচনা করিব। সন্ধির ব্যাপারে প্রত্যেকটি শব্দের অন্তর্গত বর্ণগুলির ক্রমাবস্থান, ণত্ব-বিধি ও ষত্ব-বিধি সম্পর্কে তোমাদের সচেতন থাকিতে হইবে। সংস্কৃত সন্ধি তিন প্রকার–স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি ।
পদের প্রকারভেদ (পদ-প্রকরণ)
ব্ আ ণ্ ঈ–এই চারিটি বর্ণ পরপর যোগ করিলে বাণী কথাটি পাওয়া যায়। বাণী’ বলিলে কাহারও নাম বুঝিয়া থাকি। সুতরাং বাণী’ কথাটির অর্থ আছে। উপরের বর্ণগুলিকে একটু ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া যোগ করিলে বীণা কথাটি পাওয়া। যায়। এই বীণা’ কথাটির অর্থ আছে; এই কথাটির দ্বারা কাহারও বা কোনোকিছুর নাম বুঝায়। একাধিক বর্ণের সুষ্ঠু সংযোগে এই যে বাণী ও বীণা কথা দুইটি পাইলাম, ইহাদিগকে ব্যাকরণে শব্দ বলা হয়। শব্দ ও একাধিক বর্ণ সুষ্ঠুভাবে যোগ করিয়া অর্থপূর্ণ ও শ্রুতিমধুর যে কথাটি পাওয়া যায়, তাহার নাম শব্দ।
বিশেষ্যের শ্রেণীবিভাগ
সর্বনামের শ্রেণীবিভাগ
লিঙ্গ
বচন
যাহার দ্বারা ব্যক্তি, বস্তু, গুণ ইত্যাদির সংখ্যা বুঝায় তাহাকে বচন বলে। ইংরেজীর মতো বাংলায় বচন দুটি—একবচন ও বহুবচন। সংস্কৃতের দ্বিবচন বাংলায় নাই। একটি বস্তু বা একজনকে বুঝাইলে একবচন হয়। মেয়েটি কাঁদিতেছে। বইখানা খাসা লিখেছ। চোরটাকে আচ্ছা ধোলাই দিল। একটির বেশী বস্তু বা ব্যক্তিকে বুঝাইলে বহুবচন হয়। মেয়েদের ডাকো। বইগুলো তুলতে পার না? “আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।” বাংলায় বচনভেদে বিশেষ্য ও সর্বনামের রূপভেদ হয়, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের সাধারণতঃ হয় না। অব্যয়ের রূপভেদের তো প্রশ্নই উঠে না। তবে বিশেষণপদ যখন বিশেষ্যপদের মতো ব্যবহৃত হয় তখন উহার বচন হয়।
পুরুষ
কারক ও তাহার বিভক্তি : অনুসর্গ
বিশেষণের শ্রেণীবিভাগ
ক্রিয়াপদ
ক্রিয়ার গঠন, প্রকৃতি ও রূপ-সম্বন্ধে এইটুকু বুঝিয়াছ যে (১) ধাতুর উত্তর ধাতুবিভক্তিযোগে ক্রিয়াপদ গঠিত হয়; (২) ক্রিয়াপদ বাক্যের প্রধানতম উপাদান, ক্রিয়া ব্যতীত ক্ষুদ্রতম বাক্যও রচনা করা সম্ভব নয়; এবং (৩) পুরুষভেদে ক্রিয়ার রূপভেদ হয়। ক্রিয়ার মূল-অর্থপ্রকাশক অবিভাজ্য মৌলিক অংশই ধাতু। কাল ও পুরুষভেদে যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতুর উত্তর যুক্ত হইয়া ক্রিয়াপদ গঠন করে, সেই বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিকে ধাতুবিভক্তি বা ক্রিয়াবিভক্তি বলে।মূল ধাতুর উত্তর কিংবা ধাত্ববয়ব প্রত্যয়যোগে গঠিত ধাতুর উত্তর ধাতুবিভক্তি যোগ করিয়া যাওয়া, আসা, করা, থাকা, খাওয়া প্রভৃতি যে কার্যবাচক পদের সৃষ্টি হয়, তাহার নাম ক্রিয়াপদ।
অব্যয়ের শ্রেণীবিভাগ
যখন বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া বাক্যের বাহিরে থাকে তখন ইহারা শব্দ বা ধাতু। বাক্যে প্রযুক্ত হইলে ইহারা পদ-রূপে গণ্য হয়। শব্দ বা ধাতু-অবস্থায় ইহাদের যে রূপ দেখা যায়, পদ-অবস্থায় সে রূপের পরিবর্তন হয়। লিঙ্গ বচন পুরুষ বিভক্তি ইত্যাদি এক বা একাধিক ভেদে রূপান্তর ঘটে বলিয়া ইহারা সব্যয়পদ। কিন্তু অব্যয়পদ বাক্যের বাহিরে শব্দ-হিসাবে যে রূপে থাকে, বাক্যের মধ্যে পদ হিসাবেও ঠিক সেই রূপেই থাকে। লিঙ্গ-বচন-পুরুষ-বিভক্তি-ভেদে অব্যয়ের সাধারণতঃ কোনো রূপান্তর ঘটে না। ব্যয় বা রূপান্তর নাই বলিয়াই ইহারা অব্যয়। বহু সংস্কৃত অব্যয় বাংলা ভাষায় চলিতেছে—অদ্য, অকস্মাৎ, অথবা, অর্থাৎ, অন্যথা, অবশ্য, অতএব, অতঃপর, অচিরাৎ, অতীব, অত্র, অধুনা, অন্যত্র, অপি, অপিচ, অয়ি (কবিতায়—মাধুর্যপূর্ণ সম্বোধনে), অরে, অহো, আঃ, আদৌ, আশু, ইতস্ততঃ, ইতি, ইদানীং, ঈষৎ, উচ্চৈঃ, উপরি, একত্র, একদা, কথঞ্চিৎ, কদাচ, কদাচিৎ, কদাপি, কল্য, কিংবা, কিঞ্চিৎ, কিন্তু, কুত্র, কেবল, ক্বচিৎ, ঝটিতি, তন্ত্র, তথা, তথাপি, তথৈব, তদানীং, ধিক্, নতুবা, নমঃ, নিতান্ত, পশ্চাৎ, পরশ্ব, পরন্তু, পুনশ্চ, পুনঃ, পৃথক্, প্রতি, প্রত্যহ, প্রত্যুত, প্রভৃতি, প্রাক্, প্রাতঃ, প্রায়, বরং, বা, বিনা, বৃথা, যত্র, যথা, যদি, যদ্যপি, যাবৎ, যুগপৎ, রে, সঙ্গে (গদ্য-পদ্য-সৰ্বত্ৰ), সদা, সদ্যঃ, সম্প্রতি, সম্যক্, সর্বত্র, সর্বদা, সহসা, সাক্ষাৎ, সাথে (কেবল কবিতায়), সুতরাং, সুষ্ঠু, স্বয়ং, হা, হস্ত, হে। ইহা ছাড়া ‘এবং’ শব্দটি সংস্কৃতে ‘এইরূপ’ অর্থ প্রকাশ করিলেও বাংলায় কতকটা ‘ও’ অর্থে ব্যবহৃত হয় বলিয়া অব্যয়রূপে গণ্য হইতেছে।
