মহাভারত of Vyasa
কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত
মহাভারতমাহাত্ম্য – বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! কৃষ্ণদ্বৈপায়নপ্রোক্ত এই পবিত্র উপাখ্যান অতি বিস্তীর্ণ, অতএব ইহা শ্রবণ করিবার সময় নির্দ্দেশ করুন, আমি আপনার নিকট উহা সবিস্তার কীর্ত্তন করিব। সত্যবতীপুৎত্র ভগবান্ ব্যাদেব এই গ্রন্থে একলক্ষ শ্লোক রচনা করিয়াছেন। যে-সকল ব্যক্তি উহা শ্রবণ করাইবেন এবং যাঁহারা শ্রদ্ধা ও ভক্তিসহকারে শ্রবণ করিবেন, তাঁহারা ব্রহ্মলোকে গমন করিয়া দেবতুল্য হইবেন। বেদব্যাস-প্রণীত এই পরমপবিত্র রমণীয় ইতিহাস সাক্ষাৎ বেদস্বরূপ। মহর্ষিগণ এই মহাভারতের যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া থাকেন। ইহাতে অর্থ ও কামবিষয়ক অশেষ উপদেশ প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং এতৎশ্রবণে পরিনিষ্ঠাবতী [আস্তিক্যযুক্তা —নির্ম্মলা] বুদ্ধি জন্মে। বিদ্বান্ ব্যক্তিরা দানশীল, সত্যস্বভাব, ধর্ম্মপরায়ণ ও অকৃপণ ব্যক্তিদিগকে মহাভারত শ্রবণ করাইয়া প্রচুর অর্থলাভ করেন, শ্রোতা অতিনিষ্ঠুর হইলেও এই অপূর্ব্ব ইতিহাস শ্রবণে রাহু হইতে মুক্ত চন্দ্রের ন্যায়, ভ্রূণহত্যাদি মহাপাতক হইতেও আশু বিমুক্ত হইতে পারে। বিজিগীযু [জয়াকাঙ্ক্ষী] ব্যক্তিদিগের এই জয়খ্য ইতিহাস শ্রবণ করা কর্ত্তব্য। রাজারা ইহা শ্রবণ করিলে রাজ্যলাভ ও শত্রুপরাজয় করিতে পারেন। যদি কোন যুবা রাজমহিষীর সহিত এই পুৎত্রফলপ্রদ পরম-স্বস্ত্যয়নস্বরূপ মহাভারত শ্রবণ করেন, তাহা হইলে তাঁহাদিগের বীরপুৎত্র বা রাজ্যভাগিনী কন্যা জন্মে। মহর্ষি বেদব্যাস রচিত এই মহাভারতই পবিত্র ধর্ম্মশাস্ত্র; অর্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র, এক ব্যক্তি বক্তা ও অন্যে ইহার শ্রোতা হয়েন। শ্রোতাদিগের পুৎত্র-পৌৎত্রেরও শুশ্রূষাপরায়ণ এবং ভূত্যেরাও প্রভুপরায়ণ হইয়া থাকে। যে-নর মহাভারত শ্রবণ করেন, তিনি কায়িক, বাচিক ও মানসিক ত্রিবিধ পাপরাশি হইতে বিমুক্ত হয়েন। যাঁহারা বিদ্বেষ বুদ্ধিশূন্য হইয়া এই ভারতবংশীয় ইতিবৃত্ত শ্রবণ করেন, তাঁহাদিগের ব্যাধিভয় ও পরলোকভয় নিবারণ হয়। বেদব্যাস স্বগ্রন্থে সর্ব্ববিদ্যা পারদর্শী মহাপ্রভাবশালী পাণ্ডবদিগের ও অন্যান্য রাজর্ষিদিগের কীর্ত্তী বিস্তার করিয়াছেন। ইহা অতি বিচিত্র ও পবিত্র, শ্রবণ করিলে শ্রোত্রযুগল চরিতার্থ হয়। যে মানব জীবলোকে পূণ্যসঞ্চয় করিবার মানসে সদাচারপরায়ণ ব্রাহ্মণগণকে ইহা শ্রবণ করান, তিনি সনাতন-ধর্ম্ম লাভ করেন। যিনি অতি পূতমনে সর্ব্বলোকপ্রখ্যাত এই কুরুবংশীয় ইতিহাস কীর্ত্তন করেন, তাঁহার বংশপরম্পরা ক্রমশঃ বিস্তার হইতে থাকে। যদি বেদপারগ ব্রাহ্মণ ব্রতানুষ্ঠানপরতন্ত্র হইয়া চারি বৎসর ও চারি মাস মহাভারত অধ্যয়ন করেন, তিনি সকল পাপ হইতে মুক্ত হইতে পারেন। এই মহাভারতে দেবতা, রাজর্ষি ও ব্রহ্মর্ষিদিগের বিষয় বর্ণিত ও ভগবান্ বাসুদেবের সুচরিত কীর্ত্তিত আছে। ইহাতে ভগবান্ ভূতভাবন ভবানীপতি দেবী পার্ব্বতীর অনির্ব্বচনীয় মহিমা এবং কার্ত্তিকেয়ের উৎপত্তি ও গোব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে। এই মহাভারত নিখিল বেদের সমষ্টিস্বরূপ। অতএব ধর্ম্মবুদ্ধি লোকদিগের ইহা সর্ব্বদা শ্রবণ করা কর্ত্তব্য। যিনি প্রতি পর্ব্বাহে ব্রাহ্মণগণকে মহাভারত শ্রবণ করান, তাঁহার পাপনাশ ও নিত্যকাল ব্রহ্মলোকে বাস হয়। শ্রাদ্ধকালে ব্রাহ্মণদিগকে ভারতের অন্ততঃ এক চরণমাত্রও শ্রবণ করাইলে পিতৃলোক অক্ষয় অন্নপানে পরিতৃপ্ত হয়েন। মন ও ইন্দ্রিয় দ্বারা অহোরাত্রে জ্ঞানাজ্ঞানকৃত যে-সকল পাপ সঞ্চিত হয়, মহাভারত শ্রবণ করিলে তাহা তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়। এই গ্রন্থে ভারতবংশীয় রাজাদিগের মহাবংশ বর্ণিত আছে বলিয়া ইহার নাম মহাভারত হইয়াছে। যিনি এই মহাভারতের সমুদয় সিদ্ধান্ত স্থির করিতে পারেন, তাঁহার সকল পাপ অপগত হয়। এই অদ্ভুত ইতিহাস শ্রবণ করাইলে শ্রোতা মহাপাতক হইতে পরিত্রাণ পায়। মহর্যি ব্যাস প্রতিদিন প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনানন্তর নিয়মিত তপোজপাদির অব্যাঘাতে [অবিঘ্নে] তিন বৎসরে এই মহাভারত রচনা করেন, অতএব নিয়মবিশিষ্ট হইয়া ইহা শ্রবণ করা কর্ত্তব্য। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রোক্ত এই অপূর্ব্ব মহাভারতীয় কথা যিনি শ্রবণ করান ও যাঁহারা ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে শ্রবণ করেন, তাঁহাদিগকে জন্মমৃত্যুরূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকিয়া আর পাপ-পুণ্যের ফলভোগ করিতে হয় না। যে-নর ধর্ম্মকামনায় এই ইতিহাসের আদ্যোপান্ত সমুদয় শ্রবণ করেন, তাঁহার সকল বাসনা সফল হয় ও তিনি চরমে দেবলোকে গমন করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করেন। সমুদ্র ও মহাগিরি সুমেরু যেমন রত্নাকর বলিয়া প্রসিদ্ধ, সেইরূপ বহুবিধ সুচারু শব্দে অলঙ্কৃত এই রমণীয়তর মহাভারতও এক অত্যুৎকৃষ্ট ইতিহাস বলিয়া প্রসিদ্ধ। যে ব্যক্তি অর্থীদিগকে এই শ্রবণ-সুখকর মহাভারত প্রদান করেন, তাঁহার সসাগরা পৃথ্বীদানের ফললাভ হয়। মহারাজ! পুণ্যসঞ্চয় ও বিজয়লাভের নিমিত্ত এই অদ্ভুত কথা শ্রবণ করেন। এই মহাভারতে যাহা বর্ণিত আছে, তাহা অন্যত্রও থাকিতে পারে, কিন্তু ইহাতে যাহা নাই, তাহা আর কুত্রাপি দেখিতে পাইবেন না।
