TRANSLATE WITHIN 15 MINUTES
যখন বয়স কম ছিল তখন দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর একটা শখ ছিল, এখন আর সেই শখ নেই। পৃথিবীর নানা বিচিত্র দেশ থেকে নিজের সাদামাটা দেশটাকেই বেশি ভালো লাগে। তবে আমি কখনও বিষুব রেখা পার হইনি। তাই দক্ষিণ গোলার্ধের রাতের আকাশের নক্ষত্ররাজি দেখতে কেমন লাগে সেটা নিয়ে একটা সূক্ষ্ম কৌতূহল ছিল।
আকাশের নক্ষত্রদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল একাত্তরে। বিনিদ্র রাতে যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম তখন মনে হত সেগুলো বুঝি গভীর মমতা নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণ গোলার্ধে গিয়ে আকাশের দিকে তাকালে আরও নূতন নক্ষত্রের সঙ্গে পরিচয় হবে; তাছাড়া রাতের আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্রটি দক্ষিণ গোলার্ধে একটা ভিন্ন সৌন্দর্য নিয়ে দেখা দেয়, সেটা দেখারও আগ্রহ ছিল।
তাই যখন অস্ট্রেলিয়ার বাংলা সাহিত্য সংসদ আমাকে মেলবোর্নে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, আমি যেতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভীতু ধরনের মানুষ, একা ভ্রমণ করতে সাহস পাই না। তাই যখন আমার স্ত্রী সঙ্গে যেতে রাজি হল তখন শেষ পর্যন্ত প্লেনে চড়ে বসলাম।
মেলবোর্ন পৌঁছানোর পর একটি অত্যন্ত অভিজাত ধরনের বিশেষ ট্রেনিং পাওয়া কুকুর আমাদের সবকিছু শুঁকে যখন অনুমতি দিল যে আমরা অস্ট্রেলিয়ায় পা দিতে পারি তখন আমরা বের হয়ে এলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে মেলবোর্নের বাংলা সাহিত্য সংসদের প্রায় সব সদস্য এয়ারপোর্টে চলে এসেছেন। তারা আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন আমি খুব বড় একজন সাহিত্যিক এবং আমার সন্দেহ হতে শুরু করল যে আমি ভুল জায়গায় চলে এসেছি কি না!
বাংলা সাহিত্য সংসদ বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের একটা সংগঠন। বিদেশের মাটিতে যারা থাকেন দেশের জন্যে তাদের ভিন্ন এক ধরনের মায়া থাকে। যারা কখনও দেশ ছেড়ে যাননি তারা আসলে কখনও দেশের জন্যে এই বিচিত্র মায়াটি অনুভব করতে পারবেন না।
দেশের প্রতি এই মমত্ববোধ থেকে বাংলা সাহিত্য সংসদ মেলবোর্ন শহরে নানা কিছুর আয়োজন করে থাকে; তার একটি হচ্ছে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলা থেকে সাহিত্যিকদের নিয়ে আসা। তাদের আয়োজনে সুনীল-শীর্ষেন্দু–সমরেশ মজুমদারের মতো সাহিত্যিকেরা এসেছেন এবং সেই একই আয়োজনে আমিও চলে এসেছি। নিজের সাহস দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম!
দেশে আমাকে নানা অনুষ্ঠানে যেতে হয়, শিক্ষকতা করি, তাই কথা বলাই আমার কাজ। সেজন্যে বক্তৃতা দিতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তাই বলে সাহিত্যিক হিসেবে শত শত মানুষের সামনে জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য নয়। কিন্তু সেটা কাকে বোঝাব!
