
শ্রীল-ভক্তিরক্ষক-শ্রীধর-দেবগোস্বামি
Contents
श्रीशरणा गति
श्रीमद भक्ति रक्षक श्रीधर गोस्वामी
শ্রীশরণাগতি-श्रीशरणा गति
ভগবদ্ভক্তিতঃ সর্ব্বমিত্যুৎসৃজ্য বিধেরপি ।
কৈঙ্কর্য্যং কৃষ্ণপাদৈকাশ্রয়ত্বং শরণাগতিঃ ॥
এই শ্লোকটি শ্রীপ্রপন্নজীবনামৃতের । শরণাগতি বিষয়ক সর্ব্ব-শাস্ত্র পর্য্যালোচনা করে শরণাগতি কাকে বলে—তা বলা হয়েছে । ভগবানের ভক্তিতেই সর্ব্বার্থসিদ্ধি হয়, এই দৃঢ় বিশ্বাসে বিধাতার কৈঙ্কর্য্য পর্য্যন্ত বাদ দিয়ে একান্তভাবে কৃষ্ণপাদপদ্মাশ্রয়কেই বলে—শরণাগতি । ভাগবতেও আছে—
আজ্ঞায়ৈবং গুণান্ দোষান্ ময়াদিষ্টানপি স্বকান্ ।
ধর্ম্মান্ সংত্যজ্য যঃ সর্ব্বান্ মাং ভজেৎ স চ সত্তমঃ ॥
সুতরাং “স্বজনম্ আর্য্যপথঞ্চ হিত্বা” । আর্য্যপথ পরিত্যাগ বড় সোজা ব্যাপার নয় । “উৎসৃজ্য বিধেরপি কৈঙ্কর্য্যং”—বিধাতার কৈঙ্কর্য্য বলতে বেদস্বরূপ যে ব্রহ্মা, তাঁরও আইনের গণ্ডীর বাইরে চলে যাচ্ছে । প্রকৃত কৃষ্ণপাদৈকাশ্রয়ত্ব একে বলে । অতএব শরণাগতি একটা কল্পনা নয় । এত বড় জিনিষ, যে কিছু পেয়েছে তার কাছে সবই তুচ্ছ হয়ে যায় । এমন জিনিষ আছে । সে জিনিষের সন্ধান যারা পায় তারা পরমার্থ ভাণ্ডারের চাবিকাঠি নিয়ে বাস করে ।
শ্রীশুকদেব বলেছেন—“এতাবান্ সাংখ্য যোগাভ্যাং স্বধর্ম্ম পরিনিষ্ঠয়া । জন্মলাভঃ পরঃ পুংসাং অন্তে নারায়ণঃ স্মৃতিঃ ।” কি জিনিষ নিয়ে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছ তোমরা ? চাবিতো আমার হাতে । সাংখ্য, যোগ, স্বধর্ম্মপালন, নিষ্কামভাবে বৈদিক কার্য্যের অনুষ্ঠান এসবের দৌড় তো ঐ চিত্তশুদ্ধি পর্য্যন্ত, কিন্তু ‘জন্মলাভঃ পরঃ পুংসাং’ অর্থাৎ হায়ার ফুল ফিল্মেন্ট অফ্ লাইফ্—‘অন্তে নারায়ণঃ স্মৃতিঃ’ । সুতরাং আমরা উপলদ্ধি করতে পারি যে চরমে সেই তিনিই মালিক । শ্রীভগবান বলেছেন—
তস্মাৎ তমুদ্ধবোৎসৃজ্য চোদনাং প্রতিচোদনাং ।
প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ শ্রোতব্যং শ্রুতমেব চ ॥
অর্থাৎ বেদ এবং তার থেকে পুরাণ, স্মৃতিশাস্ত্র প্রভৃতিতে যা কিছু বহিরঙ্গ উপদেশ, বিধি নিষেধ দেওয়া হয়েছে সেই গুলিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে হবে, কেননা বেদের মূল অভীষ্ট পরতত্ত্ব হলেন ভগবান, তাঁর পাদপদ্মে শরণ গ্রহণ করতে বলাই বেদের চরম তাৎপর্য্য ।