সমাস
সংক্ষেপে সুন্দর করিয়া বলিবার উদ্দেশ্যে পরস্পর অর্থ—সম্বন্ধযুক্ত দুই বা তাহার বেশী পদকে এক পদে পরিণত করার নাম সমাস। সমাসে একাধিক পদ মিলিত হইয়া যে একটি নূতন পদ গঠন করে, তাহাকে সমস্ত-পদ বা সমাস-বদ্ধ পদ বলে। সমস্ত-পদটি একটিমাত্র পদ, তাই পদটিকে একমাত্রায় লেখা চাই-ই। পদটি যেখানে বেশ বড়ো হইবার সম্ভাবনা, সেখানে পদসংযোজক রেখা (হাইফেন) দ্বারা যুক্ত করা উচিত। যেমন—হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ; অমর-দানব-যক্ষ-মানব। যে-সমস্ত পদের সমন্বয়ে সমস্ত-পদের সৃষ্টি, তাহাদের প্রত্যেকটিকে সমস্যমান পদ বলে।
শব্দ ও পদের পার্থক্য
বাংলা শব্দ-সম্ভার
বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দাবলীকে আমরা মোটামুটি পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করিতে পারি। (১) তৎসম, (২) তদ্ভব, (৩) অর্ধ-তৎসম, (৪) দেশী ও (৫) বিদেশী। যে-সমস্ত শব্দ সংস্কৃত হইতে সরাসরি বাংলা ভাষায় আসিয়া অবিকৃত রূপে চলিতেছে, তাহাদিগকে তৎসম শব্দ বলে। তদ্ = সংস্কৃত, সম = সমান; অতএব তৎসম কথাটির অর্থ হইতেছে ‘সংস্কৃতের সমান’ অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দই অপরিবর্তিত আকারে বাংলায় চলিতেছে। মূল সংস্কৃত শব্দের প্রথমার একবচনের রূপটিই বাংলায় গৃহীত হইয়াছে—অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে শব্দের শেষস্থ বিসর্গ বা ম্ (ং) বর্জন করা হইয়াছে। বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রায় অর্ধাংশ (৪৪%) এই তৎসম শব্দে পুষ্ট। সংস্কৃত, ভাণ্ডার, শব্দ, অবিকৃত, ব্যবহৃত, তৎসম, তদ্ভব, শর, উদাহরণ, পিতা, মাতা, শিক্ষালয়, আচার্য, শিক্ষক, সকল, পদ, গজ (হস্তী), ঘাস, দিক্, প্রাক্, সূপ প্রভৃতি তৎসম শব্দ। যে-সমস্ত শব্দ সংস্কৃত শব্দভাণ্ডার হইতে যাত্রা করিয়া প্রাকৃতের পথে নির্দিষ্ট নিয়মে ধারাবাহিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়া আসিয়া নূতনরূপে বাংলা ভাষায় প্রবেশলাভ করিয়াছে, তাহাদিগকে তদ্ভব বা প্ৰাকৃতজ শব্দ বলে। তদ্ = সংস্কৃত; ভব = উৎপন্ন; অতএব তদ্ভব কথাটির অর্থ হইতেছে ‘সংস্কৃত হইতে উৎপন্ন’।
প্রত্যয়
উপসর্গ
বাক্য
আমি যদি বলি, “আমায় ভালো দেখে একখানা গল্পের বই দাও,” তবে আমার প্রয়োজনটুকু বুঝিয়া আমাকে একখানি গল্পের বই আনিয়া দিবে। আমায়, একখানা, ভালো, দেখে, গল্পের, বই, দাও এবং তুমি (ঊহ্য)—এই মোট আটটি পদের সাহায্যে আমার মনোভাবটি প্রকাশ করিলাম এবং তোমাদেরও বুঝিতে কোনো অসুবিধা হইল না। এই আটটি সুসজ্জিত পদের সমষ্টিকে বাক্য বলে। যে কয়টি সুসজ্জিত পদের দ্বারা মনের কোনো একটি ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায়, তাহাদের সমষ্টিকে বাক্য বলে। বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলির তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকা চাই—(১) আসত্তি (নৈকট্য), (২) যোগ্যতা ও (৩) আকাঙ্ক্ষা।
শব্দ ও বাক্যাংশের বিশেষ অর্থে প্রয়োগ
অশুদ্ধি-সংশোধন
অলংকার