নর নারায়ণ ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।
০১.আদিপর্ব
০২.সভাপর্ব
০৩.বনপর্ব
০৪.বিরাটপর্ব
০৫.উদ্যোগপর্ব
০৬.ভীষ্মপর্ব
০৭.দ্রোণপর্ব
০৮.কর্ণপর্ব
০৯. শল্যপর্ব
১০.শৌপ্তিকপর্ব
১১.স্ত্রীপর্ব
১২.শান্তিপর্ব
১৩.অনুশাসনপর্ব
১৪.অশ্বমেধপর্ব
১৫.আশ্রমবাসিকপর্ব
১৬.মৌসলপর্ব
১৭.মহাপ্রস্থানিকপর্ব
১৮.স্বর্গারোহণপর্ব
মহাভারতের সংক্ষিপ্তসার
কুরুবংশীয়দিগের ইতিবৃত্ত, গান্ধারীর ধর্ম্মশীলতা, বিদুরের বুদ্ধি, কুন্তীর ধৈর্য্য, বাসুদেবের [কৃষ্ণ] মাহাত্ম্য, পাণ্ডবদিগের সরলতা, ধার্ত্তরাষ্ট্রদিগের দুর্ব্বৃত্ততা, স্বগ্রন্থে দ্বৈপায়ন এই সকল অবিকল বর্ণন করিয়া গিয়াছেন। ভরতসংহিতা প্রথমতঃ চতুর্ব্বিংশতিসহস্র (24000) শ্লোকে বিরচিত হয়। তাহাতে উপাখ্যানভাগ এককালে পরিত্যক্ত হইয়াছিল। পরিশেষে মহর্ষি সার্দ্ধশতশ্লোকময়ী অনুক্রমণিকায় ভারতীয় নিখিল বৃত্তান্তের সার সঙ্কলন করিলেন।
বেদব্যাসএই মহাভারত প্রস্তুত করিয়াই সর্ব্বাগ্রে স্বীয়পুত্র শুকদেবকে অধ্যয়ন করান। পরে অনুরূপ শিষ্যমণ্ডলীতে তাহা বিতরণ করেন। অনন্তর ষষ্টিলক্ষশ্লোকাত্মক অন্য এক ভারতসংহিতা রচনা করিয়াছিলেন। ঐ ষষ্টিলক্ষের মধ্যে ত্রিংশৎলক্ষ দেবলোকে, পিতৃলোকে পঞ্চদশ, গন্ধর্বলোকে চতুর্দ্দশ এবং নরলোকে একশত সহস্র শ্লোক(100000) অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে। নারদ দেবলোকে মহাভারত সুপ্রচার করেন। অসিত ও দেবল পিতৃলোকে ও শুকদেব গন্ধর্ব্ব, যক্ষ ও রাক্ষসদিগকে শ্রবণ করান এবং ব্যাসদেবের শিষ্য বৈশম্পায়ন মনুষ্যলোকে ভারত কীর্ত্তন করেন। হে ঋষিগণ! এক্ষণে আমি আপনাদিগের সমক্ষে তাহাই কীর্ত্তন করিব।
বক্ষ্যমাণ মহাভারতের দুর্য্যোধন ক্রোধময় মহাবৃক্ষ, কর্ণ তাহার স্কন্ধ, শকুনি শাখাস্বরূপ, দুঃশাসন ফল ও পুষ্প, মনস্বী [‘ধৃতরাষ্ট্রোন্মনীষী।’ ধৃতরাষ্ট্র অমনীষী– মনস্বিতাশূন্য অর্থাৎ অস্থিরমতি। একপক্ষ নানা ত্রুটিযুক্ত ও অপরপক্ষ সর্ব্বদোষমুক্ত – এই দুইটি ভাবই ইহাতে প্রদর্শিত।] রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাহার মূল। যুধিষ্ঠির ধর্ম্মময় মহাবৃক্ষ অর্জ্জুন স্কন্ধ, ভীমসেন তাহার শাখা, মাদ্রীসূত নকুল-সহদেব তাহার পুষ্প ও ফল এবং কৃষ্ণ, ব্রহ্ম ও ব্রাহ্মণগণ তাহার মূল।
রাজা পাণ্ডু বুদ্ধি ও বিক্রমপ্রভাবে নানাদেশ অধিকার করিয়া অবশেষে বনবাসী ঋষিদিগের সহিত অরণ্যে মৃগয়ারস-পরবশ হইয়া কালযাপন করিতে লাগিলেন। একদা মৃগয়াকালে সম্ভোগাসক্ত একটি মৃগকে লক্ষ্য করিয়া শরক্ষেপ করিলে ঐ মৃগ মৃত্যুকালে তাঁহাকে এইরূপে অভিসম্পাত দিল, –”মহারাজ! আপনি সম্ভোগ সময়ে যেমন আমার প্রাণসংহার করিলেন, তাদৃশ আপনিও অতঃপর সম্ভোগসুখ অনুভব করিতে পারিবেন না; তাহা হইলে নিশ্চয়ই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইবেন।” সুতরাং তদবধি অনপত্যতা [সন্তানহীনতা] নিবন্ধন তিনি অত্যন্ত বিপদে আক্রান্ত হইলেন। অগত্যা ধর্ম্ম, বায়ু, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারের ঔরসে পাণ্ডবদিগের জন্মলাভ হইল। কুন্তী ও মাদ্রী ঋষিদিগের সেই পরম পবিত্র আশ্রমে পাণ্ডবগণকে লালন-পালন করিতে লাগিলেন। অনন্তর ঋষিরা জটাবল্কলধারী পাণ্ডবগণকে রাজধানীতে ধৃতরাষ্ট্রাদির নিকটে উপনীত করিয়া কহিলেন, ইহারা পাণ্ডুপুৎত্র; অরণ্যে আমাদিগের প্রযত্নে রক্ষিত ও পরিবর্দ্ধিত হইয়াছে। ইহারা আপনাদিগের পুৎত্র, মিত্র, শিষ্য, সুহৃৎ ও ভ্রাতাস্বরূপ।” এই বলিয়া ঋষিরা সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। তাঁহারা পঞ্চপাণ্ডবকে এইরূপে সকলের পরিচিত করিয়া অন্তর্হিত হইলে কৌরব ও পুরবাসিগণ সহর্ষে সকলেই মহা কোলাহল করিতে লাগিল। তন্মধ্যে কেহ কহিল, ‘ইহারা তাঁহার সন্তান নহে।’ কেহ কেহ কহিল, ‘তাঁহারই বটে।’ কেহ কেহ বলিল, বহুকাল হইল, পাণ্ডু রাজা লোকান্তরিত হইয়াছেন; সুতরাং ইহারা তাঁহার পুৎত্র, ইহাই বা কি প্রকারে সম্ভবপর হইতে পারে? যাহা হউক, ভাগ্যক্রমে আমরা অদ্য পাণ্ডুরাজের সন্ততি দেখিলাম।’ এইরূপ কথাই সকল স্থানে লোকের মুখ হইতে নির্গত হইতে লাগিল। ঐ কোলাহল নিবৃত্ত হইলে আকাশবাণী হইল; পুষ্পবর্ষণসহকারে সুগন্ধ সমীরণ সঞ্চারণ করিতে লাগিল। ফলতঃ পাণ্ডুপুৎত্রদিগের নগরপ্রবেশকালে এই সকল শুভলক্ষণ স্পষ্টই লক্ষিত হয়। পুরবাসিগণ এই সকল অদ্ভুত ব্যাপার দেখিয়া অতিশয় হর্ষ প্রকাশ করিতে লাগিল।
অনন্তর পাণ্ডবেরা নিখিল বেদ ও বিবিধ শাস্ত্র অধ্যয়নকরতঃ পূজিত ও প্রশংসিত হইয়া অকুতোভয়ে তথায় বাস করিতে লাগিলেন। যুধিষ্ঠিরের বিশুদ্ধ আচার ও ব্যবহারে, ভীমসেনের ধৈর্য্যে, অর্জ্জুনের বিক্রমে, কুন্তীর গুরুশুশ্রূষায়, নকুল ও সহদেবের বিনয় ও শৌর্য্যগুণে প্রকৃতিরা [প্রজাগণ] অতি প্রীত ও প্রসন্ন হইয়াছিল। অনন্তর অর্জ্জুন সমাগত সমস্ত ভূপালসম্মুখে অতি অদ্ভুত ব্যাপার সমাধান করিয়া স্বয়ংবরা কন্যা দ্রৌপদীকে আনয়ন করিলেন। তদবধি অর্জ্জুন সকল ধনুর্দ্ধারীদিগের মধ্যে পূজ্য হইলেন এবং সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলে প্রচণ্ড দিবাকরের ন্যায় নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য হইতেন; কেহই তাঁহার দুর্ব্বিষহ বীর্য্য সহ্য করিতে পারত না। মহাবীর অর্জ্জুন নিজভুজবলে সমস্ত ভূপতিদিগকে পরাজয় করিয়া যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়-যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন।