বেদ মানে উপদেশ । বেদ হচ্ছে কোন যুক্তির অপেক্ষা করে না এমন সব উপদেশ । ছোট ছেলেকে যেমন প্রয়োজন মত, তার মঙ্গলমত পরিচালনা করে অভিভাবক ; আমি যা বলছি তাই কর ; ডাইরেক্ট অর্ডার । এই হল বেদের লক্ষণ । বেদ হুকুম করবে, কোন যুক্তি দেবে না । পুরাণ বন্ধুভাবে বলবে, অন্যান্য শাস্ত্র তারা যুক্তি দেবে । কিন্তু বেদ বলবে এটা কর, ওটা কর । তোমাকে বুঝতে হবে না । তুমি কতটুকু বুঝবে । ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক তোমার ।
প্রভুপাদ বলতেন—পাপী ব্রেন, কুকুরের ছানার মাথা । এই অনন্তের এক কণাও তোমার ঐ মাথায় ধরবে না । ‘চোদনাং’ মানে সেই বেদকে পর্য্যন্ত উৎসৃজ্য । ‘প্রতিচোদনাং’ মানে বেদ থেকে নিয়ে মনু প্রভৃতির বিচার যে লোকরঞ্জনের দোকান, সে সবও বাদ দাও । ‘প্রবৃত্তিঞ্চ’ ‘নিবৃত্তিঞ্চ’ মানে প্রবৃত্তি মার্গের যত কথা আছে ; এবং নিবৃত্তি মার্গের যত কথা আছে ; অর্থাৎ ভোগ এবং ত্যাগ রাজ্যের যত কথা আছে সব উৎসৃজ্য । ‘শ্রোতব্যং’ মানে ভবিষ্যতে অনেক শুনতে বাকী আছে ; এখনো সব ভালভাবে আবিষ্কারই হয় নাই ; প্রগতির যুগ এগিয়ে যাচ্ছে, শুনতে এখনো অনেক বাকী । ‘শ্রুতমেব চ’ মানে অতীতে যা শোনা হয়ে গেছে, সে সব এখন লুপ্ত । অর্থাৎ অতীতে অনেক কিছু বড় বড় ছিল, কিন্তু এই সব কিছুকেই সম্যক রূপে পরিত্যাগ করে—
‘মামেকমেব শরণং আত্মানং সর্ব্বদেহিনাম্’
একমাত্র আমার শরণ গ্রহণ কর । একটা কৈফিয়ৎ কেবল আমি দিচ্ছি, কি ? না ‘আত্মানং সর্ব্বদেহিনাং’ সমস্ত দেহিগণের আত্মা । ‘আত্মার আত্মা হন কৃষ্ণ সর্ব্ব অবতংস ।” ‘ময়ি সর্ব্বগুহাশয়ে ।’ পার্টি একমাত্র আমিই । আমিই একমাত্র ভোক্তা । আর সব ভোগ্য । অর্থাৎ যখন অন্তর দিয়ে বোঝা যাবে ভোক্তা কেবল তিনিই, অচ্যুতেরই সব, আমরা সব শক্তির পরিবার । চ্যুত অভিমানের পাল্লায় দুদিনের মালিকানা এ শুধু খোসার আত্মাভিমান । জগতের কোন জিনিষের মালিক কেউ নয় । আমার যেমন দেহ, চোখ, কান, নাক, ইন্দ্রিয়গুলি, মন, বুদ্ধি প্রভৃতির মালিক বসে আত্মা, সেই প্রকার আত্মার ভেতর বসে আছেন তিনি—মালিক পরমাত্মা । আমরা সব ‘সুপারভিসিএ্যাল এক্সজিষ্টেন্স’(superficial existence)—সব খোসার দল । এই বিচার দৃঢ় হলে শরণাগতির আওতায় গিয়ে পড়বো । শাস্ত্রীয় সর্ব্বপ্রকার বিধি নিষেধের চাবিটি তখন হাতে এসে যাবে ।