সাহিত্য-সভাটি শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছিল। শিক্ষক হওয়ার কিছু বিশেষ সুবিধে আছে। সারা পৃথিবীতেই আমার ছাত্রছাত্রী। এখানেও তারা অনেকে আছে, সবাই দলবেঁধে চলে এল। বক্তব্যের শেষে একটা প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল, আয়োজকেরা সেটা নিয়ে একটু দুর্ভাবনায় ছিলেন।
এটি নূতন শুরু হয়েছে। রাজাকার টাইপের মানুষেরা দেশে সুবিধে করতে পারে না বিদেশে সভা-সমিতিতে এসে নাকি যা কিছু করে ফেলতে পারে। আমি আয়োজকদের অভয় দিলাম রাজাকার টাইপের মানুষদের কেমন করে সামলাতে হয় সেটি নিয়ে। কবি রবীন্দ্রনাথ কবিতা পর্যন্ত লিখে গেছেন, “যখনি দাড়াঁবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে/পথ কুকুরের মত সংকোচে সত্রাসে যাবি মিশে।”
কিন্তু সে রকম কিছুই হল না। সাহিত্য থেকে দর্শক-শ্রোতার বেশি আগ্রহ ছিল শিক্ষা নিয়ে, দেশ নিয়ে, দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এগুলো আমারও প্রিয় বিষয়, দেশ নিয়ে সবসময় স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্নের কথা দশজনকে বলতে আমার কখনও সমস্যা হয় না। (তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে যখন একজন দর্শক আমার কাছে জানতে চাইল আমি কেন গোঁফ রাখি, আমি পুরোপুরি হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমি কিছু বলার আগেই আমার স্ত্রী যখন হলভরা মানুষকে এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল তখন আমার মুখ দেখানোর উপায় নেই!)
বাংলা সাহিত্য সংসদের আনুষ্ঠানিক সাহিত্য-সভাটি ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার। কিন্তু আমরা সংসদের সদস্যদের সঙ্গে ঘরোয়া পরিবেশে নিরবচ্ছিন্নভাবে সময় কাটিয়েছি। প্রতি রাতেই কারও বাসায় সবাই একত্র হয়েছে এবং আমরা বাঙালিরা যে কাজগুলো খুব ভালো পারি– খাওয়া এবং চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া– অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সেগুলো করা হয়েছে।
যে মানুষগুলোকে আগে কখনও দেখিনি তাদের থেকে বিদায় নেবার সময় সবার চোখে পানি– এ রকম বিচিত্র ঘটনা বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো মানুষের জীবনে ঘটেছে কি না আমার জানা নেই। মাঝে মাঝেই মনে হয়, ভাগ্যিস বাঙালি হয়ে জন্মেছিলাম, তা না হলে কত কিছু যে অজানা থেকে যেত! [ WORDS:- 598]
Fully Solved Composition
I translated it as per sense, you can translate it as your own way –
প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্ট্মাস্টারকে আসিতে হয়। গ্রামটি অতি সামান্য। নিকটে একটি নীলকুঠি আছে, তাই কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নূতন পোস্ট্আপিস স্থাপন করাইয়াছে।The postmaster first took up his duties in the village of Ulapur. Though the village was a small one, there was an indigo factory near by, and the proprietor, an Englishman, had managed to get a post office established there.
আমাদের পোস্ট্মাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যেরকম হয়, এই গণ্ডগ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্ট্মাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে তাঁহার আপিস ; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল। Our postmaster belonged to Calcutta( our post master was a young man from Kolkata). He felt like a fish out of water in this remote village. His office room was in a dark thatched shed, not far from a green, slimy pond, surrounded on all sides by a dense growth.
কুঠির গোমস্তা প্রভৃতি যে-সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্রায় নাই এবং তাহারা ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে।The accountant etc men employed in the indigo factory had no leisure(time); moreover, they were hardly desirable companions for decent folk.
বিশেষত(specially) কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে(mix) জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হইয়া থাকে। এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাঁহার মেলামেশা হইয়া উঠে না।Nor is a Calcutta boy an adept in the art of associating with others. Among strangers he appears either proud or ill at ease. অথচ হাতে কাজ অধিক নাই।At any rate, the postmaster had but little company; nor had he much to do.
কখনো কখনো(sometimes) দুটো-একটা কবিতা লিখিতে চেষ্টা করেন।At times he tried his hand at writing a verse or two. তাহাতে এমন ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, সমস্ত দিন তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ দেখিয়া জীবন বড়ো সুখে কাটিয়া যায়hat the movement of the leaves and the clouds of the sky were enough to fill life with joy—such were the sentiments to which he sought to give expression. – কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলা কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয়, এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে। But God knows that the poor fellow would have felt it as the gift of a new life, if some genie of the Arabian Nights had in one night swept away the trees, leaves and all, and replaced them with a macadamised road, hiding the clouds from view with rows of tall houses.
