শ্রীশ্রীপ্রেমবিবর্ত্ত Prema Vivarta of Jagadananda Pandit (INDEX PAGE)
১ । মঙ্গলাচরণ
রাধাকৃষ্ণপ্রণয়বিকৃতির্হ্লাদিনী শক্তিরস্মাদ্
একাত্মানাবপি ভুবি পুরা দেহভেদং গতৌ তৌ
চৈতন্যাখ্যং প্রকটমধুনা তদ্দ্বয়ং চৈক্যমাপ্তং
রাধাভাবদ্যুতিসুবলিতং নৌমি কৃষ্ণস্বরূপম্
শ্রীরাধাকৃষ্ণতত্ত্ব অখণ্ড-অদ্বয়-জ্ঞান সর্ব্বতত্ত্বসার ।
সেই তত্ত্বে দণ্ড-পরণাম বার বার ॥১॥
সেই তত্ত্ব কভু দুই রাধাকৃষ্ণরূপে ।
কভু এক পরাৎপর চৈতন্যস্বরূপে ॥২॥
তত্ত্ব-বস্তু এক সদা অদ্বিতীয় ভায় ।
বস্তু বস্তুশক্তি মাঝে কিছু ভেদ নাই ॥৩॥
ভেদ নাই বটে, কিন্তু সদা ভেদ তায় ।
“ভেদাভেদ অবিচিন্ত্য” সর্ব্ব-বেদে গায় ॥৪॥
বস্তুশক্তি চিৎ-স্বরূপ ভাবেতে সন্ধিনী ।
ক্রিয়াতে হ্লাদিনী তাই ত্রিভাবধারিণী ॥৫॥
বস্তুশক্তিদ্বারে বস্তু দেয় পরিচয় ।
বস্তুশক্তি ক্রিয়াযোগে সর্ব্ব সিদ্ধ হয় ॥৬॥
অখণ্ড বস্তুতে ভাব ক্রিয়া নিত্য হয় ।
শক্তি শক্তিমান্ বস্তু তবু পৃথক্ নয় ॥৭॥
হ্লাদিনী বস্তুকে দিয়া দুইটী স্বরূপ ।
ব্রজে রাধাকৃষ্ণলীলা করায় অপরূপ ॥৮॥
রাধাকৃষ্ণ-প্রণয়ের বিকৃতি হ্লাদিনী ।
অবিচিন্ত্য শক্তি রাধাকৃষ্ণ-উন্মাদিনী ॥৯॥
অঘটন ঘটাইতে ধরে মহাশক্তি ।
নির্ব্বিকারে করিয়াছে বিকার অনুরক্তি ॥১০॥
তত্ত্ববস্তু তার্কিকের অগোচর; কৃষ্ণকৃপাসাপেক্ষ
এবে এক উঠিল অপূর্ব্ব পূর্ব্বপক্ষ ।
তার্কিক না বুঝে যদি চিন্তে বর্ষ লক্ষ ॥১১॥
কৃষ্ণ যারে কৃপা করে সেই মাত্র জানে ।
লক্ষবর্ষ চিন্তি তাহা না বুঝিবে আনে ॥১২॥
রাধাকৃষ্ণ-প্রণয়ের বিকার হ্লাদিনী ।
প্রণয়ের পরে জন্মে চিত্ত-উন্মাদিনী ॥১৩॥
রাধা-কৃষ্ণ দুই হলে হয় ত প্রণয় ।
প্রণয় হৈলে তবে বিকার ঘটয় ॥১৪॥
দুই দেহ হবার আগে বিকার না ছিল ।
তবে এক রূপ দুই কেমনে হৈল ॥১৫॥
হ্লাদিনী হইতে হয় দুই দেহ ভেদ ।
কোথা বা হ্লাদিনী ছিল হইল প্রভেদ ॥১৬॥
এই প্রশ্নের এক মাত্র আছে ত’ উত্তর ।
দেশকালাতীত কৃষ্ণতত্ত্ব নিরন্তর ॥১৭॥
অপ্রাকৃত-তত্ত্বে দেশকালাদির বিচার নাই
প্রকৃতির মধ্যে দেখ কালের প্রভাব ।
ভূত-ভবিষ্যতের বুদ্ধি তাহার স্বভাব ॥১৮॥
অপ্রাকৃত-তত্ত্বে ভূত ভবিষ্যৎ নাই ।
নিত্য-বর্ত্তমান তথা বলিহারি যাই ॥১৯॥
বাঙ্মনের অগোচর অপ্রাকৃত-তত্ত্ব ।
বর্ণিতে আইসে দোষ এই মাত্র সত্য ॥২০॥
অপ্রাকৃত-তত্ত্বে কভু দোষ নাহি পাই ।
অচিন্ত্য-শক্তিতে সব সমাধান ভাই ॥২১॥
পূর্ব্বাপর হেন কথা কভু নাহি তায় ।
সর্ব্বদা নূতন সব আনন্দে মাতায় ॥২২॥
অতএব তত্ত্বে যে অখণ্ড-খণ্ড-ভাব ।
সমকালে দেখি সেও তত্ত্বের স্বভাব ॥২৩॥
বিরুদ্ধ-ধর্ম্মাশ্রয় তত্ত্ব আশ্চর্য তার গুণ ।
জন্মে নাই হ্লাদিনী তবু ক্রিয়াতে নিপুণ ॥২৪॥
জন্মিবার পূর্ব্বে রাধা-কৃষ্ণে দুই করে ।
দুঁহে প্রেমের বিকার হয়ে নিজে জন্ম ধরে ॥২৫॥
নিত্য-বর্ত্তমান তত্ত্ব কালদোষহীন ।