অনন্তর যুধিষ্ঠির বাসুদেবের [কৃষ্ণ] সৎপরামর্শে, ভীমসেন ও অর্জ্জুনের বাহুবলে দুর্দ্দান্ত জরাসন্ধ ও শ্রীকৃষ্ণ কর্ত্তৃক পরাক্রান্ত শিশুপালের বধসাধন করিয়া দীনদুঃখীদিগকে অন্নদান ও যজ্ঞান্তে ব্রাহ্মণগণকে দক্ষিণা-দান করিয়া নিরাপদে রাজসূয় মহাযজ্ঞ সমাপন করিলেন। দেশ-দেশান্তর হইতে পাণ্ডবদিগের নিকট মণি, কাঞ্চন, গো, হস্তী, অশ্ব, বিচিত্র বসন, কম্বল, প্রাবার [উত্তরীয় বস্ত্র], আবরণ ও আস্তারণ রাশি রাশি এই সকল উপঢৌকন আসিতে লাগিল। তখন পাণ্ডবদিগের অপেক্ষাকৃত উন্নতি ও সম্পত্তি দেখিয়া দুর্ম্মতি দুর্য্যোধনের মনোমধ্যে অত্যন্ত ঈর্ষা জন্মিল। বিশেষতঃ ময়দানব-নির্ম্মিত পরমাশ্চর্য্য সভা দেখিয়া তিনি যথোচিত পরিতাপ পাইলেন। সভাপ্রবেশকালে জলে স্থল ও স্থলে জলভ্রম হইলে বাসুদেবের সমক্ষে দুর্য্যোধন নিতান্ত নীচের ন্যায় ভীম-কর্তৃক উপহসিত ও অপমানিত হওয়াতে অশেষভোগসুখসম্পন্ন হইলেও দিন দিন বিবর্ণ, কৃশ ও শ্রীভ্রষ্ট হইতে লাগিলেন। পুৎত্রবৎসল ধৃতরাষ্ট্র দুর্য্যোধনের অভিমত অবগত হইয়া তাঁহার মনোদুঃখ দূর করিবার নিমিত্ত দ্যূতক্রীড়ার অনুজ্ঞা দিয়াছেন। ইহা শুনিয়া শ্রীকৃষ্ণের অন্তঃকরণে ক্রোধের সঞ্চার হইল। তাহাতে তিনি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইলেও বিবাদের অনুমোদন করিয়া দ্যূত প্রভৃতি দুর্নীতির উপেক্ষা করিলেন, তাহা নিবারণ করিবার কোনও উপায় অবধারণ করিলেন না। সুতরাং বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্যের অনভিমতে ক্ষত্রিয়বংশ ধ্বংস হইল।
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদিগের বিজয়বার্ত্তা শ্রবণ ও দুর্য্যোধন, কর্ণ ও শকুনির অভিমত বিষয় স্মরণ করিয়া সঞ্জয়কে কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমি তোমাকে সমুদয় কহিতেছি, শ্রবণ কর। কিন্তু আমার কথা শুনিয়া সহসা অসূয়াপরবশ হইও না। দেখ, আমার জ্ঞাতিবিবাদে সম্মতি নাই এবং সমক্ষে কুলক্ষয় হয়, আমি তাহাতেও প্রীত নহি। আমার পুৎত্র এবং পাণ্ডুর পুৎত্র বলিয়া অদ্যাবধি উভয়পক্ষে কোনরূপ বিভিন্নভাব প্রদর্শন করি নাই। তথাপি পুৎত্রেরা ক্রোধপরায়ণ হইয়া বৃদ্ধ বলিয়া আমাকে ঘৃণা ও অবজ্ঞা করে। আমি অন্ধ, সুতরাং পুৎত্রবৎসলতাবশতঃ সকলই সহ্য করিয়া থাকি। দুর্য্যোধন বিমহিত হইলে আমিও মোহে অভিভূত হই। দুর্য্যোধন মহানুভব পাণ্ডবদিগের রাজসূয়যজ্ঞে তাদৃশ সমৃদ্ধি দেখিয়া এবং সভাপ্রবেশকালে সেইরূপ উপহসিত হইয়া রুষ্ট ও অসন্তুষ্ট হইল। ক্ষৎত্রিয়কুলে জন্মগ্রহণ করিয়া রণস্থলে পাণ্ডবাদিকে জয় করিতে অক্ষম ও সমস্ত রাজ্য-সম্পত্তি আত্মসাৎ করিতে পরান্মুখ হইয়া পরিশেষে গান্ধাররাজের পরামর্শ গ্রহণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের সহিত কপট দ্যূতক্রীড়া করিয়া সাম্রাজ্য অধিকার করিবার কল্পনা করিল। হে সঞ্জয়! আমি সে বিষয়ের যাহা কিছু জানি, তাহা অবিকল কহিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি গুণজ্ঞ, মেধাবী ও বুদ্ধিমান; সুতরাং যুক্তিসঙ্গত কথা শুনিয়া অবশ্যই আমার বিজ্ঞতা ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাইবে।”
ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপ- “যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন ধনুর্গুণ আকর্ষণপূর্ব্বক অসংখ্য রাজগণ সমক্ষে লক্ষ্যভেদ করিয়া তাহা ভূতলে পাতিত ও দ্রৌপদীকে বরণ করিয়াছে, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন দ্বারকায় স্ববিক্রম-প্রভাবে সুভদ্রার পাণিগ্রহণ করিয়াছে, তথাপি বৃষ্ণিবংশাবতংস কৃষ্ণ-বলরাম তাদৃশ ঘৃণিত ও নিন্দিত কর্ম্মে উপেক্ষা করিয়া পরম সখ্যভাবে ইন্দ্রপ্রস্থে গমন করিয়াছেন, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, দেবরাজ ইন্দ্র নিরবচ্ছিন্ন মুষলধারে বৃষ্টি করিতে লাগিলেন, কিন্তু অর্জ্জুন তাহাতে কিছুমাত্র শঙ্কিত না হইয়া দিব্যশরজাল বিস্তার করিয়া সেই বৃষ্টি নিবারণপূর্ব্বক খাণ্ডবদাহে অগ্নিকে পরিতৃপ্ত করিয়াছেন, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, কুন্তীর সহিত পঞ্চপাণ্ডব জতুগৃহের প্রজ্জ্বলিত হুতাশন হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছে এবং অসামান্য ধীশক্তিসম্পন্ন বিদুর তাহাদিগের অভীষ্টসিদ্ধির নিমিত্ত যত্নবান্ আছে, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, ভীমসেন বাহুবলে বলদৃপ্ত মগধাধিপতি জরাসন্ধকে বধ করিয়াছে এবং দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে অনেকানেক ভূপতিদিগকে বশীভূত করিয়া রাজসূয় মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছে, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, একবস্ত্রা, অশ্রুমুখী, দুঃখিতা, রজস্বলা দ্রৌপদীকে সনাথা হইলেও অনাথার ন্যায় সভায় আনয়ন ও নিতান্ত নির্ব্বোধ দুঃশাসন তাহার পরিধেয় বসন আকর্ষণ করিয়াছে, তথাপি ঐ দুষ্ট বিনষ্ট হয় নাই, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, শকুনি পাশক্রীড়া করিয়া যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত করিয়াছে, তথাপি শান্ত ও সুশীল ভ্রাতৃগণ তাহার অনুগতই আছে, তখন আর জয়ের আশা করি নাই।