পোস্ট্মাস্টারের বেতন অতি সামান্য। নিজে রাঁধিয়া খাইতে হয় এবং গ্রামের একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা তাঁহার কাজকর্ম করিয়া দেয়, চারিটি-চারিটি খাইতে পায়। মেয়েটির নাম রতন।The postmaster’s salary was small. He had to cook his own meals, which he used to share with Ratan, an orphan girl of the village, who did odd jobs for him. [ From Post Master of Tagore]
MORE TRANSLATION
ঘড়িটা বুঝি ঠিকমত চলিতেছে না। দুইটা-কুড়িতে কলিকাতার ট্রেন আসিবে। সেই গাড়িতেই প্রদীপের ফিরিবার কথা। আসিয়া পৌঁছিলে হয়?
অরুণা স্বামীর মুখের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “ষ্টেশনে গাড়ি থাকবে ত’?”
স্বামী ঘরের মধ্যে অস্থির হইয়া পাইচারি করিয়া বেড়াইতেছিলেন, স্ত্রীর কথায় একটু থামিয়া একটা শোকাতুর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শুধু কহিলেন,—“আর গাড়ি!”
সেই স্তব্ধ-স্তম্ভিত ঘরে কথার অর্থটা স্পষ্ট হইয়া উঠিল। বাবোটা বাজিয়া ঘড়ির ছোট কাটাটা যেন আটকাইয়া গেছে,—সুধীর জীবনে দুইটা-কুড়ি বুঝি আর বাজিল না! প্রদীপের ফিরিয়া আসিবার আগেই প্রদীপ নিভিবে।
আকাশ ভরিয়া তারা জাগিয়াছে, কোটি কোটি জগৎ, কোটি কোটি জীবন! সমস্ত আকাশ ব্যাপিয়া কি বিস্তীর্ণ পথ, কি অপরিমেয় ভবিষ্যৎ! অবনী বাবু জানালা দিয়া বাহিরে চাহিলেন; রাস্তায় দূরে বাতি-থামের উপর একটা লণ্ঠন জ্বলিতেছে শুধু। সুষুপ্ত, প্রশান্ত রাত্রি।
ঘর ঠাণ্ডা রাখিবার জন্য সুধী-র শিয়রের কাছাকাছি পিলসুজের উপর মাটির বাতি জ্বালানো। সুধী বুঝি একটু চোখ চাহিল। অরুণা তাড়াতাড়ি ছেলের আরো নিকটে ঘেঁষিয়া আসিতে-আসিতে স্বামীকে কহিলেন,—“সলতেটা একটু বাড়িয়ে দাও শিগগির। সুধী কি যেন চাইছে।”
তারপর ছেলের আর্ত মলিন মুখের কাছে মুখ আনিয়া কোমলতর কণ্ঠে ডাকিলেন,—“সুধী, বাবা, কিছু বলবে?”
সুধী নিঃশব্দতার অপার সমুদ্রে ডুবিতেছে; জিহ্বায় ভাষা আসিল না,—দুৰ্বল ডান-হাতখানা মা’র কোলের কাছে একটু প্রসারিত করিয়া দিয়া কি যেন ধরিতে চাহিল।
অরুণা কহিলেন,—“এ পাশে একটু সরে এস বৌমা, সুধী বুঝি তোমাকে খুঁজছে।”
নমিতা স্বামীর পায়ের কাছে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল,—গভীর রাত্রির যে একটি প্রশান্তিপূর্ণ অনুচ্চারিত বাণী আছে, নমিতা তাহারই আকারময়ী। শাশুড়ির কথা শুনিয়া নমিতা নূতনেত্রে কাছে আসিয়া আঁড়াইতেই অরুণা কহিলেন,—“এ-সময়ে আর লোকলজ্জা নয় মা, তোমার ঘোম্টা ফেলে দাও! সুধী! মিতা, তোর মিতা—এই দ্যাখ, কিছু বলবি তাকে?”