সাহিত্যস্রষ্টার যে রচনাকৌশল কাব্যের শব্দধ্বনিকে শ্রুতিমধুর এবং অর্ধধ্বনিকে রসাপ্লুত ও হৃদয়গ্রাহী করিয়া তোলে, তাহাকে অলংকার (Figure of speech) বলে। কেয়ূর কঙ্কণ কণ্ঠী প্রভৃতি স্বর্ণালংকার যেমন রমণীদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, অনুপ্রাস-যমক উপমা-রূপক প্রভৃতি সাহিত্যালংকারও তেমনি কাব্যদেহের অঙ্গলাবণ্য ও আন্তর সৌন্দর্যকে নয়নলোভন ও চিত্তবিমোহন করিয়া তোলে। তবে মণিময় অলংকার ও বাণীময় অলংকারের পার্থক্যটি মনে রাখিও।—রমণীদেহের অলংকার একান্তই বাহিরের জিনিস, কিন্তু কাব্যালংকারের সহিত কাব্যের অন্তরের যোগ অবিচ্ছিন্ন।বাণী বহিরঙ্গে শব্দময়ী, অন্তরঙ্গে অর্থময়ী। অলংকারও তাই দ্বিবিধ—শব্দালংকার ও অর্থালংকার।
বাংলা লেখ্য উপভাষা : গদ্য ও পদ্যরূপের পার্থক্য
_________________
বাংলা ভাষা ও উপভাষা
প্রতিটি মানুষ জন্মসূত্রে কোনো-না-কোনো ভাষার অধিকারলাভ করে। সে যে পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, সেইখানে বাবা-মা এবং অন্যান্য আত্মীয় পরিজনদের মুখ হইতে যে ভাষা সে শুনিতে পায়, তাহাই তাহার মাতৃভাষা। সেই ভাষায় কথা বলিবার জন্য তাহাকে সচেতনভাবে বিশেষ কোনো প্রচেষ্টা করিতে হয় না; চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া, শ্বাসক্রিয়ার মতোই নিতান্ত স্বাভাবিক স্বয়ংক্রিয় স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সে তাহার মাতৃভাষায় কথা বলিতে শিখিয়া যায়। মানবশিশু অরণ্যে প্রতিপালিত হইলে জনসমাজে লালিত অন্যান্য শিশুদের মতো কথা কহিতে পারে না, বাকশক্তিহীন হইয়া থাকে–নেকড়ে-বালক রামুই (যে আশৈশব নেকড়ে দ্বারা লালিত-পালিত হইয়াছিল) তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
মনে রাখিতে হইবে, ভাষা কতকগুলি ধ্বনির সমষ্টি হইলেও যেকোনো রকমের ধ্বনিই ভাষা নয়। একটি বস্তুর সহিত অপর কোনো বস্তুর সংঘর্ষ বা । ঘর্ষণ হইলে, ভারী ধাতব বস্তু মাটিতে পড়িয়া গেলে কিংবা কেহ হাততালি দিলে বা আছাড় দিয়া জামাকাপড় কাচিলে নানা ধরনের ধ্বনির সৃষ্টি হয়। বলা বাহুল্য, উৎপন্ন এই ধ্বনিগুলির কোনোটিই ভাষা নয়। আবার, ভাষার দ্বারা মানুষ মনের বিচিত্র ভাবপ্রকাশ করে বলিয়া, নানাপ্রকার অঙ্গভঙ্গি বা কিছু অর্থবোধক ইঙ্গিত ইশারার দ্বারা মানুষ নিজ মনোভাব প্রকাশ করিলেও ভাষা-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সেগুলি ভাষা বলিয়া গণ্য হয় না। ইঙ্গিতের দ্বারা ভাষার কাজ কিছু চলিলেও “ঙ্গিত ভাষা নয়, ভাষার বিকল্প এক পরিপোক মাত্র। ভাষাকে অবশ্যই মানুষেরই বাগ্যন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি হইতে হইবে। পশুপক্ষী তো তাহাদের কষ্ঠোগীর্ণ বিভিন্ন ডাকের মাধ্যমে নিজেদের মনের ভাব এবং শারীরিক প্রয়োজন দলের অন্যান্য পশুপক্ষীকে বুঝাইতে পারে; কিন্তু মানবের ও পশুপক্ষীর কণ্ঠনিঃসৃত ধানিপ্রবাহের মধ্যে মূলগত পার্থক্য হিয়াছে। যে-বুদ্ধি মানুষের মুখে ভাষা জোগাইয়াছে, ইতর প্রাণীর ডাকের মধ্যে সেই পরিশীলিত বুদ্ধির নিদারুণ অভাব থাকিয়া গিয়াছে; তাই তাহা কেবল কাকলি-কূজন-হ্রেষা-বৃংহণ-এই সীমাবদ্ধ রহিয়া গিয়াছে, ভাষা হইয়া উঠিতে পারে নাই।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ভাষা মানুষের বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনিসমষ্টি হইলেও এরূপ কিছু ধ্বনির সমন্বয়-মাত্রই কিন্তু ভাষা নয়; জ্বরের ঘোরে অসুস্থ রোগীর ভুল বকা, শিশুর অস্ফুট চিৎকার বা পাগলের অর্থহীন প্রলাপ–এগুলির প্রতিটিই মানুষের বাগ্যন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চারিত ধ্বনি বটে, কিন্তু ইহাদের কোনোটিই ভাষা বলিয়া গ্রাহ্য নয়, কারণ এই ধ্বনিগুলি কোনো বিশেষ বস্তু বা ভাবের বাহন বা প্রতীক নয়। একজন মানুষের আকাঙ্ক্ষা, স্পৃহা, বেদনা, উত্তেজনা প্রভৃতি মনের কোনো-না-কোনো চিন্তার সম্পদকে অন্য একজন মানুষের মনে পোঁছাইয়া দিয়া তাহারও অন্তরে অনুকূল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করাই ভাষার প্রথম ও প্রধান কাজ। মানুষের মনোরাজ্যের ভাবসম্পদকে অপরের কাছে পৌঁছাইবার জন্য চিন্তার একটি বাহনের প্রয়োজন; ভাষা–মানুষের চিন্তার ধ্বনিমাধ্যম প্রকাশ–হইল সেই উন্নততর প্রকাশমাধ্যম। ভাষা চিন্তার শুধু বাহনই নয়, প্রসুতিও বটে; ভাষার অবলম্বন ব্যতিরেকে মানুষের চিন্তাশক্তি বিচরণে অক্ষম।