যখন বনপ্রস্থানকালে জ্যেষ্ঠভক্তিপরায়ণতাপ্রযুক্ত পাণ্ডবদিগকে অশেষক্লেশস্বীকার সহকারে বিবিধ হিতচেষ্টা করিতে শ্রবণ করিলাম এবং ভিক্ষোপজীবী মহাত্মা স্নাতক ব্রাহ্মণগণ ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অনুগত আছেন, তখন আর জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন কিরাতরূপী ভগবান্ মহাদেবকে যুদ্ধে প্রীত ও প্রসন্ন করিয়া পাশুপতমহাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াছে এবং স্বর্গে দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট যথাবিধানে অস্ত্রশিক্ষা করিয়াছে, তখন আমি আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বরদানদৃপ্ত ও দেবতাদিগের অজেয় পুলোমপু্ৎত্র কালকেয়দিগকে অর্জ্জুন পরাজয় করিয়াছে এবং দুর্দ্দান্ত দানবদল দমন করিবার নিমিত্ত ইন্দ্রলোকে গমন করিয়া কৃতকার্য্য হইয়া প্রত্যাগমন করিয়াছে, তদবধি আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীম ও অন্যান্য পাণ্ডবগণ, যথায় নরলোকের সঞ্চারমাত্র নাই, এইরূপ দুর্গম স্থানে গমন করিয়া কুবেরের সহিত সমাগত হইয়াছে, তখন আর আমার জয়াশা নাই। যখন শুনিলাম কর্ণের পরামর্শ-ক্রমে ঘোষযাত্রাগত মৎপুৎত্রেরা গন্ধর্ব্ব দ্বারা সংযত [বন্ধনপ্রাপ্ত] ও অর্জ্জুন কর্ত্তৃক বিমোচিত হইয়াছে, তদবধি আমার আর জয়াশা নাই। যখন শুনিলাম, ধর্ম্ম স্বয়ং যক্ষের আকার স্বীকার করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, তদবধি আমি জয়াশায় নিরাশ হইয়াছি। যখন শুনিলাম, বিরাটরাজ স্বসুতা উত্তরাকে অলঙ্কৃতা করিয়া অর্জ্জুনকে সম্প্রদান করিয়াছেন এবং অর্জ্জুনও আপনার পুৎত্রের নিমিত্ত তাহাকে প্রতিগ্রহ করিয়াছে, তখন আর আমি জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, নির্জ্জিত, নির্ধন, নিষ্কাসিত ও স্বজনবহিষ্কৃত যুধিষ্ঠির সপ্ত অক্ষৌহিণী সেনা সংগ্রহ করিয়াছে এবং বলিকে ছলিবার নিমিত্ত যিনি একপদে এই সম্পূর্ণ পৃথিবী অধিকার করিয়াছেন, সেই ত্রিবিক্রম নারায়ণ তাহার বহুবিধ উদ্দেশ্য সংসাধন করিতেছেন, তখন আমি আর জয়ের আশা করি নাই। যখন নারদমুখে শুনিলাম, কৃষ্ণার্জ্জুন সাক্ষাৎ নরনারায়ণাবতার, তিনি ব্রহ্মলোকে তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণ করেন, তদবধি আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, বাসুদেব লোকের হিতসাধনের নিমিত্ত কুরুদিগের বিবাদভঞ্জন করিতে গমন করিয়া পরিশেষে চরিতার্থ না হইয়া প্রত্যাগত হইয়াছেন, তদবধি আর আমি জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ ও দুর্য্যোধন কৃষ্ণকে নিগ্রহ করিতে সচেষ্টিত আছে, কিন্তু তিনি আপনার বহুবিধ রূপ প্রদর্শন করিয়া তাহাদিগকে নিচেষ্ট করিয়াছেন, তখন আর জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কৃষ্ণ প্রস্থানকালে নিতান্ত দীনা কুন্তীকে একাকিনী রথের সম্মুখে দণ্ডায়মানা দেখিয়া অশেষ সান্ত্বনাবাক্যে তাঁহাকে আশ্বাস প্রদান করিয়াছেন, তখন আর জয়াশায় করি নাই।
যখন শুনিলাম, বাসুদেব ও ভীষ্ম উভয়ে পাণ্ডবদিগের মন্ত্রী হইয়াছেন এবং দ্রোণাচার্য্য কায়মনোবাক্যে নিরবচ্ছিন্ন তাহাদিগের শুভানুধ্যান করিতেছেন, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্মদেব ‘তুমি যুদ্ধ করিলে আমি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব না’ কর্ণকে এই কথা কহিয়া সেনাধিকার পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন আর জয়ের আশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন বিষণ্ণ ও মোহাচ্ছন্ন হইলে কৃষ্ণ স্বশরীরে চতুর্দ্দশ ভুবন দর্শন করাইয়াছেন, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্ম প্রতিদিন রণক্ষেত্রে দশসহস্র লোকের প্রাণসংহার করিলেও পাণ্ডবপক্ষীয় বিখ্যত কোন এক ব্যক্তিকে বিনষ্ট করিতে পারেন নাই, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, ধর্ম্মপরায়ণ ভীষ্ম, পাণ্ডবদিগের নিকট আপনার বধোপায় অবধারণ করিয়া দিয়াছেন এবং তাহারা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়া সেই বিষয় সংসাধন করিয়াছে, তখন আর জয়াশায় করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন শিখণ্ডীকে সম্মুখে রাখিয়া মহাবলপরাক্রান্ত ভীষ্মকে নিতান্ত নিস্তেজ করিয়াছে, তখন আমি জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্মদেব মৎপক্ষীয় অসংখ্য লোককে বিনষ্ট ও অল্পাবশিষ্ট করিয়া শত্রুপক্ষীয়দিগের সুতীক্ষ্ণশরজালে বিদ্ধকলেবর হইয়া শরশয্যায় শায়িত হইয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ান হইয়া পিপাসাশান্তির নিমিত্ত পানীয় আনয়নার্থ অনুজ্ঞা করিলে অর্জ্জুন ভূমিভেদ করিয়া তাঁহাকে পরিতৃপ্ত করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বায়ু [পবন], ইন্দ্র ও সূর্য্য ইঁহারা পাণ্ডবদিগের অনুকুল আছেন এবং দুরন্ত হিংস্রজন্তুগণ যাত্রাকালে আমাদিগকে নানাপ্রকারে বিভীষিকা প্রদর্শন করিয়া থাকে, তখন আর আমি জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, বিচিত্রবীর্য্য দ্রোণাচার্য্য যুদ্ধে নানাবিধ অস্ত্র প্রয়োগনৈপুণ্য প্রদর্শন করিয়া পঞ্চপাণ্ডবের কাহাকেও বিনষ্ট করিতে পারেন নাই, তখন আমি আর জয়াশা করি নাই।