সুধী বোধ হয় একটু চেষ্টা করিল, কিন্তু চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে পারিল না।
ঘরভরা লোকজনের মধ্যেই নমিতা অবগুণ্ঠন অপসৃত করিয়া সজল চোখে স্বামীর বিবর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া রহিল,–“কেহ না থাকিলে হয়ত সকল লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়া অনেক কথা কহিত, হয়ত একবার বলিত : “আমাকে ছাড়িয়া কোথায় যাইতেছ, কত দূরে? সেখানে কাহাকে সঙ্গী পাইবে? তুমি আমাকে ভুলিয়া থাকিয়, কিন্তু আমি তোমাকে ভুলিয়া থাকিব কি করিয়া?”
অরুণা নমিতাকে সুধীর পাশে বসাইয়া দিয়া তাহার ব্রীড়াকুণ্ঠিত করতলে মুমূর্ষু সন্তানের শিথিল হাতখানি অৰ্পণ করিলেন। নমিতা দেখিল হাতখানি ঠাণ্ডা, যেন অব্যক্ত স্নেহে সিক্ত হইয়া আছে! মনে পড়িল, মাত্র সাত মাস আগে এই হাতখানিরই কুলায়ে ভীরু পক্ষীশিশুর মত তাহার দুর্বল কমনীয় হাতখানি রাখিয়া, এক উজ্জ্বল দীপালোকিত সহস্রকলহাস্যমুখর উৎসব-সভায় সে সর্বাঙ্গে প্রথম পুলকসঞ্চার অনুভব করিয়াছিল। আজো বুঝি তাহাদের নূতন করিয়া বিবাহ হইতেছে। নমিতার আজ নববধুর বেশ—সে আকাশচারী মৃত্যু—প্রতীক্ষামগ্ন দুই চক্ষু মেলিয়া স্বামীর শয্যাপাশ্বে আসিয়া বসিয়াছে। তোমরা উলু দিতেছ না কেন? আলো নিভাইয়া দাও, রাত্রির এই প্রগাঢ়-প্রচুর, অন্ধকারকে অবিনশ্বর করিয়া রাখ!
মৃত্যু আসিতেছে, ধীরে, অতিনিঃশব্দপদে—নিস্তরঙ্গ নদীর উপরে প্রশান্ত গোধুলির মত! কেহ কথা কহিয়ো না, মৃত্যুর মৃদুপদপাত শুনিবার আশায় নিশ্বাস রোধ করিয়া থাক!
অবনীনাথ হেঁচাইয়া উঠিলেন : “জানলাটা খুলে দাও শিয়রের, পথ আটকে রেখ না।”
কে একজন শিয়রের জানালা খুলিয়া দিল। আরেকজন কহিল,—“আপনি অত অস্থির হবেন না মেলোমশাই।”
অবনীনাথ চলিতে-চলিতে হঠাৎ থামিলেন : “পাগল! অস্থির আর হ’তে পারি কই, সত্য! আমাদের শরীর এমন সব স্নায়ু দিয়ে তৈরি যে অস্থির সে হতেই শেখেনি। আমরা ত’ অর আগ্নেয়গিরি নই!” দুই-পা হাঁটিয়া আবার দাঁড়াইলেন : “শুনেছি ভগবান যোগে বসে আছেন সমাহিত হয়ে, আর প্রকৃতি রাজ্য চালাচ্ছেন; বিধাতাকে আমি দুষবো না। আমি স্থির, হয়ত ভগবানেরই মতো। আমি ভাবছি ছেলে মরেছে বলে আমি বড় জোর একদিন কোর্ট কামাই কতে পাব —আমাকে একটা সাত-লাখ টাকার মোকদ্দমার রায় লিখতে হবে। আমি ভাবছি, পশু আমার লাইফ-ইসিয়োরেন্স-এর প্রিমিয়াম পাঠাবার শেষ তারিখ। আমার কি অস্থির হওয়া চলে?”