তবে শুধুমাত্র ক্ষুধা-তৃষ্ণা বা অন্যান্য জৈব বৃত্তি প্রকাশের তাগিদেই ভাষার। সৃষ্টি হয় নাই; তাহাই যদি হইত, তাহা হইলে জীবজন্তুরাও ভাষার জন্ম দিতে সক্ষম হইত। নিজেদের জৈব চাহিদাকে অপরের মনে সঞ্চার করিয়া সমস্যার সহজতর সমাধানে ভাষা মানুষকে সহায়তা করিলেও একমাত্র জৈব বৃত্তির তাড়নাই মানুষের মুখে ভাষার জন্ম দেয় নাই; তাহা হইলে মানুষ তো পশুনাদ বা
জীবজন্তুর মতো মুখের অস্ফুটধ্বনি ও ইঙ্গিতের দ্বারা নিজ প্রয়োজন মিটাইয়াই ক্ষান্ত হইত। কিন্তু বাস্তবিকভাবে সভ্যতার পথে অগ্রসর হইয়া আপন মনের উন্নততর চিন্তা ও ভাব প্রকাশের উদ্দেশ্যেই মানুষ ভাষার সৃষ্টি করিয়াছে। এই ভাষার উৎস তাহার মনে; ভাষার সহিত মানুষের আত্মার অবিচ্ছেদ্য যোগ। তাই পাশ্চাত্ত্য মনীষী প্লেটো বলিয়াছেন : “চিন্তা ও ভাষা প্রধানত একই; উভয়ের মধ্যে কেবল এইটুকুই পার্থক্য রহিয়াছে যে, আত্মার নিজের সহিত নিজের কথোপকথন হইল চিন্তা, আর আমাদের চিন্তা হইতে ধ্বনির আশ্রয়ে ওষ্ঠাধরের মধ্য দিয়া যে প্রবাহটি বহিয়া আসে, তাহাই হইল ভাষা।”
ভাষা বলিলে আমরা মুখের ভাষা এবং লেখাপড়ার ভাষা–এই দুই ধরনের ভাষা বুঝি। মুখের ভাষার ব্যবহারে দুই প্রকার সীমাবদ্ধতা আছে; পরস্পর আলাপ ও বার্তাবিনিময় তখনই সম্ভব হয় যখন বক্তা ও শ্রোতা একই সময়ে একই স্থানে অবস্থিত থাকেন। বর্তমান কালে বিজ্ঞানের সমূহ অগ্রগার ফলে অবশ্য দূরভাষ (টেলিফোন), চলমান দূরভাষ (মোবাইল ফোন) বা বেতার (রেডিও), দূরদর্শন (টেলিভিশন) ইত্যাদি ব্যবস্থার সুবিধার কারণে বক্তা ও শ্রোতা শুধু সমকালবর্তী হইলেই চলে, সন্নিহিতভাবে থাকিবার প্রয়োজন হয় না। আবার, গ্রামোফোন ও টেপ-রেকর্ডারের ক্ষেত্রে বক্তা ও শ্রোতা সমস্থানে তো থাকেনই না, এমনকি সমকালেও থাকেন না; তবে সেক্ষেত্রে ভাষার কাজ যে আলাপচারিতা, তাহা চলে না; শুধু একতরফা বলা বা শোনাই হয়। তাই গ্রামোফোন ও রেকর্ডার মুখের ভাষা বহন করিলেও প্রকৃতপক্ষে লেখার ভাষার মতোই কাজ করে।
মুখের ভাষা যে স্থানে এবং যে সময়ে বলা হয়, সাধারণভাবে শুধুমাত্র সেই স্থান ও সময়ের মানুষই তাহা শুনিতে পান। অজ্ঞাতকে জানিবার উদগ্র নেশায় যুগ-যুগান্তর ধরিয়া মানুষ যে অতন্দ্র সাধনা করিয়া চলিয়াছে, নিজের জ্ঞান-সাধনার সেই দুর্লভ সম্পাজিকে, ভাব-ভাবনার সমূহ ফসলকে, নিজের বক্তব্যগুলিকে পরবর্তী কালের মানুষজনের কাছে পৌঁছাইয়া দিবার চিরন্তন আকাঙ্ক্ষাও তো তাহার রহিয়াছে। মুখের ভাষার সাহায্যে এক স্থানের ও এক কালের মানুষের পক্ষে অন্য স্থানের ও কালের মানুষের কাছে আপন অভিজ্ঞতাপ্রসূত ও সাধনালব্ধ বক্তব্য-বিষয়গুলি পোঁছাইয়া দিবার অক্ষমতার দুর্লঙ্ঘ্য বাধা তাহাকে অতিক্রম করিতেই হইবে। মুখের ভাষার এই স্থান-কালের দ্বিবিধ সীমাবদ্ধতাকে জয় করিয়া অনুপস্থিত অজ্ঞাত অনাগত উদ্দিষ্টদের কাছে ইহাকে সযত্ন পৌঁছাইয়া দিতে মানুষ একটি অমূল্য মাধ্যম আবিষ্কার করিল মুখনিঃসৃত বাঙ্গয় ধ্বনির এক দৃশ্যরূপ সৃষ্টি করিল, যাহাকে লিপি-পদ্ধতি বলা হয়।
লিপিবদ্ধ হইলে তবেই তো ভাষা স্থায়িত্ব লাভ করিতে পারে। লিপির উদ্ভবের মাধ্যমে মানুষের মুখের ভাষার স্থায়ী রূপায়ণ সম্ভব হইয়াছে। ইহার দ্বারা মুখের ভাষাকে যেমন এক স্থান হইতে স্থানান্তরে লইয়া যাওয়া যায়, তেমনি ইহাকে এক কাল হইতে সার্থকভাবে পরবর্তী কালের জন্য রাখিয়া দেওয়াও যায়। ফলে মুখে বলা ও কানে শোনার সেই ভাষা চোখে দেখা ও পড়িবার বস্তুতে রূপায়িত হইয়া গেল; প্রধানত শ্ৰব্য ভাষা দৃশ্য লিপিতে পরিবর্তিত হইল। সুতরাং, লিপির সংজ্ঞার্থ কী বলিতে পারি?