যখন শুনিলাম, মহারথ সংসপ্তকগণ, যাহারা অর্জ্জুন-বিনাশের নিমিত্ত ব্যবস্থিত হইয়াছিল, তাহারা তৎকর্তৃক নিহত হইয়াছে, তখন আর আমি জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দ্রোণাচার্য্য অস্ত্র গ্রহণ করিয়া যাহা সতত সাবধানে সংরক্ষণ করিতেছেন, সেই দুর্ভেদ্য ব্যূহভেদ করিয়া তন্মধ্যে অভিমন্যু অসহায় হইয়া প্রবেশ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, সপ্তরথী অর্জ্জুন-বিনাশে অসমর্থ হইয়া অল্পবয়স্ক বালক অভিমন্যুকে বধ করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অভিমন্যুকে বিনষ্ট করিয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রেরা অতিশয় হৃষ্ট ও সন্তুষ্ট হইলে অর্জ্জুন রোষভরে সিন্ধুরাজ জয়দ্রতকে বিনাশ করিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন শত্রুসমক্ষে জয়দ্রতকে বধ করিয়া অনায়াসে প্রতিজ্ঞাপাশ হইতে বিমুক্ত হইয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুনের অশ্বচতুষ্টয় একান্ত ক্লান্ত হইলে বাসুদেব বন্ধন উন্মোচন করিয়া তাহাদিগকে জলপান করাইয়া পুনর্ব্বার রথে যোজনা করেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ ধনুর অগ্রভাগ দ্বারা ভীমসেনকে আকর্ষণ করিয়া যথোচিত তিরস্কার করিয়াছেন ও সে অশেষ ক্লেশ স্বীকার করিয়া ভাগ্যবলে আপনার প্রাণরক্ষা করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দ্রোণ, কৃতবর্ম্মা, কৃপ, কর্ণ, অশ্বত্থামা ও শল্য ইঁহারা প্রতীকারে পরাঙ্মুখ হইয়া সমক্ষে জয়দ্রতবধে উপেক্ষা করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দেবরাজদত্ত দিব্য-শক্তি ঘোররূপী রাক্ষস ঘটোৎকচের বধনিমিত্ত প্রযুক্ত হইয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, কর্ণ অর্জ্জুনের বধসাধন করিবার নিমিত্ত যে একপুরুষঘাতিনী শক্তি রাখিয়াছিলেন, তাহা রাক্ষস ঘটোৎকচের উপর নিক্ষেপ করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ-ধর্ম্মের বিরুদ্ধ আচরণ করিয়া মরণে স্থিরনিশ্চয়, বিশস্ত্র ও রথস্থিত দ্রোণাচর্য্যের শিরশ্ছেদ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম,অশ্বত্থামার সম্মুখীন হইয়া মাদ্রীসুত নকুল অসংখ্য লোকসমক্ষে ঘোরতর দ্বৈরথ সংগ্রাম করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই।
যখন শুনিলাম, দ্রোণবধে ক্রোধে অধীর হইয়া অশ্বত্থামা নারায়াণাস্ত্র পরিত্যাগ করিয়াও পাণ্ডবদিগের প্রধান এক ব্যক্তির প্রাণসংহার করিতে পারিলেন না, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ভীমসেন যুদ্ধে দুঃশাসনের রুধির পান করিয়াছে এবং দুর্য্যোধন প্রভৃতি অনেকেই তথায় সমুপস্থিত থাকিয়াও তাহা নিবারণ করিতে অক্ষম হইয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন অতি পরাক্রান্ত কর্ণকে সমরশায়ী করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির অতি দুর্দ্ধর্ষ দুঃশাসন, মহাবীর্য্য কৃতবর্ম্মা ও অশ্বত্থামাকে পরাজয় করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, যে শল্য ‘বাসুদেবকে পরাজয় করিব’ বলিয়া সর্ব্বদা স্পদ্ধা করিত, যুদ্ধস্থলে যুধিষ্ঠির তাঁহার প্রাণনাশ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, সহদেব কলহ ও দ্যূত প্রভৃতি কতিপয় দুর্নীতির নিদান ও অতি মায়াবী প্রবল সৌবলকে [শকুনি] মৃত্যমুখে প্রত্যর্পণ করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, দুর্য্যোধন গদাযুদ্ধে সবিশেষ নৈপুণ্য প্রদর্শন করিতেছিল, ইত্যবসরে ভীমসেন আপনার অনুরূপ বিক্রম প্রকাশ করিয়া তাহাকে সমরশায়ী করিয়াছে, তখন আর জয়াশা করি নাই।
যখন শুনিলাম, অশ্বত্থামা প্রভৃতি কতিপয় বীরপুরুষেরা সমবেত হইয়া দ্রৌপদীর প্রসুপ্ত পুৎত্রপঞ্চক বিনাশ করিয়া অতি ঘৃণিত ও নিন্দিত কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই। যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন ‘স্বস্তি’ বলিয়া অস্ত্র দ্বারা অশ্বত্থামার অমোঘ ব্রহ্মশির অস্ত্র নিবারণ করিয়াছে এবং তাহার তুষ্টিসাধন করিবার নিমিত্ত অশ্বত্থামাও মণিরত্ম পরিত্যাগ করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই।
যখন শুনিলাম, অশ্বত্থামা মন্ত্রপূত অস্ত্র প্রয়োগ করিয়া্ উত্তরার গর্ভ নাশ করেন, তদুপলক্ষে দ্বৈপায়ন ও বাসুদেব উভয়ে তাঁহাকে অভিশাপ প্রদান করিয়াছেন, তখন আর জয়াশা করি নাই।