মধ্যরাত্রির মুহূর্তগুলি মন্থর হইয়া আসিয়াছে,—এত নিঃশব্দতা বুঝি সহিবে না। আত্মীয়-পরিজনের অন্ত নাই,—সবাই প্রশস্ত ঘরে রোগীর পরিচর্যায় নিযুক্ত। এখন সবাই সেবাশুশ্রুষা পরিত্যাগ করিয়া রোগীকে ঘিরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে—শেষনিশ্বাস-পতনের প্রতীক্ষায়। পরিবারের শিশুগুলি অন্য ঘরে দাসীর তত্ত্বাবধানে রহিয়াছে,–কেহ ঘুমাইয়া পড়িয়া গত রাত্রে শোনা পথিক-রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখিতেছে, কেহ বা বসিয়া আপন আপন মা’র কথামত অর্থহীন অসম্পূর্ণ ভাষায় অচেনা ভগবানের কাছে অসম্ভব প্রার্থনা করিতেছে। সমস্ত ঘরে সুগভীর শান্তি বিরাজমান। অবনী বাবুর লঘু পদশব্দ ছাড়া কোথা হইতেও একটি অস্ফুট কোলাহল হইতেছে না। সৃষ্টি যেন গতিবেগ রুদ্ধ করিয়া একটু দাঁড়াইয়াছে!
এইটি সুধী-র পড়িবার বসিবার শুইবাব ঘর। এই ঘরেই একদিন পড়িতে পড়িতে সুধী পিছন হইতে বাবার স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর শুনিয়াছিল : “রংপুরে একটি মেয়ে দেখে এলাম,—প্রতিমার চেয়েও সুন্দর। সামনে ফাগুন মাস, কবির বলেন কাব্যের পক্ষে প্রশস্ত,তোমাকে একটি কাব্যলক্ষ্মীর সন্ধান দিচ্ছি।” সুধী একটু হাসিয়া পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে কহিল,—“কাল মার্কস্-এর কোনো জায়গায় এমন কথা লেখা নেই, বাবা।” অবনীনাথ বলিয়াছিলেন,—“তা না থাক্, নমিতা এখন নমিন্যালি আছে, তার জন্যে তোমার এক্জামিনের মার্কস কমবে না।” শেষ পৰ্যন্ত অবশ্য আপত্তি টি কে নাই, নমিতাকে বিস্তৃত শয্যার একটা সঙ্কীর্ণ অংশ ছাড়িয়া দিতে হইল। এই ঘরেই সুধী বোকার মত (প্রত্যেক স্বামীই বিবাহের প্রথম রাত্রির প্রথম সম্ভাষণে একটু বোকা হয়) নমিতাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল,—“আমাকে তোমার ভালো লাগবে?” নমিতা নিঃশব্দে কতকগুলি ঢোঁক গিলিয়া বলিয়াছিল,–“একবার যখন বিয়ে হয়েই গেছে তখন আর ভাল লাগালাগির কথাই নেই। আমাকে আরেকটু বড়ো হ’তে দিয়ে বিয়ের আগে দেখা করে’ মতটা জিজ্ঞেস করলেই পারতে!” মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ, সুধী-র এত ভাল লাগিয়া গেল যে ফের বোকার মত বলিয়া বসিল,—“দেখো, আমাকে তোমার খুব ভালো লাগবে।”…
