শ্রী বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীরচিত ব্রাহ্ম সঙ্গীত
বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী (১৮৪১ – ১৮৯৯)
সঙ্গীত-সুধা
কিরণচাঁদ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত
১৯১৫
Brahma Sangit of Vijaykrishna: মদীয় গুরুদেব শ্রীশ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী-জী বিরচিত সঙ্গীতাবলী একত্রে সংগৃহীত হইয়া প্রকাশিত হইল। এক সময়ে এই সঙ্গীতগুলি ব্রাহ্ম-সমাজে ও বাঙ্গালাদেশে যুগান্তর আনয়ন করিয়াছিল। ইহা গানে ও শ্রবণে কত পাপীর পাপমোচন, কত তাপীর তাপনিবারণ ও কত ভক্তের আনন্দাশ্রু-পতন হইয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই। যাঁহারা ব্রাহ্ম-সমাজের ভিতর দিয়া জীবনের পরিপূর্ণতার পথে অগ্রসর হইয়াছেন, গোস্বামী-জী বিরচিত সঙ্গীতাবলীর নিকট তাঁহারা অল্পাধিক পরিমাণে প্রায় সকলেই ঋণী। এই সহজ ও সরল ভাষায় রচিত গানগুলির মধুরতা ও মাদকতা অতুলনীয়।
ভাষার পারিপাট্য ও ভাবের গাম্ভীর্য্যের মধ্যেই সম্যক্প্রকারে সঙ্গীতের প্রাণ নিহিত নহে। নিতান্ত সাধারণ ভাষায় রচিত এমন অনেক সঙ্গীত আছে, যাহা শ্রবণমাত্র হৃদয়ের প্রতি তন্ত্রীতে কী এক সাড়া পড়িয়া যায়, এবং প্রাণের মধ্যে তুমুল তরঙ্গ উত্থিত হয়। অথচ অনেক সঙ্গীতের ভাষার বাঁধুনি ও ভাবের কাঁদুনি আমাদের প্রাণকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করিতে পারে না। সঙ্গীত মন্ত্রবিশেষ; ইহা ভগবৎ-ভজনের এক প্রধান অঙ্গ। তাই একান্ত প্রাণের কথা সহজ ও সরল ভাষায় যে সমস্ত সঙ্গীতে ধ্বনিত হইয়াছে, তাহাই আমাদের নিকটে অধিক মধুর লাগে।
গোস্বামী-জী-বিরচিত সঙ্গীতাবলী ব্রাহ্ম-সমাজের এক বিশেষ সম্পত্তি। ব্রাহ্ম-সমাজে সর্ব্বপ্রথম তিনিই সঙ্কীর্ত্তন রচনা করিয়া, খোলকরতাল সহযোগে কীর্ত্তনগানের প্রবর্ত্তন করিয়াছিলেন। তাঁহার ন্যায় মধুরকণ্ঠ গায়কও তৎকালে ব্রাহ্ম-সমাজে আর কেহ ছিল বলিয়া শুনা যায় না।
এই গানগুলি সংগ্রহ করিতে আমি সাধারণ ব্রাহ্ম-সমাজ হইতে প্রকাশিত ‘ব্রহ্ম-সঙ্গীত’ পুস্তক হইতে যথেষ্ট সাহায্য পাইয়াছি; এজন্য সমাজের কর্ত্তৃপক্ষগণের নিকট একান্ত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতেছি।
বিনীত
কিরণচাঁদ দরবেশ
বারাণসী
১ চৈত্র
১৩২১
এতদিনে পোহাইল
এতদিনে পোহাইল ভারতের দুখ-রজনী;
প্রকাশিল শুভক্ষণে নববেশে দিনমণি।
দেখে পাপেতে কাতর, সর্ব্বজনে জরজর,
পাঠালেন স্বৰ্গ-রাজ্য মুক্তিদাতা পিতা যিনি।
সেই রাজ্যে প্রবেশিতে, এস সবে আনন্দেতে
ছিন্ন করি পাপ-পাশ বীর-পরাক্রমে;
উর্দ্ধদিকে হস্ত তুলি, গাও তাঁরে সবে মিলি,
জয় জগদীশ বলি, কর সদা জয়ধ্বনি।
অমৃত সাগর বিনা
অমৃত সাগর বিনা শান্তি কোথা আছে আর?