এক্ষণে গান্ধারী পুৎত্র, পৌৎত্র, পিতা, ভ্রাতা প্রভৃতি সমুদয় আত্মীয়-স্বজনের নিধনদশায় এতাদৃশ দুরবস্থায় পড়িয়াছেন এবং পাণ্ডবেরা অনায়াসে অতি দুষ্কর কার্য্যের সংসাধন করিয়া পরিশেষে রাজসিংহাসন অধিকার করিয়াছে; এক্ষণে আমাদিগের পক্ষীয় তিনটি ও পাণ্ডবদিগের সাতটি সমুদয়ে দশজন অবশিষ্ট আছে। এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী সেনা বিনষ্ট হইয়াছে; হে সঞ্জয়! সেই সমুদয় স্মরণ করিয়া আমি বারংবার মোহে অভিভূত হইতেছি, চারিদিক্ শূন্যময় ও জীবলোক শোকময় বলিয়া এক্ষণে প্রতীয়মান হইতেছে। আমার আর চেতনা নাই। মন বিহ্বল হইতেছে।”
ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি সান্ত্বনা- উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ বহুবিধ বিলাপ করিয়া সহসা মূর্চ্ছিত হইলেন। অনন্তর চেতনা প্রাপ্ত হইয়া সঞ্জয়কে কহিলেন:-
“হে সঞ্জয়! এক্ষণে এইরূপ দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়া প্রাণধারণ করা অতি কাপুরুষের কর্ম্ম; বিশেষতঃ আমার জীবনে আর কোন প্রয়োজন দেখিতেছি না, সুতরাং এই অবস্থায় অবিলম্বে দেহবিসর্জ্জন করাই আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর।”
রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে কাতর দেখিয়া সঞ্জয় কহিতে লাগিলেন, “মহারাজ! দ্বৈপায়ন ও নারদমুখে আপনি শুনিয়াছেন. শৈব্য, সৃঞ্জয়, সুহোত্র, রন্তিদেব, কাক্ষীবান, ঔশিজ, বাহ্লীক, দমন, শর্যাতি, অজিত, নল, বিশ্বামিত্র, অম্বরীষ, মরুত্ত, মনু, ইক্ষ্বাকু, গয়, ভরত, দাশরথি রাম, শশবিন্দু, ভগীরথ, কৃতবীর্য্য, শুভকর্ম্মা, যযাতি ইঁহারা প্রখ্যাত রাজর্ষি-বংশে প্রসূত হইয়া অলৌকিক যশ, অসামান্য কীর্ত্তি ও ধর্ম্মযুদ্ধে জয়লাভ করিয়া পরিশেষে কালবশে এই সুখময় পৃথিবী হইতে অন্তরিত হইয়াছেন।
পূর্ব্বকালে শৈব্য রাজা পুৎত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইলে মহর্ষি নারদ এই চতুর্ব্বিংশতি উপাখ্যান তাহার সম্মুখে কীর্ত্তন করেন। তদ্ভিন্ন পুরু, কুরু, যদু, শূর বিশ্বগশ্ব, অণুহ, যুবনাশ্ব, ককুৎস্থ, রঘু, বিজয়, বীতিহোত্র, অঙ্গ, ভব, শ্বেত, বৃহদ্গুরু, উশনীর, শতরথ, কঙ্ক, দুলিদুহ, দ্রুম, দম্ভোদ্ভব, বেণ, সগর, সঙ্কৃতি, নিমি, অজেয়, পরশু, পুণ্ড, শম্ভু, দেবাবৃধ, দেবাহ্বয়, সুপ্রতিম, সুপ্রতীক, বৃহদ্রথ, সুক্রতু, নিষধাপতি নল, সত্যব্রত, শান্তভয়, সুমিত্র, সুবল, জানুজঙ্ঘ, অনরণ্য, অর্ক, বলবন্ধু, নিরামর্দ্দ, প্রিয়ব্রত, শুচিব্রত, কেতুশৃঙ্গ, বৃহদ্বল, ধৃষ্টকেতু, বৃহৎকেতু, দীপ্তকেতু, নিরাময়, কৃতবন্ধু, চপল, ধূর্ত্ত, দৃঢ়োষুধি, অবিক্ষিৎ, মহাপুরাণসম্ভাব্য, প্রত্যঙ্গ, পরহা, এই সকল ও অন্যান্যা শত সহস্র সুপ্রসিদ্ধ মহীপাল ছিলেন। ইঁহারা অশেষ-ভোগসুখ বিসর্জ্জন করিয়া নিধনদশায় নিপতিত হয়েন। অনেকানেক সদ্বিদ্বান্ প্রধান কবিগণ প্রাচীন ইতিহাস কহিবার সময় প্রসঙ্গক্রমে এই সকল বলবান্ রাজাদিগের অতুল বিক্রম, সমধিক যশ, মহাত্মতা, সরলতা, আস্তিক্য, সত্য, শৌচ ও দয়া এই সকল বিষয়ের ভূরি ভূরি নিদর্শন দিয়া থাকেন। তাঁহারা সর্ব্বগুণসম্পন্ন হইলেও পরিশেষে মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়াছেন; কিন্তু আপনার পুৎত্রেরা অতিশয় দুর্ব্বৃত্ত, লুব্ধ প্রকৃতি ও রোষপরায়ণ ছিলেন; সুতরাং তাঁহাদিগের সংহারদশায় এইরূপ কাতর হওয়া সমুচিত নহে।
বিশেষতঃ আপনি মেধাবী এবং আপনার বুদ্ধি-বৃত্তি নিয়মিত শাস্ত্রানুগামিনী আছে, অ্তএব এইরূপ বিজ্ঞ ও গুণজ্ঞ হইয়া বারংবার শোকে আক্রান্ত ও অভিভূত হওয়া আপনার পক্ষে নিতান্ত নিষিদ্ধ ও অনুপযুক্ত। আপনি দৈবনিগ্রহ ও অনুগ্রহ উভয়ই বিদিত আছেন; যাহা ভবিতব্য, অতি সাবধানে থাকিলেও তাহা ঘটিয়া থাকে; সুতরাং তাহার অনুশোচনা করা অবিধেয়। এই জগতীতলে অদ্যাপি বুদ্ধিবলে কেহই দৈবের প্রতিকূলতাচরণ করিতে পারেন নাই। কারণ, দৈবের অপরিবর্ত্তনীয় নিয়ম অতিক্রম করা কাহারই সাধ্য নহে। ভাব ও অভাব, সুখ ও অসুখ সকলই কালবশে নিয়ত পরিভ্রমণ করিতেছে। কাল সর্ব্বজীবের সৃষ্টি ও কালই তাহার সংহার করিয়া থাকেন, কাল সর্ব্বজীবের দাহ ও কালই তাহার শান্তি করেন। ইহকালে যে সকল শুভাশুভ উপস্থিত হয়, সমুদয় কাল-মূলক। প্রজার সৃষ্ট ও সংহার সকলই কাল-সহকারে ঘটিয়া থাকে। জীবলোকে সকলই নিদ্রিত, একমাত্র কাল জাগরিত আছেন। কাল সর্ব্বত্র সর্ব্বভূতে সমভাবে অবস্থান করিতেছেন। যাহা অতিক্রান্ত বা অনাগত ও যে অবস্থা বর্ত্তমান আছে, সকলই কালকৃত বিবেচনা করিয়া আপনার বিচেতন হওয়া সমুচিত নহে।”
এইরূপ প্রবোধবাক্যে সঞ্জয় পুৎত্রশোক-সন্তপ্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে আশ্বস্ত ও সুস্থচিত্ত করিলেন। ভগবান্ বেদব্যাস এই বিষয়ের এক পবিত্র উপনিষৎ কহিয়াছেন এবং অতি বিচক্ষণ কবিগণ ঐ উপনিষৎ পুরাণে কীর্ত্তন করেন।
জনমেজয়-সভায় ব্যাসের আগমন