৪। লিপি ও ভাষার স্থানান্তরযোগ্য এবং পরবর্তী যুগের জন্য সযত্ন সংরক্ষণযোগ্য এক সাংকেতিক দৃশ্যরূপ ও স্থায়ী উপস্থাপনাকেই লিপি বলা হয়। মানবমনের সুচিন্তিত ভাব-সম্পদকে স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করিয়া চিরস্থায়ী করিয়া তুলিতে এই যে লিপির উদ্ভব, তাহা যুগে যুগে মানুষের দীর্ঘকালব্যাপী নানা পরিকল্পনা-প্রচেষ্টার ফলশ্রুতি। আদিমকাল হইতে চিত্রলিপি, গ্রন্থিলিপি, ভাবলিপি, চিত্রপ্রতীকলিপি, ধ্বনিলিপি (শব্দলিপি, দললিপি ও বর্ণলিপি) প্রভৃতির নানা স্তরের মাধ্যমে ক্ৰমবিকাশ ঘটিয়া আধুনিককালে লিপির এই বর্তমান রূপটি গড়িয়া উঠিয়াছে।
স্থান ও কালের ব্যবধানে অবস্থিত অগণিত শ্রোতা ও পাঠকের উদ্দেশ্যে লেখার ভাষা ব্যবহৃত হয়; তাই লেখার ভাষার গঠন মুখের ভাষা হইতে কিছুটা পৃথক্, ধারাবাহিক আদর্শের সনুসারী। লেখার ভাষা লেখকের সুস্থ মস্তিষ্কপ্রসূত ও লেখনী-নির্গত একমুখী স্রোতের ধারা, তাহা অবাধ স্বচ্ছন্দগতি; ইহাতে বাধা যেমন নাই, আলাপেরও কোনো অবকাশ নাই। মুখের ভাষা একেবারে আটপৌরে সহজ সরল স্বতঃস্ফূর্ত সাবলীল; কিন্তু লেখার ভাষা পোশাকী, তাই খানিকটা কৃত্রিম। মুখের ভাষা ক্ষণিক, লেখার ভাষা স্থায়ী; বক্তা মনে যাহা ভাবেন হয়তো তাহাই বলিতে পারেন, কিন্তু লেখক মননশীল, সংযত; মনের চিন্তা-ভাবনাকে পরিশীলিত ও মার্জিত করিয়া তবেই তিনি কলমের মুখে আনেন।
স্থান ও গোষ্ঠীবিশেষে মুখের ভাষায় অল্পবিস্তর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু লেখার ভাষায় কথ্য বা মৌখিক ভাষার সর্বজনগ্রাহ্য সাধারণ রূপটিই পরিগৃহীত হয়। তাই অঞ্চলভেদে কথ্য ভাষায় রূপভেদ থাকিলেও লেখার ভাষায় আঞ্চলিক বৈচিত্র্য বা বৈষম্য থাকে না।
ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিসমষ্টির কোনো সুনির্দিষ্ট সর্বসাধারণ রূপ নাই। বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন প্রকার ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহৃত হয়, কারণ, প্রতিটি ভাষারই ধ্বনি, শব্দ বা পদবিন্যাস রীতির নিজস্ব কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য রহিয়াছে। ইংরেজী ভাষার ধ্বনি সমাবেশ-বিধি, পদগঠন-পদ্ধতি বা বাক্যনির্মাণ-রীতি বাংলা, সংস্কৃত বা হিন্দী ভাষার নিয়মাবলীর সহিত পুরাপুরি মিলিয়া যায় না। আবার বিশ্বব্যাপী বিপুল মানবগোষ্ঠীর সকলেই তো আর একই ভাষা ব্যবহার করেন না।
৫। ভাষা-সম্প্রদায় : যে জনসমষ্টি নিজেদের মধ্যে ভাবপ্রকাশ ও ভাববিনিময়ের জন্য একই ধরনের ধ্বনিসমষ্টির বিধিবদ্ধ বিশিষ্ট রূপটি ব্যবহার করে, ভাষা-বিজ্ঞানীরা তাহাকে একটি ভাষা-সম্প্রদায় বা ভাষা-গোষ্ঠী (Speech Community) বলিয়া আখ্যা দিয়াছেন।
যেমন : ছাত্রছাত্রীরা তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে শেখে’–এই ধ্বনিসমষ্টি একটি নির্দিষ্ট ক্রম-অনুসারে বিন্যস্ত করিয়া যে ভাব প্রকাশ করা হইয়াছে, তাহা শুধু বাঙালীরাই ব্যবহার করেন এবং ইহার দ্বারা প্রকাশিত ভাবটি কেবল বাঙালীরাই বুঝিতে পারেন। তেলুগু, মারাঠী বা উর্দু ভাষাভাষী মানুষেরা, যদি তাহারা বাংলা ভাষা না জানেন, কিছুতেই এই বাক্যটির অর্থ বুঝিতে পারিবেন না। সেইজন্য বাঙালীদের একটি ভাষা-সম্প্রদায় বলা যায়। এই একই ভাব প্রকাশের জন্য অন্যান্য ভাষা-সম্প্রদায় অন্য ধরনের ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহার করিবেন। যেমন, এক্ষেত্রে ইংরেজরা বলিবেন–”Students learn from their teachers, বিদেশে এইরকম ফরাসী, চীনা, জাপানী, জার্মান প্রভৃতি নানা ভাষা-গোষ্ঠী যেমন রহিয়াছে, আমাদের দেশেও তেমনি গুজরাটী, তামিল, কানাড়ী, অসমিয়া, ওড়িয়া প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষা-সম্প্রদায় আছে।