তখন শরণাগতি ‘মামেকমেব শরণং’ ‘যাহি সর্ব্বাত্ম ভাবেন ।’ সর্ব্বপ্রকারে—কায়, মন, বুদ্ধি, বাক্য—যা কিছু আছে সব দিয়ে, সব নিয়ে শরণাগত হও । এই হল শরণাগতি । হে উদ্ধব ! তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয়, তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নাই, আমার আত্মা পর্য্যন্ত সব কিছুই তোমার । তাই তোমায় আমার এই চাবি কাঠিটি দিয়ে দিলাম । গীতায় অর্জ্জুনকে ঐ প্রকার বলেছেন, “প্রতিজানে প্রিয়োঽসি মে” লোকে বোঝে না, বললেও বুঝবে না, আসল কথাটা হচ্ছে আমিই সব । রকমারী মনোহারী বাক্য-প্রদর্শনী, ধর্ম্ম, কর্ম্ম যেখানে যা কিছু দেখছ, সব শো বটল্ । তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় । তাই তোমাকে প্রতিজ্ঞা করে এই নগ্ন সত্যটা বলছি যে আমিই সব । আমার তৃপ্তি বিধানই হচ্ছে একমাত্র করণীয় একে বলে অদ্বয়জ্ঞান ।
‘ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশতঃ স্যাদীশাদপেতস্য’—এখান হতে চ্যুত হয়ে ধর্ম্ম কর, কর্ম্ম কর, জপ কর, যোগ কর, ত্যাগ কর,—যেমন “মুনয়োঃ বাতরসনা শ্রমণা উর্দ্ধমন্থিনঃ” ইত্যাদি যাই কর কিছু সুবিধা হবে না । পয়ঃ পানকারী ব্রহ্মচারীকে মহাপ্রভু বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছেন । প্রহ্লাদও বলেছেন “নিগমস্য সারম”—যেখানে যা কিছু ধর্ম্মের কথা আছে সব ‘স্বাত্মার্পণং’ সব আত্ম-নিবেদনেই সার্থক । নিজেকে নিবেদন করাই হল যাবতীয় ধর্ম্মের সারকথা । ‘আমি তো তোমার তুমি তো আমার’ এর উপর যা কিছু সাজসজ্জা—সবই সুন্দর । সুতরাং যে সেটি বুঝতে পারল তার আর ভয় কি ? তার দুনিয়াদারী, তার অভিমান সব খসে গেল । ‘তৎপরত্বেন নির্ম্মলম’ একটাই অস্ত্র । ‘শ্রীকৃষ্ণপ্রীতিকামঃ’ । ‘প্রপার্টি বিলংস টু কৃষ্ণ’ । দুর্গা পূজাই কর, কালীপূজাই কর, সংকল্প করে যা কিছুই কর না কেন চরমে সেই “কৃতৈতৎ কর্ম্মফলং শ্রীকৃষ্ণায় সমর্পিতমস্তু” ।
মূল লক্ষ সেই একে গিয়ে শেষ । যতদিন সাধন চেষ্টাপর রয়েছে ততদিন তা আচারে থাকে, সিদ্ধ হয়ে গেলে অন্তরে গাঁথা হয়ে যায় । অন্য কোন বিচার সেখানে আসর করতে পারে না । কর্ম্ম, জ্ঞান, যোগ, তপ, পূজা, অর্চা সমস্তের শুদ্ধি বিধানের লিঙ্ক ঐখানে । আগ্নেয়গিরির ধূম যতদূরেই দেখ না কেন, আগুন থাকে তার গর্ভে ।
‘স বৈ পূংসাং পরোধর্ম্মো যতো ভক্তিরধোক্ষজে’
“শ্রদ্ধা শব্দে বিশ্বাস কহে সুদৃঢ় নিশ্চয় ।
কৃষ্ণে ভক্তি কৈলে সর্ব্ব কর্ম্ম কৃত হয় ॥”
অতএব “মর্ত্যো যদা ত্যক্তঃ সমস্ত কর্ম্মা নিবেদিতাত্মা বিচিকীর্ষিতো মে, তদামৃতত্বৎ প্রতিপদ্য মানো মমাত্মভূয়ায় চ কল্পতে বৈ ।” এই “আত্মভূয়ায়’ মানে হচ্ছে—