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, “যিনি যমুনাদ্বীপে শক্তি পুৎত্র পরাশরের ঔরসে অবিবাহিতা সত্যবতীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন, যিনি জাতমাত্রে যাগক্রিয়া দ্বারা আপনার দেহপুষ্টি এবং নিখিল বেদ, বেদাঙ্গ ও ইতিহাস অধ্যয়ন করেন, তপোনুষ্ঠান, বেদাধ্যয়ন, ব্রত, উপবাস, সন্তান ও যজ্ঞ দ্বারা যাঁহাকে কেহই অতিক্রম করিতে পারেন নাই, যিনি এক বেদকে চতুর্দ্ধা বিভক্ত করেন, যিনি শান্তনু রাজার বংশরক্ষার্থে তদীয় ক্ষেত্রে পাণ্ডু, ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরকে উৎপাদন করেন, পাণ্ডবগণের পিতামহ সেই ত্রিলোকীবিশ্রুত মহাকবি মহর্ষি বেদব্যাস শিষ্যগণসমভিব্যাহারে পরীক্ষিৎপুৎত্র রাজা জনমেজয়ের সর্পযজ্ঞদর্শনার্থ সভামণ্ডপে প্রবেশপূর্ব্বক রাজগণ ও সদস্যগণে পরিবৃত সুখাসীন রাজা জনমেজয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। জনমেজয় ঋষিকে সমাগত দেখিয়া সভ্যগণসহ সসম্ভ্রমে দণ্ডায়মান হইয়া উপবেশনার্থ সুবর্ণময় আসন প্রদান করিলেন। মহর্ষি আসনে অধ্যাসীন হইলে জনমেজয় বিধিপূর্ব্বক তাঁহার সৎকারাদি করিয়া পিতামহ ব্যাসদেবকে পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমনীয়, মধুপর্ক দিলেন। মহর্ষি তদ্দত্ত পূজা প্রতিগ্রহ করিয়া পরম সন্তুষ্ট হইলেন। রাজা জনমেজয় এইরূপ ভক্তি-সহকারে পূজাবিধি সমাপন করিয়া সমীপে উপবেশনপূর্ব্বক তদীয় কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিলেন এবং মহর্ষিও রাজার অনাময়-প্রশ্ন [স্বাস্থ্যাদি কুশল-জিজ্ঞাসা] করিলেন।
তৎপরে ভগবান্ বাদরায়ণি সভাস্থ ব্যক্তি কর্ত্তৃক পূজিত হইয়া তাঁহাদিগকে প্রতিপূজা করিলেন। পরিশেষে রাজা জনমেজয় কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিলেন, “ভগবান্! কুরু ও পাণ্ডব এই উভয়পক্ষের যাবতীয় বৃত্তান্ত আপনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন, অতএব জিজ্ঞাসা করি, ইঁহাদিগের পরস্পর ভেদ ও তাদৃশ সর্ব্বভূতভয়ঙ্কর ঘোরতর সংগ্রাম-ঘটনার কারণ কি? এই সমস্ত বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীর্ত্তন করিয়া আমাদিগের একান্ত কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তকে পরিতৃপ্ত করুন।” বেদব্যাস তাঁহার প্রার্থনাবাক্যে সন্তুষ্ট হইয়া সম্মুখোপবিষ্ট নিজ শিষ্য বৈশম্পায়নকে আদেশ করিলেন, “বৎস বৈশম্পায়ন! তুমি আমার নিকট কুরু ও পাণ্ডবদিগের ভ্রাতৃবিচ্ছেদ প্রভৃতি যাবতীয় বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়াছ, এক্ষণে তাহা কীর্ত্তন কর।”
বিপ্রশ্রেষ্ঠ বৈশম্পায়ন উপাধ্যায়ের আদেশক্রমে রাজা, সদস্য ও অন্যান্য ভূপতিগণের সমক্ষে কুরু-পাণ্ডবদিগের গৃহবিচ্ছেদাদিঘটিত অতি প্রাচীন মহাভারতীয় ইতিহাস বলিতে আরম্ভ করিলেন।
মহাভারত-কথারম্ভ
বৈশম্পায়ন প্রথমতঃ কায়মনোবাক্যে গুরুচরণে প্রণিপাত করিয়া ব্রাহ্মণগণ ও অন্যান্য বিদ্বদ্গণকে প্রণাম করিলেন। পরে মহর্ষি বেদব্যাস-প্রণীত অপূর্ব্ব উপাখ্যান-কীর্ত্তন-বিষয়ে কৃতসংকল্প হইয়া রাজা জনমেজয়কে কহিলেন,—মহারাজ! ভগবান্ বাদরায়ণির মুখনিঃসৃত এই অমৃতকল্প মহাভারতীয় কথা যেমন রমণীয়, আপনাকেও তদনুরূপ উপযুক্ত পাত্র লাভ করিয়াছি; অতএব ভারত-কথনে আমার অন্তঃকরণ অতিমাত্র উৎসাহিত হইতেছে! হে মহারাজ! রাজ্যলোভপ্রযুক্ত কুরু-পাণ্ডবদিগের গৃহবিচ্ছেদ ও সর্ব্বভূতবিনাশক সংগ্রাম এবং পাণ্ডবদিগের দ্যূতমূলক বনবাস সবিস্তর বর্ণন করিতেছি, অবধান করুন।
রাজর্ষি পাণ্ডুর মরণানন্তর যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব অরণ্যবাস পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বগৃহে প্রত্যাগমন করিয়া অচিরকালমধ্যে বেদবিদ্যা ও ধনুর্বিদ্যায় সম্পূর্ণ খ্যাতিলাভ করিলেন। পুরবাসিগণ তাঁহাদিগের এতাদৃশ অসম্ভাবিত নৈপূণ্য দর্শন করিয়া সকলেই নিতান্ত অনুরক্ত হইয়া উঠিল। কৌরবকুল তদ্দর্শনে সহসা অসূয়া-পরবশ হইলেন। তৎপরে মহাবল সৌবল, ক্রুরকর্ম্মা কর্ণ ও দুর্ম্মতি দুর্য্যোধন, ইঁহারা ঐকমত্য অবলম্বনপূর্ব্বক পাণ্ডবদিগের নিগ্রহচেষ্টা ও নির্ব্বাসনের বাসনা করিলেন। দুর্য্যোধন শকুনির পরামর্শক্রমে রাজ্যলাভার্থ পাণ্ডবদিগের উপর নানাবিধ উপদ্রব করিতে আরম্ভ করিলেন। একদা তিনি অন্নে বিষসংযোগ করিয়া ভীমকে উপযোগ করিতে দিলেন। ভীমসেন সবিশেষ না জানিয়া বিষান্ন ভক্ষণ ও তাহা জীর্ণ করিলেন। অপর এক দিবস ভীম গঙ্গাতটে নিদ্রিত ছিলেন, এই অবসরে দুর্ম্মতি দুর্য্যোধন তাঁহার হস্তপদাদি বন্ধনপূর্ব্বক জলে নিক্ষেপ করিয়া স্বনগরে প্রত্যাগমন করেন। পরে ভীম জাগরিত হইবামাত্র স্বয়ং বন্ধন ছেদন করিয়া উত্থিত হইলেন। একদা বৃকোদর নিদ্রায় অভিভূত আছেন, এমন সময়ে দুর্য্যোধন এক ভয়ঙ্কর কৃষ্ণ-সর্প দ্বারা তাঁহার সর্ব্বাঙ্গ দংশন করান, তাহাতেও তাঁহার প্রাণবিয়োগ হইল না। মহামতি বিদুর পাণ্ডবদিগের সেই সেই বিপদ্-উদ্ধার-বিষয়ে সতর্ক থাকিলেন। যেমন দেবরাজ স্বর্গস্থ হইয়াও জীবলোকের হিতসাধন করেন, তদ্রূপ বিদুর দুর্য্যোধনের পক্ষে থাকিয়াও পাণ্ডবদগের শুভসাধন করিতে লাগিলেন।