কিন্তু এক-একটি ভাষা-সম্প্রদায় যে ভাষার মাধ্যমে ভাববিনিময় করে, সেই গোষ্ঠীর সকলেই যে সেই নির্দিষ্ট ধ্বনিসমষ্টি ব্যবহার করিয়া সম্পূর্ণ অবিকৃতভাবে সেই ভাষায় কথা বলেন, তাহা না-হইতেও পারে। কথ্য ভাষা ধরিয়া বিচার করিলে দেখা যায়, ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত বৃহৎ সমাজে ব্যবহৃত ভাষায় অল্পবিস্তর বৈষম্য থাকে। পাশাপাশি অঞ্চলের মৌখিক ভাষায় এই বৈষম্য সর্বদা খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান না হইতে পারে, কিন্তু যে ভাষা-গোষ্ঠীর এলাকা বিস্তৃত এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি, সেই গোষ্ঠীর দুই প্রান্তে বসবাসকারী লোকেদের মধ্যে বার্তাবিনিময় ঘটিলে এক অঞ্চলের লোকের মুখের কথা অন্য অঞ্চলের মানুষের পক্ষে সম্পূর্ণরূপে বোধগম্য না হইবার যথেষ্ট সম্ভাবনা। রহিয়াছে। প্রধানত ধ্বনি-পরিবর্তনের মধ্য দিয়াই এই রূপান্তর লক্ষ্য করা যাইলেও শব্দের রূপে এবং প্রয়োগেও এই পার্থক্য দেখা যায়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ-সংলগ্ন বিহার ও ঝাড়খণ্ড রাজ্যের প্রান্তিক অঞ্চল, প্রতিবেশী অঞ্চল মানভূম, সিংভূম, অসম রাজ্যের কাছাড় ও ত্রিপুরা রাজ্যের বাঙালী-অধ্যুষিত বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষা-সম্প্রদায়ের মানুষ। ইহা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের হুগলী-হাওড়া অঞ্চলের সহিত বাংলাদেশের বরিশালের কথ্য ভাষার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। যেমন : প্রথম অঞ্চলের লোকেরা যেখানে বাড়ি, চাকর, ঢাক, ভাই, ছিল, পেয়েছে বলেন, দ্বিতীয় অঞ্চলের লোকেরা সেখানে যথাক্রমে বারি, চাহর, ডাক, বাই, আছিল ও পাইছে বলেন। পশ্চিমবঙ্গের ‘ছেলে’ বরিশালের মানুষের কথ্য ভাষায় ‘পোলা’ বা ‘ছাওয়াল’-এ পরিণত হইয়াছে, পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা ‘সঙ্গে’ বলিলে বাংলাদেশের লোকেরা বলেন ‘লগে’ বা ‘সাথে’।
একই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত দুটি অঞ্চলের মধ্যে দূরত্বজনিত ব্যবধান যত বৃদ্ধি পায়, দুটি স্থানের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্রটিও ততই ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া পড়ে; ফলে তাহাদের উচ্চারিত ধ্বনি, ভাষারীতি, এমন কি বাচনভঙ্গিমার মধ্যেও যথেষ্ট তফাত দেখিতে পাওয়া যায়। বীরভূম ও বর্ধমান, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া অঞ্চলগুলি পাশাপাশি অবস্থিত বলিয়া এই অঞ্চলের অধিবাসীদের মুখের ভাষা অনেকটা একইরকম; বীরভূমের লোকের কথা বর্ধমানের লোকেরা সহজেই বুঝিতে পারেন। অথচ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার কোন মানুষ বাংলাদেশের চট্টগ্রামের লোকেদের কথ্য ভাষা প্রায় কিছুই বুঝিতে পারিবেন না। উভয়ে একই ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও দুটি অঞ্চলের দূরত্বগত ব্যবধান, যোগাযোগের মেলামেশার ও কথাবার্তা বলার সুযোগের নিদারুণ অভাবই উভয়ের মধ্যে উচ্চারিত ধ্বনির ও ভাষারীতির বিস্তর পার্থক্য গড়িয়া তুলিয়াছে। অঞ্চলবিশেষে কথ্য ভাষার মধ্যে এই স্বাতন্ত্র্য হইতেই উপভাষা সৃষ্টি হয়। তাহা হইলে উপভাষার সংজ্ঞার্থ কী বলিতে পারি?
৬। উপভাষা ও একই ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত অঞ্চলভেদে দৈনন্দিন ব্যবহারিক কাজে ও কথাবার্তায় ধ্বনিগত, রূপগত এবং বিশিষ্ট বাগধারাগত বৈশিষ্ট্য লইয়া যে ভাষা প্রচলিত থাকে, তাহাকে উপভাষা বলে। একই ভাষার অন্তর্গত এক-একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত উপভাষাগুলির বিশেষ রূপের সহিত আদর্শ ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনি, রূপ ও বাধারার ব্যবহারে অনেক পার্থক্য থাকে।
সব ভাষা-গোষ্ঠীরই উপভাষা থাকে না। সাধারণত ক্ষুদ্র ভৌগোলিক সীমার মধ্যে নিতান্ত অল্পসংখ্যক মানুষ লইয়া কোনো ভাষা-সম্প্রদায় গড়িয়া উঠিলে সেখানে কোনো উপভাষা পরিলক্ষিত হয় না। কারণ, ছোট্ট পরিসরে সকলের সহিত সকলের ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদান, বাগবিনিময়ের পরিপূর্ণ সুযোগ থাকায় ব্যক্তি বিশেষের উচ্চারণ-দোষ কিংবা ভুল প্রয়োগজনিত বিভেদ গড়িয়া উঠিবার কোনো অবকাশই থাকে না। কিন্তু একটি বিশাল এলাকা জুড়িয়া কোটি কোটি মানুষ লইয়া গড়িয়া উঠা ভাষা-সম্প্রদায়ের মধ্যে উপভাষার উদ্ভব অনিবার্য। কারণ, বৃহৎ ভূখণ্ডে এক অঞ্চলের মানুষের সহিত অতি-দূরবর্তী অন্য অঞ্চলের মানুষের মেলামেশা ও কথাবার্তার সুযোগ ক্ষীণ হওয়ায় কালক্রমে উভয় স্থানের কথ্য ভাষার তফাত গড়িয়া উঠে, যাহা হইতে আঞ্চলিক ভাষা-গোষ্ঠী বা উপভাষার। সৃষ্টি হয়। এইভাবেই বাংলা ভাষা-গোষ্ঠী পাঁচটি প্রধান ঔপভাষিক অঞ্চলে বিভক্ত হইয়া গিয়াছে–রাঢ় অঞ্চলে রাঢ়ী উপভাষা, বরেন্দ্রভূমি অঞ্চলে বরেন্দ্রী উপভাষা, বঙ্গাল ভূমিতে বঙ্গালী, ঝাড়খণ্ড অঞ্চলে ঝাড়খণ্ডী এবং কামরূপে কামরূপী উপভাষার সৃষ্টি হইয়াছে।
ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ, জলপ্লাবন ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে কিংবা রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে কোনো উপভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুত কিছু পরিবার সমষ্টিগতভাবে স্বদেশ ত্যাগ করিয়া অন্যত্র উপনিবেশ গড়িয়া তুলিয়া বসবাস করিতে পারে। মূল স্থান হইতে পরিভ্রষ্ট এবং প্রধান ভাষা-সম্প্রদায় হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন সেই উপভাষা কালক্রমে সুযোগ পাইলে একটি মূল ভাষা-সম্প্রদায়ে পরিণত হইতে পারে। লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাইলে, জীবিকা ও শিক্ষা সহজলভ্য হইলে, মনীষী ও বলিষ্ঠ লেখকের আবির্ভাব ঘটিলে, কিংবা ধর্মবাণীর বাহনরূপে গৃহীত হইলে উপভাষা আপন পথ ধরিয়া বিকশিত হইয়া কালক্রমে নূতন ভাষা বলিয়া পরিগণিত হয়। এক সময় সমগ্র মধ্য-ইউরোপে জার্মানিক ভাষা প্রচলিত ছিল। খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দের কিছু পূর্বে এই ভাষা-সম্প্রদায়ের একাধিক দল বিচ্ছিন্ন হইয়া ইংলন্ডে আসিয়া উপনিবিষ্ট হইয়াছিল; সেই দলের একটি উপভাষা নিজের পথ ধরিয়া বিকশিত হইয়া আধুনিক কালের শ্রেষ্ঠ ভাষা ইংরেজীতে পরিণত হইয়াছে। জার্মানিক ভাষা-সম্প্রদায়ের আরো কয়েকটি দল বিচ্ছিন্ন হইয়া বিভিন্ন দেশে গিয়া আইসল্যান্ডিক, নরওয়েজীয়, সুইডিশ, দিনেমার, ওলন্দাজ প্রভৃতি ভাষার সৃষ্টি করিয়াছে, আর যে দলটি ওইখানেই থাকিয়া গিয়াছিল, তাহাদের উপভাষাই কালক্রমে আধুনিক জার্মান ভাষায় পরিণত হইয়াছে।
সারা পৃথিবীর প্রায় চার হাজার ভাষাকে তাহাদের মূলীভূত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে প্রধানত তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের পদ্ধতির সাহায্যে যে কয়েকটি ভাষা-বংশে বগীকৃত করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে নানা কারণে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হইল ইন্দো-ইউরোপীয় বা মূল আর্য ভাষাবংশ। এই ভাষাবংশ হইতে জাত ভাষাগুলি পৃথিবীর দুই বিশাল মহাদেশ এশিয়া ও ইউরোপের বহু অঞ্চলে প্রচলিত রহিয়াছে। শুধু ভৌগোলিক বিস্তারেই নয়, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতেও এই ভাষাবংশ হইতে জাত প্রাচীন ও আধুনিক ভাষাগুলি পৃথিবীতে প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। এই বংশের প্রাচীন ভাষা সংস্কৃত, গ্রীক ও ল্যাটিন এবং আধুনিক ভাষা ইংরেজী, জার্মান, ফরাসী, ইতালীয়, বাংলা প্রভৃতি সাহিত্য-সৃষ্টিতে এতই সমৃদ্ধ যে, ব্যাস-বাল্মীকি-হোমার-ভার্জিল-কালিদাস এবং শেক্সপীয়ার-গ্যেটে-দান্তে-পেত্রার্ক রবীন্দ্রনাথের অবিস্মরণীয় অবদান এখন আর কোনো বিশেষ ভাষা বা ভাষা বংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকিয়া সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেরই অমূল্য সম্পরূপে বিবেচিত হয়।
বাংলা ভাষার আদি উৎস এই মূল আর্য ভাষাবংশ হইতে দীর্ঘকাল ব্যাপিয়া নানারূপ স্বাভাবিক পরিবর্তন ও ক্রমবিকাশের ধারায় মধ্যবর্তী অনেকগুলি স্তর পার হইয়া বাংলা ভাষা জন্মলাভ করিয়াছে। মূল আর্য ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী তাহাদের আদি বাসস্থান দক্ষিণ রাশিয়ার উরাল পর্বতের পাদদেশ হইতে আনুমানিক ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নিকটবর্তী সময় হইতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়াইয়া পড়িতে শুরু করে। ভারতীয় আর্য উপশাখাঁটি আনুমানিক ১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ভারতে প্রবেশ করিবার পর হইতে প্রাচ্য, প্রাচ্যা প্রাকৃত, মাগধী প্রাকৃত, মাগধী অপভ্রংশ-অবহট্ঠ প্রভৃতি নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়া আনুমানিক ৯০০ হইতে ১০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বাংলা ভাষাটির জন্ম দিয়াছে।