“দীক্ষা কালে ভক্ত করে আত্মসমর্পণ ।
সেই কালে কৃষ্ণ তারে করে আত্ম-সম ॥
সেই দেহ করে তার চিদানন্দময় ।
অপ্রাকৃত দেহে কৃষ্ণের চরণ ভজয় ॥”
কৃষ্ণভজন ব্যতীত অন্য কোন কৃত্য নাই । চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চব্বিশ ঘণ্টাই তাঁর পাওনা । একটু বিস্মৃতি এলেই ভক্তের কাছে যেন প্রলয় হয়ে যাবে । একটু স্মৃতির এদিক ওদিক হলেই চমকে উঠবে—কি করছি ? তাঁর সেবা ভুলে আছি ? সময়কে কৃপণের ধনের মত আগলে রাখে । যেন ব্যর্থ না যায় । পুঁজি কমলেই সর্ব্বনাশ । শরণাগতির ডিগ্রি অনুসারে নিবেদিতাত্মার ডিগ্রিও বেড়ে যায় । ‘ক্ষান্তিরব্যর্থকালত্বং’ এই ভাব লক্ষণে প্রতিষ্ঠিত হয় ।
পরাৎপরতত্ত্বের—লীলাকল্লোলবারিধি ভগবানের ঔদার্য্য ও মাধুর্য্য-পরসেবা-বৈচিত্র্যসম্ভার এই শরণাগতির ভিত্তির উপরই যথাযোগ্যভাবে আত্মপ্রকাশ করেন ।
সেই শরণাগতির চরমপ্রকাশে দেখা যায়, “কৃষ্ণভক্তিরসভাবিতামতিঃ” অতি সুদুষ্প্রাপ্য জিনিষ । ও কোথাও পাওয়া যায় না । অমূল্যধন কোটী কোটী জন্মের সুকৃতি দিয়েও কেনা যায় না । একমাত্র প্রকৃত রসবোধ—একমাত্র লৌল্যই প্রাপ্তির কারণ । যে পেয়েছে, তার সবকিছু প্রাপ্তি হয়ে গেছে । ‘রসভাবিতামতিঃ’ রসিকশেখর তার সব কিছু হরণ করে নিয়েছেন ।
“চিত্ত কাড়ি’ তোমা হইতে বিষয়ে চাহি লাগাইতে
যত্ন করি নারি কাড়িবারে ।”
এ অতি অমূল্যনিধি । একি সহজে হয় ! ‘ন বৈ বিদুঃ ঋষয়ো নাপিদেবাঃ’ । বড় বড় ঋষি—রিসার্চ্চস্কলার তাঁর কোন পাত্তাই পায় না । এই প্রকার ভক্তের চেষ্টা অলৌকিক । সমাজ তাঁকে পেয়ে ধন্য ।
এবং ব্রতঃ স্বপ্রিয়নামকীর্ত্ত্যা
জাতানুরাগো দ্রুতচিত্ত উচ্চৈঃ ।
হসত্যথো রোদিতি রৌতি গায়-
ত্যুন্মাদবন্নৃত্যতি লোকবাহ্যঃ ॥
এই নব প্রীত্যঙ্কুর যার চিত্তে হয় ।
প্রাকৃত ক্ষোভেও তার ক্ষোভ নাহি হয় ॥
শ্রীমন্মহাপ্রভু এই রসভাণ্ডারের সন্ধান নিয়ে জীবজগতের ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন—
“যদি গৌর না হইত তবে কি হইত
কেমনে ধরিতাম দে ।
রাধার মহিমা প্রেম-রসসীমা
জগতে জানাত কে ?
মধুর বৃন্দা বিপিন-মাধুরী
প্রবেশ চাতুরী সার ।
বরজ-যুবতী ভাবের ভকতি
শকতি হইত কার ॥”
“ শিব বিরিঞ্চি বাঞ্ছিত ধন
জগতে ফেলিল ঢালি ।
কাঙ্গালে পাইয়া খাইল লুটিয়া
বাজাইয়া করতালি ”
নিতাই গৌরহরি বোল ।
SOURCE: শ্রীভক্তিরক্ষক হরিকথামৃত- Sridhar Deva Goswami