ভুলে’ সে অমৃতে যেই, বিষয়-বিষের কুণ্ডে,
করে শান্তি অন্বেষণ, ভ্রম বুদ্ধি তার।
ওরে সন্তাপিত জীব, বৃথা কেন ভ্রমিতেছ,
কাঁদিতেছ ভবারণ্যে, হ’য়ে শান্তিহারা;
অমৃত সাগরে যাও, যাবে তাপ পাবে শান্তি,
সকলের তরে আছে মুক্ত তাঁর দ্বার।
এই দেহের এত অহঙ্কার
এই দেহের এত অহঙ্কার;
অবশ্য মরিতে হবে কিছু দিনান্তর।
হ’লে দেহ প্রাণ-হীন, কোথা রবে অভিমান,
ভূমিতে পড়িয়ে রবে হয়ে শবাকার;
পিতা মাতা বন্ধুগণ, সম্মুখে করি’ রোদন,
গাইবে তোমার গুণ করি হাহাকার।
এখন’ প্রবোধ মান, ত্যজ কুপথ-গমন,
কুৎসিত ভাবে দৰ্শন নরনারীচয়;
সর্ব্বলোক অপমান, অনাথ-অর্থ-হরণ,
পরনিন্দ পরপীড়া কর পরিহার।
সকল শূন্যময় হেরি
সকল শূন্যময় হেরি না হেরিয়ে বিভু নয়নে।
আমার হৃদয় শুকায়ে গেল হে,—এ—।
শুনেছি সাধু-সদনে, চায় যে তাঁরে,
তাঁহারে দেখিতে পায় নিজ অন্তরে;
আমি ডাকিতে পারি না মোহে, পাইব কেমনে।
প’ড়েছি অগাধ কূপে, না দেখি উপায়,
বিনা সেই করুণা-সিন্ধু প্রভু দয়াময়;
তাঁর নামের গুণে পাপী তরে, শুনেছি শ্রবণে।
প্রেম বিনা হৃদয় শুকালো
প্রেম বিনা হৃদয় শুকাল’;
আর সইতে নারি, কাতর প্রাণ, পাপেতে মন ডুবিল।
এখন যেদিকে হেরি হে দয়াময়,
দেখি প্রেমহীন শুষ্কভাব মলিন হৃদয়,
কোথাও নাইক’ সুখ, মনের দুখে ভ্রমিতেছি হ’য়ে ব্যাকুল।
তুমি ত নাথ প্রেমেরই সাগর,
এসেছি তোমার দ্বারে হইয়ে কাতর,
পূরাও পূরাও আশা, প্রেমদানে তাপিত প্রাণ কর শীতল।
দীননাথ, আমরা দীনের বেশে
দীননাথ, আমরা দীনের বেশে
এসেছি হে তোমারই দ্বারে;
শুনে তোমার দয়ার কথা,
এসেছি বড় আশা ক’রে।
প’ড়ে মোহ-অহঙ্কারে, দেখিতে না পাই তোমারে,
কোথা প্রভু দয়া ক’রে
দেখা দাও দীনের হৃদি-কুটীরে।
কারেও না দেখি সংসারে, পতিতে উদ্ধার করে,
পাপ-হৃদয় কেমন করে,
ওহে পতিত-পাবন, একবার চাও হে ফিরে।
দীনবন্ধু, এই দীনের প্রতি
দীনবন্ধু, এই দীনের প্রতি হও সদয় হে;
আমার আর কেহ নাই তোমা বিনা, এ জগৎ-মাঝারে।
আমি লইয়াছি শরণ, ওহে দীন-শরণ,
কৃপাময় কৃপা করি’ কর মোরে ত্রাণ,
আমি অতি দুর্ব্বল, (দীননাথ) নাই কোন সম্বল,
তুমি হীনবলের বল, তাই ডাকি তোমারে।
বাসনা ক’রেছি মনে
বাসনা ক’রেছি মনে দেখিব তোমায়;
তোমার করুণা বিনা না দেখি উপায় হে।
পাপে মলিন আমি দিবস যামিনী,
দয়া ক’রে ত্রাণ কর দেখি দীনহীন হে।
দয়াময় নাম তোমার শুনিয়া শ্রবণে,
ল’য়েছি শরণ পিতা, দাও দরশন হে।
পিতা গো দেখা দাও
পিতা গো দেখা দাও,
আমায় দেখা দিয়ে প্রাণে বাঁচাও।
আমি তোমারই নাথ, তোমারই চিরদিন,
তোমার দীনহীন অধম তনয়।
আমি একাকী অরণ্য-মাঝে,
আমার ভয়ে অঙ্গ অবশ হ’ল ,
ওহে কোথায় রইলে হৃদয়ের ধন
কোথা রইলে প্রাণ-সখা, দেখা দাও।
আমি আর যাব না, পিতা তোমায় ছেড়ে,
আমায় ক্ষম এবার দয়া ক’রে।
চিরদিন জ্বলিবে কি
চিরদিন জলিবে কি হৃদয়-অনল প্রভো,