কালদোষ-বিচার প্রাকৃতে সমীচীন ॥২৬॥
শ্রীঅদ্বয়তত্ত্ব আর রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব ।
সমকাল সত্য নিত্য আর শুদ্ধ সত্ত্ব ॥২৭॥
শ্রীরাধাকৃষ্ণই শ্রীচৈতন্য
অতএব রাধাকৃষ্ণ দুই এক হঞা ।
অধুনা প্রকট মোর চৈতন্য গোসাঞাঁ ॥২৮॥
“অধুনা” বলিতে কালভেদ নাহি কর ।
অপ্রাকৃতে কালভেদ নাহি তাহা স্মর ॥২৯॥
“রাধাকৃষ্ণ ছিল, ভেল চৈতন্য গোসাঞি” ।
এ বলিলে কালদোষ সত্যবস্তু হারাই ॥৩০॥
‘একাত্মা’ শব্দেতে যদি শ্রীচৈতন্য মান ।
রাধাকৃষ্ণে হবে ভাই আধুনিক জ্ঞান ॥৩১॥
“অগ্রে রাধাকৃষ্ণ কিবা শচীর নন্দন” ।
এ বিচারে বৃথা কাল না কর কর্ত্তন ॥৩২॥
বলিয়াছি অপ্রাকৃতে সব বর্ত্তমান ।
চৈতন্য কৃষ্ণেতে তর্কে হও সাবধান ॥৩৩॥
সমকাল নিত্যকাল দুই তত্ত্ব সত্য ।
অখণ্ড অদ্বয় লীলা তত্ত্বের মহত্ত্ব ॥৩৪॥
প্রণয়-বিকার-শক্তি সেই আহ্লাদিনী ।
দুই তত্ত্বে সমকাল রাখে এই জানি ॥৩৫॥
সেই ত’ চৈতন্য এবে প্রপঞ্চ-প্রকটে ।
সঙ্কীর্ত্তন করি’ বুলে গঙ্গাসিন্ধুতটে ॥৩৬॥
কৃষ্ণলীলার অধিক এই শ্রীচৈতন্যলীলা ।
প্রণয়-বিকার যাতে উৎকট হইলা ॥৩৭॥
উৎকট হইয়া কৃষ্ণে রাধাভাবদ্যুতি ।
মাখাইল প্রেমভরে আহ্লাদিনী সতী ॥৩৮॥
ব্রজের অধিক সুখ নবদ্বীপধামে ।
পাইল পুরট কৃষ্ণ আসি’ নিজ কামে ॥৩৯॥
শ্রীচৈতন্যের স্বরূপ
চৈতন্যমুরতি কৃষ্ণের অপূর্ব্বস্বরূপ ।
কৃষ্ণমূর্ত্তি চৈতন্যের স্বরূপ অপরূপ ॥৪০॥
হ্লাদিনীর দুই সাজ পরম মধুর ।
মধু হৈতে মধু, তাহা হৈতে সুমধুর ॥৪১॥
সুমধুর স্বরূপ কৃষ্ণের চৈতন্য মুরতি ।
নিরন্তর করি তাঁতে দণ্ডবন্নতি ॥৪২॥
যদি বল ‘একাত্মা’ শব্দে ব্রহ্ম নির্ব্বিকার ।
যাহা হৈতে রাধাকৃষ্ণস্বরূপ সাকার ॥৪৩॥
এ সিদ্ধান্ত হৈতে নারে শ্লোকের আভাসে ।
সেই দুই এক আত্মা চৈতন্যপ্রকাশে ॥৪৪॥
ব্রহ্ম শ্রীচৈতন্যের অঙ্গকান্তি
চৈতন্য নহেন কভু ব্রহ্ম নির্ব্বিকার ।
আনন্দবিকারপূর্ণ বিশুদ্ধ সাকার ॥৪৫॥
ব্রহ্ম তাঁর শ্রীঅঙ্গের জ্যোতি নির্ব্বিশেষ ।
ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা কৃষ্ণচৈতন্যবিশেষ ॥৪৬॥
অতএব ‘একাত্মা’ শব্দেতে শ্রীচৈতন্য ।
বুঝেন পণ্ডিতগণ স্বরূপাদি ধন্য ॥৪৭॥
সেই ত’ ‘একাত্মা’-তত্ত্বে কর পরণাম ।
রাধাকৃষ্ণসেবা পাবে, সিদ্ধ হবে কাম ॥৪৮॥
পরমাত্মা শ্রীচৈতন্যের অংশ
যদি বল ‘একাত্মা’ শব্দে হয় পরমাত্মা ।
যাহা হইতে রাধাকৃষ্ণ হয় দুই আত্মা ॥৪৯॥
শ্লোকের আভাসে তাহা কভু নহে সিদ্ধ ।
“চৈতন্যাখ্য”-শব্দে হয় বড়ই বিরুদ্ধ ॥৫০॥
মূলতত্ত্ব শ্রীচৈতন্যস্বরূপ জানিবা ।
তাঁহার অংশ পরমাত্মা সর্ব্বদা বুঝিবা ॥৫১॥
রাধাকৃষ্ণ-ঐক্য সেই ‘একাত্ম’-স্বরূপ ।
শ্রীচৈতন্য মোর প্রাণ-নাথ অপরূপ ॥৫২॥
রাধাপদ-দাসী আমি রাধাপদ-দাসী ।
রাধা দ্যুতি সুবলিত রূপ ভালবাসি ॥৫৩॥
পরাৎপর শচীসুত তাঁহার চরণে ।
দণ্ড-পরণাম মোর অনন্যশরণে ॥৫৪॥