একুশ বছর ধরিয়া সুধী এই ঘরে বসিয়া কত স্বপ্ন দেখিয়াছে। ইস্কুলে পড়িতে-পড়িতে তাহার মনে হইয়াছিল, পণ্ডিতমশাই হইয়া ছেলেদের বেঞ্চির উপর দাঁড় করাইয়া দিবার মত সুখ বুঝি আর কোথাও নাই; থার্ড ক্লাশে উঠিয়া সে ভাবিয়াছিল যে, সে মোক্তার হইয়া শালা আঁটিবে ও খোঁচা খোঁচা দাড়ি রাখিয়া পেসকারকে ভয় দেখাইবে। ষোল বছর বয়সে সুধী কীসের Endynion পড়িয়া একটি অপরিচিত ভাববিলাসী ব্যর্থ-প্রেমিকের বেদনার স্বপ্নে তাহার স্বল্প-প্রসার ভুবনকে অনুরঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছিল; বি, এ পাশ করিয়া কঠিন রক্তাক্ত মাটিতে পা রাখিয়া সীমাশূন্য আকাশের নীচে দাঁড়াইয়া দুই ফুসফুস ভরিয়া প্রচুর বাতাস নিতে-নিতে সে স্বপ্ন দেখিয়াছিল স্বাধীন গর্বিত ভারতের—উপরে উদার উজ্জ্বল আকাশ, পদনিম্নে উত্তরঙ্গ উদ্বেল সমুদ্র! এই ঘরে বসিয়াই।
পুত্রের মৃত্যুশয্যাপার্শ্বে অরুণাকে দেখিবে এস,-মা’কে! চিত্রাপিতের মত বসিয়া আছেন। যে হাতখানা দিয়া নমিতা স্বামীর হাত ধরিয়া আছে, সেই হাতখানি অরুণা নিজের কোলের উপর টানিয়া লইলেন। কতদিন ধরিয়া যে ঘুমান নাই তাহা তাহার হতাশ স্থির দুই চক্ষুতারকা দেখিয়া নির্ণয় করা অসম্ভব,—সব শ্রান্তি ও প্রতীক্ষার আজ চরম অবসান হইবে। অরুণার মন বাইশ বছর পূর্বের অতীততীরে উড়িয়া গিয়াছে। বাইশ বছর পূৰ্বে অরুণা এই সংসারে পদার্পণ করিয়াছিল,–একটি বৎসর ফুরাইতে-না-ফুরাইতেই যখন অরুণার প্রথম সন্তানসম্ভাবনা হইল, তখনকার সেই সুখরোমাঞ্চময় অনুভূতিতে বিস্ময়ে সে বাণীহীন হইয়া গিয়াছিল। তাহার যেন সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে ভয় হইতেছিল। নভচারী কোন নক্ষত্র হইতে একটি জ্যোতি-স্ফুলিঙ্গ মতলে প্রাণ পাইবার আশায় তাহার শরীরকে আশ্রয় করিয়াছে,–যেন কোন্ অতিথি-আত্মা—আত্মপ্রকাশের বিপুল ব্যাকুলতায় অরুণাকে মিনতি করিতেছে। সে-দিন মনে আছে অরুণ গভীর রাত্রে ছাতে উঠিয়া নক্ষত্ৰমণ্ডিত অবারিত আকাশের দিকে তাকাইয়া প্রার্থনা। করিবার উপযুক্ত ভাষা খুঁজিয়া পায় নাই, স্বামী ডাকিতে আসিলে তাহাব মনে হইয়াছিল, যে ক্ষুদ্র মাংসাপণ্ডটা তাহার জঠরে আকারহীন অবস্থায় সঙ্কুচিত হইয়া আছে, তাহা একদিন দৈর্ঘ্যে, আয়তনে ও বলশালি তায় ঐশ্বৰ্যময় হইয়া উঠিবে—সৃষ্টির এই গৌরবপূর্ণ অভিজ্ঞতায় অরুণার মন ‘সুখাবেশে অবশ হইয়া পড়িল! এই জ্বণ একদিন কর্মে, সাহসে, তেজে, দীপ্তিতে অগ্রগণ্য হইবে, হয়ত বা ভালবাসিয়া একটি নিখিলব্যাপ্ত বিরহবেদনার কবি হইবে কে বলিতে পারে! কিন্তু সে যে আবার একদিন ক্ষণস্বপ্নের মতই কয়েকটি বর্ণের বুদ্বুদ তুলিয়া অদৃশ্য হইয়া যাইবে, তাহা কে কবে ভাবিয়াছিল! আর দু’টি মাত্র মুহূর্তের পর অরুণা কি বলিয়া ও কতখানি জোর দিয়া চীৎকার করিয়া উঠিবে, তাহা ভাবিয়া পাইতেছিল না। এতগুলি বৎসর ধরিয়া সে যত আকাঙ্ক্ষা করিয়াছে, যত স্নেহ বর্ষণ করিয়াছে, তাহার এই ভয়ঙ্কর অকৃতার্থতা সে সহিবে কি করিয়া? ভালবাসা এত ভঙ্গুর কেন, আশা কেন এত অসহায়?