কই, বিষয়-বাসনা পাপের বেদনা, এখন’ত ঘুচিল না।
দাও দরশন জুড়াই হে নয়ন,
নাহি প্রয়োজন অন্য কোন ধন,
প্রভো, তোমার চরণ অমূল্য-রতন, আমি শুনেছি হে;
দুখানলে দগ্ধ হ’ল হে জীবন,
ওহে দীননাথ, লইলাম শরণ,
দরিদ্রের দুঃখ কর হে মোচন, দরিদ্রের দুখ-হারী হে।
চেয়ে দেখ নাথ
চেয়ে দেখ নাথ, একবার এ অধম সন্তানে;
পাপে তাপে জর জর, ত্রাণ কর ছায়াদানে।
তোমা বিনা বল আর,
কে করিবে নিস্তার,
কে তারে কাতরে, ওহে কাতর-শরণ;
দয়া-গুণে ক্ষমা কর এ শরণাগত জনে।
পাপের যাতনা আর
পাপের যাতনা আর সহিতে না পারি নাথ,
হৃদয় দহিছে সদা জ্বলন্ত অনলে হে।
মনেতে প্রতিজ্ঞা করি, পাপ-পথ পরিহরি,
কেমন এ প্রবল অরি, ছাড়ে না আমায় হে;
কোথা হে দীন-শরণ, কর কর কর ত্রাণ,
দরশন দিয়ে পাপ-যাতনা ঘুচাও হে।
মলিন পঙ্কিল মনে
মলিন পঙ্কিল মনে কেমন ডাকিব তোমায়;
পারে কি তৃণ পশিতে জ্বলন্ত অনল যথায়।
তুমি পুণ্যের আধার, জ্বলন্ত অনল সম,
আমি পাপী তৃণসম, কেমনে পূজিব তোমায়।
শুনি তব নামের গুণে, তরে মহাপাপী জনে
লইতে পবিত্র নাম, কাঁপে হে মম হৃদয়।
অভ্যস্ত পাপের সেবায়, জীবন চলিয়া যায়,
কেমনে করিব আমি, পবিত্র পথ আশ্রয়।
এ পাতকী নরাধমে, তার যদি দয়াল নামে
বল ক’রে কেশে ধ’রে, দাও চরণে আশ্রয়।
ওহে জগদীশ
ওহে জগদীশ,
আমার আর কেহ নাই, তোমা বিনা এ সংসারে
আমার কেবল পাপে মতি, নাহি অন্য মতি
(ওহে) কি হইবে গতি, বল হে আমারে।
আমি দেখিতেছি সব, এই যে বৈভব
এ সকল নয় নাথ আমারি কারণ;
আমি তোমারি কারণে;—দয়াময়—
এ সংসার অরণ্যে,
(ওহে) আসিয়াছি, তোমায় পাইবার তরে।
প্রভু দয়াল
প্রভু দয়াল, সাধুমুখে আমি শুনেছি;
অকূল-পাথারে প’ড়ে ডাক্তেছি।
আমায় দিয়ে চরণ-তরী, উঠাও হে কেশে ধরি,
আমি আশা করিয়ে চেয়ে র’য়েছি।
অস্পৃশ্য পামর আমি, দয়ার ঠাকুর তুমি,
অগতির গতি প্রভো, মনে জেনেছি;
তুমি করিয়ে অধম-তারণ, নাম ধর পতিত-পাবন,
তা’ত অধম-জনা হ’তে জেনেছি।
করিতে পাপী উদ্ধার, হ’য়েছ প্রকাশ এবার,
মোর সমান পাপী প্রভো, কোথা পাবে আর;
প্রভো, যে তোমার শরণ লয়, তার দশা কি এমন হয়,
আমি পাপার্ণবেতে ডুবে র’য়েছি।
অখিল তারণ ব’লে
অখিল-তারণ বলে’ একবার ডাক তাঁরে।
একবার ডাক তাঁরে ভক্তসঙ্গে, ভাসি সবে প্রেম-তরঙ্গে,
দয়াময় দয়াময় দয়াময় বলে’।
—একবার হৃদয় খুলে —
যদি যাবে ভব-সিন্ধু পারে, ডাক তাঁরে ত্বরা করে’,
দয়াময় দয়াময় দয়াময় বলে’।
—একবার মনের সাধে —
Brahma Sangit of Vijaykrishna
Read more
Ram Mohan Roy’s letter to Lord Amherst in connection with English Education (1823)
ব্রাহ্মধর্ম্মের মত ও বিশ্বাস-দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (1869)
More Book by Vijaykrishna Goswami
- ব্রাহ্মসমাজের বর্ত্তমান অবস্থা এবং আমার জীবনে ব্রাহ্মসমাজের পরীক্ষিত বিষয় (১৮৭২)
- যোগ-সাধন (১৮৮৬)