দুর্য্যোধন গুহ্য ও বাহ্য বিবিধ উপায় দ্বারা পাণ্ডবদিগকে বিনষ্ট করিতে না পারিয়া পরিশেষে বৃষসেন ও দুঃশাসন প্রভৃতি কতিপয় ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি অনুসারে বারণাবতে জতুগৃহ [গালা প্রভৃতি দাহ্য পদার্থ দ্বারা নির্ম্মিত গৃহ বিশেষ] প্রস্তুত করাইলেন। তৎপরে পুৎত্রবৎসল রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্যভোগের লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া পাণ্ডবদিগকে নির্ব্বাসিত করেন। পাণ্ডবগণ মাতৃ-সমভিব্যাহারে হস্তিনা হইতে বারণাবতে প্রস্থান করিলেন। তৎকালে বিদুর তাঁহাদিগের মন্ত্রী ছিলেন। পরে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদিগকে জতুগৃহ বাসের আদেশ দিলেন। তাঁহারা এক বৎসরকাল তথায় নির্বিবঘ্নে বাস করিয়া পরিশেষে বিদুরের পরামর্শক্রমে এক সুড়ঙ্গ নির্ম্মাণ করিলেন। পরে সেই জতুগৃহে অগ্নি প্রদান করিয়া এবং দুর্য্যোধনের দুর্ম্মন্ত্রী পুরোচনকে দগ্ধ করিয়া সাতিশয় শঙ্কিত-মনে রজনীযোগে জননী-সমভিব্যাহারে অরণ্যে প্রস্থান করিলেন। প্রস্থানকালে পথিমধ্যে বিকটাকৃতি হিড়িম্ব রাক্ষসকে দেখিতে পাইলেন। হিড়িম্ব মুখব্যাদানপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে ভক্ষণ করিতে উদ্যত হইলে ভীমসেন স্ববিক্রমপ্রভাবে তাহাকে বধ করেন। অনন্তর আত্মপ্রকাশভয়ে ভীত হইয়া ঐ রজনীতেই তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। প্রস্থানকালে ভীমসেন হিড়িম্বানাম্নী রাক্ষসীর পাণিগ্রহণ করিয়া তাহার গর্ভে ঘটোৎকচ নামক এক পুৎত্র উৎপাদন করেন।
পরে পাণ্ডবেরা ব্রহ্মচারিবেশে একচক্র নগরীতে এক ব্রাহ্মণের আবাসে উপনীত হইয়া বেদাধ্যয়নে মনোনিবেশপূর্ব্বক কিয়ৎকাল অতিক্রম করেন। একদা মহাবল মহাবাহু ভীমসেন স্বীয় বাহুবলে ক্ষুধার্ত্ত বকনামক রাক্ষসকে বধ করিয়া একচক্রা-নগরের উপদ্রব নিবারণ করিলেন। তৎপরে পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীর স্বয়ংবরবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া পাঞ্চালদেশে আগমনপূর্ব্বক দ্রৌপদী লাভ করেন এবং তথায় এক বৎসর বাস করিয়া পরিশেষে হস্তিনাপুরে প্রত্যাগত হয়েন। তখন ধৃতরাষ্ট্র অভ্যাগত পঞ্চপাণ্ডবকে কহিলেন, “তোমাদিগের ভ্রাতৃবিগ্রহ [ভ্রাতৃদিগের পস্পর বিবাদ] হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা দেখিতেছি; যেহেতু আমি খাণ্ডবপ্রস্থে তোমাদিগের বাসস্থান অবধারণ করিয়া দিয়াছিলাম, কিন্তু তোমরা তাহাতে সম্মত হইলে না; অতএব এক্ষণে তোমরা কতিপয় গ্রাম লইয়া বাসার্থ সেই বিশালরথ্যাকলাপমণ্ডিত [বহু বড় বড় প্রশস্ত রাস্তাযুক্ত] খাণ্ডবপ্রস্থে প্রস্থান কর।”
পাণ্ডবগণ তাঁহার আদেশক্রমে বহুমূল্য রত্নরাশি গ্রহণপূর্ব্বক স্বজনগণ-সমভিব্যাহারে খাণ্ডবপ্রস্থে গমন করিলেন। পরে বাহুবলে অন্যান্য ভূপালগণকে পরাভূত করিয়া এক বৎসর তথায় অবস্থিতি করেন। ধর্ম্মপরায়ণ পাণ্ডবগণ এইরূপে শত্রুদমন দ্বারা ক্রমশঃ অভ্যুদয় লাভ করিতে লাগিলেন। মহাযশাঃ ভীমসেন পূর্ব্বদিক, অর্জ্জুন উত্তরদিক, নকুল পশ্চিমদিক্, ও সহদেব দক্ষিণদিক, জয় করিয়া এই সসাগরা ধরামণ্ডলে একাধিপত্য স্থাপন করিলেন। সূর্য্য ও সূর্য্যসদৃশ পঞ্চপাণ্ডব দ্বারা ধরণীমণ্ডল যেন ষট্সূর্য্যে উদ্ভাসিত হইল।
একদা ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কোন বিশেষ কারণবশতঃ প্রাণ হইতে প্রিয়তর ভ্রাতা অর্জ্জুনকে বনে যাইতে কহিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জ্জুন তদীয় আজ্ঞাক্রমে বনে প্রবেশ করিয়া ত্রয়োদশমাস তথায় বাস করিলেন। পরে এক দিবস দ্বারাবতী নগরীতে গমন করিয়া কৃষ্ণের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁহার সুভদ্রানাম্নী ভগিনীর পাণিগ্রহণ করেন। যেমন শচী ইন্দ্রকে পাইয়া এবং লক্ষ্মী কৃষ্ণকে পাইয়া আহ্লাদিত হইয়াছিলেন, সুভদ্রা অর্জ্জুনকে পতিলাভ করিয়া তদ্রূপ আহ্লাদিত হইলেন। পরে বাসুদেব-সমভিব্যাহারে অর্জ্জুন খণ্ডববন দগ্ধ করিয়া ভগবান্ হুতাশনকে পরিতৃপ্ত করিলেন। অগ্নি পরিতুষ্ট হইয়া অর্জ্জুনকে গাণ্ডীব ধনুঃ, অক্ষয় তূণীর ও কপিধ্বজরথ প্রদান করিলেন। অর্জ্জুন সেই সমস্ত বস্তু প্রতিগ্রহ করিলেন এবং খাণ্ডবাগ্নি হইতে ময়দানবকে উদ্ধার করিলেন। ময়দানব তাঁহার প্রসাদে পরিত্রাণ পাইয়া নানাবিধ মণিকাঞ্চন-মণ্ডিত ও পরমরমণীয় এক সভামণ্ডপ নির্ম্মাণ করিয়া দেন।
দুর্ম্মতি দুর্য্যোধন ময়-নির্ম্মিত সভার লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া শকুনির পরামর্শানুসারে কূট পাশক-ক্রীড়া [ষড়যন্ত্রমূলক পাশা খেলা] দ্বারা যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করিয়া দ্বাদশ বর্ষ বনবাস ও এক বৎসর অজ্ঞাতবাসের আদেশ দিলেন। ধর্ম্মরাজ তদনুসারে এয়োদশ বৎসর অতিবাহিত করিয়া নিজ রাজ্যে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক স্বকীয় ধনসম্পত্তি প্রার্থনা করেন। তাহা না পাওয়াতেই তাঁহাদিগের ঘোরতর সমরানল প্রজ্বলিত হয়। পরিশেষে তাঁহারা বিপুলপরাক্রম প্রকাশপূর্ব্বক দুর্য্যোধনের প্রাণসংহার করিয়া পুনর্ব্বার আপন রাজ্য-সম্পত্তি সমুদয় অধিকার করেন। হে মহারাজ! উভয়পক্ষে যেরূপ আত্মবিচ্ছেদ ও সংগ্রাম উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা আমি সংক্ষেপে কীর্ত্তন করিলাম।

front page › Forums › Mahabharata of Vyasa (Bengali Translation by Kaliprasanna Singha)
Tagged: Bangla Bhasha, Mahabharata