ভৌগোলিক, রাষ্ট্রিক, সামাজিক ইত্যাদি কারণে যেমন এক ভাষা হইতে একাধিক উপভাষার উদ্ভব হইতে পারে, তেমনি কোনো একটি উপভাষা শক্তিশালী হইয়া অন্য উপভাষাগুলিকে নিজের আওতায় আনিয়া কিংবা লুপ্ত করিয়া এককভাবে পূর্ণ ভাষারূপে উদ্ভূত হইতেও পারে। বহুজনভাষিত কোনো ভাষায় সামান্য কিছুও স্থায়ী সাহিত্যকীর্তি রচিত হইলে সেই ভাষা কখনই পুরাপুরি মুখের ভাষা হইতে পারে না; সাহিত্যে শিক্ষায় বক্তৃতায় আইন-আদালতে বেতার-দূরদর্শন বা সংবাদপত্রে সর্বত্রই ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত সকলে ভাষাটির একটি সর্বজনীন আদর্শ রূপ ব্যবহার করেন, কিন্তু শিক্ষিত মনের অনুশীলনের বাহিরে, ঘরে ও প্রতিদিনের কাজকর্মে বিভিন্ন অঞ্চলের লোকেরা নিজের অঞ্চলে হুবহু ভাষার সেই শিষ্টরূপটির পরিবর্তে আঞ্চলিক উপভাষাই ব্যবহার করেন।
যে ভাষা-সম্প্রদায়ে একাধিক উপভাষা রহিয়াছে, সেখানে ভদ্র-সমাজে ও লেখাপড়ায় সর্বজনব্যবহার্য শিষ্টভাষাটির মুলে কোনো একটি বিশেষ উপভাষা থাকে। সেই উপভাষাটির সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রিক সামাজিক বা বাণিজ্যিক প্রাধান্যের জন্য কিংবা উপভাষাটিতে বলিষ্ঠ যশস্বী কবি-সাহিত্যিক-মনীষীর আবির্ভাবের কারণে সেই বিশেষ উপভাষাটিই প্রবল ও বহুব্যবহৃত হইয়া অন্যান্য উপভাষাগুলিকে আচ্ছন্ন করিয়া একচ্ছত্র হইয়া উঠে। সুতরাং দেখা যাইতেছে, ভাষার মধ্যে যেমন কয়েকটি উপভাষা থাকে, তেমনি কয়েকটি উপভাষা হইতে। নূতন ভাষাও গড়িয়া উঠে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বাংলা ও অসমিয়া প্রথমে একই ভাষার দুটি উপভাষা ছিল; পরে ইহাদের মধ্যে আঞ্চলিক পার্থক্য বৃদ্ধি পাইল, উভয় জনগোষ্ঠী সংস্কৃতির দিক্ হইতে পৃথক্ হইয়া গেল, দুটি উপভাষাতেই কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি হইতে লাগিল এবং উপভাষা-দুটির কথ্য রূপের মধ্যে পারস্পরিক বোধগম্যতার অভাব দেখা দিল। ফলে আঞ্চলিক রূপ-দুটিকে বাংলা ও অসমিয়া নামে দুইটি স্বতন্ত্র ভাষারূপে চিহ্নিত করা হইল।
ভাষা ও উপভাষা-বিষয়ে এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা করা হইল, তাহা হইতে, আশা করি, এইটুকু বুঝিতে পারিয়াছ যে, কালগত স্থানগত সামাজিক রাজনীতিক সাহিত্যিক প্রভৃতি বিভিন্ন কারণে ভাষা ও উপভাষার মধ্যে নানা পার্থক্য থাকিলেও উভয়ের মধ্যে একটি অটুট নাড়ির যোগ রহিয়াছে। উপভাষা ভাষার কোনো উপবিভাগ নহে। সবগুলি উপভাষাই বাংলা ভাষার বিশিষ্ট রূপটি প্রকাশ করিতেছে। ইহাদের কোনো একটিকে বাংলা ভাষারূপে চিহ্নিত করা যায় না; আবার কোনো একটিকে বাদ দিয়াও বাংলা ভাষার পরিচয় পাওয়া যায় না। গদ্য-পদ্য সাধু-চলিত সব ধরনের লেখ্য ভাষাও যেমন বাংলা, বাঁকুড়া মেদিনীপুর চট্টগ্রাম ঢাকা নদীয়ার মানুষের কথ্য ভাষাও তেমনই বাংলা।
ভাষা-বিজ্ঞানের আধুনিক ধারণার ভিত্তিতে বলা যায়, কোনো ভাষা-গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভাব-বিনিময়ের একটি বিমূর্ত নিরাকার ব্যবস্থা (Abstract System) হইল ভাষা, আর উপভাষা সেই ব্যবস্থার মূর্ত (Concrete) গঠন অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক রূপ। সব উপভাষারই কথ্য (মৌখিক) ও লেখ্য (লিখিত) দুইটি রূপ আছে; তবে লেখ্য-রূপটি সমাজের সর্বস্তরে মান্যতা পায় বলিয়া কোনো ভাষার পরিচয় দিতে হইলে কেবল তাহার লেখ্য রূপটিরই উদাহরণ দেওয়া হয়। কিন্তু লেখ্য ভাষাও তো একটি উপভাষা মাত্র। এই লেখ্য উপভাষার দুইটি রূপ–গদ্য ও পদ্য; ভাষারীতি অনুযায়ী, বাংলা গদ্যের সাধু ও চলিত দুইটি উপবিভাগ রহিয়াছে।
কথ্য উপভাষা দৈনন্দিন কথাবার্তায় এবং লেখ্য উপভাষা সাহিত্য-রচনায় ও চিঠিপত্র লেখায় ব্যবহৃত হয়। তবে কথ্য বা লেখ্য যাহাই হউক না কেন, প্রতিটি উপভাষাই সম-মর্যাদাসম্পন্ন, কোনোটিই অন্য কাহারও তুলনায় উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট নয়। সবগুলি উপভাষার কথ্য ও লেখ্য রূপের সমবায়েই ভাষার প্রকৃত রূপটি উদঘাটিত হয়।
প্রতিটি ঔপভাষিক অঞ্চলের মানুষকে তাহার নিজস্ব উপভাষার মৌখিক রূপটির পাশাপাশি লেখ্য রূপটির সহিতও পরিচিত হইতে হয়। শিক্ষার্থীরাও বিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সহিত কথ্য ভাষা-রূপটি ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে পাঠগ্রহণের সময় পাঠ্যপুস্তকের লেখ্য ভাষা-রূপটির সহিতও পরিচিত হইয়া যায়।
Home › Forums › Higher Bengali Grammar-Vamandev Chakraverty
Tagged: Bengali Grammar, Grammar