বসিয়া থাকিতে থাকিতে অরুণার এক সময় মনে হইল আজিকার রাত্রিটি তাহার জীবনের সাধারণ রাত্রিগুলির মতই একটা। পরীক্ষার সময় মাঝরাতে উঠিয়া ঘুমন্ত সুধীকে পড়িবার জন্য জাগাইয়া দিতে হইত,গায়ে ঠেলা দিলেই বুঝি সুধী এখনি হাত-পা মেলিয়া তেমনি জাগিয়া উঠিবে। টেবিলে আলো জ্বালিয়া সুধী পড়িতে বসিলে, অরুণা ছাতে উঠিয়া আকাশের কাছে সন্তানের কুশল প্রার্থনা করিবে, অন্ধকার স্বচ্ছতর হইয়া আসিতে থাকিলে, মাঠে নামিয়া ফুল কুড়াইয়া ছেলেকে গিয়া উপহার দিবে। অরুণার মনে হইতেছিল খানিকক্ষণ চোখ বুজিয়া থাকিয়া পরে চাহিয়া দেখিলেই দেখিবে যে, এই রাত্রির চেহারাটা সম্পূর্ণ বদলাইয়া গিয়াছে। তিনি জাগিয়া-জাগিয়া এতক্ষণ একটা দুঃসহ দুঃস্বপ্ন দেখিতেছেন মাত্র। এই ভাবিয়াই তিনি চক্ষু বুজিলেন, হঠাৎ একটা অসংলগ্ন চীৎকারে মাথা তুলিয়া চাহিয়া দেখিলেন, অবনীনাথ দুই হাতে মাথার চুল ছিঁড়িতেছেন।
ব্যাপারটা আবার আয়ত্ত হইল। কিন্তু গাঢ় নিদ্রায় অরুণার চক্ষুপল্লব ভারাক্রান্ত হইয়া আসিতেছে; নিদ্রা যে শোকমাধুৰ্যপূর্ণ বিস্মৃতি আনিয়া দেয়, তাহারই নদীতে তিনি এইবার স্নান করিবেন। এই ঘরদুয়ার স্বামী-পুত্র—সব অপরিচিত আত্মীয়; এত দিনের কঠিন কদৰ্য ক্লান্তির পর আজ তাহার ঘুম আসিবে। অরুণ ছেলের পাশে শুইয়া পড়িলেন।
ইহার পর আর দুইটি মিনিটু-ও বুঝি কাটিল না। রাস্তায় কিসের একটা শব্দ হইতেই, সবাই অসঙ্গত প্রত্যাশায় সচকিত হইয়া উঠিল; প্রদীপ ফিরিয়া আসিল বুঝি।
সমস্ত আত্মীয়বন্ধু সুধী-র আরো কাছে ঘেঁসিয়া আসিয়া সমস্বরে চেঁচাইয়া উঠিল; একটা-বিয়াল্লিশ মিনিটের সময় সুধী যে নিশ্বাস ত্যাগ করিল, তাহা আর ফিরিয়া গ্রহণ করিতে পারিল না। তাহার জন্য বাতাস ফুরাইয়া গেছে।
আশ্চৰ্য্য, অরুণার ঘুম ভাঙিল না। অবনীনাথ হঠাৎ ছুটিয়া আসিয়া ফু দিয়া বাতিটা নিবাইয়া দিলেন; চীৎকার করিয়া কহিলেন, “খবরদার, কেউ কাদতে পাবে না—সবাই চুপ করে থাক, কারু মুখ। থেকে যেন একটাও শব্দ না বেরোয়, ওকে চলে যেতে দাও।”
খোলা জাল্লা গুলি দিয়া বন্যার মত অজস্র অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়া পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিতে লাগিল—মৃত্যুর নিঃশব্দ তরঙ্গ! চাদ কখন অস্ত গিয়াছে,—আকাশে হঠাৎ মেঘ করিল নাকি,-রাত্রি বোধ হয় আত্মঘাতিনী হইল! ঘরে যতগুলি লোক ছিল অবনীনাথের আকস্মিক আর্তনাদে একেবারে হতবাক হইয়া গেছে; নিস্পন্দ, নিবালম্ব—কাহারো মুখে কথা ফুটিতেছে না। অবনীনাথ ঘরের মধ্যখানে একটা স্তম্ভের মত অচল হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন, আর নমিতা কি করিবে কিছু বুঝিতে না পারিয়া, ভয়ে স্বামীর হিম, শক্ত বাহুটা দুই হাতে মুঠি করিয়া আঁকড়িয়া রহিয়াছে।
SOURCE- অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত – কাকজ্যোৎস্না (উপন্যাস)